মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

অপরাহ্ণ সুসমিতো



কালিমাটির ঝুরোগল্প



ঘুঘু


বাবা বয়সের সমান ডালপালার ভারে নত, ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটেন। বাবার দেখাদেখি আমিও ওরকম হাঁটি।
মায়ের কড়া হুকুম দুপুরে ভাত খাবার পর ঘুমাতে হবে যাতে সন্ধ্যায় আমরা ঘুমের বানে ভেসে না যাই। রাতে ক্লাসের পড়া পড়তে হবে। এত ভাই বোন। আমাদের আলাদা বিছানা নেই। গাদাগাদি করে পাশাপাশি ঘুম।

আমার ইমিডিয়েট বড়বোন টুপ্পি। মাথার কাছে বসে নিউজপ্রিন্টের কাগজে সারাক্ষণ পেন্সিলে অঙ্ক করত, পুরো খাতা একবার পেন্সিলে লেখা হয়ে গেলে আবার বলপয়েন্ট দিয়ে লিখত খরচ বাঁচাবার জন্য।

নতমুখী বাবা এই ঘুমভরাট দুপুরে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলতেন;
: পোটলা হাঁটতে যাবি?

এই গরম ভুনাদুপুরে ঘুম বাদ দিয়ে ঘর থেকে বেরুলে মা খুন করে ফেলবে। টুপ্পি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে আর কি…

: বাবা! মা’কে বলব তুমি পোটলাকে নিয়ে বেরুচ্ছ? হচ্ছেটা কি? কই যাবে তোমরা?
বাবা ফস করে টুপ্পির মুখ চেপে ধরে বলতেন : তোকে হাওয়ার মিঠাই কিনে দেব।
ও ঘুষের প্রণোদনা পেয়ে চুপ। আমি বাবার সাথে ঝুঁকে হাঁটি। হাত ধরে হাঁটি।

রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল গাছের সমাবেশ। গরমে রাস্তার পিচ থেকে একটা পিচ মাখা গন্ধ ছড়াতে থাকে এই মফস্বলে। গাছের কাছ থেকে পাখির থেমে থেমে ডাক শোনা যায়। বাবা বললেন: ঘুঘুপাখি।

ঘুঘুডাকের এই পাখিটা যে ঘুঘুপাখি তখন জানলাম। থেমে থেমে ডেকে দুপুরের নূপুর বাজায়। আমি খুব ভালো চোখে দেখি না। খুব খুব ভারী পাওয়ারের চশমা। বাবা আঙ্গুল উঁচিয়ে আমাকে পাখি দেখানোর চেষ্টা করেন, পাখি দেখতে পাই না।

তখনি একটা অস্পষ্ট ডাক আসে কানে আমার, বিড়ালের। মিঁয়াও…

আমি বাবার হাত টেনে খপ করে হাঁটা থামিয়ে দিই। আমরা থামি। চোখে ভালো দেখতে পাই না বলে কান খাড়া করি খরগোশের মতো…

একটা চি চি ডাক… আর একটা মিঁয়াও ডাক…
ডাক লক্ষ্য করে একটা ঝোপের দিকে দৌড় দিই হঠাৎ। ঝোঁপের পাশে ঘন ঘাসের আড়ালে চি চি ডাক আরো জোরে ভেসে আসে কানে। উবু হয়ে তুলে নিলাম ছানাদুটো। বাবা বললেন, ঘুঘুপাখির বাচ্চা। বিড়ালটা ভয়ে পালিয়েছে…

দুই হাত মুঠো করে পাখির বাচ্চা দুটো আমার হাত কোলে তুলে নিই। পথে ঘাটে লোকজন দেখা যাচ্ছে না। দূরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন তীক্ষ্ণ বাজে।

গরম নামছে চৈত্রপরবে। বাবা ভয়ার্ত গলায় বলছেন আমাকে;
: জানিস পোটলা, পৃথিবীর অসুখ করেছে খুব।  
আমি বললাম;
: কবে ভালো হবে? কবে আবার স্কুলে যাব?
: জানি না রে…
: আমরা মরে যাব?
: জানি না রে…

আমার ভয় লাগে। বাবা আবার বিড়বিড় করেন।

: জানিস পোটলা, আমাদের দেশে চেঁচামেচি বেশি, লজিক কম। তাই তো পুরোহিত হুজুর বাবাজী বেশি, বিজ্ঞানী কম।

দুপুরমাখা এই দুপুরে কথাটা আমার হাতের তালুতে লে্প্টে থাকা ঘুঘুছানার ঠোঁট ছুঁয়ে মিশে যায় রোদের বর্শায়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন