সমকালীন ছোটগল্প |
সান্ধ্যসঙ্গীত
ও কর্ণফুলী
এ সেই কর্ণফুলী, কিছু আগে যেখানে প্রসন্ন সন্ধ্যা নেমেছে। এই ক্ষীণ অন্ধকারে, পাখিদের উড়ে চলা ডানার ঘুঙুরে, স্মৃতিবিস্মৃতির
মিলিত এই লগ্নে দূরে সময়ের সাম্পান ভেসে যায়।
চৈত্রকাল অবসানে নদীর সাথে
এখন গ্রীষ্মহাওয়ার মিতালি। এমন সন্ধ্যার মায়াময় আধো আলোয় আধো ছায়াগাঢ়তার কালে তিনি
তার দুর্বল হাতের মুঠো খোলেন। বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া সময় সে হাতের মুঠো
খোলা পেয়ে বেরিয়ে আসতে চায়! প্রিয় এক শিষ্যের কোলের তার মাথা রাখা। চোখ বেয়ে গড়িয়ে
নামছে নুন। সময় মাপলে তাকে অতি প্রবীণই বলা চলে, কিন্তু সত্যিই
কি তিনি তাই.. কর্ণফুলীর ঢেউ জানে, বোয়ালখালী
ছাড়িয়ে সমস্ত বঙ্গদেশের হাওয়া জানে, আকাশের অগুনতি
নক্ষত্র জানে তিনি তার তারুণ্যকে কখনই বিসর্জন দেননি। তেমনই কখনও আপোষ করেননি কোনো প্রতিকূলতার সাথেও।
মধ্যযুগের পুঁথিতে কাঁইচা
খাল নামে যে খালের কথা আছে সে এই কর্ণফুলীই যার জন্ম হয়েছে লুসাই পাহাড়ে। লুসাই
পাহাড়.. আবছা নামটা হঠাৎই স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে উঠে এল তার। সাথে সাথেই এক ঝাঁক
স্মৃতির স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। মনে পড়ে যায় মিজোরাম। মিজোরাম মনে হবার প্রায় পর
মুহূর্তেই আসাম আর রেঙ্গুনের কথা মনে পড়ে। আহ.. ডুবে যান তিনি সহসা পূর্ব স্মৃতিতে! স্পষ্ট
দেখতে পান, ওই হেঁটে যায়
বোয়ালখালীর গোমদন্ডী গ্রাম ছেড়ে কে, অজানার দিকে, ভাগ্য অন্বেষণে।
কিশোর রমেশ অকালে পিতৃহীন
হওয়ায় পরিবারের দায় হঠাৎ এসে পড়েছিল তারই ওপর। পাঠজীবনের ইতি ঘটে যায় তখনই। পূর্বপুরুষের কবিরাজি পেশাকে প্রথমে
জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন করলেও কিছুকাল পর সেই পেশা ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে পথে।
ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছায় বার্মার রেঙ্গুন শহরে। মনোহারী এক দোকানে কর্মচারী চাই। ঘুরতে
ঘুরতে সে পৌঁছে যায় সেই দরজায়।
বছর পাঁচ, কেটে যায় রেঙ্গুন শহরে । কাজ আর কাজ। কবে যেন কাজের মাঝে গ্রীষ্ম পেরিয়ে
বসন্ত এলো। নবপল্লবে সেজে উঠলো প্রকৃতি। আর মনের ভেতর কীসের তুমুল এক চোরাটান। মন
কেবল হারাই হারাই করে। একেই বুঝি বসন্তঋতু বলে। বার্মিজ ওই এক মেয়ে, মাথায় ফুল গুঁজে, পায়ের মল
ঝমঝমিয়ে হেঁটে যায়, সে বেচাকেনা
ভুলে দুখানি পদ্মযুগলের দিকে চেয়ে। যেন চারপাশে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। বুকের ভেতর
বেজে উঠছে একটানা দ্রিমিদ্রিমি। পাড় ধ্বসে পড়ার শব্দ সেবারই সে প্রথম শুনেছিল।
কাজে মন বসে না আর। চোখের কাজলে, সে কেবল ডাক
দিয়ে যায়। নাওয়া-খাওয়া, বিশ্রাম বা
কাজ সবই বন্ধ হবার যোগাড়। কেবল থেকে থেকে ওই মুখ, ওই পা দুটো
দেখার জন্য সে দিনরাত পথের ধারে তাকিয়ে...
কিছুকাল পর আবার এক প্রবল
টান আসে। সে টান কর্ণফুলীর, গোমদন্ডীর।
আবার দিশেহারা বোধ করে সে। কখনও স্থির হয়ে ভাবতে চায় জীবন আদতে এক ভ্রমণ। পথে
ছড়ানো যা কিছু ঈশ্বরের সম্ভার সব কিছুর জন্যই হয়ত টান আসে, তবে ছেড়ে এলে ধীরে ধীরে তা কমে আসে। যেমন সে এতকাল ভুলে ছিল গোমদন্ডীকেও।
পথিকের পথই সম্বল। পথে ছড়িয়ে থাকা রত্ন যা কিছু সব কি তার নিজের হতে হয় না কি হয়!
কিন্তু কর্ণফুলী বুঝি তা বুঝতে পেরে এবার অন্যদিক থেকে ডাক পাঠায়। মাকে মনে পড়ে।
আর অমনি মা যেন নাভিকুণ্ডলে বসে সজোরে মারে টান। এ টান তো শেকড়ের টান, বড় অমোঘ। এবার কী করে ফেরাবে সে ডাক। আর পাঁচ বছর বাদে সে কিশোর এখন আঠারর
সদ্য তরুণ। সব ছেড়ে স্বর্গীয় পিতার ভিটেতেই ফেরে। পিতার কবিরাজি সেই পেশাকে
পূণর্বার আঁকড়ে ধরে এবার সে থিতু হতে চায়।
পিতৃপুরুষের ভিটেয় ফিরে
সবকিছুই আপন করে নেয় সে। আর কাজের ফাঁকে ফুরসৎ মিললেই বেরিয়ে পড়ে। যেখানেই কবির
লড়াই, সেখানেই সে। মুগ্ধ হয়ে শোনে। বুঁদ হয়ে যায় সেই গানে।
লুসাই থেকে নেমে এসেছিল সে।
ছোট ছোট ঢেউ তুলে পতেঙ্গার কাছে এসে সে মিলিত হয়েছে বঙ্গপোসাগরের উত্তাল জলরাশিতে।
কর্ণফুলী। জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কালের সাক্ষী হয়ে বহমান এই নদী। কত সময় পেরিয়ে গেল
তিনি ভাবেন। এ জায়গাটায় দুপাশে পাহাড়, উঁচু খাড়ি।
প্রায়ান্ধকারে ঝোপঝাড়গুলো যেন মানুষের মত, নির্বাক
দাঁড়িয়ে। বড় নির্জন এ
স্থান। বড্ড প্রিয় তার। মন চাইলেও যেখানে আজকাল আর একা আসতে পারেন না। শরীর সায়
দেয় না। বড় সন্তান যজ্ঞেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর
তারই মত কবিয়াল। আজ বড় কোনো গানের আসরে তার ডাক পড়েছে। এই সন্তানটি তার অধিক
স্নেহের কেন না কবিগানে সেও মেতে ওঠে ঠিক পিতারই মতো। কে জানে আজ বাড়ি থাকলে হয়ত অসুস্থ শরীরের পিতাকে
কর্ণফুলীর ধারেকাছে আসতে দিত না, নেই বলেই.. যে
শিষ্যটির কোলে মাথা পেতে শুয়ে আছেন তিনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করেন। আজ এই শিষ্যর
কল্যাণেই কর্ণফুলীর কাছে তার যাবতীয় সমর্পণ।
কর্ণফুলীর জলে এখন যেন প্রণয়
ও অবসানের সন্ধিকাল। দূরে কোথাও কোথাও এক আধটা আলো জ্বলে উঠছে। ঘাসের ওপর শতরঞ্চি পাতা। তিনি
এতক্ষণ শুয়ে ছিলেন। ডান হাতে ভর করে আধশোওয়া হলেন। আকাশে গোলগাল পূর্ণচাঁদ।
ঝিরিঝিরি হাওয়া। গরম কিছুটা কম এখন। কিছু জোনাক উড়ছে নিজস্ব আলো জ্বেলে। জলে নেমে
আসা চাঁদের আলো মেখে চিকচিক করছে জলের ঢেউ, তিনি হারিয়ে
যাচ্ছেন.. প্রথম স্ত্রী অপূর্ববালার মাঝে। এইরকম গোলগাল চাঁদপণা মুখই ছিল তার। আর
বড় অবুঝ ছিল সে বালিকা। মায়াবতী অপূর্ববালা যেন ডাকছে তাকে এই কর্ণফুলীর জলে, এমন পূর্ণিমায় অপূর্বকে নিয়ে তিনি কতবার এসেছেন এখানে। অস্ফুট উচ্চারণে
ঠোঁট কেঁপে উঠছে তার। বলছেন, অপূর্ব.. অ পূ
র্ব... শিষ্য কিছু বা চঞ্চল হলো এই সময়। গুরুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। অসুস্থ
শরীর। রাত বাড়লে সে একা সামলাতে পারবে না। তার ওপর শরীরের এই হাল, যদি কিছু বাড়াবাড়ি হয়, যজ্ঞ দাদাকে
সে কী জবাব দেবে.. ঠিক সে সময়, কাছে এক
সাম্পান এসে ভিড়ে। লগি ধরে থাকা মূর্তিমান এক পুরুষ যাকে অন্ধকারে এতক্ষণ স্থির
মনে হচ্ছিল সে, সাম্পান থেকে
নেমে তাদের কাছে এগিয়ে আসে। শতরঞ্চির এক কোণে আলগোছে বসে তার পা দুটো কোলের ওপর
টেনে নেয়। গুরুর শিষ্য যে সেও। কথা নেই । নিশ্চুপ তিনজনই। হঠাৎ তিনিই কথা বলে
ওঠেন। শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে মৃত্যুর পর তাকে কবর দিতে বলেন থেমে থেমে। তারপর বলে
উঠলেন, “আধার ঘরত রাইত
কাডাইউম কারে লই..”
এ কী কথা বাবা!
পরক্ষণে তিনি হেসে ওঠেন।
বলেন, ওরে শোন, মাঝিরঘাটে
জগদ্ধাত্রী পূজায় কবিয়াল মোহন বাঁশী ও চিন্তাহরণের কবিগানের আসর বসেছে..
কবিগানের প্রতি অন্যরকম এক টান থেকেই বন্ধুদের
নিয়ে সে আসরে সেও উপস্থিত। আসর শুরু হবে। শ্রোতা-দর্শক অধীর হয়ে অপেক্ষায়। আসরে
উঠলেন কবিয়াল চিন্তাহরণ এবং কবিয়াল মোহণ বাঁশী। কিন্তু আসরে উঠেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন
কবিয়াল চিন্তাহরণ।
মুহূর্তকাল পর মৃদু গুঞ্জন
শুরু হল। সে গুঞ্জন ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগল। লড়াইগান প্রেমীদের ভেতর তখন
প্রবল চাঞ্চল্য, বিরক্তি। তারা
লড়াই চায়। কবির লড়াই।
আর তখনই দেখা গেল কোমরে
চাঁদর পেঁচিয়ে ঋজুভঙ্গীতে মঞ্চে উঠে আসছে এক তরুণ।
শুরু হল নবীন-প্রবীনের লড়াই।
নবীন রমেশ। জীবনের প্রথম লড়াই। আশ্চর্য, জীবনে
প্রথমবার সে কবিগানের লড়াইতে নেমেছে অথচ তাকে হারাতে হিমসিম খাচ্ছেন কবিয়াল মোহন
বাঁশী। টানা আট ঘণ্টা, কেউ কাউকে
হারাতেই পারছে না। শেষে আপোষ। গান শুনতে গিয়েছিল রমেশ। হঠাৎই হয়ে উঠলো কবিয়াল
রমেশ।
কবিয়াল হতে গেলে গুরুর কাছে
তালিম চাই। খুঁজতে খুঁজতে পরের বছর কধুরখীলের প্রবীন কবিয়াল নবীন ঠাকুরের কাছে সে
হাজির হয়েছিল তার শিষ্য হতে। গুরু ফেরাননি তাকে। ধীরে ধীরে শিখে নিয়েছিল গাজীরগীত, ঢপকীর্তণ, কবিগান, বৈঠকীগান আরও কত কী। কঠোর সে অনুশীলন।
পুরনো দিনের কথায় বুকে চেপে বসে
ওজনদার পাথর, শ্বাস ফেলতে
বড় কষ্ট হয়। আজ সব
স্মৃতি কেন ঘুরেফিরে আসছে। বারবার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের কাছে। জীবনের কত
রূপ তো তার দেখা হলো, কত বিচিত্র
ঘটনা। শোষণ আর দারিদ্রর সাথে জীবন কেটেছে তার। তারই মাঝে তো বৃটিশ সরকারের রক্তচোখ
উপেক্ষা করে তিনি কবির লড়াইয়ে মেতে উঠেছেন। বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবী জুড়ে নেমেছে
অশান্তি. বিশ্বযুদ্ধ। থামেননি তিনি। সারা বাংলায় নেমে এসেছে দুর্ভিক্ষ। দেশভাগ।
কখনও কোথাও থেমে থাকেননি তিনি।
শ্বাস যেন ছোট হয়ে আসছে ।
সময়, কত সময় গেল বয়ে..! কোথা থেকে কোথায় এলেন।
শ্রীমতি অপূর্ব মোহিনীকে মনে
পড়ে ফের। বছর দুই না যেতেই অপূর্বর ঘর আলো করে জন্ম নিল রমেশ অপূর্বর প্রথম কন্যা
সন্তান। ফুটফুটে
জ্যোৎস্নামাখা মেয়েটির পর অপূর্ব পরপর আবার দুই কন্যা ও এক পুত্র জন্ম দিল। কিন্তু
ঈশ্বর পৃথিবীতে এদের জন্য সময়কাল নির্ধারণ করেছিলেন খুবই অল্প। তাই পরপর দুবারই
সন্তান বিয়োগ। শেষে অপূর্ববালাও..
রমেশ তখন ছন্নছাড়া, পাগলপারা তার সৃষ্টি নিয়ে। রমেশের দিদিমা কৌশল্যবালা বুঝেছিলেন সংসার টিকিয়ে
রাখতে হবে। তারই চেষ্টায় পালটি ঘরের
মেয়ে অবলাবালা এসেছিল সংসারের হাল ধরতে। অবলাবালা এবং তার সংসারে এসেছে চার পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান। তবু অপূর্বকে তিনি একদিনের জন্যও ভুলতে পারেন নি। আহ.. শ্বাস ছোট হয়ে আসে কেন.. বাতাস কই.. জীবন আদতে এক ভ্রমণ, পথ থেকে পথে অন্তহীন যাত্রা।
কোথা থেকে যেন অপূর্বর ডাক
ভেসে আসছে। তিনি কান পাতেন। চঞ্চল হন।
অপূর্ব ডাকছে.. অপূর্ব…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন