ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২)
পাশে রাখা সিঙ্গল সোফায় বসল সে। বসতে না বসতেই কলিং বেল –
আবার উঠতে হল। দরজা বারবার খুলতে হয় বলে দিনের অধিকাংশ সময়ে লিপিকা লিভিংরুমে বা
কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। নিজের দায়িত্বে রান্নাঘরের দেওয়াল ভাঙিয়ে ওপেন কিচেন করে নিয়েছে। একজাতীয় আব্রুহীনতায় কখনো সামান্য অস্বস্তি হলেও সুবিধে
অনেকখানি। শোভন দিনের অধিকাংশ সময়ে ছোটোঘরে অথবা বেডরুম-লাগোয়া তিনকোণা ছোট্ট
ব্যালকনিতে আপন দুনিয়ায় ব্যস্ত। বেশ ক’বছর ধরে একান্ত বাধ্য না হলে লৌকিকতা,
আসা-যাওয়া, দরজা বন্ধ, দরজা খোলা – সমস্ত থেকে সরে থাকতে পছন্দ করে। সপ্তাহে একদিন
বাজার, মাসে একবার মুদীখানা বাঁধা। অন্যসময়ে দরকার পড়লে অনলাইন খরিদারি বা ফাঁকা
সময়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে কাছাকাছি কাজ সেরে আসে লিপিকা। দরজা খুলতেই শিউলি হুড়মুড়িয়ে
ঢুকল।
--ও কাকী, খাওনি এখনো?
--এই বসব। তুই একটু ঘুরে আসবি অন্য বাড়ি সেরে?
--ওরে ব্বাস, আবার আসব? দেখি যদি টাইম পাই—। তিনটে
বাজল গো – ওদিকের ফ্ল্যাটে কাজ বাকি।
একমিনিট না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল শিউলি। লিফটে নিচে নামল।
গেটের কাছে সাইকেল বাঁধা আছে – বেরিয়ে যাবে। আর আসবে না সকালের আগে। লিপিকা দরজা বন্ধ করে অদূরে খাওয়ার
টেবিলে গিয়ে বসল। ম্যাটের ওপরে কাচের প্লেট ওলটানো আছে। ভাত, তরকারি আর ডিমের
ঝোলের বাটির পাশে সার্ভিং স্পুনে খাবার লেগে শুকিয়ে উঠেছে। পাশের ম্যাটে শোভনের
এঁটো প্লেট ঘন্টাদেড়েক ধরে শুকোচ্ছে। আগে খেয়াল করলে শিউলিকে ধুয়ে দিয়ে যেতে বলত।
অক্ষম রাগ হচ্ছে লক্ষ্য করেনি বলে। লিপিকা পিটপিটে, পরিপাটি। শোভনের প্লেট আর
হাতাদু’খানা আলতো করে তুলে কিচেন সিঙ্কে নামিয়ে দিয়ে নতুন এনে টেবিলে বসল। দু’চামচ ভাত, পাশে তরকারি, পুচকে বাটিতে ডিমের ঝোল তুলে নিল। ভাত মেখে আলগোছে মুখে দিয়ে মনে হল, বেশ খিদে আছে। ডেকচি থেকে আরেকটু ভাত প্লেটে নিতে
গিয়ে দেখল – শোভন খুব কম খেয়েছে। মাছের বাক্স পরিষ্কার করার ব্যস্ততায় শোভনের
খাওয়ার সময়ে দেখা হয়নি। নিজে নিয়ে খেলে প্রতিবার এই কাণ্ড ঘটে। জ্বালাজ্বালা রাগ
ভর করছে মাথায়, শোভন কি প্রি-নার্সারির বাচ্চা? খিদের আন্দাজ বুঝে খেতে পারে না! অনেকবার বুঝিয়ে বলেছে,
দরকার-অদরকারে কতবার খাওয়ার সময়ে থাকা সম্ভব হয় না। শোভন হাসে, মাথা ঘামায় না।
উবু হয়ে বসে খাওয়ার অভ্যেস শোভনের। খাওয়ার টেবিলের থেকে
চেয়ারটা সামান্য দূরে সরিয়ে নেয়। দু’পা ভাঁজ করে বসে, একটু এগিয়ে ঝুঁকে লম্বা হাত
বাড়িয়ে দিয়ে ভাত মেখে মুখে তোলে। অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে খায়। চিবোতে চিবোতে চোখ
অর্ধনীমিলিত হয়ে যায়। খাবারের কুচি ছোটো হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে গলনালী ধরে নেমে
পাকস্থলীর কাছাকাছি পৌঁছে যায় টের পায় না।
অবচেতনের রাস্তায় কোন একটা গলিঘুঁজি রাস্তায় ঢুকে পড়ে। কখনো ইঁট বের করা পাঁচিলের পাশে জল ছেড়ে রোগা কুকুরের খাড়া
লেজের মতো সড়াৎ করে হারিয়ে যায় সরু গলিটা। কখনো ফড়ফড় করে ফ্যানের হাওয়াতে উড়তে
থাকে ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের ছবিওয়ালা পাতা। বাংলা ক্যালেণ্ডার দু’পাশে নেচে নেচে চুনকাম পোচড়া করা সাদা দেওয়ালের গায়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি দাগ ফেলতে থাকে। দাগদুটো ক্রমশঃ
গভীর হতে থাকে। পরের বছরে আবার ঠিক ওই গজালেই আরেকটা নতুন ক্যালেণ্ডার এসে বসে
যায়। এসবের মধ্যে ঘুরে অনেক সময় খরচ করে ফেলে শোভন। পাশের চেয়ার থেকে আলতো হাতে
লিপিকা ঠেলা মারে,
--কী হল কী? খাও!
শোভন চোখ খুলে বিব্রতমুখে হাসে, পরের গরাস মুখে তোলে। বেশির
ভাগ দিনই লিপিকার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। নিজের প্লেট বাটি সরিয়ে কিচেনের সিঙ্কে রেখে
আসে, খাবারের বাসন তুলে দেয়
ফ্রিজে। পাশের চেয়ারে চুপ করে বসে থাকে। শোভনের খাওয়া শেষে হওয়ার অপেক্ষা যে করে
তা নয়, এমনিই বসে থাকে। শোভনের অলিগলি অবশ্য দেখতে পায় না। অনুমান করে সে পথগুলো আরো
লম্বা হয়েছে, তাতে খাওয়ার সময় আরো বেড়ে গেছে। লিপিকার খুব ধৈর্য্য। সহজে রাগ হয়
না, মাথা গরম হলে প্রকাশ করে না – এইসব মূল্যবান গুণ আয়ত্বে আছে বলে সংসারযাপনে
ছন্দপতন ঘটে না।
বেশ ছোটোখাট চেহারার মানুষ লিপিকা। ফর্সা রঙ ছাড়া চেহারার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য বিশেষত্ব
কিছু নেই। কথা বলে কম - নরম গলায় আস্তে, থেমে, সতর্কভাবে।
লিপিকা সিঙ্কে বাসন ধুতে থাকে। দূর থেকে আবছা
রবীন্দ্রসঙ্গীত ঢলদুপুরে ভেসে আসে – অলকে কুসুম না দিও, শুধু শিথিল কবরী
বাঁধিও...। লিপিকার আনমনা কানে গানের সুর কেটে মোবাইলের রিংটোন আসে। হাত ধুতে ধুতে থেমেও যায়। কাজ সেরে ঘরে পৌঁছে দেখে দেবিকার মিসড্ কল।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন