বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

কৌশিক দত্ত




স্বপ্নমেলা 





আনপড় মানুষ। দৈনন্দিনতায় ব্যস্ত গুটিসুটি লুকিয়ে থাকা অনুজ্জ্বল মানুষ। বইমেলা তবু মানে না। বইমেলা নাছোড়। টানাটানি করে। বইয়ের রঙ টানে, গন্ধ টানে, লেখা টানে। যেন টেবিল থেকে, তাক থেকে চেয়ে আছে মায়াবী ময়ালেরা, চোখ মেলালেই টেনে নেবে অমোঘ। বইমেলা গোলকধাঁধা। ঢুকে পড়লে খেই হারিয়ে যায়। আর বেরোনো যায় না, যতক্ষণ না ঘাড় ধরে বের করে দেয় শেষের বাঁশি।  

বইমেলায় তাই আর যাব না ভাবি। মেলা খরচ হয়ে যায় এবং হাতে-কাঁধে ব্যথা। বেশি পড়াশোনা না জানলে যা হয়, যে বই দেখি, তাই চমকপ্রদ লাগে। একটু নেড়েচেড়ে দেখলেই অচেনা বিষয়, অজানা কথা। আফসোস হয়। কত কিছু জানি না, জানা হল না! কলুর বলদের জীবনে কী অর্জিত হল? কতটুকু? অনেক অনেক বই কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে, পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কেনা হয়ে যায় বেশ কিছু। পড়া হয়ে ওঠে না। বাড়ি হয়ে ওঠে লাইব্রেরি আর আমি থেকে যাই আনপড়। পরবর্তী বইমেলায় একইরকম মূর্খ, অদীক্ষিত; একইরকম চমকিত, চমৎকৃত। এগোনো হয় না। গতানুগতিক অ্যানাকোন্ডা রোজ সকালে গিলে ফেলে, রাতে উগড়ে দেয় ক্লান্ত। লালায় মাখামাখি। বইয়ের আলমারির পাশে খাট পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্নে বই দেখি না। অন্যরকম রাক্ষসেরা আসে, অথবা ফুল-টুল বা আলতো পিকনিক। 

বইমেলায় তাই আর যাব না ভাবি। মেলা স্বপ্ন এসে যায় দিনমানে। আর আফসোস, হীনম্মন্যতা। তার চেয়েও বড় কথা, সারাবছর পড়াশোনা না করে বইমেলায় কদিন বই ভর্তি থলে হাতে ঘোরাঘুরি করে, দৈবাৎ দেখা পাওয়া (বাস্তবে বহুদিন হারিয়ে যাওয়া) সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে হাসি বিনিময় করে আর রোল-চাওমিনের দোকানে ভিড় করা পারবারিক মানুষদের উদরকেন্দ্রিকতার উদ্দেশে খ্যাঁদা নাকটাকে যথাসাধ্য সিঁটকে এই যে সংস্কৃতিবান শিক্ষিতবাবু বাঙালি সাজার চেষ্টা সস্তা যাত্রাপালার সঙের মতন, এই বাৎসরিক মিথ্যাচার নিজের, এই মুখোশ, আর সহ্য হচ্ছিল না। নিজেকে থামানো জরুরি ছিল। তিন বছর সত্যিই যাইনি বইমেলায়। আরও অনেকদিন না যাবার কথা ছিল। 

কথা রাখতে পারিনি। এবার আবার গেলাম। কলেজ জীবনের মতো আনন্দ নিয়ে গেলাম। বইমেলা টানছিল। কিছু ব্যক্তিগত কারণে এই বইমেলা ছিল আমার জন্য বিশেষ। যখন মেলায় যাওয়া বন্ধ করেছিলাম, তখন ছিলাম বেঘর একাকী। ইতোমধ্যে বাঁধা পড়েছি এবং ঘর বেঁধেছি। আমার স্ত্রী একনিষ্ঠ পাঠিকা। আমার না পড়া বইগুলো তিনি পড়ে ফেলছেন এক এক করে। সুতরাং আত্মহারা হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে বই কিনে ফেলা আজ আর ততখানি মূর্খামি নয়। আগামী এক বছরের মধ্যে বাড়িতে আনা বইগুলো অন্তত একজন পড়ে ফেলবেন নিশ্চিতভাবে। তিনিই আমার লাইসেন্স। 

উপরন্তু তিনি সুলেখিকা। একথা আমার বলা উচিত নয় দুই কারণে। প্রথমত ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলে নিরপেক্ষ বিচারের যোগ্যতা নষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত সাহিত্যগুণ বিচারের যোগ্যতা বা সেই বিষয়ে কোনো শিক্ষা আমার কোনোকালেই ছিল না। পরিচিত কিছু পাঠক তাঁর সম্বন্ধে এরকম বলেন এবং বেশ কিছু সম্পাদক ও প্রকাশক তাঁর লেখা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন দেখে  এরকম ধারণা করেছি। সে যাইহোক, এবছর বইমেলায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হল। প্রথমটি ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনী থেকে ‘নারীবাদী চিঠি ও অন্যান্য’ নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন। দ্বিতীয়টি 'ঐহিক' থেকে একটি ছোটগল্পের বই, ‘অনান্দনিক গল্প সংকলন’ নামে। তিন নম্বরটি তাঁর একার লেখা নয়, তাঁর  সম্পাদিত। 'লিরিকাল বুকস'-এর উদ্যোগে গার্হস্থ্য হিংসা ও মহিলাদের ওপর তার প্রভাব নিয়ে দেশের ও বিদেশের বেশ কয়েকজন বাঙলাভাষী নারীবাদী তাত্ত্বিক ও সমাজকর্মীর লেখা প্রবন্ধের সংকলন ‘খাদের ধারে ঘর’।            

অস্বীকার করব না, এই বইগুলোর কারণে বেশ খানিকটা উজ্জীবিত আর উৎফুল্ল ছিলাম। আবার চিন্তাতেও ছিলাম, নতুন বই প্রকাশের সময় লেখকের সঙ্গে জড়িত সকলেই যেমন থাকে। প্রতিজ্ঞা ভেঙে প্রায় রোজ বইমেলায় যাবার পিছনে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি সম্ভবত ছিল এই বই তিনটিই। অন্য কয়েকজন বন্ধুর নতুন বই ঘিরেও উৎসাহ ছিল। আজকাল পুস্তক চয়নেও মুখপুস্তকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, বিশেষত আমাদের মতো নষ্ট ভ্রষ্ট যারা বুকের ওপর খোলা বুক রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর ফেসবুকে ফেস গুঁজে রাত জাগে, তাদের ওপর এর প্রভাব বিপুল। নানাজনের লেখা বিভিন্ন রিভিউ দেখে ইচ্ছে-নদী ঝিরঝিরিয়ে বয়। দীর্ঘ হয় উইশ লিস্ট। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে নতুন উইশ জেগে উঠে হুশ করে বেহুঁশ করে দেয়। বইমেলা ফুরোতে টের পেলাম সাতান্নটা বই কিনে ফেলেছি, পত্র-পত্রিকা বাদ দিয়ে। আমার কেনা বইগুলো পড়ার দায়িত্ব শেষ অব্দি যাঁর, তাঁকে অতএব সপ্তাহে একটার বেশি বই শেষ করতে হবে, নইলে আমার আর পরের বছর যাওয়া হবে না মেলায়।              

কিছু লেখকের জোর করে বই গছানোর অভ্যাস নিয়ে অনেকেরই অস্বস্তি আছে। অনেকে এ নিয়ে সোচ্চারে নিন্দা করেন। আমি তেমন রূঢ় হতে পারি না। দেখা হলেই "আমার বইটা নাও এক কপি, আশি টাকা মাত্র", বললে কিনে ফেলি চক্ষুলজ্জায়। গোপনে জানাই, সেভাবে কেনা অধিকাংশ বই পড়া হয় না, কারণ ইচ্ছেটা মরে যায় শুরুতেই। দেখা হলে ভদ্রতা করি, কিন্তু দেখা না হলে খুশি হই মনে মনে। এবার ঠিক করেছিলাম, এসব এড়িয়ে চলব। চেনা মুখ এড়ানো সহজ, অপরিচিতের পানে ফিরে তাকাতেই হয়, কবি বলেছেন। মিডিয়া সেন্টারে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের শেষে সবে বেরোচ্ছি সপরিবারে, এমন সময় এক মধ্যবয়স্ক কৃশকায় ভদ্রলোক নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষণের মতো প্রায় মাটি ফুঁড়ে উদিত হলেন। হাতে তিনখানা বই। "নিন না, দেখুন বা।" "না, নেব না।" "না না, বিক্রি করছি না, এমনি দিচ্ছি পড়ানোর জন্য, পড়ুন," বলে আমার সাত বছরের মেয়ের হাতে একটা গছিয়ে দিলেন। বইটির নাম, ‘রচনা সংকলন’, তা তখন  খেয়াল করিনি। আরও একটা দিতে চাইছিলেন। ফ্রিতে অত বই নেওয়া উচিত নয় বলে বারণ করলাম এবার। তিনি আমার দিকে ঘুরে বললেন, " কষ্ট করে লিখেছি, একশোটা টাকা দিন।" দিলাম। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল সাহিত্যিকের এই করুণ পরিস্থিতি দেখে। কেন এভাবে পথে বই ফেরি করতে বাধ্য হন আমাদের লেখকেরা? আমরা পাঠকেরা, প্রকাশকেরা তাঁদের আরেকটু সম্মানজনক জীবন দিতে পারলাম না! বাড়ি ফিরে কষ্ট খানিক কমল বইটা নেড়েচেড়ে। না, ইনি সাহিত্যিক নন। নিতান্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় স্তরের কিছু রচনা, ‘একটি বিকেলের বর্ণনা’ গোছের। এতদিন আমার গর্ব ছিল যে আমার চেয়ে খারাপ কেউ লিখতে  পারে না। সেই অহংকারটাও চূর্ণ হল একশ টাকার বিনিময়ে। এখন আর কী প্রত্যয় নিয়ে বাঁচব?                   

বইমেলার আরেক আকর্ষণ আড্ডা। সাহিত্যিক মহলে আমাকে কেউ চেনেন না, তবু নানা সময়ে নানাভাবে আলাপ হয়ে গেছে নানা জনের সঙ্গে। দিল্লিতে থাকার সময় সৌরাংশু আর শৌভকে পেয়েছিলাম উপরওয়ালার উপহারের মতো। বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন বা কনট প্লেসের কফি হাউজে আড্ডা হত। ওরা নানা বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলত, কবিতা গল্প পড়ে শোনাতো। আমি শুনতাম। মাঝেমাঝে বেকুবের মতো ফোড়ন কাটতাম, যাতে ব্যাপারটা দেখতে আড্ডার মতো লাগে। এখন দেখা হয় ওরা কলকাতায় এলে। স্ত্রীর সূত্রে আলাপ অনিমিখ, বহতা, সৌমিতদের মতো প্রতিভাবান কবি-লেখকদের সঙ্গে। বইমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে ওরা গল্প করে, আমি শুনি আর শিখি। লিটল ম্যাগাজিনের তাঁবুতে জড়ো হয় যেসব অভিযাত্রী, তাদের মধ্যে এখনও আছে বহুযুগের ওপার হতে ভেসে আসা কিছু চেনা চেনা ঝোড়ো মুখ। কেমন আছ? এই তো এবারের সংখ্যাটা। বাহ! দেখি। যারা হেরে যায়নি, ভেসে যায়নি ঘোলা স্রোতে, যারা এখনো সাঁতার কাটছে উজান বেয়ে, তাদের দেখে শান্তি পাই… তাদের জন্য গর্ব বোধ করি দু'দণ্ড, আবার প্রাত্যহিকতায় ডুবে যাবার আগে। যে বাতাসে তারা স্বাস নিচ্ছে, সেই বাতাস টেনে নিই বুক ভরে। সেও এক বাৎসরিক সঞ্চয়।           

গর্ব বোধ করানোর ষড়যন্ত্র করে তৈরি ছিল আরও কিছু তরুণ-তরুণী। বুড়ো হতে হতে চোখে চালসে পড়ে বলেই হয়ত আমরা তরুণদের ভালো ঠাহর করতে পারি না। অহেতুক সন্দেহ জন্মায় পরবর্তী প্রজন্ম সম্বন্ধে। তাদের কাছ থেকে যা শিক্ষণীয়, তা শিখতে পারি না। পিছিয়ে পড়ি। অগ্রগামী তরুণদের সঙ্গে স্থবির আমাদের এই ব্যবধানকে  ইংরেজিতে বলে 'জেনারেশন গ্যাপ'। আসলে বয়সের ফারাকটা বড় কথা নয়। আমরা আমাদের গুদামঘরে তালা দিয়ে চাবি হারিয়ে ফেলেছি। নইলে আনাদের চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা নিজেদের দরজা জানালা খোলা রেখেছেন সযত্নে, তাঁরা তো দিব্বি তরতর করে হেঁটে চলেছেন ওদের মিছিলে পা মিলিয়ে।      

মিছিল। মিছিলেই মানুষ বড় হয়। মিছিলেই বৃদ্ধ তরুণ হয়। বইমেলায় তরুণেরা এবার এনেছিল মিছিল। দিচ্ছিল বিনে পয়সায়। এনআরসির বিরোধিতায় সোচ্চার ও উজ্জ্বল ছিল তারা। বইমেলায় রাজনীতি হওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে তখন সুশীল মহলে জোর বিতর্ক। বই মানুষকে ঘুমন্ত অরাজনৈতিক থাকতে দেয় কিনা, সেই প্রশ্ন বরং আমাকে তাড়িত করে। যথেষ্ট পড়াশোনা করিনি বলেই আত্মসুখী অলস জীবন কাটাতে পারছি, এমনটাই আমার ধারণা। যাদের মন খুলে গেছে, তারা আর একা বাঁচতে পারে না। সমষ্টির প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের একা একা সুখী হতে দেয় না। তাদের হাঁটাচলা মিছিল হয়ে ওঠে। বইমেলায় চিকেন পকোড়া খেতে যখন আপত্তি নেই, বাইবেল-কোরান-গীতা-হন্যমান চালিশা বিলিতে আপত্তি নেই, তখন ক’টা ছেলেমেয়ে নিজ বিশ্বাস অনুসারে  রাজনৈতিক লিফলেট বিলি করলে আপত্তি কেন?   

রাজনীতিতে যারা এদের বিপক্ষ, তাদের আপত্তি থাকতেই পারে। কেন্দ্রীয় সরকারি দলের সমর্থকরা এদের কাজকর্ম পছন্দ করবেন না, তা প্রত্যাশিত। সেই দলের সমর্থকদের মধ্যে যারা গুণ্ডা প্রকৃতির, তারা এই ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করায় তাই আশ্চর্য হইনি। সেই আক্রমণের ফাঁকে ছাত্রীদের যৌন  নিগ্রহও করা হয়েছে শুনে ব্যথিত হয়েছি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্দশা দেখে। অবাক হয়েছি কলকাতার বুকে বইমেলাতেও এরকম কাজ হতে পারে দেখে। তবে স্তম্ভিত হয়েছি পুলিশের আচরণ দেখে। শান্তিরক্ষা যাঁদের কাজ, তাঁরা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা না করে, আক্রমণকারীদের বিন্দুমাত্র বাধা না দিয়ে আক্রান্তদের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাদের কিল-চড় মেরে কলার ধরে তুলে নিয়ে গেলেন, যখন বইমেলার মাইকে বাজছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে এনআরসি বিরোধী বক্তৃতা ও স্লোগান! প্যারাডক্স! গোঁজামিল! তারপর থানায় আরেক কাণ্ড, কিন্তু সেসব বইমেলার বাইরে, তাই এখানে নয়।          

উচ্ছেটা শেষ পাতে পরিবেশিত হলেও ভোজটা একেবারে মাটি হয়নি। বরং সুস্বাদ লেগে আছে মুখে। এই বইমেলা অনেককিছু দিল। বই, বন্ধু, শিক্ষা, গতি… কত কী! এখন এসব সঞ্চয় নেড়েচেড়ে দেখছি আর ভাবছি, আবার বাঁচা যায় কিনা।                                                                            





1 টি মন্তব্য:

  1. সামগ্রিক অনুভব বড় উদ্দীপক। ভাষা সঙ্গত করেছে যথাযথ। সামান্য বিষাদে জাড়িত আপাতলঘু এই লেখা আনন্দ দিল। অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন