আমাদের চেনা দুনিয়ার
বাইরে আরো অনেক দুনিয়া আছে। আমরা ছোট্ট মানুষরা তাদের জানতে, চিনতে চাই না চট করে।
অথচ বড়র দিকে, মহতের দিকে যদি তাকাই আপনা থেকেই খসে পড়তে থাকে চারপাশের হীন
গতিবিধিগুলি। শিল্পী হওয়ার একটা মস্ত সুবিধে হল চারপাশের এই অপমান,অসম্মান শিল্পে
সাজিয়ে দিয়ে যেতে পারা।কবি বা লেখকেরাও ব্যতিক্রম নন। কবিতা, গল্প, নাটক প্রকাশের
মধ্য দিয়ে তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার ভার যেমন লাঘব হয় তেমনই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে
সত্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার রসদও জুগিয়ে যাওয়া যায়। সত্য সবসময়ই প্রকাশমান।
আমি সত্যিটা দেখিয়ে দিচ্ছি বলে সত্যকে উজাগর করা চলে না, সে সর্বদাই বেআব্রু। আর
যে স্বতই বেআব্রু তার আর বাটপারের ভয় কী? অপরদিকে মিথ্যের
শরীরে চাপানো থাকে রংবেরং পোশাক। নিজেকে উপস্থাপন করতে কত রংঢং সাজিয়ে তুলতে হয়।
গলা উঁচু করে কথার পালিশ দিতে হয়, বিজ্ঞাপন করতে হয়। আজ এ কথা সকলেই জানেন, সকলেই
বোঝেন। মিথ্যের একমাত্র সত্যি হল যে সে মিথ্যে। সকলের মনোজাগতিক রুল একরকম হতে
পারে না অথচ আমরা সকলেই কমবেশি এই ভুলটা করে বসি যে নিজের মতো করেই অপরের আচরণকে
বিচার করে ফেলি। যা আমার ভালো লাগছে দুনিয়া তেমন ভাবেই চলবে -- এ ধরনের গাজোয়ারি
বিশ্বাস মানুষের মনে ক্রমশ চেপে বসছে। কিন্তু এরকম ভাবনা দ্বারা ব্যষ্টিক দুনিয়া
হয়ত পরিচালিত হতে পারে, সামগ্রিক দুনিয়া কখনই নয়। সেক্ষেত্রে নিজের এবং অপরের
মতামতের মধ্যে একটা সুষ্ঠু ব্যালেন্স করে চলাই বিধেয়। নতুবা সভ্যতার ধাঁচা বিপুল পরিমানে
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা, অপিচ ভেঙে পড়াও অসম্ভব নয়। বর্তমানে তেমনই এক ভয়াবহ
স্থিতি তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে।
পরিকল্পিত ও খুব
সূক্ষ্ম দক্ষতার সঙ্গে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের মানসিক
ব্যবহারের উপর। অদ্ভুত একটা কালো হাওয়া বইছে দেশের মাথার উপর। যারা সক্ষম হচ্ছেন
মাথা ঢেকে নিতে তারা রক্ষা পাচ্ছেন অন্যদিকে যারা পারছেন না তাদের উপর কালো বাতাস
নেমে আসছে অভিশাপের মতো। নিজস্ব বিচারবোধ হারিয়ে তারা ক্রমশ পরিণত হচ্ছেন অপরিচিত
মানুষে। কালও যাকে নিজের মনে হয়েছে আজ তার চোখের দিকে তাকাতে ভয় করছে। সে চোখে
কোনো আলো নেই পরন্তু চাপচাপ অন্ধকার যেন ঠেসেঠুসে ভরা। ইচ্ছা না-পূরণের দাবি তাকে
করে তুলেছে হিংস্র অসামাজিক ষড়যন্ত্রের দাস। কালো বাতাস যা চাইছে সে তাই করতে যেন
বদ্ধপরিকর। তাতে যদি নিজের ক্ষতিও হয় তাও সই। ভারতবর্ষ অনেক কালো সময় দেখেছে
কিন্তু এমন সুচারু ভাবে ঘটিয়ে তোলা অমঙ্গল দেখেনি কখনো। একটা ব্যাপারে হয়ত সকলেই কমবেশি
একমত হবেন যে, অসহনশীলতার নগ্ননৃত্যের যে পরিবেশ আজ আমজনতার মনে বাসা বেঁধেছে তাকে আর ক্ষণিক
দুর্বলতার দোহাই দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। একই ঘটনা একাদিক্রমে ঘটতে থাকলে তার
চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় (যাঁরা এ কাজে পারদর্শী, তাঁরা এ কাজ শুরুও
করেছেন)। নচেৎ অন্তর্দ্বন্দ্বের পঙ্কিল অন্ধকারে মঙ্গল-অমঙ্গল বিভেদ-ঢাকনাটির
চিরতরে বিনষ্টি ঘটে।
আমি এ বছর(২০২০)
৪৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় গেছি চারদিন। কোনো সন্দেহ নেই যে এর পূর্বে যতবারই
গেছি এবছর গেছি তারচেয়ে অধিক দিন। কিন্তু পূর্ব পূর্ব বইমেলায় যাওয়ার সঙ্গে এবছর
বইমেলায় যাওয়ার কিছু ফারাক ছিল। আগে বইমেলায় যাওয়া মানেই ছিল বই দেখা, বই কেনা।
কিন্তু এবছর সেটি হয়েছে কম। উত্তরের সারাদিনের জন্য বইমেলা বাইট নিতে নিতে সময়
গেছে। ফলে যত না বইপত্র ঘেঁটেছি মেলাকে ঘেঁটেছি তারচেয়ে বেশি। যে চারদিন আমি
বইমেলায় ছিলাম সেই চারদিন কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখিনি বা কানেও আসেনি। এক
আনন্দময় সামগ্রিকতার প্রকাশই ছিল বেশি। লোকেরা বইয়ের দোকানে ভিড় জমিয়েছিল। নতুন
বইয়ের ব্যাগ শোভা পাচ্ছিল তাদের হাতে। বন্ধুদের সঙ্গে সমবেত সেলফি তোলা হচ্ছিল। খাওয়াদাওয়া,
গানবাজনা চলছিল দেদার। অতীতের মতোই এবছরও বইমেলা ছিল বেজায় ফুর্তিবাজ। কাজের
সিলসিলায় মেলার মধ্যে চক্রাকারে ক্রমাগত পাক খাওয়ার কারণে মেলার মুখর ও প্রাঞ্জল
রূপটিকে দেখেছি আমার উপস্থিতির চারদিনই। বাইবেল দান হতে দেখেছি বিনামূল্যে। কিন্তু
তা নিয়ে কোনো হইচই নেই। যাঁরা দিচ্ছেন তারা যেমন নির্বিকার দায়িত্ব পালন করছেন
তেমনি যাঁরা নিচ্ছেন তারাও যে কোনো বিশেষ অভিপ্রায় দ্বারা চালিত হচ্ছেন তেমনটি বোধ হচ্ছিল না। একবার তো এমনও হল যে
টেবিল থেকে হুড়মুড়িয়ে বেশ কিছু বাইবেল পড়ে গেল রাস্তায়। বইমেলায় আসা মানুষই সেসব
তুলে গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করেছেন। এতদূর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। এ হল বইমেলা আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার ঠিক দু’দিন আগের
ঘটনা। শেষের দু’দিন আমি যাইনি। তাহলে
অচানক কী এমন ঘটল যে বাতাসের দিক পরিবর্তনে টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বইমেলার কপালে লেগে
গেল 'অশালীন অভব্য'তার কালিমা?
যেহেতু ঘটনার দিন
আমি বইমেলা যাইনি, যেহেতু আমি প্রত্যক্ষদর্শী নই তাই ঘটনা যে ঠিক কী ঘটেছিল তা আমি
জানি না। পরে আমার যে বন্ধু বা পরিচিতজন সেদিন মেলায় উপস্থিত ছিল তাদের কাছে যা
শুনেছি তা হল এআরসি, এনপিআর, সিএএ বিরোধী একটি মিছিল খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে ঘুরছিল
মেলায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধেই ছিল মিছিল। মিছিলটি সারা মেলা ঘুরে
বিজেপি স্টল জনবার্তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে শুরু হয় চাপানউতর। ক্রমে পরিস্থিতি গরম
হতে থাকে এবং এক সময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। পুলিশ এলে জটিলতা আরো বাড়ে। একটি আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহ্যবাহী বইমেলায় এ ধরনের আচরণ আদৌ কতটা কাম্য এ নিয়ে বিস্তর
মতভেদ আছে। একদল বলেন এতে বইমেলার সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে, ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে
এরপর বইমেলায় আসার আগে ভাবতে হবে, বইমেলার শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। বইমেলার ভিতরে
রাজনীতিক প্রতিবাদের এ হেন অপপন্থা মানুষকে বিরক্ত করেছে এবং একবার যা শুরু হয় তা
আর থামে না এমন ধারণাতে যদি বইমেলা প্রাঙ্গণকেও রাজনৈতিক
বাদ-বিসম্বাদের আখড়া করে তোলা হয় তাহলে বইমেলা শ্মশানে পরিণত হতে বাধ্য।
এমনিতেই অনলাইন পারচেজের সুবিধে হয়ে যাওয়াতে লোকজন ঘরে বসেই পছন্দসই বই কিনতে
পারেন। অপরদিকে অন্যদল বলেন প্রতিবাদের জায়গা হিসেবে বইমেলাকে বেছে নেওয়া অত্যন্ত
বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত কারণ এখানে প্রচুর মানুষ আসেন স্বইচ্ছায়, ফলে তাদের কাছে
দেশের সুরত-এ-হাল বয়ান করা অনেক সহজ হয়ে যায়। যেহেতু আমি সেদিন মেলায় যাইনি তাই এর
ভালো বা মন্দের ব্যাপারে কিছু বলা শোভা পায় না, স্বাভাবিকভাবেই। সে বিচার করবে
আগামী সময়। আমি শুধু একটাই কথা বলব, সাদা পাতার উপর কালো অক্ষরে প্রতিবাদ
লেখা হলে তাতে যেমন সাদা পাতা কলুষিত হয় না, তেমনি অক্ষর কালো বলে তার গরিমাও
তমসাঙ্কিত হয় না। মানুষ তার অজস্র চিহ্ন
চারপাশে ছড়িয়ে রাখবেই। কিছু বোধ্য কিছু অবোধ্য, কিছু বা বধ্য কিছু অবধ্যও। কোনো
ছবি যদি নগ্ন হয় বা কোনো ছবি আবৃত, তাতে
ছবির যেমন কিছু এসে যায় না, শেষ পর্যন্ত ছবিই বেঁচে থাকে, তেমনই বইমেলার ওই বিশেষ দিনটির জন্য আশা করা যায়
বইমেলার গায়ে কোনোরকম আঁচড়ের দাগই আর লেগে থাকবে না। বইমেলা তো নিছকই বই বিকিকিনির
জায়গা নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের হার্দ্যিক মিলনস্থানও বটে। ফলে মানুষ মানুষের
টানেই আগামীদিনেও বইমেলামুখো হবেন এ আশা রাখাই যায়।
বইপ্রেমী অসংখ্য মানুষের
স্বতঃস্ফূর্ত অভিবাদনে আগামীদিনেও বইমেলা চলবে তার নিজস্ব চলনেই। যতদিন পৃথিবীতে
অন্যায় থাকবে প্রতিবাদও সরব হবে ততদিন। তার কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। বৃহত্তর মানবতার
স্বার্থে তা করাও অনুচিত। প্রতিবাদ পদ্ধতি হয়ত বদলাতে পারে, স্থান ও কাল বদলাতে পারে। জীবনের এই দোলায়িত
ছন্দ আছে বলেই কবিতা আছে, শিল্প আছে, মানুষ আগুন নিয়ে ঘর করে। পথ চলতি পাশের ঝোপের
অন্ধকারেও জোনাকি জ্বলে। জীবনের ক্রমজটিলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের অসহিষ্ণু
স্বরগ্রাম উচ্চ হবে এ যেমন স্বাভাবিক
তেমনই কোনো অনায্য কারণে, ঐতিহাসিক স্বীকৃতিবিহীন কারণে যদি কেউ অনমনীয় ভঙ্গিতে
ছুরিকা শাণিত করে তাহলে তৎক্ষণাৎ তা খণ্ডনের জন্য গাঢ় অর্থপূর্ণ প্রতিক্রিয়া
ফিরিয়ে দেওয়াই সভ্যতার মূল কাজ হবে। এর জন্য কোনো বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণের প্রয়োজন
নেই, দরকার শুধু চোখ কান খোলা রেখে বৈপরীত্যের আত্মাটিকে অনুধাবন করা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন