বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

যশোধরা রায়চৌধুরী




সত্যের অতীত এই বইমেলা






বইমেলা নাকি আবার মিলন মেলায় ফিরে যাবে? ওখানে ঢাকা ছাত। ওখানে সবটাই ভেতরে। এই খোলা ময়দানের মজাটাই নাকি থাকবে না? আর ক'বার পরিবর্তন হবে মেলার মাঠ? আর ভাল্লাগে না বাপু।

বইমেলায় শনি রবিবার এত ভিড় কেন? ভিড়ে এত লোক বেরোয় কী করে!  
বইমেলায় লোকে কী করতে আসে? ফিশফ্রাই খাওয়া? না বই কেনা?
এত এত তো লোকজন দেখছেন। কারুর হাতে একটাও বইয়ের প্যাকেট দেখছেন?
বইমেলাতেও আন্দোলন? পুলিশের ঝামেলা? এবার একটা জোর বৃষ্টি নামুক।

আসলে বইমেলার মত মেলা কলকাতায় আর একটিও নেই। বলা বাহুল্য, অন্য  অনেক মেলা চলে গোটা শীতকালে। কলকাতার মেলার ক্যালেন্ডার বহুবর্ণ। অন্যান্য অনেক মেলায় টাকার অংকে কেনাবেচা হয় বেশিই হয়ত, সেখানে হয় বেশ ভাল ভিড়।  ক্রেতাদের ঠাসাঠাসি। বিধাননগর মেলায় মিশর বা তুর্কি থেকে আসে মহামূল্য দ্রব্য। গৃহবধূরা আদত বাংলাদেশের শাড়ি কেনেন ঠেলাঠেলি করে। কিন্তু বইমেলার মত একটি মেলা যে কলকাতায় হয় সেজন্যে আমি যতটা গর্ব বোধ করি প্রতিবছর, ততটা আর কোন কিছুতেই না। প্রতিবার থিকথিকে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, রাশি রাশি ছোটবড় বইয়ের প্রকাশকের স্টলের দিকে তাকিয়ে, আমার চোখে জল আসে।

এ আমাদের সারা বছরের ফসল ঘরে তোলার উৎসব। এ আমাদের সারা বছরের অপেক্ষার পর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবার উৎসব। নিশ্চিত, যে, বড় প্রকাশকদের কাছে বইমেলা ধরার জন্য আকুলতা, ৪০ বা ৫০টা টাইটেল মাঠে আনতে পারার আকুলতা যতটা, ছোট্ট অনামা লিট ম্যাগের বাৎসরিক সংখ্যাটা পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারার আনন্দ ততটাই।

অনেক সমালোচনা হয় প্রতিবছর। কেউ লেখেন, টিকিট করা উচিত। অবাধ প্রবেশ করে লাভ কী! বাজে লোক ঢোকে। কেউ বলেন, বই কেনার লোক নেই। কেউ  বলেন, বাংলা বই কেনার লোক কমছে। কেউ ভিডিও করেন, ছেলেমেয়েরা জানে না, সহজ পাঠ কার লেখা। ঠাকুমার ঝুলি কার লেখা জিজ্ঞাসা করলে বলেন,  ঠাকুমার!

কাগজে ছাপা হবে মাতব্বরদের লেখা। সেখানে বলা থাকবে, আসলে কেউ পড়ে না, শুধু পড়ার মত দেখায়। সেখানে বলা থাকবে, ক’ কপি ছাপা হয় নতুন, ফেকু লেখক, ফেকক (পড়ুন ফেসবুক লেখক) দের বই, যে, প্রতিদিন তা আউট অফ প্রিন্ট হয়ে যায়? জোর করে বইকে হট কেক বানানোর জন্য, আর্টিফিশিয়াল  ক্রাইসিস তৈরি করার জন্য এত কম কপি আনা হচ্ছে মেলায়? ছাপা হচ্ছে কম? কত রকমের হিসেব বেরোয় বইমেলার পর। ২৩ কোটি বই বিক্রি। ৩০০০ কোটি  টাকার কেনাবেচা। আবার প্রত্যেক প্রকাশক হাত উল্টে বলেন, ভাল বিক্রি না।  ওদিকে মার্কেজ বা নবারুণের ওপর বিশেষ সংখ্যা করা পত্রিকার ছোট্ট স্টলের ছেলেটি বলে, সব কপি তার উড়ে বেরিয়ে গেছে নাকি!

সত্যি মিথ্যা অর্ধসত্য প্রায় সত্য সত্যাতীত!

কত কিছুর সঙ্গে দেখা হয় বইমেলায়। এই সবের মাঝে আমাদের প্রতি বছর বইমেলায় দেখা হবার আকুলি বিকুলি চলে। পরিকল্পনাগুলো সব হয় বইমেলা কেন্দ্রিক।

এই বইমেলায় দেখা হল একগুচ্ছ বন্ধুর সংগে, আর দেখা হতে হতেও হল না আরো একগুচ্ছ বন্ধুর সঙ্গে। এই না দেখা হওয়াগুলো বেদনা হয়ে বেজে বেজে যাবে। দেখা হওয়াগুলো ছবি হয়ে ফেসবুকে ঝুলে ঝুলে থাকবে। পরের বছর অব্দি।

বাড়িতে বই রাখার জায়গা নেই, কিনব না কিনব না করে করেও, শেষ পর্যন্ত আমরা বেশ কিছু বই কিনে ফেলব। অন্তত আলমারির দেড়খানা তাক ভরিয়ে দেবার মত বই তো বটেই। এই চব্বিশ পঁচিশটা বইয়ের মধ্যে পড়া হয়ে যাবে দু’তিনটি। বাকিগুলো পাঁজা হবে, পড়ব পড়ব করে পরের বইমেলা এসে যাবে। পাতলা চটি কবিতার বইক’টা হারিয়ে যাবে।  

সব হবে। ভাল মন্দ মিলিয়ে। জীবন যেমন। তবু, শুধু বইয়ের জন্য একটা বছরের এমন উৎসব? আর কোথাও এভাবে হয়? এই মাতামাতি?

৩টি মন্তব্য:

  1. সত্যি মিথ্যা অর্ধসত্য প্রায় সত্য সত্যাতীত!

    উত্তরমুছুন
  2. চমৎকার লেখা যশোদি। চমৎকার! দেখা হল না এবারও। অনেকের সঙ্গেই যেমন দেখা হয়নি। অপেক্ষায় থাকি আগামী বারের জন্য।

    উত্তরমুছুন
  3. বইমেলায় লোকে ভীড় করে খেতে !

    শুদ্ধ বাঙালীয়ানার জমাট-বাঁধা স্বাদ
    নস্টালজিয়ার জিভে আশ মিটিয়ে অনেকটা পেতে !

    উত্তরমুছুন