বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

শুভশ্রী পাল




আমার উৎসব ‘বইমেলা’  



বইমেলা। মধ্যবিত্ত কেরানি বাবার মেয়ের এই শব্দটার সাথে পরিচয় হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে গেছিল। মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা আমার বইএর জগৎ বলতে পাড়ার লাইব্রেরিই সব। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবা নিয়ে গেছিল বর্ধমান বইমেলায়। জ্যাক লন্ডনের ছোটগল্প আর ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট কিনে দিয়েছিল বাবা। হাঁ করে গিলেছিলাম বইএর দোকান। সেই প্রথম...

বড় হওয়ার পর বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোকে ছাপিয়ে আমার উৎসব কবে যে বইমেলা হয়ে উঠেছে, বুঝতেই পারিনি। বইমেলার আগে থেকে শুরু হয়ে যায়  তোড়জোড়। টাকা জমিয়ে বই কেনার প্ল্যান। নতুন বইএর লিস্ট আর স্টল নম্বরের একটা লম্বা লিস্ট হতে থাকে কয়েকমাস আগে থেকেই। বছরের যাবতীয় কাঙ্ক্ষিত দেখা হওয়া-হওয়িদের দিন ওই বইমেলা জুড়ে। বিকেলের পর থেকে  বইমেলা টার্ন নেয় খাদ্যমেলায়, তার আগেই দুপুর থাকতে থাকতে ঘুরে নিই প্রকাশনার স্টল। অতঃপর লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের টেবিল। চেনামুখেদের আনাগোনা মন ভালো করে দেয় নিমেষেই। 

বইমেলার একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া আছে। আমরা টেকস্যাভি হয়ে ওঠার আগে যেরকম বেঁধে বেঁধে থেকেছি, বইমেলা ফিরিয়ে দেয় সেসব দিন৷ এখানে এসে  কেউ কাউকে ফোন না করেই খুঁজে নিই আগ্রহতুতো লোকজনকে। প্রতিবার মেলায় নতুন নতুন লেখার এবং লেখার কলমের হাতেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়।
এবারে মেলার আগে হিয়া খোঁজ দিল তনুজের। ওর বইএর নাম এবং কভারেই আমি ছিটকে গেছিলাম। দুদিন ধরে কোয়ার্কের স্টলে হত্যে দিয়ে তনুজের বই খুঁজলাম। ওর আগের একটা বইও হাতে দিল। এই বই ঘিরে চলল আলাপ আলোচনা। এই সবের সাথে ভাষার সাথে আড্ডা, বাতিঘরের টেবিলে গিয়ে ভীড় করা, রাতুলদার কাছে ছবি তুলে দেওয়ার আব্দার... ক্ষিদের সময় খেতে খেতে মনে পড়ে যায় প্যাভিলিয়নে থাকা বন্ধুদের মুখ, খাবার নিয়ে চলে যাই তাদের কাছে। টেবিল গোছাতে গোছাতে অপ্রত্যাশিতভাবে ডিমের ডেভিল পেলে আকাশের মুখে গোধূলির হাসি ফুটে ওঠে। আমি ওদের বলি কীভাবে ওরা রাজা আর আমি টুনটুনি পাখি হয়ে উঠছি দিনদিন। 

মাঠে বসে এ ওর কেনাকাটি দেখে নিই এক ফাঁকে। ব্যাঙ্ক ধর্মঘট আর স্যালারি না হওয়ার বিপর্যয় নেমে আসায় পরিচিত প্রকাশনার স্টলে গিয়ে আব্দার করে আসি পছন্দের বই আমার জন্য সরিয়ে রাখার। পরে সংগ্রহ করব বলে। বইএ ভারী হয়ে ওঠা ব্যাগ জায়গা করে নেয় লিটিল ম্যাগাজিনের টেবিলের নীচে। আমি উড়ে বেড়াই প্রজাপতি হয়ে। খুঁজে না পাওয়া মুখেদের খুঁজতে চলে যাই মাঠের ওপাশে টয়লেটের কাছে। যেভাবে বেডরুম, ডাইনিং হল আর বাথরুমে সাবলীল আনাগোনা, ক’টাদিনের জন্য প্যাভিলিয়ন থেকে টয়লেট তারই রেপ্লিকা  হয়ে ওঠে। পরীক্ষার জন্য উইক এন্ডে মেলা যেতে না পারায় বিষণ্নতা ঘিরে ধরে আমাকে। শেষ দিনের ঘন্টা শুনে সবাই কেঁদে ফেলে। কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া আজও সম্ভব হয়নি। বইমেলা একটা আবেগের নাম। একটা উদযাপনের সময়, আর সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ। 

বইমেলা শেষ হয়েও ঠিক শেষ হয় না। রেশ থেকে যায় আরো কিছু সময় জুড়ে।  নতুন বই পড়তে পড়তে সেসবের আলোচনা-প্রতিক্রিয়ায় নিবিড় হয় বন্ধুত্ব, পরিচয়। বাদ পড়ে যাওয়া বইদের নামে ভরে ওঠে অনলাইন কার্ট। আর আমরা এগিয়ে যাই এক সমৃদ্ধ আগামীর দিকে...




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন