(সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন : পল রেইনবো)
স্থান,
আধিপত্য ও জ্ঞান : ভণে মিশেল ফুকো শুনে পূণ্যবান
[মিশেল ফুকো। উম্মাদনার দার্শনিক। সিমন
ড্যুরিং সম্পদিত ‘The Cultural Studies Reader’-এ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩) পল রেইনবোকে
দেয়া মিশেল ফুকোর এই সাক্ষাৎকারটিতে ফুকো আলোচনা করেছেন স্থাপত্য, সমকাম ও যৌনতা, জ্ঞান
ও সামাজিক ক্ষমতা বা আধিপত্যের অনুষঙ্গসমূহ সম্পর্কে। ফুকো বলেছেন, বস্তুগত পরিবর্তন
সমূহকে কোনমতেই বিষয়ীকেন্দ্রিক পরিবর্তনগুলোর জন্য দায়ী করা চলে না। উদাহরণ হিসেবে
বলা যেতে পারে, মধ্যযুগে যখন প্রথমবারের মত, ঘরের বাইরে নয়, বরঞ্চ ঘরের ভেতরে চিমনীর
ব্যবহার শুরু হল, তখন আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কসমূহ বদলে গেল। চিমনীকে ঘিরেই নতুন নানা
সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উদ্ভব ঘটল। কিন্তু সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার এই পালাবদলের কারণ হিসেবে
শুধুমাত্র চিমনীর স্থাপত্য বা গঠনশৈলীকে দায়ী করলেই চলবে না, বরং মধ্যযুগের শুরুতেই
পশ্চিমে যে নতুন নতুন ডিস্কোর্স ও মূল্যবোধের সূচনা হয়েছিল, সেসবের দিকেও দৃষ্টি দিতে
হবে। ফুকো আরো জানান, ‘স্বাধীনতা’ বা ‘চিন্তাশীলতা’-র মত বিমূর্ত শব্দসমূহের সত্যিকারের
প্রাণ-প্রতিষ্ঠার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো স্থান, জীবনাচরণ, মূল্যবোধ ও ডিস্কোর্স বা
জ্ঞান প্রপঞ্চসমূহের বস্তুগত পুনগর্ঠন। পুনর্গঠনের এ প্রক্রিয়াকে ফুকো আখ্যা দিয়েছেন
‘মুক্তির অনুশীলন’(Practices of Liberty) নামে। অলমতি বিস্তারেন। সাক্ষাৎকারটি পড়া
যাক।]
পল রেইনবো :
অতীত বা বর্তমানের কোন স্থাপত্য-কর্মটিকে আপনার স্বাধীনতা বা প্রতিরোধের শক্তিবাহী
বলে মনে হয়?
মিশেল
ফুকো : আমি মনে করি না যে কোন নির্দিষ্ট বস্তুকে আলাদা করে
‘স্বাধীনতা’-র প্রকরণ বা ‘নির্যাতনে’-র প্রকরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে বা দেখা যায়।
অবশ্য এমন কিছু স্থাপত্যকর্ম রয়েছে, যাদেরকে বেশ নিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতার বিরোধী বলে
সনাক্ত করা যায়। যেমন একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাপকে আমরা কিছুতেই স্বাধীনতা বা মুক্তির
ধারক বলে মনে করতে পারি না-- তবে, পাশাপাশি এ ব্যাপারটিও মনে রাখা দরকার যে একটি সমাজব্যবস্থা
যত ভয়ঙ্করই হোক, নিপীড়ন ও ফাঁসিকাঠের পাশাপাশি
প্রতিটি সমাজেই কিন্তু প্রতিরোধ, অবাধ্যতা এবং বিরোধীপক্ষগুলোর সম্মিলনের সম্ভাবনা
থেকে যায়। অন্যদিকে দেখুন, আমি মনে করি না যে পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু বা প্রতিষ্ঠান
আছে, যাকে পুরোপুরিভাবে অর্থাৎ ঐ বস্তু বা প্রতিষ্ঠানটিকে তার আঙ্গিকগত বা প্রকৃতিগতভাবেই
বিচার করে সম্পূর্ণতা, স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা যায়। স্বাধীনতা বা মুক্তি
হলো একটি অনুশীলন। কোন নির্দিষ্ট আইন বা প্রতিষ্ঠানই
মানুষের মুক্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারে
না। বড়জোর যেটা করা যেতে পারে, তা হলো, কিছু নির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে আমরা
কিছু বাধা, কিছু নিষেধ আলগা করার বা অতিক্রম করার একটি চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু
পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সম্ভবতঃ একারণেই ‘স্বাধীনতা’কে
নিশ্চিত করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বা আইন তৈরি করা হয়, তারাই ‘স্বাধীনতা’র একদম বিপক্ষে
চলে যায়। এটা এই কারণে নয় যে ঐসব আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট...
আসলে ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটিই হলো একটি সার্বক্ষণিক অনুশীলন কর্ম।
পল রেইনবো:
নাগরিক স্থাপত্যকর্মগুলোর মাঝে কাদের আপনি কিছুটা হলেও স্বাধীনতার ইঙ্গিত প্রকাশে সক্ষম
হয়েছে বলে মনে করেন? এক্ষেত্রে সফল জনা কয়েক স্থপতির কথা বলবেন কি?
মিশেল ফুকো
: হ্যাঁ, কিছুটা হলেও লো কর্ব্যুসিহের নাম করা যেতে পারে... জানি না কেন যে আজকাল তাঁকে
ছদ্ম-স্টালিনিস্ট বলা হয়-- এটা এক ধরনের নিষ্ঠুরতা। যা হোক, আমি নিশ্চিত যে, কর্ব্যুসিহে ছিলেন একজন
আন্তরিক ও দরদী মানুষ, যিনি তাঁর তাবৎ স্থাপত্যকর্মে মুক্তির ব্যঞ্জনাকে ধরতে চেয়েছেন।
কর্ব্যুসিহের এই আত্যন্তিক নিষ্ঠা সত্ত্বেও কিন্তু আমি মনে করি না যে, শেষ পর্যন্ত
কোন বস্তুর গঠনাকৃতিই কখনো স্বাধীনতার রক্ষক
হতে পারে। স্বাধীনতার রক্ষক স্বাধীনতাই।
পল রেইনবো : মোদ্দা কথাটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, একা স্থাপত্য
কোন সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না?
মিশেল ফুকো
: পারে। যখন স্থপতির অন্তর্নিহিত মুক্তির তাগিদ জনতার ‘স্বাধীনতার অনুশীলন’-এর সাথে
খাপ খায়।
পল রেইনবো
: আপনি ডাক্তার, কারারক্ষী, পুরোহিত, বিচারক ও মনস্তত্ববিদদের রাজনৈতিক বিন্যাসের প্রধান
মূর্তি হিসেবে চিহ্নায়িত করেছেন। আপনি কি স্থপতিদেরও এই তালিকায় রাখবেন?
মিশেল ফুকো
: ব্যাপারটা ঠিক ওভাবে নয়। আমি যে ডাক্তার বা উপরোক্ত পেশাবর্গের মানুষদের নাম করলাম--
সেটা ঠিক রাজনৈতিক আধিপত্যের মূর্তিগুলোকে চিহ্নায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে নয়, বস্তুতঃ
আমি ঐ সব শ্রেণীর মানুষদের একারণেই উল্লেখ করেছি, যেহেতু তাদের মাধ্যমেই ক্ষমতা প্রবাহিত
হয় ও ক্ষমতা সম্পর্কের কাঠামোয় তাদের অবস্থান
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্ভিং গফম্যান তাঁর চমৎকার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, একটি মানসিক হাসপাতালে
একজন রোগীর অবস্থান মূলতঃ অত্যন্ত জটিল ক্ষমতা সম্পর্কেরই প্রতিফলন। কিম্বা, ধরা যাক,
একটি খ্রীষ্টীয় বা ক্যাথলিক চার্চে (প্রটেস্ট্যান্ট চার্চে অবশ্য অবস্থাটা ভিন্নতর)
একজন বিশপ ক্ষমতা কাঠামোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। স্থপতিকে এদের সাথে তুলনা
করা যাবে না। হাজার হোক, আমার ওপর স্থপতির কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি যদি আমার ঘরে কোন
পরিবর্তন আনতে চাই, নতুন পার্টিশন লাগানো বা বাড়তি চিমনী ঝোলানো-- স্থপতির কোনই নিয়ন্ত্রণ
নেই।
পল রেইনবো: সম্প্রতি স্থপতিদের মহলেও ‘উত্তরাধুনিকতা’ খুব নজর
কেড়েছে। দর্শনের এলাকাতেও, বিশেষতঃ জাঁ ফ্রঁসোয়া লিওতার এবং জুর্গেন হেবারমাস ‘উত্তরাধুনিকতা’র কথা বলেছেন। স্পষ্টতঃই ঐতিহাসিক
অভিসম্বন্ধ ও ভাষা আধুনিক জ্ঞানতত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ‘উত্তরাধুনিকতা’কে
আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যাখেন/ স্থাপত্য ও দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে ‘উত্তরাধুনিকতা’
যে সব নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে, সে বিষয়ে আপনার অভিমত?
মিশেল ফুকো: কেন জানি না
আমার মনে হয়, চতুষ্পার্শ্বেই একটি ভীষণ সরলীকরণ প্রবণতা বিরাজ করছে... যেমন ধরুন, পুরনো
দিনের সুখ-বিলাসের সস্তা-বন্দনা, অতীত গৌরবের কাল্পনিক রূপকল্প রচনা, যা কোনদিনেই মানুষের
ছিল না। আমার তো ভীষণ হাসি পায় যখন দেখি আধুনিক যুগে যৌনতাকে সম্পূর্ণ ভয়স্কর একটি
ব্যাপার বলে মনে করা হয়। বর্তমানে শুধুমাত্র টেলিভিশন সুইচ অফ্ করে দেওয়ার পর পরই কেউ
শয্যায় যাবার কথা চিন্তা করতে পারে। তাও আবার গণহারে উৎপাদিত বিছানায়। “সেই গৌরবোজ্জ্বল সময় আজ
আর নেই...”। কি সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়? যখন দিনে আঠারো ঘন্টা মানুষকে কাজ করতে হতো ও
পরিবারের ছ’জন সদস্য ঠাসাঠাসি করে এক বিছানায় ঘুমোত? বর্তমান বা সামান্য আগে পার করে দেয়া অতীত সম্পর্কে ঘৃণার যে ভয়াবহ ফলাফল,
তা’ হলো, সম্পূর্ণ পৌরাণিক এক অতীত সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, হেবারমাস কর্তৃক উত্থাপিত
সেই সমস্যার কথাটি ভাবুন। যদি কেউ কান্ট কিম্বা
ওয়েবারের কাজকে পরিত্যাগ করে, তবে সে অযৌক্তিকতার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে।
হেবামাসের এ বক্তব্যের সাথে একমত হবার পরেও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। আমার মতে, সেটা
হলো, অষ্টাদশ শতকের শুরু হতেই দর্শন ও সমালোচনামূলক
চিন্তার মুখ্য প্রতিপাদ্য হচ্ছে, কী এই যুক্তি যা আমরা এত ব্যবহার করি? এর ঐতিহাসিক
প্রভাবগুলোই বা কী? কী এর সীমাবদ্ধতা? যুক্তির
বিপজ্জনক দিকগুলোই বা কোথায়? আমাদের ভুলে গেলে
চলবে না যে সামাজিক ডারউইনীয় মতবাদের বর্ণাঢ্য যৌক্তিকতার উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে
বর্ণবাদ, যা নাজিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অভেদ্য উাদাহরণসমূহের অন্যতম।
পল রেইনবো:
সে সব যাক্। যুক্তি ও ইতিহাসের মধ্যে যে সরল বিরোধীতা, তার মধ্যে যে কোন একটির পক্ষ
অবলম্বন করতে বলা হলে...
মিশেল ফুকো
: হ্যাঁ। ধরুন, হেবারমাসের সমস্যাটা হলো, ইতিহাস কেন্দ্রিকতার বিপক্ষে তাঁকে এক দুর্জ্ঞেয়
চিন্তা নির্মাণ করতে হয়। আমি তাঁর তুলনায় অনেকগুণ
বেশি একজন ইতিহাসবাদী ও নীৎশেবাদী। প্রকৃতপক্ষে,
ইতিহাসের যথাযথ ব্যবহার কোথাও হয় নি, হয়নি আন্তঃঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সঠিক ব্যবহার।
অথচ, এ আন্তঃঐতিহাসিক বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি
অত্যন্ত স্বচ্ছ ও ‘অতীতে ফিরে যাওয়া’ নীতির
প্রবল বিরোধী। ইউরোপের কৃষক স্থাপত্যের একটি নিবিড় পাঠই আমাদের বলে দেবে যে শুকনো খড়
ছাওয়া ছোট ঘরগুলো আদৌ খুব সুখের কোন বস্তু নয়। ইতিহাস আমাদের ইতিহাসবাদের হাত হতে রক্ষা
করে-- সেই ভয়াবহ ইতিহাসবাদের হাত, যা কিনা বর্তমানের সমস্যা মেটাতে অতীতমুখীনতার প্রশ্রয়
দেয়।
পল রেইনবো: আপনার পরবর্তী গ্রন্থে দু’টোর অধীতব্য বিষয় সম্ভবতঃ
গ্রীক ও আদি খ্রীষ্টানদের মাঝে যৌনতা সম্পর্কিত? এ বিষয়ক কোন স্থাপত্য নিদর্শনের কথা
যদি আলোচনা করতেন?
মিশেল ফুকো
: রোমক সাম্রাজ্যে গণিকালয়, প্রমোদগৃহ, অপরাধ
এলাকা ইত্যাদির পাশাপাশি এক ধরনের আধা ঘন-প্রমোদালয়
ছিল, থার্মেস। এই থার্মেস (Public Bathroom) ছিল প্রমোদ ও পারস্পরিক সাক্ষাতের অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যা ধীরে ধীরে ইউরোপের বুক হতে মুছে গেল। মধ্যযুগে এই থার্মেস
যেমন ছিল পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক সাক্ষাতের এলাকা, তেমনি সেখানে পুরুষের সাথে
পুরুষের ও নারীর সাথে নারীর মিলন বা সাক্ষাতও
কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যদিও নারী-নারী বা পুরুষ এ সম্পর্কের ব্যাপারে খুব কমই উল্লেখ
করা হয়ে থাকে। এ ত্রিবিধ সম্পর্কের মাঝে যে সম্পর্কটি সবচেয়ে বেশি নিন্দা হিসেবে গণ্য
হতো এবং যার চর্চা ছিল স্বভাবতঃ সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ থার্মেস (Public Bathroom)-এ নর-নারীর
প্রকাশ্য সম্পর্ক-- ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের সময় হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পল রেইনবো: কিন্তু আরব বিশ্বে থার্মেস (Public Bathroom / Hammam
Khana)-এর এই সংস্কৃতি আজো আছে!
মিশেল ফুকো
: হ্যাঁ, কিন্তু ফ্রান্সে এটা একদমই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অবশ্য
এ ব্যাপারটির অস্তিত্ব ছিল। ‘লেজফোঁ দু পাহি’ (The Children of Paris) ভাস্কর্যে কিন্তু
এ ব্যাপারটি খুঁজে পাবেন। এই ভাস্কর্যটির অন্যতম চরিত্র, লাসিনেইহ ছিল একটি শুয়োর বিশেষ,
বেশ্যার দালাল, যে কিনা বয়স্ক পুরুষদের আকর্ষণ করার জন্য বালকদের ব্যবহার করত এবং তাদের
ব্লাকমেইল করত। এরকম একটি দৃশ্যও সেখানে আছে।
বস্তুতঃ সুরিয়ালিস্টদের প্রচন্ড সারল্য ও সমকাম বিরোধিতার মাধ্যমে এসব ব্যাপারের বিরুদ্ধে
লড়তে হয়েছিল। যে কথা বলছিলাম। তখনকার সময়ে Public Bathroom / হাম্মামখানাগুলো যৌনসাক্ষাতের
এলাকা হয়ে উঠেছিল। এই হাম্মামখানাগুলো ছিল যেন অনেকটা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আনন্দের গির্জার মত, যেখানে মানুষজন ইচ্ছাখুশী
মাফিক যেত, হাঁটত, একজন আর একজনকে বেছে নিত, দেখা সাক্ষাত করত, আনন্দ করত, খেতো বা
পান করত, আলাপ আলোচনা করত...
পল রেইনবো: অর্থাৎ যৌনতা তখন অন্যান্য প্রমোদের থেকে পৃথক করা
হতো না। নগরগুলোর প্রাণকেন্দ্রেই তারা স্থাপিত ছিল। এগুলো ছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি
ও একটি বা উদ্দেশ্য ছিল তাদের...
মিশেল ফুকো :
ঠিক। গ্রীক ও রোমানদের কাছে যৌনতা অবশ্যই একটি সামাজিক প্রমোদ হিসেবে গণ্য হতো। পুরুষ
সমকামীতার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে বিষয়টি বেশ কৌতুকোপদ্দীপক, মেয়েদের সমকামীতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা
অনেকটা একইরম - সেটা হচ্ছে প্রায়ই নর-নর ও
নারী-নারীর মধ্যকার যৌন সম্পর্কটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে আমাদের চোখে প্রতিভাত হয়
এবং সামাজিক সম্পর্কগুলো যৌনসম্পর্ক হিসেবে অনুমান করা হয়। গ্রীক ও রোমানদের অভ্যাস
ছিল মূলতঃ যৌন সম্পর্ককে সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপকতম অর্থে প্রতিষ্ঠা করা। হাম্মামখানাগুলো
ছিল সামাজিকতার একটি বিশাল কেন্দ্র যা যৌন সম্পর্ককে অন্তর্ভূক্ত করত। বস্তুত: হাম্মামখানা
ও গণিকালয়ের মাঝে চমৎকার প্রতিতুলনা করা যেতে পারে। সত্যি বলতে, গণিকালয় হলো একটি স্থান,
স্থাপত্যকর্ম ও আনন্দের জায়গা। অ্যালেইন কার্বন তার ‘লে ফিলস দু নোচেস (নোচেসের যুবকেরা)’-এ
সামাজিকতার এই বিশেষ দিকটি সম্পর্কে আমাদের
চমৎকার অবহিত করেছেন। নগরীর পুরুষেরা গণিকালয়ে পরস্পর সাক্ষাৎ করতো। তাদের মধ্যের পারস্পরিক
বন্ধন তৈরী হতো। বন্ধনটা কিসের ভিত্তিতে? হ্যাঁ, একই নারীরা তাদের প্রত্যেকের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে, একই ব্যাধি ও সংক্রমণে তারা
সংক্রমিত হয়েছে। এই যে গণিকালয়ের সামাজিকতা, এটি কিন্তু প্রাচীন যুগের থার্মেস (Public
Bathroom) সামাজিকতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিষয়।
পল রেইনবো:
নিয়মতান্ত্রিক স্থাপত্য বিষয়ে বর্তমানদিনে
অনেক তথ্যই আমাদের কম-বেশি জানা হয়ে গেছে। কিন্তু, স্বীকারোক্তিমূলক স্থাপত্য বিষয়ে
আপনার অভিমত, যে জাতীয় স্থাপত্যের স্বীকারোক্তিমূলক প্রযুক্তিকৌশল ব্যবহৃত হয়?
মিশেল ফুকো :
অর্থাৎ ধর্মীয় স্থাপত্য? এগুলোর প্রধান সমস্যা হলো তারা বড্ড শেনোফেবিয়াগ্রস্থ। জীবনকে কেন্দ্র করে কিছু সংক্ষিপ্ত
নিয়ম-কানুন যে কেউ ওখানে খুঁজে পাবেন। ঘুম, আহার, প্রার্থনা, মঠের কোন সেলে বা কুঠুরীতে
কে থাকবে এমত প্রতিটি বিষয়েই বিধিবদ্ধ নীতিমালা খুঁজে পাওয়া যাবে। সবকিছুই একদম শুরু
থেকে পরিকল্পনা করা।
পল রেইনবো:
শক্তি বা ক্ষতার যে প্রযুক্তি, যেখানে নিয়মাবদ্ধতা
ও স্বীকারোক্তি মুখোমুখি, সেখানে স্থান একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে।
মিশেল ফুকো:
হ্যাঁ, যুথবদ্ধ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থান
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার অনুশীলন এমন একটি ব্যাপার, যেখানে স্থান অত্যন্ত মৌলিক
ভূমিকাসম্পন্ন। ১৯৬৬ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ছে, স্থপতিদের একটি গ্রুপ আমাকে স্থান-এর
ওপর একটি পঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমাদের পঠনের শেষ পর্যায়ে একজন জাতীয় মনস্তত্ববিদ
আমার ওপর রীতিমতো কামান দাগা শুরু করলেন। ‘স্থান’ হলো প্রতিক্রিয়াশীল ও পুঁজিবাদী ধারণা,
পাশাপাশি ‘ইতিহাস’ ও ‘হয়ে ওঠা’টা হলো বৈপ্লবিক।
ঐ সময়ে অবশ্য এমন একটি ডিস্কোর্স খুব অস্বাভাবিক
কিছু ছিল না। আজকাল এমন কথা বলা হলে যে কেউ হাসিতে ফেটে পড়বে।
পল রেইনবো:
স্থপতিগণ, যখনি তারা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ইমারতের
নির্মাণ কৌশলকে বিশ্লেষণ করতে চান, যেমন একটি হাসপাতাল কিম্বা স্কুল, প্রাথমিকভাবে
সবসময়ই প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন। হাজার হোক, ওটাই তাদের ডিজাইন।
অথচ আপনার আগ্রহটা যেন স্থান বা ব্যপদেশের (Space) ওপরই বেশি, অন্ততঃ স্থাপত্যের চেয়ে।
ইমারত (Building) ও ব্যপদেশ বা স্থান সম্পর্কিত এ দু’টো দৃষ্টিভঙ্গীর ভিন্নতা আপনি
কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মিশেল ফুকো :
আসলে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর মাঝে তফাৎ আছে। সত্যি বলতে, স্থাপত্য আমার কাছে সহায়ক একটি
উপাদান মাত্র, যা একটি নির্দিষ্ট জায়গার ভেতরে কিছু মানুষের মাথা গোঁজার ঠাই অন্তত:
করে দেয়, তাদের চলনের প্রণালীবদ্ধকরণ সম্পন্ন
করে। একইভাবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিধিবদ্ধকরণেও নিষ্পন্নীকৃত করা হয়ে থাকে।
সুতরাং একে শুধু স্থানের কোন উপকরণ হিসেবে ভাবলে ভুল করা হবে। স্থান তো তা-ই যাকে সামাজিক
উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আমি একজন ঐতিহাসিককে চিনি যিনি মধ্যযুগের প্রত্মতত্বের এলাকায়
চমৎকার কিছু বিশ্লেষণাত্মক কাজ করেছেন। এ কাজে তিনি স্থাপত্যের সমস্যা, যেমন মধ্যযুগে বাসগৃহগুলোর অবস্থান তুলে
ধরেছেন। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ধরা যাক, চিমনী নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। ধরা যাক,
তিনি সেই বিশেষ মুহূর্তটি আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন, যখন প্রথমবারের মত ঘরের
ভেতর চিমনী স্থাপন সম্ভব হলো, আগের মতো খোলাঘর বা ঘরের বাইরে কোন চিমনী নয় সেই বিশেষ
মুহূর্তটিতে পূর্বের সব বিষয় বদলে গেল এবং আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্কগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন মানুষ ঘরের ভেতর চিমনী লাগানোর জন্য এত অস্থির হয়েছিল? আমরা
দেখতে পাই যে, প্রযুক্তির ইতিহাসে বছরের পর বছর এমনকি একটি গোটা শতাব্দী খরচ হয়ে যেতে
পারে শুধুমাত্র উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর যথাযথ প্রয়োগের জন্য। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, নব নব প্রযুক্তি সবসময়ই
নতুন মানব সম্পর্কের গঠনে আঙ্গিকগত ভূমিকা রেখেছে, পাশাপাশি এ-ও সত্য, প্রযুক্তির বদল
কখনোই সম্ভব হতো না, যদি মানবীয় সম্পর্কের
যথাযথ ক্রিয়া ও করণকৌশল বিকাশ লাভ না করতো।
যা গুরুত্বপূর্ণ তা’ হলো আন্তঃসম্পর্ক। একের ওপর অন্যের অর্থহীন প্রভূত্ব নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন