পাগলা গারদ থেকে
(১)
রাত এলেই আমার এই পাগলা গারদ থেকে ছিটকে পালিয়ে
যেতে ইচ্ছে করে। অন্ধকার হলে মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ঘুরি। সেই প্রাইমারী স্কুল।
মায়া দিদিমণির রোলকল। বকুলবীজ কুড়িয়ে বাঁশি বানাই। টিফিনবেলা ববিতার বুকে হাত দিয়ে
বলি, তুই বড় হয়ে আমায় ভালোবাসবি তো? কী অদ্ভুত সমতল ওর বুক তখন! আমাকে ছোট রেকাবিতে পাতার পরোটা দেয়। খেয়ে উঠে
বাজারে যেতে বলে। টেপ জামা সরিয়ে খুকুকে চেপে ধরলে তবে ওর কান্না থামে। আমাকে বলে,
অসভ্য! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? নতুন বুঝি! তারপর আমি বাজারে গিয়ে সব ফরমায়েশ হারিয়ে ফেলি। ভুলে যাই বাড়ি ফেরার পথ।
অথচ ববিতা ভাত রেঁধে আমার জন্য অপেক্ষা করছে তখন। পাগলা গারদে রাতে খাওয়ার ঘন্টা
বেজে ওঠে। স্টিলের থালায় ববিতাই বেড়ে দেয় সাদা ভাত আর ট্যালটেলে মাছের ঝোল। আমি ওর
বয়সী বুকের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ঝোলে ভাত মাখি থালা জুড়ে।
(২)
সেদিন ভোরবেলা হঠাৎই রেণু বৌদিকে দেখলাম। শেষ পাঁচ
বছরে যাকে চোখেও দেখিনি একবার, সে কিনা স্বপ্নে এলো মায় গন্ধটুকু নিয়ে অবিকল।
নিমেষে বর্ধমানের সেই তপ্ত দুপুরগুলো পেড়ে ফেলল তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে। দিব্যি বিলি
কেটে দিলো চুলে। তারপর হ্যাঁচকা টানে মুখ নামিয়ে আনলো রাক্ষুসীর মতো। জর্দার গন্ধ
লেগে ছিলো জিভে। আমার হাতে তখন বর্তুল ঝাঁঝালো পানশালা। কৌরি পাইনের চেয়েও নিটোল
সুঠাম ছুঁতেই গোপন সংকেতে খুলে গেলো চেতনার ভেজানো দরজা। তীব্র আলো ও আনন্দের
বাধাহীন স্রোত নিয়ে চোখ খুললাম পাগলা গারদের বিছানায়। সারা শরীরে তখনও জর্দার
তীব্র গন্ধ। শার্সির গায়ে লেপ্টে আছে শেষ রাতের আলগা অন্ধকার আর ফোঁটা ফোঁটা ঘাম।
(৩)
আজকাল পাগলামিটা গেড়ে বসার আগে থেকেই বেশ বুঝতে
পারি। ঘাড়ের কাছে একটা গরম ভাব ক্রমশ বাড়ে। চারপাশের মানুষগুলো কেমন অস্বচ্ছ হয়ে
আসে। উঁচু পাঁচিলের ওপারে দোতলা বাড়ির ছাদে নাইটি মেলতে আসা ববিতাকে চিনতে ভুল হয়
না। সেই মুখের ছাঁদ। ভিজে চুল।
জলে নয় ঘামে। আমার সারা শরীর নেতিয়ে কেঁচোর মতো হয়ে যায়। নিজের মুখে নিজেরই থুতু
ছেটাতে ইচ্ছে করে। ববিতার চোখ থেকে টপ টপ করে জলের বদলে ঘৃণা উপচে পড়ে। ও আমার বুকে কিল মারে বারবার। দাঁতে দাঁত ঘষে
বলে, তাহলে আসিস কেন? এটুকু রাখতে পারিস না যখন!
(৪)
তোমার খয়েরি ছিঁড়ে যেদিন সাদা ফোঁটা আনতে পারব
আমি, সেদিন সুখ আসবে অবিকল। হাত দেখে একথাই বলেছিলো অচেনা সন্ন্যাসী। তোমাকে বলিনি
তা কোনোদিন, ভুলেও বলিনি তবু ভুলিনি কিছুতেই। ভুলিনি বলেই আজও তোমার কোটরে গেলে
শুধু ক্ষুধার্ত ডিমের মৃদু কান্নার জলে ভেজে আমার সানাই। রাধা চায় ধারাস্নান, তবু
বাঁশি ফেলে রেখে বারবার ডুবে মরে বেহায়া কানাই।
(৫)
তোমাকে কিছু দিতে পারিনি আমি ববিতা। কিচ্ছু না।
আসলে ভালোবাসাও শুকিয়ে গেছে দেবার আগেই! তুমি প্রশ্রয় দিয়েছো, অপেক্ষা করেছো। শুধু
আয়ু ক্ষয়ে গেছে। নরম সরম সেই জীবনের খোঁজ পাওয়া হয় নি কোনোদিন। বাজার ঘেঁটে কুড়িয়ে
এনেছি বালি ও কাঁকড় শুধু। তবু তুমি ভালোবেসে খুঁজেছ পুষ্পবীজ। সময় বয়ে গেছে।
ফুরিয়েছে নুড়ি ও পাথরের লুকোনো সঞ্চয়। ভালোবাসা ক্ষয়ে ক্ষয়ে রয়ে গেছে ঘৃণার দোকান।
বয়ামে বয়াম ভরে সাজিয়ে রেখেছো সব মৃত জাদুঘরে। আজ তাই, মরণে সুখ নেই তোমার ক্ষরণে
সুখ নেই। আমিও ক্লান্ত তবু লিখছি তোমার কথা থুতু ও বীর্যে আর এঁকেছি তোমার ছবি
প্রস্রাবে, চোখ ভেজা জলে। ইদানিং ঝাঁঝালো গন্ধ বেশ চরে খায়, গরম ঘিলুকে মাখে পরম
ভাতের সাথে আমাদের আদরের ঘৃণা আস্তাবলে।
(৬)
এসো ববিতা, নিজেকে জ্বালাই শেষবার। কাঠকুটো
যা আছে সংগ্রহে, জড়ো করি হাতে হাতে।
জোনাকি ও জানে, তাই সব পুঁজি ফুৎকারে আলো
জ্বালে। গৃহস্থের ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় অন্ধকার রাতে।
তুমি ফের সাজো বিড়ালিনী, আমি হব বাদামী শিয়াল
আমার ঘাড়ের লোমে মুছে নেবে আঁশটে গন্ধ যত
জমিয়েছ শরীরে, থাবায়।
আমারও পাপ সব ধুয়ে দিও, ঘামে ও আঁচলে
ধোঁয়া মরে আঙরা লাল হলে উনুনে ফুটিয়ে নেবো
ফুল নয়, রাতের খাবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন