ডোরালীন
চিতাবাঘ ও চিত্রমর্মর শহর
শহরটা পড়ে আছে ডোরানো চিতাবাঘের মোহবীজ ছড়িয়ে। উপত্যকাময়
গোধূলি নামছে। আস্তে ধীরে। কাঁটাওলা ম্যাপবই
পারাপারের ল্যাটিচিউট বেয়ে উঠে যায় পুরোনো ক্যাথিড্রালের প্রকাশ্য ক্রুশের ফাঁকে।
আমি মেরুসংক্রান্ত চুম্বকরেখার গায়ে প্রাচীন সেমিকোলন লাগাই; একটু উত্তাপের জন্য
দীর্ঘশ্বাস। গির্জাফেরত বার্ধক্যের আলগা হয়ে আসা রোমকূপে হলুদ জীবাশ্ম। ব্যাকরণহীন
পড়ে থাকে মেরুকরণের নগ্ন হাওয়া। হাইওয়ে জুড়ে সমর্পণের ভঙ্গি। সমস্ত যাত্রা থেকে
ছুটি নেওয়া বিশ্বাসী মানুষেরা গির্জার দেয়ালেতে রেখে আসে প্রাচীন প্রশ্রয়;
সন্ধ্যানামানো চোখের নিয়মমাফিক নুনছাপ। দীর্ঘ তুষারপাতের সেই পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে
হেঁটে যাই ভোরবেলার নতুন বরফগন্ধী ঈশ্বরের দিকে। প্রজন্মের প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে
উঠে যায় নভেম্বরের পপলার সকাল।
ক্যানভাসের বর্ণময় প্রেক্ষাপট মাত্রা খোঁজেনি কখনও। কিউবিস্ট রোদ্দুর যেদিন
রেখালীন দ্বীপান্তর ডেকেছিল, পশ্চাৎপটের অসবর্ণ যোনিপথে প্রবেশিকাপত্র রাখল
বস্তুতান্ত্রিক সমতল। ফলত ত্রিমাত্রিক অবকাশ
-অবাধ
-ইষৎগভীর
-রহস্যময়
রং থেকে এবার দৃশ্যে ফিরব। ওই দেখো আমাদের উড়াল পর্বত। আদিগন্ত পাথরের ভাঁজে হিমাঙ্গনা বুটিক বিছিয়েছে।
পরদেশি ঋতু। উদাত্ত পপলার সুর। আহা নগ্ননির্জন সেই নিসর্গ!
তাতে কবির কী?
নিসর্গ পরিধির পায়ে নজরানা দেয় না
অনিশ্চিত সিঁড়িঘরের স্বতন্ত্র অক্ষর
কোহেরেন্ট গভীরতা বিনির্মাণ ডাকলেই দৃশ্যে ভাঙচুর, পেনসিলে
জলোচ্ছ্বাস। খোদাই করছে পরিযায়ী ভোরের প্রাথমিক সমীকরণগুলো। ইন্দ্রিয়ঘেঁষা
দৃশ্যাবলির সমান্তরাল রমণে ছেদরেখা টেনে ময়ূর বসছে। ফলতঃ অগোছালো পরিসর
-আপাত এলোমেলো
-কৌণিকরহস্য
-জ্যামিতিভোর
তো সেই নিসর্গে রয়েছে সোরিয়া – এস্পানিয়া দেশের এক ছোট্ট শহর। শহর বলবো না পুরাতাত্ত্বিক ডেরা? যে ডেরায় বসত
করে ডোরানো ওই চিতাবাঘ। আসলে চিতা কোনো বিষয় নয়, এক চিত্রমর্মর নিসর্গ; যেখানে
বসানো হল লা দেসা পার্ক। অনেক উঁচু থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক চিতাবাঘ হলুদ আলো
গিলতে গিলতে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পেটের ভেতর থেকে ওগরানো রোশনাই ছড়িয়ে
পড়ছে সাদা পাতায় কালো ডোরায়। আর সেই ডোরার ক্ষতস্থান খুলে বেরিয়ে পড়ছে নীলচে ভাষার
কঙ্কাল। কঙ্কালের হাত পা মায় সমস্ত শরীরটাই খুলে রাখি মাথা থেকে। চোখের সামনে কেবল
ঝুলে থাকে অক্ষিকোটর। সেখানে চোখ বসাই। চোখের সঙ্গে দৃষ্টিতন্ত্রের যোগসাজস
নিতান্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বমাত্র। অগ্রাহ্য করি। কারণ তত্ত্বের সঙ্গে প্রাণকৃষ্ণের
যতটা যোগচিহ্ন ঠিক ততটাই বিয়োগচিহ্ন মনরাধার। তো সেই রানাদেওয়ারাধার সঙ্গে অঙ্ক
কষাকষিতে ছেদ টানলে, দেরিতে ওঠা রোদ বিভঙ্গ দিচ্ছে যে শহরে তার পাথুরে উপত্যকার
ঢালে পড়ে থাকে অক্ষরবিহীন কিছু ছেদ যতি চিহ্ন – যার নাম দেওয়া গেল চেতনা। তো সেই ভাষা থেকে কঙ্কাল থেকে চোখ থেকে চেতনার ঘর
পর্যন্ত হেঁটে এসে দেখছি –
কতদিন হেঁটেছি শ্যাওলামাখা ভিজে ভিজে এলাকা
স্বাদে নুন সুর, গা বেয়ে নামা লালচে পাথুরে দৃষ্টিপথ।
মুহূর্তে উন্মুক্ত হয়ে গেছে সামনে দীর্ঘ মালভূমি, নাভি।
যোনিমুখ ঘেঁষে ওঠা জিভের শরীরে গমক্ষেত, সদ্য কেটে নেওয়া
ফসলের
গা দিয়ে চলে যাওয়া নভেম্বরের পপলার সকাল। [চিতাবাঘ
শহর -১১]
শুনেছি পপলার এক গাছের নাম। কেমন এই পপলার গাছ? দেখিনি
কখনও। দৃষ্টিতন্ত্রের অবিশ্বাসগুলো কথা কয়ে ওঠে – জীবনভোর শুধু সন্ধিবিচ্ছেদ করে গেলি; এবারে দুচারটে সন্ধিযোগ কর –
নাভি
মালভূমি
লাল সবুজ উপত্যকা
সদ্যকাটা ফসলের উদ্যাপন
টিলার ওপর হলুদ দূর্গের প্রতিরোধ
যোনিমুখ ঘেঁষে ওঠা জিভের শরীরে গমক্ষেত
তো এভাবেই জুড়তে জুড়তে হাতের পাতায় উঠে আসছে নভেম্বরের মসৃণ
সকাল। আর সেই সকালের পাশে আকারে প্রকারে ইঙ্গিতে পপলার বন্দিশ।
দৃশ্য মাত্রই দ্বিমাত্রিক, যদি চিত্রকর ক্যানভাস গড়ে। দৃশ্য
মাত্রই ত্রিমাত্রিক, যদি নিসর্গ বুনে রাখে ক্যানভাস। কিন্তু কবির তাতে কী? দৃষ্টির
সীমানা ঘেঁষে এই যে দিগন্তবিস্তারে নেমেছে দৃশ্যেরা, তারা কেউ নিজের ক্ষণে নেই
খানে নেই। তো এই অবস্থান সম্পর্কিত দোটানাগুলোর সামনে বসিয়ে দিই এক আদিগন্ত আয়না।
পাথুরে অসমতল পারদপ্রলেপ। ফলে মসৃণতা পাচ্ছে না দৃশ্যাবলি। ভাঙনধরা নদীপাড়ের মত
বিশৃঙ্খল, উঁচুনিচু ব্যাকরণহীনতা। দৃশ্যমুখগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছে একা থাকার পিঠের
মত। ভাঙা ভাঙা মুখগুলোর ভেতর লাফিয়ে
উঠছে আর এক মুখ। এক বৃত্ত থেকে আর এক বৃত্ত; যতিচিহ্নহীন বুদবুদ জুড়ে জুড়ে উঠে
আসছে এক নিঃসঙ্গবোধ। আর সেই বোধের ভেতর পা ছড়ানো অবোধ মেতেছে ছিনিমিনি খেলায় –
মেরুদন্ডের ধূসর আলোয় নমনীয় ঘামের রেখা বরাবর
তৈরি হয় গোপন হিংস্রতার নতুন ক্যালেন্ডার
শরীর জুড়ে যে রেখার উপত্যকা তার দুপাশের পাহাড়ে
কোনো সূর্যোদয় রাখা নেই
কেবল মোমবাতির শিখায় উজ্জ্বল ভোঁতা টিলার শীর্ষ
আমি দাঁত বসাই [চিতাবাঘ
শহর -১৫]
গণের চোখ থেকে নেমে আসা জন, তন্ত্র সন্ধান করলেই সমকোণী
বার্তা দেখি; অতিভুজ বেয়ে কেমন সুসম বৃত্ত! জ্যামিতির টান টোন মিলিয়ে মিলিয়ে একটা
ভোর বুনি। অথচ ভোরের কোনো জ্যা-বোধ দেখিনি কখনও; কমলালেবুর কোয়াছাড়ানো আলো যেমন
দিক মানে না, দিগভ্রমও অস্বীকার করে। দু মাত্রায় আঁকা ভোরের পাতা থেকে ঝরে যায়
মিতি ও তার নির্ধারণ। আর আমার কড়িকাঠগোণার আজন্ম অভ্যেসগুলো হাতের নাগালে লটরপটর
করলে ফন্দি ও ফিকির দুটোকেই সাজিয়ে তুলি, স্ব এর একটু তফাতে; স্বতন্ত্রবার্তায়।
বার্তামগ্ন দোটানাগুলো যাবকিযাবনা নৌকোয় পা রাখে। অনন্ত এই চলাচলে অচল হয়ে পড়ে
থাকে সমস্ত গণকযন্ত্র। আর এস্পানিয়ার নুমান্সিয়া জনপদের আত্মহত্যা ঝুলে থাকে নিথর
কমার রোমান আর্চে। যুদ্ধতন্ত্রের গোপন আঙুলে তখন শোষণশ্যালকের বাজপাখিপ্রেম। তো এই
সব বস্তুতান্ত্রিক সমতলগুলো যখন বিনির্মাণ ডাকছে, আমি অগোছালো হয়ে উঠি কবির গোছোনো
পরিসরে। বস্তুর ফাঁদ কৌণিকরহস্যের অন্তরাল থেকে হাতছানি দিলে কবির কম্পোজিশানগুলো
ভাঙি, আবার জুড়ি, জুড়ি আবার ভাঙি। পাথর মৃত্যু গির্জা – এদের প্রত্যেকটা জানলায় হাত পাতলেই কুয়াশা কুয়াশা; রহস্যময়তার ধার ঘেঁষে
অপেক্ষা করে আছে দারুমর্মর কারুকাজ -
(১) পাথুরে হিসেব – মেলাতে পারলে নিলামবালা ছআনা। না মেলাতে পারলে পাথরের দুপ্রান্ত থেকে উঠে আসা
নিলামের নিয়ম চেলে চেলে নয়নাভিরাম হবে বালা –
$$ à সুর
আর পাথুরে বাতাস মিলে তৈরি করে চলেছে এক আশ্চর্য আয়না ঘেরা একমুখো পথ। পাথুরে
বীজের গায়ে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলা নামিয়ে আনছি বাক্যে। না হওয়া কবিতাগুলো আমাদের
চালাকি নিয়ে পালিয়েছে নীলচে খাদের ভেতর। নদীসাপে চকিতে গড়ালো পাথর ওই উঁচু টিলা
থেকে। তারপর স্তব্ধতা। শ্যাওলামাখা ভিজে ভিজে এলাকা। স্বাদে নুন সুর; গা বেয়ে নামা
লালচে পাথুরে দৃষ্টিপথ। সারা গায়ে স্পর্শ বলতে পাহাড়ি মস। ঠান্ডায় হাত রাখলে উঠে
আসবে গন্ধ, পাথুরে বিশ্বাস। একদিন পড়ে ফেলা যাবে ভেবে পাথুরে দেয়ালে,
স্যাঁতস্যাঁতে ছবি করে খোদাই করছি সবকিছু। পাথরের ধূসর পৃথিবী একবেলা মুক্ত রাখলে
আরো কাছে ডেকে উঠবে টুনিটুনির সবুজ উত্তাপ ß $$
তো সেই তাপ উত্তাপ কমতে কমতে একদিন সমুদ্র। উচ্ছল চলাচল
ঘেঁষে পা রাখল পৃথিবীর প্রথম মাতৃভাষা। তারপর অনাদি অনন্তকাল অন্ধকারমুখী
যন্ত্রণাগুলো নুন জড়ো করে করে নিজেকে বদলে ফেলল পাথরে; পৃথিবীর দ্বিতীয় ভাষা। কী
আছে এই দ্বিতীয় ভাষায়? একপৃথিবী পাথুরে দেয়াল। দেয়ালের পরতে পরতে জমে উঠছে
ক্যামোফ্লাজে রাখা কবির ভাবনাগুলো। বিশাল এক পার্বত্যপ্রবাহের মত অনন্ত এই
সংসারপথ। পথের একপাশে ক্রমশঃ ব্যক্ত হচ্ছে রূপমগ্ন প্রকৃতি আর অন্যপাশে অব্যক্ত
পুরুষ। আর এই ব্যক্ত থেকে অব্যক্তে অনায়াস যাতায়াতগুলো লুকিয়ে পড়ছে পাথরের ভাঁজে
ভাঁজে। হাত রাখি ঠান্ডা পাথরে। আঙুলে উঠে আসে পাথুরে বিশ্বাস। ঘষে ঘষে ভাঁজগুলো
সিধে করি। আঙুলে উঠে আসে উত্তাপ।
তাপেরও একশ আটটা নাম। ওই যে দীর্ঘ তুষারপাতের রাস্তায় হেঁটে
আসা চৌরাস্তার বাজনদার, তার অর্ধনমিত আকোর্দেওনে গলে পড়ে উজ্জ্বল সবুজ মোম – তাপ দেয় শীতে কুঁকড়ে আসা আমাদের পাঁজরের ভাঁজে। না লিখতে
পারা পাতাগুলোর গায়ে যে মেঘলা ফুটেছে তারও নরম তাপে ভিজে যায় আঙুলের প্রান্ত।
অন্ধকারের গায়ে সেই আঙুল বোলালে উঠে আসে যন্ত্রণার তাপ; তাপদগ্ধ অক্ষরসমূহ।
অক্ষরের ইশারাপাখি ক্রমাগত উড়ছে। শীতে ঢাকা চলাচলে ওড়ার উষ্ণতাগুলো তৈরি করছে
শব্দের আঁকাবাঁকা রাস্তা। যেখানে মুছে গেছে যন্ত্রণার রঙ, মুছে গেছে দগ্ধতার ছাপ।
শুধু ভরে আছে জ্যোৎস্নালীন পতনশীল পালক। পালকের বহুরৈখিক রহস্যময়তা সার্চলাইট ফেলে
ফেলে যায় নিসর্গে। আর সেই আলোর পিছনে ছায়ার মোড়কে থাকে যাপনের শাশ্বত অন্তর্ঘাতগুলো।
নিটোল বৃত্তের পরিসীমা ভেঙে ভেঙে উঠে আসে শাহরিক বুদবুদ –
গির্জার সামনে ভিক্ষে চাওয়া
রোমানিয়ার মেয়েটার হাতের তালুতে
বাসা করেছে ক্রিমসন ঋতু
ঠোঁটের সাদায় যতিচিহ্নহীন বাক্যের রুক্ষতা
শূন্য আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো এগিয়েছে বাজার ছাড়িয়ে
যেদিকে জনতা [চিতাবাঘ
শহর -১৬]
(২) মৃত্যুর খতিয়ান – খত দেখে অক্ষরের দোটানা আর দোজখের টানাবোনাগুলো অনন্ত শূন্য পর্যন্ত প্রসারিত
করলে দোহার উঠবে কাশে ও মহাকাশে। সুপারস্ট্রিং এর টেনে রাখা ছড়ে স্পন্দনের রীতি ও
রেওয়াজগুলো চিনে নেবে মৃত্যুচেতনা; সচেতন নিঃসঙ্গতা যার আর এক নাম -
&& à
পুরোনো কবির আত্মহত্যার গল্প মিশিয়ে দিতে থাকি পুকুরটার খুন হওয়ার ঠিক আগেকার
থকথকে জলে। আজ এতদিন পরে সাধারণ বেড়ানোর মধ্যেও আমাদের ভেতর অনিবার্য পতনের গন্ধ
খেলা করে। সেই অতিদূর সময়ে যখন গোটা গ্রাম আত্মহত্যায়। আরও একটু দূরে একটা মেয়ে
একা, একটা গাঢ় কালচে এল্ম গাছের কান্ডে হাত বোলাতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলবে
একঝাঁক মৃত সাদা মথ।, তার পাশে একটা ছুরি গিঁথে আছে। কবে যে পড়ে গেছি আমি প্রাচীন
ভাস্করের অন্তগর্তে; মৃত সন্তান প্রসব করেছে সঙ্গিনী – রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার ধাতব যোনি। বাক্যের মৃত্যু – ছেদ চিহ্ন গুঁড়ো গুঁড়ো ভেসে; অথচ আমাদের স্যানাটোরিয়ামের স্বপ্ন ছিল উদাত্ত
পপলার বনে; কবি, মৃত্যু, হাঁটুতে মুখ গুঁজে থাকা লাইনের স্তূপ। মৃত্যুর অব্যবহিত
আগেও টের পাই আমার হাতে জড়িয়ে রয়েছে অক্ষর আর মৃত্যুও তারই সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে
আছে নিশ্ছিদ্র পাথরে ß &&
অলীক সংকেতে গাঁথা মৃত্যু, যাপনের শব্দ খুঁটে খুঁটে হাঁটে
অনিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে জীবনের মোড়কে তুলে রাখে দুঃখ। আর অনিশ্চিতের সম্ভাবনাগুলো
দৈনন্দিন পাখির ডানায় মুখ গুঁজে সুখ খোঁজে। সুখ আকার স্তব্ধতা পরস্পরের দেহে আঁচড়
কেটে কেটে পথ হাঁটে। সুখেরও একশ আটটা নাম। আকারের ঊনপঞ্চাশ অভিব্যক্তি। শুধু
উনপাঁজুরে স্তব্ধতা একা, নৈঃশব্দ্য ডাকে নিথর সময়ের বাহুতে। বাহুলগ্ন কাল মুগ্ধবোধ
পাঠ করে অনন্ত চৌরাস্তার চৌষট্টিকলায়। তারই মাঝে কবির ছোট ছোট সময়ের নির্ণয়;
গালিবীয় ঢং; কেন্দ্রীভূত করছে চৌষট্টি ইমেজের শরীরী মুদ্রাগুলো। শব্দের সংকেত
বার্তার ইশারা জন্মাবধি নৈঃশব্দ্য ডাকছে। আহা সেই ডাক! ইশারাসূদূর নক্ষত্রমন্ডলী
থেকে জড়িয়েছে আমাদের নাভিতে। জন্মলগ্ন থেকে বয়ে গেছে শিরায় শিরায়। প্রতিরাতে তারই
গজল শুনি রক্তপ্রবাহে। স্বপ্নপাওয়া শব্দেরা জেগে ওঠে নিভৃত কবির নির্জন চৌকাঠে;
জেগে ওঠে মৃত্যুচেতনা। সেই নৈঃশব্দ্যের ভেতর ধ্রুপদী অঙ্গমার্জনা। মৃত্যুচেতনার
অঙ্গ থেকে ঝরে যায় মৃণ্ময়দেহ। দেহের কিনার ঘেঁষে অগুন্তি গণ্ডির রেখা গড়িয়ে যায়
শূন্যমগ্ন শব্দের দিগন্তে। আঙুলে জড়ানো শব্দেরা নৈঃশব্দ্য ডাকলে খুলে যাচ্ছে
বাক্যের উৎসমুখ। মুখের ভেতর মুখোশের গল্পেরা সমস্ত আত্মহত্যা থেকে খুলে রাখছে
হননের অধ্যায়গুলো। শব্দনির্মিত দৃশ্যের সিমসিম খুলে অ-দৃশ্য হচ্ছে শাশ্বত অ-মৃতের
সুজনসন্ধানে।
(৩) গির্জার গণনগাথা – গথের শৈলী আর গণিতের চোখ থেকে জন্ম নিয়েছে যতগুলো গির্জা, তার দেয়ালে আঙুল
ঠেকালে ভিজে ভিজে লবণাক্ত স্বাদ। নিভে আসা স্বাদকোরকের পুরাতত্ত্ব নুনের হিসেব
জানেনি কখনও। স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা ধরা সময়ের গায়ে পুরোনো প্রাণসংকেত লেখা থাকে
নগ্ননয়নের দীঘল দীর্ঘশ্বাসে –
&& à মাথা
তুললেই আবার গির্জা, প্রকাশ্য ক্রুশটার পাশে কাঠি জমিয়েছে পাখিরা। গির্জাফেরত
বার্ধক্যের সামনে কমা; কাফেতেরিয়ার গায়ে সেমিকোলন; লক্ষ্য রাখছে আমাদের ছড়িয়ে
দেওয়া নিঃশ্বাস। রোগা, মনখারাপের রুমাল পকেটে নিয়ে চলা মানুষদের সঙ্গে দেখা যায়
ঈশ্বরের কথোপকথন হয় চোখের তলায় জমে থাকা কালিতে, সোনালি পাথরের গির্জা থেকে বাইরে
বেরোলে সে দেখতে পায় ধীর একটা মেঘলা বেড়াল গির্জার প্রাচীন অব্যবহৃত অংশের ওপর
থেকে তাকে লক্ষ্য করছে। অক্ষর মানুষের সব অনুভূতি ধরে রাখতে পারে না। তাহলে এইসব
ছোট উড়ানের দৃশ্যগুলো কোথায় যায়? অন্তত কি সামান্য দীর্ঘশ্বাস কিংবা অশ্রু হয়েও
ভাষার দেয়ালে ফুটো করে দিতে পারে? ভাষার ফ্রেস্কোয়? বহুপরে গির্জার দেয়ালের নষ্ট
ছবি উদ্ধার করতে এসে শিল্পীরা যাকে নুনের ছাপ বলে চিহ্নিত করবেন ß &&
অনন্ত সময়ের পিঠে ঝোলানো ঝাঁপি থেকে দুচারটে চাপানউতোর –
- মণিবন্ধে রাখা সময়ের গিঁট যাদের আলগা হয়ে এলো তাদের
দীর্ঘশ্বাসে কতখানি নুন জমে ওঠে?
- মনখারাপের বকুলতলায় আদুরে গোধূলি যাদের কেবল অন্ধকারের
আগমনি শোনাচ্ছে, তাদের চোখের নোনা বার্তারা কতখানি ফুটো করতে পারে ভাষার
ফ্রেস্কোয়?
এ সব প্রশ্ন ঝরিয়ে দেয় আদমশুমারির পিছনের ঝুরঝুরে পাতাগুলো।
ঝরাপাতায় মুখ রেখে বসা মানুষগুলো স্মরণাতুর জানলা খুললেই পুরাণসম্ভব বৃত্তান্ত
গড়িয়ে যায় বিশ্বাসী মানুষের কথোপকথনে...
পাইনের গায়ে জমে ওঠে সময়ের নিশ্চিত বলিরেখা। রেখার করতলে
উবু হয়ে বসা মানুষেরা খাটো হয়ে আসা দৈর্ঘ্যের গুনাগার দিতে থাকে শ্বাসের দীর্ঘতা
দিয়ে...
গুনাগারপ্রণালী হাতড়ে পাওয়া বার্তারাঃ---
- যাপন সংক্রান্ত মোহপুরাণের পাঠ নেওয়া মানুষেরা হ্যান্ডনোট
লিখে রাখে বয়ঃসন্ধির ফড়িংমগ্ন রাস্তায়
- আগামী অশ্বিনীবার্তা হাতে করে ফেরা মানুষেরা
কস্তুরিগন্ধের দিনে কুড়োনো রোদবার্তা জমা করে অনন্ত শূন্যের জঠরে
পুরোনো পাঁজর ঘেঁষা সময়ের এই বন্ধনীতে মুখ রাখে কবি। কিন্তু
কবি তো কোনো বন্ধন মানতে পারে না। তার নিঃশ্বাস দীর্ঘ হতে থাকে...
বেজে ওঠে মনখারাপের সিন্ধু
সিন্ধুর নিঝুম জলে সারি সারি ঝিনুক
প্রতিটা ঝিনুকের ভেতর আত্মহননে মাতে সার বাঁধা মুক্তোর দল
প্রতিটা হনন থেকে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু
মুক্তোর বুকচোঁয়া জলে গড়ে ওঠে কবিতার শরীর
শরীরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে কবির চেতনঘরের হৃদয়হরণ
ঠিকানা
যে কবিতার পাতা থেকে মোহবীজ খুঁটে খুঁটে এই ফসলের উদ্যাপন
তার পোষাকী পরিচয়:
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম ১৯৭৮, কলকাতা। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। জীববিদ্যায় স্নাতক
ডিগ্রির পর কাজ করেছেন পুরুষ যৌনকর্মী সমীক্ষা থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুবাদক
পর্যন্ত হরেকরকম। পরে পড়াশোনা করেছেন এস্পানিওল ভাষা। সেইসূত্রে পেয়েছেন স্পেনীয়
সরকারের রুই দে ক্লাবিখো বৃত্তি। ২০০৮ সালে স্পেনীয় সরকার ও ফুন্দাসিওন আন্তোনিও
মাচাদো কবিতাবৃত্তি (Beca International
Antonio Machado de Creation Poetica)। যার
ফলস্বরূপ স্পেনীয় রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে লেখা হয়েছে কবিতার বই চিতাবাঘ শহর (কৌরব, ২০০৯), পরে
প্রকাশিত হয়েছে এই বইয়ের এস্পানিওল তর্জমা La Ciudad Leopardo (Olifante, 2010)। প্রকাশিত
কাব্যগ্রন্থ: দহন
খাতা থেকে (প্রথম আলো, ২০০০), উজ্জীবন (রোদ্দুর, ২০০১), জাদুপাহাড়ের গান
(ভাষাবন্ধন, ২০০৬), বৌদ্ধ লেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ (কৌরব, ২০১২)। ২০০৮ থেকে কৌরব সম্পাদনায় যুক্ত। চিতাবাঘ শহরের দৌলতে ডাক পেয়েছেন
স্পেনীয় কবিতা উৎসব এক্সপোয়েসিয়া (Expoesia)
ও কলোম্বিয়ার মেদেয়িন আন্তর্জাতিক
কবিতা উৎসবে(Festival Internacional de Poesia
de Medellin, 2012)। বৌদ্ধ লেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১৩ সালের যুব সাহিত্য আকাদেমি
পুরস্কার পেয়েছেন। পেশায় স্পেনীয় সরকারি ইন্সতিতুতো সেরবান্তেস (Instituto Cervantes), নয়াদিল্লীতে এস্পানিওল ভাষার শিক্ষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন