ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(নবম অধ্যায়)
(১৮)
অনেকদিন পর সে রাত্রে পেটপুরে ভালমন্দ খেল বিবাক। এমন
আদর যত্ন বহুকাল তার অদৃষ্টে জোটেনি।
এরপর দিন চার কি পাঁচ পরের কথা। বিকেলের পর একটানা
বৃষ্টি নেমেছে। এবং বৃষ্টি যে চট করে থামবে সে লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। হয়ত বা সারারাত
ধরেই বর্ষা চলবে। বিবাক একলা চুপ করে ঘরে বসে। বাইরে কৃষ্ণাষ্টমীর অন্ধকার মেঘে
ঘনীভূত করে তুলেছে। গোপী নেই, একটু আসছি বলে সেই যে বেরিয়েছে, তারপর দু’দুটো দিন
পার হয়ে গেছে গোপী ফেরেনি। কে জানে হঠাৎ কোথায় চলে গেল। আর গেলই যদি বিবাককে সঙ্গে নিয়ে যেতে
পারত। এই রকম আচরণের জন্য গোপীর ওপরে মনে মনে রুষ্ট হচ্ছিল বিবাক। এমন সময় দোরের কাছে মাধবীকঙ্কণ এসে উপস্থিত। হাতে একটি কলাপাতা
ঢাকা দেওয়া পাত্র। বোঝাই যায় সেটি সে বিবাকের জন্য এনেছে। এই রকম বর্ষায় মেয়েটির
পরনের কাপড়চোপড় অনেকখানি ভিজে গেছে।
মাধবীকঙ্কণকে দেখা মাত্রই বিবাক হঠাৎ আবিষ্কার করল মেয়েটি প্রায় বিবাকেরই সমবয়সী।
এবং আরও একটু মন দিয়ে খেয়াল করলেই বোঝা যায় মেয়েটি নিতান্তই সাধাসিধা গ্রাম্য মেয়ে
নয়। বরং চোখে মুখে যথেষ্ঠ শিক্ষিতের ছাপ রয়েছে। বিবাকের বুক ধড়াস করে উঠল এবং
সচরাচর যা হয় না, তার একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অনুভূতি হল। চারিদিকে শুনশান, কেউ
কোথ্থাও নেই। তার হাত পা অবশ হয়ে এল।
সেই রাত্রিটা গভীর দাগ কেটেছিল বিবাকের মনে। মাটির ঘরের
আনাচে কানাচে, গাছপালায় বাঁশবনে, ঝিমঝিম নিশীথের একটানা বর্ষাধারা। চারধার
নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিবাকের মুখের দিকে চেয়ে মাধবীকঙ্কণ বলেছিল,
তোমার জন্য এটা নিয়ে এসেছি।
অবাক বিস্ময়ে সেদিকে চেয়ে বিবাক দেখল মাধবীকঙ্কণের দুই
চোখে স্থির বিশ্বাস ও সরল পবিত্রতা। ভেজা
বাতাসে বিবাকের নাকে মেয়েটির
চুলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিল হঠাৎ। বাইরে এমন সময় কড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এমন
অবস্থায় সারা জীবনেও যে সব চিন্তা মনে ঠাঁই পেত কিনা সন্দেহ, সেই সব চিন্তা ভাবনারা এসে উঁকি দিয়ে যায়।
বিবাক বলল, তুমি তো দেখছি খুব ভিজে গেছ। এসো ঘরে এসে
বোসো। মাধবীকঙ্ঙ্কণ একটু উশখুশ করে তারপর ধীর পায়ে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়াল, কিন্তু
সেও যেন কিছু ভাবছে... হাতের পাত্রটা ধীরে ধীরে মেঝেয় নামিয়ে রেখে বলল, এটা খেয়ে
নিও...
তার কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র আড়ষ্টতা নেই, বরং কিছু কৌ্তুক
মিশ্রিত কৌ্তুহল। বিবাক শুধলো, ক্ষেত্র কাপালি কই? তাকে দেখছি না!
সে কথার কোনও জবাব দিল না মাধবীকঙ্কণ। সামান্য গম্ভীর
সুরে জিজ্ঞেস করল, গোপী ফেরেনি তো?
এরপর বিবাক অনেক
সময় ভেবে আশ্চর্য্য হয়েছে সেদিন তখন স্বাভাবিক ভাবে অত কথাবার্তা কি করে সে কয়েছিল
কে জানে? মাধবীকঙ্কণ বলেছিল, দ্যাখো এবার এখনও ভাল করে বর্ষা শুরু হয়নি, এইবেলা
ঘরটা খুঁচি দিয়ে রেখো... না হলে কি ঘরদোর টেকে?
এমন ধরনের কথা বিবাকের কানে সম্পূর্ণ নতুনতর। নারী গতিকে
চেনে না, চিনতেও চায় না। পুরুষের উদ্দাম বহির্মুখী আকাঙ্ক্ষাকে শান্ত সংযত করে
তাকে গৃহস্থালী করে তুলতে চায়। এই শক্তির বিরুদ্ধে খুব কম পুরুষই জয়ী হতে পারে।
এরপর বেশ কিছুদিন বিবাক বাড়ির সামনে পেছনে বেড়া দিয়ে শাকের ক্ষেত, বেগুনের ক্ষেত
করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। দাওয়ার ধারে ধারে যত্ন করে লাল নীল বেগুনী দোপাটির চারা
পুঁতল। বর্ষার জল পেয়ে অতি দ্রুত সেগুলো ফুলন্ত হয়ে উঠল। মাধবী কোথা থেকে তাকে একটি চাঁপা ফুলের ডাল এনে
দিয়েছিল। আজ সকাল থেকে বিবাক সেটার পেছনেই পড়ে। তার সারা শরীর ধুলোয় ও ঘামে
শ্রান্ত হয়ে উঠেছে। মাধবীকঙ্কণ এসে বলল, মাগো কি ছাগলেরই না উৎপাত!
তুমি তো গাছ লাগিয়েই খালাস। আমি এদিকে রোজ কঞ্চি হাতে দুপুরবেলা ছাগল তাড়াই! বেশ
মজা না!
বিবাক হাঁ হয়ে গেল। মুখ তুলে ভারি আশ্চর্য্য হয়ে বলল,
আচ্ছা তোমাকে গাছ পাহাড়া দিতে হবে না। ও কাজ আমি করব! বলতে গিয়ে দেখল
মাধবীকঙ্কণনের মুখচোখ দারুণ গম্ভীর। তার চক্ষু দুটি দোপাটি বা চাঁপার ডালের দিকে
নেই। সে বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিবাকের ঘামে ভেজা হাত পিঠ বুক পর্যবেক্ষণ করছে। তার
ঠোঁটদুটি শুকনো, অবিন্যস্ত বেশবাস, রাত্রে বোধহয় ভাল করে ঘুমোয়নি। তার কোটরাগত দুই
চোখে যেন লেখা ‘থাকিব যোগিনী হঁঞা তোঁহাক সেবিঞাঁ... তোমাকে সেবা করে যোগিনী হয়ে
থাকব।
বিবাক বুঝল তার ঘামে ভেজা শরীরখানি থেকে খুব তীব্রভাবে
সোঁদা মাটির গন্ধ উঠে আসছে। অনেকটা স্বপ্নোথ্থিত হয়ে চারাগাছ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে,
তারপর মাটিমাখা দুই হাত দিয়েই ধীরে ধীরে মাধ্বীর দুই অনাবৃত বাহু স্পর্শ করল।
তারপরের মুহূর্তগুলো বিবাকের জীবনে অত্যন্ত গোপন ও
পবিত্র। যেন স্বর্গ থেকে দেবতারা নেমে এসে
তার কানে কানে কথা বলছে। বিবাক ডাকল, মাধ্বী!
প্রত্যুত্তরে মাধবীকঙ্কণ বলল, সপনে দেখিল ম কাহ্ন!
স্বপ্নে যে শুধু তোমাকেই দেখলাম কানহা!
আকাশের পটে তখন আগুনের অক্ষরে সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে।
বিবাক অবাক হয়ে দেখল, এ ঘোর রজনী মেঘে ঘটা কেমনে আইল বাটে!
মাধবীকঙ্কণের শরীরে বন কুসুমের সুগন্ধ, সে নব পুষ্পিতা
মল্লিলতার মত তন্বী লীলাময়ী। নিষ্ঠুর জনারণ্যে বিবাক এতদিন পথ হারিয়ে বিপন্নের মত
ঘুরছিল। এখন দেখল চারিদিকে ভাঁটার জল কলকল করে নেমে যাচ্ছে। চাঁদকাঁটার বন কোথাও
উঁচু ডাঙা, কোথাও বা পাড় ধ্বসে নদীগর্ভে পড়ে গিয়ে কাশঝোপের শিকড়গুলো বাইরে
ঝুলছে... কুন্দগুল্ম, সিন্দুবার, শিরীষ, অর্জুন, নীপ, বেতসের ভিড়ে রেবা নদীর অবুঝ
ছুটে চলা। তারা কেউই কোনও মন্তব্য প্রকাশ করল না। খড়ের ঘরের মেঝেয় মাধবীর একদম
কাছটিতে বিবাক হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। পূর্বদিকের খিড়কি জানলা দিয়ে হু হু করে মাঝে
মাঝে বর্ষার দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকছে। ঘরে একটি মাত্র প্রদীপ। তার অনুজ্জ্বল আলোয়
অতীতের সব কিছুকেই হঠাৎ বড় অকিঞ্চিৎকর বড় তুচ্ছ বলে মনে হল। মনে হল জীবনে অনবরত
বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে প্রচুর লড়াই করতে হয়েছে বলেই আজকের এই মুহূর্তগুলো তার কাছে স্বর্গীয় বলে মনে হচ্ছে। মাধবীকঙ্কণের
মস্তকের গুয়ামুটি কবরী ও অঙ্গের শ্বেত পাটশাড়ী বিবাকের মাথায় চোখে কিসের যেন ঘোর
তুলল। ইতিপূর্বে চুম্বন কি বস্তু সে অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল এমনই
যে মানুষের অন্তরতম ইচ্ছেগুলো ঠিক সময় বুঝেই আত্মপ্রকাশ করে। মাধ্বীকে সজোরে চেপে
ধরে বিবাক ক্ষুধার্তের মত তাকে আপাদমস্তক চুমু খেতে শুরু করল। প্রথম দিকটা হকচকিয়ে
গেলেও মিনিট দুই একের মধ্যে মাধ্বীও ব্যাপারটা উপভোগ করতে শুরু করল। বলা বাহুল্য
এটা তার ভীষণ ভাল লাগছে।
এসব ঘটনা নিয়ে পরে বিবাক যতবারই ভেবেছে, দেখেছে তার আর
মাধ্বীর মধ্যে খুব বেশি কিছু মনে রাখার মত ঘটনা তেমন কিচ্ছু ঘটেনি। মাধ্বীর মা
নেই, ভাই বোনও কেউ নেই। সংসারে থাকার মধ্যে ঐ এক ক্ষেত্র কাপালি। তা তিনি তো গোটা
দিনমান দুনিয়ার গাঁ গঞ্জ ঘুরে ঘুরে বেড়ান। রাজকর আদায় উশুলের কাজটি ব্যতীত যদি আর
কিছু কর্ম থাকে তা হল গ্রামের কোতয়ালী বিচার বন্দোবস্তো করা। বুদ্ধিমতী মাধ্বী
পিতার অনুমোদন সাপেক্ষে অচিরেই বিবাককে নিজেদের বাটীতে নিয়ে আসবার সুবন্দোবস্তো
করে ফেলল। ততদিনে চিড়াইবাড়ি গ্রামটির প্রতি বিবাকেরও মায়া জন্মে গেছে। উপরন্তু
রয়েছে মাধ্বীর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। গোপী কাউকে কিছু না বলে গৌড় চলে গিয়েছিল। তার
গতিবিধি বরাবরই এমন। সে যুগে রাজা মহারাজারা শিল্প সংগীতে পারদর্শীকে মহার্ঘ্য
খেতাব খেলাত হীরে জহরৎ ইত্যাদি দিয়ে সন্মানিত করতেন। বেচারি গোপী তার অমোঘ আকর্ষণ
এড়াতে পারেনি। খ্যাতির যশাকাঙ্ক্ষা তাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।
বিবাক বলল, তোর সঙ্গে কিন্তু আড়ি। সারাটা সকাল আজ তুই
কোথায় ছিলি? একটু সলজ্জ হেসে বিবাকের দিকে দুই আয়ত চোখ নিক্ষেপ করে মাধ্বী বলল, আর
তুইই বা আজ সারাদিন কি এমন ব্যস্ত ছিলি যে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে ইদিক পানে এলিই না!
বিবাক দেখল আজ সারাটা দিনমান সে এই অনুপম মুখটি চাক্ষুস
করেনি। যে মুখ সে আজ মনে মনে ভেবে এসেছে, সে ভাবনার সঙ্গে এই মুখাবয়বের কোনও
সাদৃশ্য নেই। বিবাক আজকাল মাঠে যায়। সেখানে গিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে কাপাস তোলে।
কাপাস সংগ্রহে পূর্বের মত আবার সে মনোনিবেশ করেছে। বলতে গেলে এই কর্মটি তার রক্তে
প্রবাহিত এবং এটিই তার প্রধান জীবিকা। সে কারণে তার মন এখন অনেক ভাল আছে। তার
ইচ্ছা এবার এই চিড়াইবাড়িতেই পাকাপাকি বসবাস করবে। তারপর আর কিছুদিন অতিবাহিত হলে
একটা তাঁতঘর তৈরী করবে। সেই দামুন্যা গ্রামে থাকতে মুকুন্দদাদা তাকে যেমন পরামর্শ
দিয়েছিল, নিজস্ব তাঁতঘরে বিবাক এবার নিজের হাতে জামদানী বস্ত্র তৈরী করবে। এই কাজে
সে ক্ষেত্র কাপালির পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা আশা করে। রেশমের হাতঝাড়া বা কোয়া থেকে
পোকা কেটে বার হয়ে গেছে, তার সুতোয় যে কাপড় বোনা হয় তার নাম ‘মটকা’। আর সুতো মিশান দিয়ে বুনলে হয় ‘বাফতা’। দিনের বেলাটা বিবাক মাঠে কাপাস তোলার ফাঁকে ফোকরে এই সব
বুদ্ধি চিন্তা করে। ভাবে অনেক হল, এবারে কেন জীবনে একটু থিতু না হই? ঠিক এমন
ভাবনকালে তার মাধ্বীর সুললিত মুখখানি মনে পড়ে। মাধ্বী! মাধ্বী! মাধ্বী!
এই-ই! ... আমার কথা বুঝি কানে যাচ্ছে না?... মাধবীকঙ্কণ
খিঁচ করে বিবাকের চুলে এক টান মারল। উঃ বলে চমকে উঠল বিবাক। দুদিন আগেও বোঝেনি
মাধ্বী তাকে আস্তে আস্তে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলছে। এখন বুঝল। বুঝল এই সেদিনও সে ছিল সহায়শূন্য, আত্মীয়শূন্য, গৃহশূন্য, জগতে সম্পূর্ণ একাকী। কোথা থেকে মাধ্বী তার একদম পাশটিতে এসে
দাঁড়িয়েছে। অত্যন্ত কৌ্তুকের সঙ্গে বিবাক বলল, তবে রে! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! - বলে
এক ঝটকায় মাধ্বীকে নিজের বুকের কাছে টেনে এনে তাকে সবলে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে
শিহরণ... বিবাকের দুই সবল বাহুদ্বয়ের মাঝে মাধ্বী কৃত্রিম ছটফট করছে, এমন সময় এই
দৃশ্যটা ক্ষেত্র কাপালির চোখে পড়ে গেল। এ গ্রামে পা রাখা ইস্তক বিবাক কাপালির সরস
তির্যক হাস্যমুখ চাক্ষুস করেছে। কখনও তার রোষ দেখেনি। সে প্রয়োজনও পড়েনি। আজ দেখল
কাপালির দোর্দন্ডপ্রতাপ রূপ। কি করবে বিবাক ভেবে পেল না।
সেই দিনই রাত্রে, অনেক রাত তখন, গোপী আর বিবাক ফিসফিস
করে নিজেদের মধ্যে গোপনে শলা করছিল। গোপী বলল, জল সঞ্চা্লনের জন্য দক্ষিণভাগে
নদীগর্ভে একটি ক্ষুদ্র খাল কাটা হয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে তোরা দুজনে পালিয়ে যা। কেউ
জানতে পারবে না। কারণ এখনও অব্দি ও পথের সন্ধান কেউ পায়নি।
বিবাকের মাথায় অন্য ভাবনা। ভাবছে জীবনের এই দিকটা নিয়ে
এতদিন কোনও চিন্তা ভাবনাই করতে হয়নি। আজ যদি চিড়াইবাড়ি গ্রাম ত্যাগ করতে হয় তো
সানন্দে এ কাজ করবে, কিন্তু তার পক্ষে মাধ্বী বিনে একটি দিনও বেঁচে থাকার কথা কল্পনা করাও অতি দুঃসাধ্য। না, তার মনে
কারুর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা বা রাগ নেই। আজ নিয়ে তিনদিন মাধ্বীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই। নিজ গৃহের
একটি গোপন কুঠুরির মধ্যে মাধ্বীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। দরজার বাইরে থেকে শেকল
দেওয়া। ক্ষেত্র কাপালি একজন বয়স্থা দাসী স্থানীয় মহিলাকে সেখানে কড়া পাহাড়ায় রেখে
দিয়েছে। মাধ্বী কেমন আছে, কি করছে কিচ্ছুই জানবার উপায় নেই। কাজেই চিড়াইবাড়ি ত্যাগ
করতে হলে গোপনে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।
গোপী বুঝল অবস্থা বেশ জটিল। জোয়ান বয়সে ক্ষেত্র কাপালি
একবার একলা লাঠি চালিয়ে ডাকাত ভাগিয়েছিল। এখনও এ গ্রামে তার কথাই শেষ কথা। এও শোনা
যায় তার নাকি একদল নিজস্ব ঘোড় সওয়ার দল যত্রতত্র এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। যদিও তা গোপীর এখনও চাক্ষুস করা হয়নি।
কিন্তু কাপালির লেঠেল বাহিনীকে সে অবশ্যই দেখেছে। ক্ষেত্র কাপালির ভয়ানক জাত ক্রোধ। বিবাককে বলল, খবর পেয়েছি আফগান শাসক শের খান খুব শিঘ্র গৌড় দখল করতে
এগিয়ে আসছে। সেখানে তাকে বাধা দেওয়ার মত
কেউ নেই। শোন ক্ষেত্র কাপালি কাল চিড়াইবাড়ি থেকে গৌড় রওনা দিয়েছে। পালানোর এই
সুযোগ।
উত্তেজনায় বিবাকের বুক কাঁপলেও বাইরে সে শান্ত। মনে মনে
ভাবে, ইচ্ছে করে সে আর মাধ্বী বেশ একা একটি ঘরে..., ছোট খিড়কি দিয়ে সূর্যাস্তের
রাঙা আলো এসে পড়েছে। তার উন্মুক্ত চাঁচর-চিকন কেশ কাঁধের ওপর লুটিয়ে। সেইখানে
নিজের মস্তক রেখে মাধ্বী তাকে শুধোচ্ছে - তর এমন মতি হঠাৎ হল কেন বিবাক? এমন দিন
যে আসবে আমি কিন্তু কখনও ভাবিনি!
বিয়ের কথা তোর মনে নেই না রে মাধ্বী! হ্যাঁ রে তোর বর
কেমন ধারা মানুষ ছিল রে?... তোকে নিশ্চই খুব ভালবাসত?
এই রকম দু’চারটে প্রশ্নের মাঝেই বিবাক মাধ্বীকে সবেগে
নিজের বুকের একদম কাছটিতে টেনে ধরে আনল।
আজ বিকেলে মাধ্বী কিছু বিশেষ প্রসাধন করেছে। তার চুল আজ বল্লকী ছাঁদে কবরী বাঁধা,
নাসায় বেসর পঁউছি। সর্বাঙ্গে চন্দন-পঙ্ক। বিবাকের শরীরে ঘাম... অস্ফুটে কি যেন
বলতে চায়। মাধ্বী বলল, কতদিন পর আজ আলোচালের ভাত, কুলের টক, শিম্ব-উড়শি দাল, পাবতা
মাছ রেঁধে রেখেছি। এখন এসব ছাড়! ওঠ! খাবি চল!
নাহ্! এই অপূর্ব হাসি-অশ্রু মাখানো কল্পলোক ছেড়ে বিবাক
কিছুতেই উঠবে না। এ পর্যন্ত সে কারুর কাছে কিচ্ছু চায়নি, হাত পেতে চাইতেও পারে না।
আত্মমর্যদাবোধ তার আছে কিনা জানা নেই, কিন্তু একটু আশ্রয় একটু আত্মীয়তা ছাড়া আর যে
চলে না। উদগ্রীব হয়ে সে মাধ্বীকে শুধলো, তোর রাতে ঘুম হয় মাধ্বী? আমার কিন্তু
একটুও ঘুম হয় না। রোজ রাত্তিরে শুধু জেগে থাকি। আজ কিন্তু তোকে আমি সারারাত্তির
জাগিয়ে রাখব! বুঝবি এবার জেগে থাকা কাকে বলে? আমার কাছে আয়...
কথায় কথায় রাত গভীর হয়। অন্যমনস্ক বিবাক তখনও নিশ্চুপ
বসে। গোপী তাড়া দিল - ওঠ্! ওঠ্! ভোরের আলো ফুটে গেলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। শেষে
কি বেঘোরে প্রাণ খোয়াবি? গোপীর তাড়ায় উঠে বসে বিবাক কিন্তু হাত পা কেমন অসাড় অবশ। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে এক মাটিতে থিতু হওয়া তার ভাগ্যে নেই। আজ রাতের আকাশ খুব
পরিষ্কার। মেঘ বৃষ্টির কণামাত্র চিহ্ন নেই। অন্ধকার পথে চলতে কোনও অসুবিধেই হল না।
দিব্যি নিঃশব্দে তারা মাধ্বীদের গৃহের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। তবে সচরাচর রোজ যে পথে
আসে আজ অন্য একটা ঘুর পথে এসেছে এখানে। এই সব বাঙ্গালা বাটীগুলো বেশ শক্ত দালান
কোঠা। বড় বড় কাঠের খুঁটির ওপর খড়ের চাল, দেওয়ালে পায়রাখোপি কপাট। আর একটি আয়ের
কপাট রয়েছে একটু দূরে। পা টিপে টিপে বিবাক সেই দিকেই গেল। এ গৃহের কোথায় কি রয়েছে
সবই তার নখদর্পনে। কপাট ঠেলার দরকার হল না, তার পায়ের শব্দে মাধ্বী নিজেই উঠে
এসেছে। অন্ধকারে দুজন দুজনকে স্পর্শ করা মাত্রই কি এক আনন্দ। কি অদ্ভূত শিহরণ।
ঘরের ভেতর একটি ছাপর খাট। সোজা সেখানেই
দুজনে চলে গেল। অন্ধকারেও
বিবাক বুঝল ক’দিনে মাধ্বী কেমন শুকিয়ে
গিয়েছে। মুখে সে হাসি নেই। তবু দুই হাত দিয়ে বিবাকের কণ্ঠ জড়িয়ে আস্তে আস্তে
উচ্চারণ করল, আমি মরে গেলেও তোর মুখে কথা ফুটবে না বল্!
বিবাক কোনও উত্তর দিল না। বলল, বাইরে গোপী নজরদারি করছে,
আমরা এক্ষুনি পালাব! চল ওঠ্!
কিন্তু বাবা যে বলেছে, তুই নাকি আমাকে ভুলিয়ে নিয়ে
বাদশার হারেমে বিক্রি করে দিবি? সত্যি?
বিবাকের ইচ্ছে হল বলে, তাই কখনও হয়? তোকে আমি এত ভালবাসি
আর তুই কিনা...
কি হল বিবাক? আমার কথার সত্যি জবাব দে! আজ ক’দিন ধরে
আমার মনের যে কি অবস্থা..., মাধ্বীর শ্লেষ
জড়িত কণ্ঠে উদ্গত অশ্রু। বিবাক তার জলে ভেজা দুই গাল আঙ্গুলে মুছে অস্পষ্ট সুরে
বলল, কেন মিথ্যে ভয় পাচ্ছিস? চল আমার সঙ্গে। এখান থেকে সোজা কাবুল যাব। বাদশা এখন
ওখানেই আছেন।
অন্ধকারেও মাধ্বীর দুই কানের বলি ও চাকি জ্বলজ্বল করছে।
গলার ‘সুতলি’ ও বক্ষের ‘কাকলী কাঁচুলি’, চুলের পানকাটা এবং নিতম্ব মন্ডলে ঘাঘর
কিঙ্কিণী ইত্যাদি সবই স্পষ্ট প্রতীয়মান। সে ধনী বংশের কন্যা, বিধবা, কিন্তু পিতার
ঘরে সে অযত্নে প্রতিপালিত নয়। তার পিতা
তাকে যথেষ্ঠ ভালবাসে।
মাধ্বী শুধলো, তুই কাবুল যাওয়ার রাস্তা চিনিস?
রাস্তা ঠিক চিনে নেব। কোনও চিন্তা নেই...
ঠিক এমনি সময় বাইরে কিসের শব্দ শোনা গেল এবং উপুর্যপরি
লাঠির শব্দ। ঘরের ভেতর চমকে উঠল দুজনেই। মাধ্বী বলল, ঐ... ঐ কুটিলা ঠিক ফিরে
এসেছে! এক্ষুনি পালিয়ে যা বিবাক!
না! পালাই যদি দুজনে একসঙ্গে পালাব।
উফ্! পালা বলছি! কুটিলা দাসী দেখতে পেলে আর রক্ষে নেই...
কিন্তু মাধ্বীর কথা ফুরনোর আগেই অন্ধকারে কপাটের সম্মুখে
কুটিলা এসে উপস্থিত। তার হাতে ছোট লম্ফ জাতীয় ‘টানুনী’। টানুনীর আলো ঘুরিয়ে মাধ্বীর কক্ষখানি একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিল কুটিলা। নিয়ে বাইরে থেকে ঝনাৎ শব্দে কপাটের শেকল তুলে দিল। অন্ধকার কক্ষে বিবাক তখন লুকিয়ে।
তার মন বলছে বাইরে নিশ্চয়ই গোপীর কিছু একটা বিপদ ঘটেছে। এদিকে এ কক্ষ থেকে নির্গত
হওয়ার কোনও দ্বিতীয় পথ নেই। অস্ফুটে মাধ্বী ডাকল – এই-ই!
বিবাক সাড়া দিল না। ছাপর খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে সবলে
মাধ্বীকে নিজের শরীরের সঙ্গে চেপে ধরল। তারপর ক্ষিপ্র হস্তে মাধ্বীর বক্ষের ‘কাকলী
কাঁচুলি’ সরিয়ে সেখানে নিজের মুখ গুঁজে দিল। বাইরে তখন লাঠিয়ালদের তুমুল লাঠি
ঠোকাঠুকির শব্দ। সেই শব্দের সঙ্গে মিলে মিশে যাচ্ছে গোপীর আর্তনাদ।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন