রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




ধারাবাহিক উপন্যাস



প্রিয়দর্শিনী 




(অষ্টম অধ্যায়)       

(১৭)           

১৫৩৮তে গল্প শুরু হয়েছিল, আর এখন সন ১৫৫৫। মধ্যে প্রায় সতেরো  বছরের ব্যবধান। এই দীর্ঘ সময়ে দেশ এবং মানুষজন, দুয়েরই পরিণতি  এলোমেলো এবং অসমাপ্ত। ছায়া ছায়া হিমহিম পট পরিবর্ত্তনের ইতিহাস। ১৫৪৫ খৃষ্টাব্দে ৩রা জুন শের শাহর পরলোক প্রাপ্তি হয়। হুমায়ুন বাদশা এরপর যখন দীর্ঘ সময় পর মোগল সুলতানাত্ পুনরুদ্ধার করেন, বিবাককে সম্রাট ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলে, বিবাকের প্রার্থনা মত হুমায়ুন সম্রাট দুঘন্টার   জন্য মোগল সিংহাসনে বসিয়ে সম্রাটের প্রাণ রক্ষার প্রতিদান স্বরূপ পুরস্কার প্রদান করেন। কেউ বলেন, দু’ঘন্টা নয়, বাদশাহী সিংহাসনে বিবাক বারো ঘন্টার জন্য অধিকার লাভ করেছিল। ইতিহাসে এর তেমন কিছু প্রমা নেই কিন্তু মূল  ঘটনাটি পুরোপুরি সত্য। একজন ভিস্তিওয়ালা গঙ্গায় নিমজ্জিত হুমায়ুন সম্রাটের প্রাণরক্ষা করে বাদশাহী তখত্এ বসবার দুর্লভ সম্মান লাভ করতে পেরেছিল।

পঞ্চদশ শতকের শুরুতে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের অবস্থা কেমন ছিল, আজ আর তা ভাল করে জানার উপায় নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে সে যুগের সাহিত্য পাওয়াও যায় না। বঙ্গদেশ বলতে সে সময় সামগ্রিক ভাবে কোনো নির্দিষ্ট দেশ ছিল না। গৌড়কে কেন্দ্র করে প্রাচীন বাংলা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু গৌড় মালদা অঞ্চলে গঙ্গা নদী আজ পর্য্যন্ত এতবার বাঁক বদল করেছে, গোটা  ভারতবর্ষে আর কোথ্থাও এমনটা দেখা যায়নি। সুতরাং সে সময়ের অনেকানেক পুরাকীর্তি কবেই নদীগর্ভে বিলীন। তবে গৌড় এবং গৌড় মন্ডলীই যে আদি বাঙ্গালী সভ্যতার উৎস, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেবকোট মালদহ  তাহেরপুর ইত্যাদি স্থানগুলিকে একত্রে গৌড় মন্ডলী বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ইতিহাস বলছে, গৌড়ের প্রথম হিন্দুরাজা গণেশ। কিন্তু এর সপক্ষে কোনও নির্দিষ্ট প্রমা নেই। রাজা গণেশের রাজ্যকাল বা কীর্তিকলাপ দূরে থাকুক, ঐ নামে কোনও রাজা আদৌ ছিলেন কিনা তা নিয়েও ঐতিহাসিক মহলে আজও বাগ বিতন্ডা চলে। সে সময়ের হিন্দুর রচিত কোনও ঐতিহাসিক বিবরণও অমিল। বিদেশীদের মধ্যে ইবন বতুতা ১৩৫০ সনে দিল্লী থেকে বাংলায় আসেন। গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী ‘সোদ কা ওয়ান’ (সাতগাঁ) পৌঁছেছিলেন তিনি  বঙ্গদেশের সুলভতা লক্ষ্য করেতাঁর দীনার (রৌপ্য মুদ্রা), দিবহাম(১/৮) দীনার প্রভৃতির প্রকৃত মূল্য জানা না থাকলেও সেকালে বাংলায় চাল তেল ঘৃত যে অন্যান্য দেশ অপেক্ষা অধিক সুলভ ছিল, তা তাঁর উক্তি হতেই স্পষ্ট বোঝা  যায়। তিনি লিখেছেন, সোনার গাঁ থেকে স্থলপথে ৫২।।০ ক্রোশ গমন করলে বাংলা রাজ্য পাওয়া যায়। এদেশের রাজারা বাণিজ্যের জন্য বিদেশে যান। দেশের অভ্যন্তরে জ্যোতিষী, শিল্পী ও পন্ডিতদের যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব। রেশমের কীট  পালিত হয় ও অভূতপূর্ব সূক্ষ্ম রেশমবস্ত্র সহজলভ্য

রাজা গণেশের কিছু পর বঙ্গের দুই গৌরব প্রসিদ্ধ কবি আবির্ভূত হন। চন্ডীদাস ও  তাঁর কিছু পরে কবি কৃত্তিবাস। আদি বাঙ্গালী কবি এঁরাই। কিন্তু শিক্ষা বিষয়ে  সাধার বাঙ্গালী সমাজ অনেক পশ্চাতে অবস্থান করত। মিথিলাই তখন সংস্কৃত  চর্চ্চার প্রাণকেন্দ্র। আর সে যুগের লেখাপড়া মানেই হল এক কথায়, সংস্কৃত পড়া, চর্চ্চা করা। সুতরাং নদীয়াবাসী কৃত্তিবাসকেও ‘পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড় গঙ্গাপার’ অর্থাৎ বরেন্দ্র ভূমিতে যেতে হয়েছিল। তবে সাধার মানুষ রাজনীতি  নিয়ে খুব একটা ভাবিত হত না। হিন্দুদের সাধারণ জাতীয় প্রকৃতিই এই যে, যতক্ষণ না তাদের ধর্ম বা গার্হস্থ্যজীবন অক্ষুণ্ন থাকে, ততক্ষণ এরা কারুর বিরুদ্ধাচারণ করে না। অতীতে দেখা গেছে যতক্ষণ কেউ ধর্ম বা সমাজে হস্তক্ষেপ  করেনি, সে রাজশক্তির বিচার করতে বসেনি, ভাল মন্দ যেমনই হোক নিজের ধর্মাচার নিয়েই বরাবর ব্যস্ত থেকে গেছে। মুসলমান পীর ফকিরকে হিন্দু শ্রদ্ধার চোখেই দেখে এসেছে। সন্তানের মঙ্গল কামনায় পীরের দরগায় সির্ণী মেনেছে। পাঠান আমলে যে কোনো নব গঠিত রাজ্যে হিন্দু মুসলমান একত্রে পাশাপাশি বসবাস করেছে। ভারতবর্ষের পঞ্চদশ শতাব্দী এই রূপেই অতিবাহিত হয়অন্তত  বাংলার ইতিহাসে এই ছবি আমরা দেখতে পাই। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলায় হুসেন শাহ রাজা হন। সে এক স্বর্ণযুগ ছিল। তখন শুধু যে গৌড়ের লোক স্বর্ণপাত্রে আহারাদি সারত তা নয়, সমগ্র বঙ্গেই মানুষজন মোটামুটি শান্তিতে বেঁচেছিল। হুসেন রাজা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গুণের মর্যদা রাখতেন, শিল্প সাহিত্যে উৎসাহ দিতেন। বাবর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বঙ্গদেশে যে কেউ  সিংহাসন অধিকার করতে পারে, সেইই সর্বত্র রাজা বলে সন্মানিত হয়ে থাকে।’

বাংলায় মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার অনেক বছর পর অব্দিও দিল্লির অধীনতা বাংলা চট করে স্বীকার করেনি। আবার পাঠান রাজত্বের অবসান হওয়া  মাত্রই যে বাংলায় মোগল শান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাও নয়। ১৫২৬এ বাবরের রাজ্যারম্ভ থেকে শুরু করে ১৫৫৬ পর্যন্ত আকবরের রাজ্যলাভ পর্যন্ত বাংলায় মোগল আধিপত্য ভাল করে কায়েম হয় নি। এই সন্ধিযুগেই কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মোগল কর্মচারী কর্তৃক অত্যাচারিত হন। প্রজার খিল (পতিত) জমি লাল (উর্বর) লিখে বিনা উপকারে খতি (ঘুষ) খেয়ে সাধার মানুষের জীবনকে কীভাবে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল, চন্ডীকাব্যে কবি সেই কথাগুলি বিশদে লিখে গেছেন এবং তাঁর বক্তব্য সমান ভাবে বর্তমান বাংলার জনজীবনে আজও প্রাসঙ্গিক।

হুসেন শাহর মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসন বহু হাত ঘুরে অবশেষে দায়ুদ খাঁর হাতে আসে। তখন দিল্লীর তখতে্ মোগল সম্রাট আকবর আসীন গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোগল পাঠানে ভয়ংকর লড়াই, ফল - দায়ুদের পরাজয় ও মৃত্যু। ইতিহাস বলছে, দায়ুদেরই হিন্দু সেনাপতি ও আরো কয়েজন ধন সম্পদ, রসদ, কিছু অস্ত্রসস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে নৌকো সহযোগে প্রথমে গঙ্গা, তারপর  ত্রিবেণী কাছে যমুনা দিয়ে সমুদ্রের কাছে পৌঁছে গেলেন। সেটা ব-দ্বীপ অঞ্চল, যেমন দুর্ভেদ্য জঙ্গল, তেমনই বড় বড় মশা, বিষাক্ত পোকামাকড় ও সাপ। এবং জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ। অকুতোভয় সেনাপতিরা সেই জঙ্গল কেটেই মাটি দিয়ে গড় তৈরী করলেন, বসতি গড়লেন। তৈরী হল সমাজ। গৌড়ের যশ হরণ করে এই সমাজ তৈরী হল বলে দেশটির নামকরণ করা হল যশ-হর বা যশোর। কালক্রমে  যশোর খুলনা আরো শ্রীবৃ্দ্ধি লাভ করলে জনপদও বৃদ্ধি পায়। পূর্ববঙ্গর সৃষ্টি এই ভাবেই। পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ় অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল শুধু অজয় নদের দুই পার্শ্বের কিছু বসতি ও কর্ণভূমের রাজা লাউসেনের রাজত্বে। সুদূর দিল্লী থেকে এই সব স্থান কোনও দিনই বাদশাহী শানের আওতায় থাকেনি। রাঢ় বঙ্গের অবস্থান  অধিক মাত্রায় জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এর প্রাচীন ইতিহাস খুব বেশী কিছু জানা যায় না।

তবে বাংলা ভাষার আদি উৎস যাইই থাক, এ ভাষার সংস্কৃতি ও কৃষ্টি চিরকাল মানুষকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে এসেছে। যদি অতীতের মধ্যেই ভবিষ্যতের  বীজ নিহিত থাকে, তবুও বাংলা ভাষার ভবিষৎ নিরূপণ অতি দুঃসাহসিক
কিন্তু এহ বাহ্য, ভাষার ইতিহাস ও তার ভবিষৎ নিয়ে পন্ডিতরা চিন্তা ভাবনা করুন। আমাদের উৎসাহ অন্য জায়গায়। ঝিকিমিকি ডিঙাখানি চড়ে বিবাক আর গোপী গৌড়ে ফিরে এল। দীর্ঘ পথশ্রমে দুইজনেই ক্লান্ত। সন্ধ্যা হয় হয়। তারা যে এই রকম হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে ক’য়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করবে তা কেউ জানত না। বিবাক আজকাল গোপীর সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করত। ‘চিড়াই বাড়ি’ পৌঁছে চেনা পরিচিত কাউকেই তারা দেখতে পেল না। এ জায়গাটা গৌড়ের মধ্যেই পড়ে বটে কিন্তু এখানের লোক সাধার গৌড়বর্গের মধ্যে পড়ে না। সূত্রধর ও ছুতার ধরনের লোকজনই এখানে বেশি বসবাস করে। নৌকা বা ডিঙি নির্মাই এদের প্রধান জীবিকা। সন্ধ্যের দিকে আবার ঘন মেঘ করে তুমুল  বৃষ্টি নামল। কেউ কোথাও নেই, বাড়িঘর অপরিষ্কার, রাত্রিবাসের অনুপযুক্তএই ক’দিনেই ছাঁচতলায় বর্ষার জল পেয়ে কাঁইবীচি ফুটে চারা বের হয়েছে। কুটিরের বিভিন্ন স্থানে খড় উড়ে চালার বাখারি ঝুলে পড়েছে উঠোনে হাঁটু সমান জঙ্গলে নানা পতঙ্গ কুস্বরে ডেকে চলেছে। ঝোপে ঝোপে জোনাকি। গোপী খুঁজে পেতে একটা লণ্ঠন ধরালো। নজরে এল ঘরের মাটির মেঝেয় কি পোকায় খুঁড়ে একরাশ মাটি জড়ো করেছে। সব দেখে বিবাকের মনটা কেমন দমে গেল। এখানে সে  থাকবে কেমন করে? এরকম জায়গায় থাকলে সে অবধারিত মরে যাবে এর চেয়ে হুমায়ুন বাদশার সঙ্গে কাবুল চলে গেলেই ঢ়ের বেশি ভাল হত। সত্যিকারের প্রেম ভালবাসা বরাবর তাকে আকর্ষ করেছে। বাদশার হৃদয় অতিশয় দরাজ।
গোপী অপ্রতিভ হয়ে গেছে। এই রকম ঘনঘোর বর্ষা, তার ওপর নিতান্ত আনাড়ি। এতদিন গোপী জানত বিবাকও তার মত যেমন তেমন করে রাত্রিবাস করতে পারে। কিছু খাবার জুটলে ভাল, তা নয়ত না খেয়েও দিনের পর দিন কাটানো কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু এখন তার মন যেন অন্য কিছু বলছে। লণ্ঠনটা হাতে তুলে নিল গোপী। বাইরে থেকে পাকা লাঠিগাছটা আনতে যাবে বলে সবে পা বাড়িয়েছে এমন সময় দোরের কাছে কার মুখ। এক মাথা কাঁচাপাকা চুল, চওড়া নাক, কর্কশ ভুরুর নীচে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। ছ’মনী চেহারায় প্রাচীন মর্যদাবোধ।
তুই সেই চোদ্দ বছরে যেমন পাগল ছিলি গোপী আজও দেখছি তাই-ই আছিস!’ তারপর হতভম্ভ বিবাকের দিকে চেয়ে - ‘ইটি কে?’
ও হল বিবাক। আমার দোসর। চিড়াই বাড়ি দেখব দেখব বলছিল তাই নিয়ে এলাম।
তোর মাথা খারাপ আছে! ভদ্দরলোকের ছেলেকে সঙ্গে নে এয়েছিস তা খাওয়াবি কী?
তা কেন? এই তো এখানে উনুন আছে।

বিবাকের ততক্ষণে ঘোর কেটে মাথা সজাগ হয়ে উঠেছে। চিড়াই বাড়ি, লাঘাটা এগুলো গৌড়ের প্রসিদ্ধ স্থান। নানা ধরনের ছোট বড় নৌকা ডিঙি পানসি ইত্যাদি তৈরীর বিখ্যাত জায়গা। বিবাকের বহুদিনের ইচ্ছা তার নিজের একটা ডিঙি থাকবে। নিজেই তৈরী করে নেবে না হয়... তারপর সেই সুখাসন ডিঙা চড়ে, সে বড় বেশিদিনের কথা নয়। এই সেদিনও বিবাক দলবল সুদ্ধ মাঠে গিয়ে কাপাস তুলেছে। তারপর সেই কাপাস বাড়িতে এনে নিপুণ হস্তে চরখির সাহাজ্যে সুন্দর  তুলায় পরিবর্তিত, আছড়া দিয়ে ফুটিয়ে শরকাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে পাঁজে পরিণত করা, তারপর সেই পাঁজ থেকে চরখায় সুতা প্রস্তুত করা। এই রকম গৃহজাত সুতোর লালপেড়ে ধড়া পরে সানন্দে এ পথে সে পথে সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে বেড়ানকিন্তু সে সুখ বেশিদিন টিকল কই! গোপীকে দেখে তার সঙ্গে দিন  কতক এদিক সেদিক করতেই মাথা থেকে তুলো কাপাস চরখা সুতো এসব জিনিষগুলো বেমালুম গায়েব। বদলে তার মনে হল দুনিয়াদারির কত কিছুই তার এখনও না দেখা রয়ে গেছে। ব্যস সেই মেনে হওয়া হল তার কাল। মাঠে গিয়ে কাপাস তোলা তার শিকেয় উঠল। উন্মুক্ত নদীবক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই সে চাক্ষুস করে নিয়েছে দূরের ঝাপসা আমবন, জলার ধারে লাল হাঁসের দল, বহুদূরে  দিকচক্রবালে গাঁয়ের সীমানায় এক আধটা নীল পাহাড়। আকাশের ঘন কাল মেঘের দল নিচে ঝুঁকে রয়েছে সেই বসতির ওপর, ছায়াভরা পদ্মপুকুর, সারা বাংলা এক অতুলনীয় কমনীয় রূপ হয়ে তার দুই চোখে নিমেষে ধরা দিল
দেখলে ক্ষেত্র কাপালির ভাবখানা দেখলে একবার! যেন সব চিন্তা ওর একলার!... বলতে বলতে ব্যাজার মুখে লণ্ঠনটা তুলে ধরে গোপী তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বলে ওঠে, তোমার জন্য বাদশাহিখানা আসছে! কী অত বসে বসে তখন থেকে ভাবছ? ওঠো! ওঠো!
বিবাক শুধলো, বাদশাহীখানা কে আনছে? ইনি কে এসেছিলেন? তোমার কেউ হয় বুঝি?
গোপী হেসেই খুন। বলল, হাসি খুব সোজা জিনিষ, বুঝলে? কই দাও দিকি তোমার মত চাঁদপানা মুখ... হুঃ! তার বেলা...

ক্ষেত্র কাপালি ঘন্টা খানেকের ভেতরেই ফিরে এল, কিন্তু একলা নয়। সঙ্গে এল মাধবীকঙ্কন। কাপালির একমাত্র মেয়ে। সাদা থান পরা, বিধবার বেশ। ঘোমটার নিচে দুই বর্হিমুখী উজ্জ্বল চক্ষু। বিবাক দেখল। দেখল নদীতীরের নাকেলশ্রেণীর  পত্রশীর্ষে নবমীর জোৎ্যস্না। শিরীষকুসুমকোঁআলী, তিনভুবনজনমোহিনী তার  রূপে মুগ্ধ হয় তিন ভুবনের অধিবাসীরা। শিরীষ কুসুমের মতই কোমল সে
বিবাক ভাবল, এ ক্ষেত্র কাপালির মেয়ে? মেয়েটির সন্মন্ধে আগ্রহে ও কৌতূহলে  তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। চিবুকের গড়নটি নিখুঁত। হিঙ্গুল ললাটে ও  কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। লণ্ঠনের নিভু আলোয় তার যেন কিসের নেশা ধরে গেল।

ক্ষেত্র কাপালি এ তল্লাটের নামকরা গাঁতিদার। তাছাড়া তার নাকি সুবিস্তৃত  মহাজনী কারবার। গ্রামের দক্ষিণ পূবে পুরনো আমলের আবাসবাতিজমিদারীর আয় কার্যে সেকালে গ্রামে গ্রামে পাটোয়ারী এবং মন্ডল বা মির্ধা থাকত একজন করে। অনেক জায়গায় আবার গ্রামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিবাদের মীমাংসা তাঁরাই করতেন। এ গ্রামে ক্ষেত্র কাপালি এমনই একজন। বিবাক মুগ্ধ নয়নে ক্ষেত্র কাপালির মেয়ের দিকে চেয়ে রইল। দুটি সুন্দর নিটোল বাহু। কী অপরূপ চুল! মেয়েটি নিচু হয়ে তাদের দুজনের জন্য স্বহস্তে ঠাঁই করে দিচ্ছিল।
গোপী বলল, প্রথমটা তো বিশ্বেসই হয়নি যে উনি হুমায়ুন বাদশা। ভাবলুম কে না কে! তারপর যখন জল থেকে টেনে তুললাম...
তুই নাকি যুদ্ধে যাচ্ছিলি? গেলে আর অক্ষত ফিরতে পারতিস?
কাপালি স্নেহপূর্ণ তিরস্কার করল। তোর ঘর বাড়ির খোঁজ নেই, দুই বিঘা ধানী জমি ছিল, তাও উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিস! ও সব শখ কি তোর মত লোকজনদের শোভা পায়?
বাদশা যদি গৌড়ে থাকতেন তো ঠিক আমি তেনার কাছে কদর আদায় করেই ছাড়তাম।
দূর হ! চাল নেই চুলো নেই! মুখের পানে চাইবার কেউ নেই! উনি চললেন বাদশাকে গান শোনাতে। ওরে গাধা নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। গৌড়ের রাজসিংহাসন টালমাটাল... এই অবসরে নিজের নিজের আখের নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হবে।
আজ্ঞে সে আপনি যাই-ই বলুন আমি কিন্তু বাদশার কাছ থেকে রাজকীয় খেলাত ঠিক আদায় করেই নেব, দেখে নেবেন!
আমি আর কী দেখব বলতো? নেহাৎ গ্রামের কোতয়ালীটা আমারই দায়ে... তা  নইলে... একটা কথা সব সময় মনে রাখবি তোর এখন বয়স অল্প। অর্থ উপার্জনের এইই সময়। এখন আলস্য ব্যসনে কাল কাটালে...
লণ্ঠনের নিভু আলো থেকে ঘরের ভেতরে প্রচুর ধুম জমা হচ্ছে ও তাতে চারদিকটা ঝাপসা মত অন্ধকার। গোপীর নাম নেই, বংশ মর্যদা নেই, চালচুলো  নেই... পারে শুধু গান গাইতে আর গানের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নাচ করতে। ক্ষেত্র কাপালি গম্ভীর হয়ে বলল, চেহারা নিয়ে কি তুই ধুয়ে জল খাবি? কেউ খেয়েছে কখনও? বাদশার দরবারে যাসনি তো আগে, তাই জানিস না। নইলে দেখতে পেতিস তোর মত গাইয়ে আর নাচুনের সেখানে অভাব নেই।

মাধবীকঙ্কন এ অবধি কোনও কথা বলেনি। আগাগোড়া চুপ করেই রয়েছে। ইতিমধ্যে মেঝেতে জল ছিটিয়ে দুজনের বসবার ঠাঁই করে দিয়েছে। ভিজানো চিঁড়ে, দধি, কর্পূর মিশ্রিত শীতল জল, ছেনা, সন্দেশ ইত্যাদি। ছোট ছোট দুটি কলার পাত পেড়ে একে একে সব সাজিয়ে রাখছে। বিবাকের মনে হল এই দূর পল্লি প্রান্তে সকল শ্যামলতা, সকল সরসতা শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনই পড়ে আছেএবং এই সৌন্দর্য্য খাঁটি বাংলার জিনিষ - বেহুলা লখিন্দরের গানে, ফুল্লরার বারোমাস্যায়, সুবচনীর ব্রতকথায়, বাংলার বৈষ্ণব কবিদের রাধিকার রূপ বর্ণনায়, পাড়া গাঁয়ের ছড়ায়, নানান উপকথায়, সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্পে... ভাগ্যিস সেদিনে শেষ পর্যন্ত বাদশার সঙ্গে বিবাক কাবুল চলে যায়নি!

(ক্রমশ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন