কীভাবে শত্রুতাকে প্রতিবন্ধী করেছি আমরা
যৌথতা এক নিরালম্ব নীলাঞ্জন। হাওয়ামোরগের মুখগুলো যখন ঘুরে
যায় আমাদের একা দিনের পিঠে, জাহাজের পালে লটকে থাকা মেঘ নেমে আসে বুকের কাছে।
আঙুলে আঙুল জড়ানো আলম্ব আয়োজন। চোখের ভেতর উত্তাল হয়ে ওঠে সবুজ জলের আভাস। আর
কাঁধের খুব কাছে শুনতে পাই একটি স্বর। আঙুলেরা কোনো বর্ণ বিভেদ মানে না। স্বরটিকে
তুলে নেয় যত্নে। হাতের পাতায় দেখি চোখ-না ফোটা ছোট্ট পাখিটা। অলীক পাখিরবের ভেতর
তোমার নিচুগ্রামের পলকা ছোঁয়া। পলকা থেকে কীভাবে যেন পালকের স্বপ্ন। আর স্বপ্ন
মাত্রই আরো একটি হাতের ছোঁয়া। আমি থেকে আউলে ওঠা আমরা হাত বাড়িয়ে দিই পাখিটার নরম
শরীরে। একটু মাটি একটু ভালোবাসা দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে তার চোখ। পাখিডাকা গান গোপনে
গোপনে। চোখে দিই নীল কাজলের ভাষা;
আমাদের যৌথতা। দুহাতে জড়িয়ে যায় আঙুলের নৈঃশব্দ্য। মৃতবৎসা যোনির সবুজ ফরাশে জেগে
ওঠে যৌথকবিতার মুখ।
জানুয়ারী ২০০৯। কলকাতার শীতার্ত সন্ধ্যা। তিলোত্তমার খসখসে
ত্বকের নিচে কোনো সংশ্লেষ নেই, রোদ্দুর চেনেনি ক্লোরোফিল। হলদেটে শীতঘুমে আচ্ছন্ন
নগরী। চিলেকোঠা ঝাঁপ ফেলা ন্যুব্জ সময়ের জমাট নাব্যতায় হঠাৎই ধরা পড়ল সফেন উষ্ণতার
তরঙ্গ। কৌরব অনলাইন এক মুঠো রোদ্দুর নিয়ে হাজির করল যৌথকবিতা কর্মশালা। ঝরাপাতার
মৌসুম বৃষ্টির সঙ্গমে জারিত করলেন কৌরবের বহুকবি। আর সেই কর্মযজ্ঞেই হাতে উঠে এল
কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ও প্যাট ক্লিফর্ড এর ‘চতুরাঙ্গিক/স্কোয়েয়ার্স’।
‘চতুরাঙ্গিক/স্কোয়েয়ার্স’ একটি যৌথ উদ্যোগ। আসুন, এই
অভিনব উদ্যোগের ইতিবৃত্তে একটু ঘুরে আসি। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় আমাদের দেশে
সর্বজনবিদিত, বাংলা ও ইংরিজি দু ভাষাতে সমান্তরাল ভারতীয় সাহিত্যের প্রতিনিধি,
পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে না। আমেরিকান প্যাট ক্লিফর্ড সিনসিনাটির গৃহহীন আবাসিকের
ডাইরেক্টর। এটা যদি তাঁর দিনের পরিচয়, তবে দিনান্তের পরিচয় হল তিনি কবি, ভাষা
কবিতার কবিতাকার। এই দুই কবির যৌথশালায় গড়ে উঠেছে ‘চতুরাঙ্গিক/স্কোয়েয়ার্স’। মানুষের
প্রতি গভীর আস্থা নিয়ে যাঁরা আজও মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাঁদের পৃথিবীর সরণও
সেইসব অন্ধ মানুষের অঙুলিহেলনে, যারা জীবনানন্দের সেই আঁধারের রূপকার-
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই,
করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া
[অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’/ জীবনানন্দ]
প্যাট ক্লিফর্ড যখন নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রতিপদে বাধা
অতিক্রম করতে করতে অন্ধকার থেকে হাতড়ে ফিরছেন আলোর সন্ধানে, সেই অন্ধকারের
প্রেক্ষাপটে আরো একটি মাত্রা যোগ করল সত্যজিৎ রায়ের “শতরঞ্জ কি খিলাড়ী” চলচিত্রটি। বাংলাভাষায় আকৃষ্ট আমেরিকান কবি
প্যাট ক্লিফর্ড যখন “Teach
Yourself Bengali” নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, তখন তাঁর কর্মজীবনের পাড়ে ভেঙে পড়া ঢেউগুলো ভিতরমহলে
একটু নিবিড়ে একটু গভীরে ডাক দিয়ে গেল।
শতরঞ্জে বিছানো ঘুঁটিগুলো, তাদের একপা চলন, সমান্তরাল বা কৌণিক চলনের বোধে কবির
চেতনার ঘরে দান ফেলল মানসী। সানাইবাদকের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে যে ইংরেজদের একদিন
আমন্ত্রণ করেছিলেন অবোধের রাজা ওয়াজেদ আলি শাহ, তাদেরই নির্মম নিয়ন্ত্রণের বলি
হলেন তিনি। আর সিনসিনাটির প্যাট ক্লিফর্ড কয়েক টুকরো আকাশ জুড়ে ছাদহীন মানুষের
জন্য গড়া এক টুকরো বাসার উচ্ছেদ সম্ভাবনার অভিমানে, মান থেকে কেড়ে নেওয়া সমস্ত হুঁশ
একত্র করে চোখের ভর আর চোখরাঙানিয়া ত্বরণের ব্যর্থ হিসেব ভেঙে দিতে দিতে এক অভিনব
যাত্রাপথে বেরিয়ে পড়লেন। একক যাত্রা নয়, যৌথযাপন। আর এই যৌথতায় প্যাট ক্লিফর্ডের
সঙ্গী হলেন আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। এক একটি ভাবনার পঞ্চমুখী সুড়ঙ্গে চলতে চলতে
যেটুকু প্রতিফলন চেতনের চৌকাঠে, সেখানে মুখর হয়ে উঠবে দুই কবির মৌন অনুভব।
সমান্তরাল চলনে যেমন আজ্ঞে জঁহাপনার অঙ্গীকার নেই, তেমনি দেহলীন আশ্লেষের তৃষ্ণা
নেই। অথচ এক নিঃশব্দ দেয়ানেয়ার খেলা চলবে দুটি ভিন্ন ভাষার অন্তরালে। এমনই এক
ছাঁচভাঙা সম্ভাবনার দিগন্তে ডানা মেললেন দুই কবি, যার চালচিত্রে রইল সত্যজিতের
চলচিত্র। “The making of Chaturangik/Squares”-এ প্যাট ক্লিফর্ডের ভাষায়-
I
immediately felt a sickening resonance between the political machinations at
work in nineteenth-century Lucknow and my own struggles. When we discussed
themes for our next collaborative project, that film quickly rose to the top of
the list
এইখানেই দেখি ‘চতুরাঙ্গিক/স্কোয়েয়ার্স’ কথাটির ব্যাখ্যা করেছেন প্যাট ক্লিফর্ড। কেমন সেই ব্যাখ্যা?
আসুন কবির ভাষাতেই পড়া যাক-
এবারে পাঠক, আপনার ঠোঁটের পেয়ালায় দুচুমুক চুক্তি। গ্রীন
টি-এর স্বাদ পাবেন না। অথচ শব্দমায়ার ফ্রি রাডিক্যালগুলোকে আপনি জারিত করবেন নিজের
মত করে। শব্দের অস্থির খোলে যেটুকু অর্থের মাখামাখি সেখান থেকে মুক্তি দেবেন ওই
খোলা আকাশে। যেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যেখানে সমুদ্রের প্রহরায় কোনো জেলখানা
নেই। তাই আসুন, কবিকৃত চতুরাঙ্গিকের ব্যাখ্যা মুলতুবি রেখে একটু অন্যভাবে তাকাই।
মাথায় রাখুন, শতরঞ্জ খেলায় ঘোড়া, গজ, নৌকা আর রাজা - এরাই প্রধান অঙ্গ। বাকিসব
অঙুলিহেলনের অপেক্ষায় উপেক্ষিত, সাধারণতন্ত্র। এবার চোখ বন্ধ করুন, বইটির পাতায়
পাতায় বিছানো শতরঞ্জে চতুরাঙ্গিকের চারটি অঙ্গ ঢেলে দিন। বন্ধ চোখের অন্ধকারেও
দেখুন কিছু মূর্তি কেমন বিমূর্ত, হাতপাহীন কবন্ধেরা নিঃশব্দে জায়গা বদল করছে। এবার
চোখ খুলুন। দেখুন, কেমন অনায়াস বিভঙ্গে ছক্কাহীন খেলার কম্পাস ঘুরছে ঘুরছে
ঘুরছে... আপনি জানেন পালাবার মাত্র চারটিই পথ অথচ দিশাহীন হতে না পারার যন্ত্রণায়
আকুল। ঘোড়া, গজ, নৌকা আর রাজা এই চারি অঙ্গের রূপে চারঅধ্যায় আমাদের হাত ধরে।
কোথাও কি পৌঁছে দিতে চায়? না বোধহয়। আর্যনীল বা প্যাট ক্লিফর্ড তো গন্তব্যের
প্রতিশ্রুতি দেন না। কারণ কোনো গন্তব্য নেই, এই পথচলাতেই আনন্দ। অবিরাম জলযুক্তির
মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সম্ভাবনার বাতিস্তম্ভগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান কবি। আর আমরা
অবাস্তবকে উপেক্ষা করে ছক্কাহীন সম্ভাব্যতায় বুঁদ হয়ে থাকি-
এতদূর এসেছি একটা খয়েরি
বাক্যের খোঁজে। কনট্র্যাস্টের
দোনলা বাঁচিয়ে। ফর্সা ভোর বা
ঘন রাত্তিরের পাশ কাটিয়েও
পায়ে যে গোলক ঠেকে তার
সাদা-কালো এড়ানো যায় না।
রোদের পাশেই ছায়া। বরফের
ওপর সীল। [নৌকা]
আমার মোনোলিঙ্গুয়াল চরিত্রের দোহাই মেনে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম শুধু
বাংলাটাই পড়ব বলে। কিন্তু অচিরেই ব্যর্থ হল সংকল্প। মনের গহনে লুকিয়ে থাকা
বাইলিঙ্গুয়াল চরিত্রের আকাঙ্ক্ষা আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল একেবারে গোড়ার অধ্যায় ‘ঘোড়া’র
প্রথম কবিতাটিতে-
how they have disabled rivalry
her suspension structured
timing small varieties of
“resistance”. a negotiation
sequence. realizing mobility
hangs on a thread. her
mechanical star retains
nothing
of the show. predicated habits
nice and neat. [Knight]
ওই “resistance” শব্দটায় প্রতিহত বিষাদকণারা আলোর সরলবর্গীয় চলনপথে প্রতিসরণের সূত্রাবলী
অমান্য করেনি। বরং অস্থির কর্ণিয়ার পিছনে ঝোলানো লেন্স পেরিয়ে রেটিনার নিস্তব্ধ
দেওয়ালে তৈরি করল উল্টো প্রতিবিম্ব। মস্তিষ্কের নিভৃতশালায় শারীরবৃত্তের জটিল
রসায়নে সেই প্রতিবিম্ব আবারও উল্টে যাওয়াই নিয়ম। কিন্তু নিয়মের পাটভাঙা চিহ্নসমূহ
মনের কোনো গহনে লুকিয়ে থাকে। নিভৃতে তৈরি করে এক আপোষহীন প্রতিরোধ, যে মানতে চায়
না বিজ্ঞানকেও। আর তাই বুঝি “resistance” শব্দের প্রতিবিম্ব সোজা হল না, স্থির হল না। দর্শনবিন্দুতে
সে হয়ে উঠল সুদর্শন। অবিরাম ঘূর্ণনের আবর্তে চেতনার অচেনা বিন্দুতে ধরা পড়ল এক
তীব্র সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স। চক্রের গতি উপেক্ষা করে নিতান্ত অবহেলে পর পর গেঁথে
গেল গান্ডীব শর। মীনাক্ষীর মুঠো খুলে কাপে তাপে রক্তচাপ; গুণ যেমন নীয়কের চাপ চাপ
ভূমিকায় পিছুতাড়া করে। আমি ছুটতে থাকি বিস্তীর্ণ কোলাহল থেকে উৎসের
কেন্দ্রবিন্দুতে। ছুটতে ছুটতে বিংশ ঊনবিংশ সংখ্যার বেড়াজাল, সময়ের অহেতুক দোলাচল পেরিয়ে পৌঁছে যাই এক শহর সময়ে।
ইতিহাসের গা খুলে ‘অবোধ’-এর বোধ থেকে উঠে আসা মহীরুহ যত শেকড় ছড়িয়েছিল সেই নবাবী
আমলের মহলে, বাজারে, আপেলকন্যায়, স্ফটিকে কিম্বদন্তী করা মামি করা এক শহর সময়ে-
কিভাবে শত্রুতাকে প্রতিবন্ধী করেছি
আমরা
তার ঝুলন্ত অবস্থা সারবন্দী দানা দানা
বিচিত্র প্রতিরোধের দান আসছে
একের পর এক চুক্তির ক্রমিকতা মেনে
আমাদের সচলতা সূতোয় ঝুলে আছে
ভেবে যান্ত্রিক তারাগুলো আমাদের
কিছুই ফেরায় নি
কি নিপুণ তার বিধেয় গুণ
[ঘোড়া]
এবারে পাঠক মণিবন্ধে কিছুটা সময় রেখে শতরঞ্জের সাদা কালো খোপের আরোহ অবরোহ
বেয়ে ইংরিজি ও বাংলা দুটো কবিতাতেই চোখ রাখুন, ঘুরেফিরে। একে অপরের অনুবাদ মনে হল?
মিল? হয়ত কোথাও আছে। ভাবনার যৌথকামিতায়। অথচ স্কোয়ারের চারটি দিকের নিপুণ সমতায়
তারা প্রতিহত হয়েছে। বারেবারে। মুক্তিকামিতায়। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে হাঁটাপথে পাড়ি
দিয়েছেন দুই কবি। জীবনের অসহ্য কারণেরা পায়ে পায়ে অকারণ সাগরবেলায়; নীলরঙ বন্দিশে
লোনা জল চুঁয়ে আসা অমিতসন্ধ্যারা মেতে উঠেছে তুমুল মিতাক্ষরে। যাপনের ডানায় ছড়িয়ে
থাকা কিছু সৌরভ আর চলমান ভালোবাসা চেতনার দরবারে যেটুকু মুখর, মুখ থেকে ঠিক সেটুকু
দূরত্বেই গড়ে ওঠে দুই খোপের দুটো লিপি। তাদের চলনে খুঁজে দেখুন, পেলেও পেতে পারেন
ঘোড়ার আড়াই পা।
our sweetest songs surely
rising up like abdication. I
expected to see one zodiac of
progress when I began to
think. witnesses occupy this
square, the word “si” is
written. So underpinned that
sweeping meant breaking.
when you finally reach the
eighth rank turn against
scrutiny. [Bishop]
মুরগীর লড়াই আর শতরঞ্জের খোপ খোপে বসা সাজানো রাজার লড়াই নিয়ে রাজনৈতিক
দ্বন্দ্বকে চলমান চিত্রের সম্ভারে উপহার দিয়েছিলেন সত্যজিত রায়, তাঁর “শতরঞ্জ কি খিলাড়ী”
চলচিত্রে। পিছনে ফেলে আসা অবোধ রাজ্যের এক মূক সময় কথা কয়ে ওঠে সিনেমার সেটে বসানো
লক্ষ্মৌ নগরীর পথে, রাজদরবারে, নবাবের তখ্তে। মির আর মির্জা সাহেবের চেকমেট এবং
ডালহৌসির চেরিপ্রিয়তা অবোধ সুলতান ওয়াজেদ আলি শাহকে শতরঞ্জ গুটিয়ে নিতে বাধ্য করে।
তখনও কিছু পায়রার ডানা আর স্বপ্ন নামানো ঘুড়ির রঙ লক্ষ্ণৌর আকাশে। রঙে ঢঙে নবাবী
ঐশ্বর্যের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অভিমান ধরা দেয়; আমাদের মধুরতম সংগীতও সিংহাসন ত্যাগ করে নজরদারীর বিরোধিতায়। তবু এই লুকোনো
খোলসের ভেতর কবি অনুভব করেন শিল্পের বন্ধন-
............... জন্মের বহুকাল
আগের খোলসে শিল্পের কি দমবন্ধ
লাগে? প্রেক্ষাগৃহে কি ধরা পড়ে
ছায়াছবির অস্বাচ্ছন্দ্য? [ঘোড়া]
যে কোনো ভাবনার কেন্দ্রে থাকে একটি বিষয়। প্যাট ক্লিফর্ডের “The making of Chaturangik/Squares” থেকে জানতে পারি সত্যজিত
রায়ের “শতরঞ্জ কি খিলাড়ী” চলচিত্রটি এই যৌথকবিতা প্রয়াসের ভাবনাকেন্দ্র। আপনি কি আধুনিক কবিতার পাঠক?
আপনি কি অপেক্ষা করে আছেন, কবিদ্বয় এই কেন্দ্রীয় বিষয়টি থেকে চেতনার পাড় ধরে
হাঁটতে হাঁটতে অবচেতনে, যন্ত্রণার ঘুঁটি চেলে অবক্ষয় থেকে কয়েক টুকরো দহন কুড়িয়ে
মেঘলা আঁচল বিছানো যে কোনো সর্বনামের অস্পষ্ট দোটানায় বিষয়ের তানানা বাজিয়ে আলো
থেকে ক্রমশঃ অন্ধকারের পাড়ে পৌঁছে দেবেন আপনাকে। কিন্তু উপায় নেই পাঠক। সাবজেক্ট
থেকে অবজেক্টের এই কেন্দ্রাভিগ চলনে নাস্তি এই কবিদের। বরং অবজেক্ট থেকে
সাবজেক্টের দিকে কেন্দ্রাতিগ চলন তাঁদের। আসুন একটা স্তবক পড়ি-
এক ছক্কাহীন সম্ভাব্যতা। আমার ভাজা মাছ
ওল্টানো তুমি দেখোনা। তোমারটার জাত
আলাদা। ছাল আলাদা। চোখ বড়। শুধু
মাছিগুলো দুজনেরই। নিয়ম জন্মায় দান দেবার
লয়-তাল থেকে। দূরের দেশটাই বড় লাগে।
দ্বীপ দেখলেই কাদের মনে জেলখানা আসে।
কি আসে যায় পুরুষের ওপর নারী নাকি সেই
নীচে! রাজার চোখে
জল না জলকষ্ট!
বিষ্ঠাভারী হ্রদের পাখির থেকে আমারা বাঁচাই
অমিলের পংক্তিগুলো [গজ]
শতরঞ্জের সাদাকালো খোপ খোপে Pawn মেপে হোরিখেলা হরণেও যেতে পারো যেটুকু যাওয়ার ছিল। যদি পারো সেও তো আমাদের এক
পা চলন, ঘুরে ফিরে সেই বাসী শতকে। অথচ মেইনল্যান্ড থেকে দু পা হাঁটলেই ছোট ছোট
বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলি আভ্যন্তরীন বিদ্যুতালোকে উজ্জ্বল। সমান্তরাল অস্তিত্ত্বে রহস্যময়ীর
ইতিবৃত্তে যে জটিল বন্ধন, প্লটের একাংশে সেই আড়াল সেই আবডালে রেণু রেণু জীবনের
তীব্র ঝলক। ঘুরে ফিরে কবিতার অবয়বে। যেখানে সেই আলখাল্লার জেব থেকে বেরিয়েছিল
মায়াবী সীমূম-
a wooden veneer drives the
plot. The pawn becomes a
queen. But a poem that
embodies a cloak reveals its
dagger. The book has no
sound at all. It baits us and
patiently wais until the
bayleaf saves the last silver
drop. Restless and stripped to
prepare for vaccination. [King]
আমার তৃষ্ণাগুলো আজও ভারতীয়, দাবা ও দাবির ভিতর এক পা-ই
হাঁটে সামনের খোলা পথে; ছড়ানো শত্রুতার জালে কখনও বা কোণিক, তবু এক পা-ই। ওই
পাখিডাক জানলাগুলো ক্রমান্বয়ে ভেসে আসে আমাদের ঘেরাটোপ দ্বীপে। আমার ধীর
গজেন্দ্রগমন পেরিয়ে যায় পাঁচ ছয় সাত... ঘুরে দাঁড়ানোর পালা ওই আট নম্বরে।
প্রতিবন্ধী শত্রুতাও যখন নজরদারী। কাঁপন লাগে তাসবাড়ির গায়ে, পায়ের তলায় পরতে পরতে
জড়িয়ে থাকে টেকটনিক প্লেট, অবিরাম পতঙ্গের স্রোত-
বিচ্ছিন্নতা এসেছিল ধীরে। গজগমন পায়ে।
ভেঙে পড়া তাসবাড়ির নীচে টেকটনিক
সৃপশরীর। ওপ্র দিয়ে অবিরাম স্রোত।
অ বি রা ম...বাড়ন্ত ব-দ্বীপ নয়, খাঁড়ি
নয়। আচমকা দালাল তুলে নিলে যা হয়,
পণ্য সম্পন্নতায় ঠেকে না, চপস্টিকের
প্রতীকী ফাঁক। লেফাফা খুলে এক দ্বীপ
ধরা পড়ে। তার মাঠ। ছাপাখানা। লাঙল-
দেওয়া ঘোড়া। তারই বিচ্ছিন্নতা। পর্দা।” [গজ]
পাঠক, আপনার ভাসামেঘ চোখের ওই রোদ্দুরে নেশায় ভর করে আমরা
পৌঁছে গেলাম চতুরাঙ্গিকের শেষ অঙ্গে। ‘রাজা’। যে রাজার সঙ্গে পাশাখেলা। যে
রাজত্বের মাঝবরাবর পাতা ছিল ছক্কা-পাঞ্জার এক নিবিড় দীর্ঘসূত্রতা। আসুন পাঠক,
আপনার সঙ্গে চুক্তির শেষ খেলাটায় এবার টেরাকোটা সাজাই। প্রথমে স্কোয়ারের সমান্তরাল
বাহুর অসহ্য সমতাগুলো দুটুকরো করুন। খেয়ালে রাখুন প্রতি দুটুকরো, দুটো অসমতার ভেতর
যেন বাতাস বুনে দেয়। প্রতিটি অসমতায় একটি পাখির ডাক। এবারে চোখ রাখুন ওই ওড়াআগল
স্কোয়ারের কেন্দ্রে, যেখানে দ্বিস্তর পালকের ওমে তুহিনও ডানা মেলল। সুতরাং, ওই যে
জলছল চৌকাঠে দরিয়া বসালেন, তার আসমানী সীমানায় সমস্ত টুকরোগুলো উড়িয়ে দিন এবার; ওই
যেখানে নীল, নীলিমায় বাসা বাঁধে-
কত্থকের দ্রুতির ভেতর পড়লে যা
হয়। ঘূর্ণনে পড়লে। আমাদের
চোখের ওপর পড়তে থাকে ফোঁটা।
রাজত্বের মতো। আমাকে না বেরতে
দিলে বিশৃঙ্খলাই চলবে। পরে অবশ্য
দর্শকেরা হাততালি দিতে শুরু করে।
ততক্ষণে তোমার জলছাপ পড়ে গেছে
আমার গোটা দিস্তায়। [রাজা]
অথচ এ খেলায় কোনো ছক্কা ছিল না। তবু কেন এই ভাগ্যবিধাতা?
কত্থকের দ্রুত লয়ে যেমন ঘূর্ণি ওঠে, তেমনি এই তীব্র প্রশ্নের ঘূর্ণন জেগে থাকে
বুকের মধ্যে। চেতনার ওইপারে যত নির্মিত মুখ
উঁকি দেয় বিমূর্ত অবয়বে, তাদের বিষণ্ণ
সুর অব্যয় হতে থাকে। শুধু জেগে থাকে অজস্র প্রশ্নের নামেলা উত্তর। রাজা ও
রাজত্বের প্রাতিষ্ঠানিক শাসন দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চায় মুক্তিকামিতায়। তাই বিষয় ও
বিষয় ঘিরে সমস্ত অলঙ্কার কবি বিসর্জন দেন, মাঝমাঠের সলিটারি ডিম ফেটে বেরিয়ে আসে
সদাবাহার নতুন লিখনভঙ্গি, যেখানে পুরোনো ঐতিহ্যের শাসন মানার দায় নেই, যেখানে আমরা
সবাই রাজা, যেখানে অন্তরা বাজছে ওই নীল সুরেলা গোধূলিতে-
tradition begins again. epilude
of a sunset blue. Hot tea with
sugar cream. A time it is as
titles
drool. a time of innocence.
retreating eloquence. Princely
Gold leaves of fallen trees.
We
Play a game of Kings and their
colonies. geometric muses. our
support cools without being
noticed. It is out of
proportion. [King]
শেষে এসে পাঠক, আসুন, এক্কেবারে পয়লা পাতায় ফিরি একবার।
কবিদ্বয়ের দেওয়া ভূমিকার দিগন্ত ছুঁয়ে স্কোয়ারের দ্বিমাত্রিক চলন থেকে
বহুমাত্রিকতায় পা রাখি। যেখানে চতুর্থ মাত্রাটি অহেতুক পিছু হাঁটে না বা নিঃসঙ্গ
বেহালাবাদকও পা ফেলে ঈশ্বরকণাদের সঙ্গে। নির্জন বিসর্গ নিয়ে নিবিড়ে সিরসির করে
শুয়োর পালকদের শহর-
কিভাবে এইসব চিঠিপত্র এসে পৌঁছল সে নাই বা বললাম। তীরচিহ্ন
ভর্তি এক ঘরে দুই কমিশনার। কর্সিকান দত্তক ভাই হবার তাড়নায়। কূটনীতিক যে, দোলচিতে
লেখে। প্রশাসন লেখে কোমল গান্ধারে। “গোলাপের সুস্বাস্থ্যের জন্য হাড়ের গুরুত্বের কথা মনে আছে?” মনে পড়ে? ফুলের পাপড়ির শুশ্রূষা ছাড়া আয়ুর্বেদ?” একজন আমেচার বেহালা-বাদক। অন্যজন তার তবলচি। এই মুহূর্তে
ঘরভাগ করে রয়েছে এই শুয়োরপালকদের শহরে
কি বিভ্রান্তিকর আচরণে তাঁরা বাঁধা! ভাবি এক বাক্স, মৌচাক ও
ঝুড়িভর্তি রচনার কথা। সংযোগী অব্যয় পরিবেশন করা হয়েছে কচ্ছপের মাংশের মতো।
অবিশ্বাস্য অতীতের এক সরাইখানায়
দুই কমিশনার আবার ফিরে যাচ্ছে সমাজে। সমাজভাবনায়। পরিণত
মানুষটা ঐ বৈকালিক কেল্লার টোপ ছেড়ে দেন। তাদের যুগ শেষ। সায়ামীজ যমজদের এবার
ছাড়ানোর পালা।
যে
কবিদের যৌথশালায় আমার এই ফিরে দেখা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
প্যাট ক্লিফর্ড
প্যাট ক্লিফর্ড এক স্বাধীন সাহিত্য স্কলার। ওহিওর সিনিসিনাটিতে
এক গৃহহীনদের আশ্রয়স্থলের কোওর্ডিনেটার। তাঁর রচিত চ্যাপবুকগুলো A story by fair: Rules for Radicals (২০০৬),
Ring of Honor (২০০৭), চতুরাঙ্গিক/SQUARES(২০০৯).
তাঁর কবিতা ও গদ্য বহু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত যেমন Boog City, Hundreds,
Streetvibes, Black Robert, Jacket, Helix, Sunday Indian, CyPress Magazine
ইত্যাদি। তিনি কবিতাপাঠ SUNY, Buffalo, Bangla Academy in Kolkata, India and in
workshops in San Francisco and Kolkata. ২০০৭ সালে নারোপা সামার রাইটিং প্রোগ্রামে Asylum এর পাঁচমিনিট সংস্করণটি পারফর্ম করেন।
দ্বিভাষিক
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক ও তত্ত্বাবধায়ক। পেশা – কারিগরি গণিত। কৌরব পত্রিকা, কৌরব অনলাইন ও
The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৮টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে
স্মৃতিলেখা (২০১২), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯), late
night correspondence (2008) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার
রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই, অসংখ্য দ্বিভাষিক অনুবাদ। তাঁর ইংরেজী ও ইস্পানি
কবিতা সংকলিত হয়েছে –The Harper-Collins Book of Indian Poetry in English (2011),
La Pared de Agua, a Spanish anthology of contemporary Bengali poetry (Olifante
Press, Madrid 2011), Indivisible: An Anthology of South Asian American Poetry
(University of Arkansas Press, 2010), The Literary Review Indian Poetry (New
Jersey: Fairleigh Dickinson University, 2009)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন