বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

রঞ্জনা ব্যানার্জী




নয়নতারা


সকাল ছ’টায় আসতো নয়নতারা, রাত ন’টায় ফিরতো বাড়ি বেশ দূরে, তাও রিক্সাভাড়া নিতো না।

প্রবাদ আছে টাকা ছড়ালে বাঘের দুধ মেলে, কিন্তু টাকার টোপ দেখিয়েও দীর্ঘদিন আমাদের পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী শাশুড়িমায়ের জন্যে একজন দক্ষ সেবিকা পাইনি। আমাদের ঘরকন্নার সহকারী ছোটখাটো সবিতারানি এই কাজের যোগ্য ছিলো না।   নয়নতারাকে পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছিলাম আমরা। এ কাজে দক্ষ কিন্তু যখন তাকাতো মনে হ’ত যেন ভেতর খুলে দেখছে। কথা বলতো কম কিন্তু হেঁয়ালিতে  ভরা, ঠিক বাড়ির ঝিয়ের মত কথা নয়। প্রথমদিন ওকে কাজ বোঝাতে গেলে বললো, আহা এত যত্ন করে বাঁচা কেবল মরবার জন্যে! নয়নতারা কেন চলে গিয়েছিল আমরা জানি না। তবে ও সেইদিন টাকাগুলো দেখেছিল

সুবীর পনেরো লাখ টাকা বোঝাই ব্যাগটার বান্ডিল গুনতে বলে, ওয়াশরুমে ঢুকেছিল। এবারকার প্রজেক্টে ভালো উপরি পাচ্ছিলো। পুরো টাকা একসঙ্গে ব্যাংকে রাখার ঝুঁকি অনেক। আমি বিছানার ওপরে বান্ডিলগুলো বিছিয়ে গুনছিলাম। বেখেয়ালে দরোজা আঁটকাইনি। আবছা টোকা পড়েছিল হয়তো বা, খেয়াল করিনি। ‘মাসিমার পেট নরম হয়েছে কাঁচাকলা লাগবে।’ চমকে উঠেছিলাম। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা; না পারছি আড়াল করতে, না পারছি উঠতে। আমার চোখে চোখ রেখে ও বললো, ‘যার যা ন্যায্য তার বেশি নেওয়া মানা’আমি নিজেকে সামলে কড়া গলায় ধমকালাম, ‘তুমি যাও আমি আসছি’চোখের পলকে বেরিয়ে গেলো। আমি কাঁচকলার ব্যবস্থা করে শাশুড়িমার ঘরে গিয়েছিলাম। নয়নতারা ওঁর পায়ে তেল মালিশ করছিলকেমন আছে জানতে চাইলে মুখ না তুলেই বলেছিল, ‘ওঁর সময় হয়েছে’আমি শাশুড়িমা’র গায়ে হাত রাখলাম। উনি চোখ মেলে তাকালেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘খারাপ লাগছে?’ উনি মাথা নাড়লেন। আমি নয়নতারাকে  জিজ্ঞেস করলাম, ‘সময় হয়েছে মানে কী?’  
ও উত্তর দেয়নি
সেই দিন নয়নতারা ন’টা বাজবার আগেই চলে গিয়েছিল।

পরদিন আর আসেনি। আটমাসের রুটিন ফের এলোমেলো। অফিস গেলাম না। দুপুরের দিকে শাশুড়িমায়ের প্রচণ্ড পেট ব্যথা। ডাক্তার এসেছিলেন। বললেন, আগের দিনের কাঁচকলায় শরীর কষেছে।
বিকেলের দিকে ফের ভালো বোধ করছিলেন। সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুজো করছিল রিমি। হঠাৎ বললো, দিদিভাই মা’লক্ষ্মীকে কেমন অদ্ভুত লাগছে না?    
-কেমন?
-ভালো করে দেখো!  
মূর্তির দিকে তাকিয়ে শিউড়ে উঠলাম। সেই ভেতর ফালা করা দৃষ্টি! মুখে বললাম, নাহ্‌।  

পুজো শেষে রিমি শাশুড়িমা’র মাথায় ফুল ছোঁয়াতে গিয়েছিল। উনি তখন চলে গেছেন। চিৎকার করে কাঁদছিল রিমি। আর আমার কানে বাজছিল, এত যত্ন করে বাঁচা কেবল মরবার জন্যে!
শ্রাদ্ধশান্তি শেষে রিমিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লক্ষ্মীর মূর্তিতে কী দেখেছিলি সেদিন? ও এড়িয়ে গেলো। 

নয়নতারার দেওয়া ঠিকানায় গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। আশ্চর্য! ঐ ঠিকানায় নয়নতারা নামের কেউ ছিলো না কোনোদিন। এটা একটা ফার্ণিচারের দোকানের ঠিকানা। মালিক জানালেন ১৯৮২ সাল থেকেই তিনি এই জায়গায়। নয়নতারার ছবি দেখেও চিনলেন না।
পনের লাখ টাকা আলমারিতে শাড়ির ভাঁজে গুছিয়েছিলাম সেই সেদিন। আলমারির খুললেই মনে হয় হাড়-মাস খুলে দেখছে কেউ। বলছে, ন্যায্যের বাইরে নেওয়া মানা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন