বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৮৬)


রংপুরের গান কি দিনাজপুরের গানের সঙ্গে জায়গা বদল করছে। না কি দিনাজপুরের গান পথ হারিয়ে ঢুকেই পড়ে রংপুরের গানের গহীনে। গানের এই জায়গাবদল নিয়ে ভাবতে বসলেই গানের মোহনমায়া ঘিরে ধরে। গান তো জায়গা বদল করতেই পারে। জায়গা বদলালে স্থান কালও বদলাতে পারে। তবে কি রংপুরের গানের বর্ণময়তায় লিপ্ত হতে পারে দিনাজপুরের গান। গান তো কেবলমাত্র গানই থাকে না, বিশেষত লোকগান; গানের কথা সুর বাজনার খুব অন্তরপ্রদেশ থেকে কেবল উঠে আসতে থাকে অন্তহীন সব মানুষেরা। মানুষ তো কেবলমাত্র মানুষই নয় যে তার দেশকাল হাটগঞ্জ আমোদপ্রমোদ জীবনযাপনের খুঁটিনাটি ভাষাবিন্যাস লোকাচার বাঁচবার প্রকৌশল সব সমস্ত সহই তুমুল জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। গানের ভিতর দিয়ে সে তার আঞ্চলিকতাকে যথার্থই চূড়ান্ত আঞ্চলিক করে তোলে। তাই রংপুরের গানের প্রবাহে প্রবাহিত হতে হতে রংপুর তার মানবজীবনের পানসি ভাসায় দিনাজপুরের ঘাটে। আবার অঞ্চলকথা নিয়ে দিনাজপুরও মিশে যায় রংপুরে। এই চলাচলটুকু ভ্রান্তির সীমা পরিসীমায় ধাক্কা খেতে খেতে রংপুরের গানের ভেতরকার গাড়িয়ালভাই ও গরুর গাড়ির চাকার যান্ত্রিক শব্দের চাপান উতোর নিয়ে দিনাজপুরের দিকে, দিনাজপুরের গানের দিকে যেন আশ্চর্য এক বাওকুমটা বাতাস হয়ে ঘুরে ঘুরে মরে। রংপুরের গানটি হাহাকার ছড়িয়ে দেবে দিনাজপুরের গানের পল অনুপলে।




(৮৭)


জায়গাবদল কিংবা স্থানবদলের প্রেক্ষিত স্পর্শযোগ্য এক কালখন্ডের ধাক্কায়, ধাঁধায়, ধরাছোঁয়ার অনির্নেয় কোন নিরপেক্ষতায় আশ্রয় খুঁজে পেতে চাইলেও গানের সুর তাল দিয়ে আমরা তো আদতে গানটিকেই ছুঁতে পাবার চেষ্টা করবো। রংপুরের গানের নিজস্বতায় কখন যেন আলগোছে দিনাজপুরিয়া গানের মাত্রা ও লয় এসে আছড়ে পড়বে সেই সামান্য মরমীয়া জীবনযাপন কিংবা দর্শনাশ্রিত যাপনের গাম্ভীর্যতায় কবেকার হারিয়ে যাওয়া চিলমারীর বন্দর তুষভান্ডারের বড়হাট দিনাজপুরের জমিদারের ধানগোলা গরুচুমানী গানের আসর বাঁশিয়ালের সুরের আবহে ভিনদেশী কোন মেজাজই বা এনে দিতে পারে। জীবনের গূঢ় কোন  রহস্যময়তাই এক্ষেত্রে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে যা অপেক্ষাকৃত দার্শনিক হয়ে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় কখন যেন গলাগলি হাঁসের মতো হাসির মতো দিনাজপুরের  গান ভেঙে, গড়িয়ে নামে রংপুরীয়া গানের গোলকে।




(৮৮)


উড়ে যাওয়া মেঘের নীচে মেঘেদের জটজটিলতায় সে কি শুনতে পায় কবেকার বাঘের ডাক। আদিঅন্তহীন জলজঙ্গলের ভিতর দিয়ে বহুধাব্যপ্ত নিসর্গের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো সেই সব বাঘেদের অস্ত্বিত্ব-অনস্ত্বিজাত ডাকগুলিও কেমন আত্মগত হয়ে ওঠে। সে তো ইতিমধ্যেই দেখেও ফেলে বিষ্মরণফেরত বাঘেদের নিঃসঙ্গ হেঁটে যাওয়া। দূরাগত বাঘের ডাক দিয়ে আস্ত এক বাঘভান্ডারই বুঝি নির্মিত হয়ে যায়। বাঘেদের ডোরাকাটা শরীরে দুপুররৌদ্র রৌদ্রপ্লাবনের গাম্ভীর্যকে অসামান্য  এক উজ্জ্বলতায় পৌঁছেই দেয় এমত ধারণাজাত কোলাহলে অরণ্যভূমের শাল জারুল শিমুল বৃক্ষরাজির সন্নাসীসুলভ মগ্নতায় বাঘেদের চোখে বারবার লেপ্টে যেতে থাকে জীবনমরণের এক ঘোর। মেঘের নিচে আলো ও অন্ধকারের যৌথতায় সংলাপবহুল কোন নাট্যকাব্যই যেন সমগ্রের চিরকুটবাহিত অংশ হয়ে একসময় সমগ্রতাকেই লজ্জিত করে ফেলতে থাকে। বাঘের থাবার নিচে ব্যাঘ্রশাবকের নিশ্চিন্ত নিদ্রার দৃশ্য নদী জল নিসর্গের ধারাবাহিকতায় অমোঘ এক ছায়াদৃশ্যই রচনা করে ফেলে যার বৈধতার বাধ্যবাধকতায় অকালবর্ষণের এক পৃথিবীর জাগরণ পরবর্তী সহজতায় মাইল মাইল হাওয়াসমুদ্রের প্রচলিত লোকাচার লোকনাচের বিরহকালীন বিপন্নতায় কেবলই থিতু হয়, থিতু হতে থাকে। ঝোপঝাড়ে, ঝোরা নালা নদীর বহুবর্ণিল প্রবাহের গহনপ্রদেশে ডুবে যেতে যেতে লুপ্ত সময়পট থেকে বাঘের অতিবৃহৎ তর্জন গর্জন সমেত ফিরে ফিরে আসতে থাকে আর আকাশজোড়া পাখিদের উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটিকে সংহত হতে দেবার অবকাশটুকুও না দিতে চেয়ে ধারাবাহিক জেগে ওঠে ভেসে ওঠে কেবলই বাঘের ডাক।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন