বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




ধারাবাহিক উপন্যাস



প্রিয়দর্শিনী 




(সপ্তম অধ্যায়)   
   

(১৬)           

কলার  মান্দাসে একা ভাসি, রাই...
মোগল দরবারে প্রথম দিন এসে একটুও ঘাবড়ায় নি বিবাক। হুমায়ুন বাদশার সঙ্গে ইতিপূর্ব্বেই তার মোলাকাত হয়ে গেছিল সেই সেবারে মাঝ গঙ্গা থেকে তাঁকে যখন বাঁচিয়েছিল বিবাক, যার পর নাই খুশী হয়েছিলেন তিনি। তখুনি বিবাককে শাহী দলের সঙ্গী করে নিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন এরপর তিনি নাকি এখান থেকেই সোজা কাবুল যাবেন কনৌজ ও চৌসার যুদ্ধে হার হয়েছে বটে কিন্তু খুব শিগ্গিরি নতুন সেনাবাহিনী যোগাড় করে শক্তিশালী দল গড়ে শের শাহর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। কারণ যার তার হাতে তো হিন্দুস্থানকে ছেড়ে দেওয়া যায় না! ( হিন্দুস্থান - এই শব্দটা সেদিনই বিবাক প্রথম শোনে) শুনে হুমায়ুন বাদশার সঙ্গে কাবুল যেতে প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল বিবাকের। কেমন দেশ কাবুল একবার স্বচক্ষে দেখবে। কিন্তু বাধ সাধল গোপী যে গোপী প্রত্যেক কথায় হাসির ফোয়ারা ছোটায়, বিবাক তাকে ছেড়ে শাহী দলের সঙ্গে সুদূর কাবুল চলে যাবে জানতে পারার পর থেকেই কেমন গুম মেরে গেল। হাসি উধাও, চোখে অবিশ্বাস আর মুখে কোনক্রমে বলল, ‘আপনি মজিল আর লঙ্কা মজাইল’। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত।  তুই যে সম্রাটের সঙ্গে কাবুল যাবি বলছিস, শামসের খঞ্জর চালাতে জানিস? ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতে পারবি? গরু ঘোড়া বকরী ইত্যাদি খানা খেয়ে হজম করতে পারবি? মন চাইলেও চট করে বাংলা দেশে ফিরে আসতে পারবি না! হিন্দুস্থানি গান শুনে দুই কান ঝালাপালা হবে, বাংলায় কথা কওয়ার লোক পাবি না। এসব যদি সহ্য করতে পারিস তো বাদশার সঙ্গে যা!’
বিবাক চুপ। এত কিছু সমস্যা তার মাথাতেই আসেনি। গোপী আবার বলল, সম্রাট আজকাল আর কান দিয়ে দেখছেন না বুঝলি? দেখলে আজ তাঁকে গঙ্গায় ডুবে মরতে হত না।
বিবাক বলল, তোমার এই হেঁয়ালিটা বুঝতে পারলাম না।
বুঝে কাজ নেই আর! অনেক হয়েছে, এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চলো।

তারা পানসি করে গৌড়ের দিকে ফিরছিল। হুমায়ুন বাদশা সদলবলে ঘোড়াঘাটের দিকে রওনা দিয়েছেন। অবশ্য তাঁর দলবল বলতে মুষ্টিমেয় ক’য়েক জন সৈন্য, যাদের পরনের শতচ্ছিন্ন পোষাকটি ছাড়া সঙ্গে আর কিচ্ছু নেই। বিবাক নিঃশব্দে  চেয়েছিল সেই দিকে। কাবুল দেশ এখান থেকে কত দূর কে জানে! এখনও বিবাক নিঃশব্দেই চেয়ে রয়েছিল দেখে হুমায়ুন বললেন, তোমার উপর আল্লার রহমত বর্ষিত হোক! বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ্! যুদ্ধ বিগ্রহ শেষ হলে তোমাকে কাছে টেনে নেব’!

বাদশা আজ অকাতরে খেতাব বিলোচ্ছেন। আমীর ওমরাহ থেকে শুরু করে ভিস্তিঅলা পর্যন্ত সবাই ইচ্ছে মত উপহার কামনা করছে, আর সঙ্গে সঙ্গে বাদশা তা দিয়েও দিচ্ছেন। কারণ দিল্লী আগ্রার প্রতি বাদশা বাবুরের অত টান ছিল না, যতটা ছিল সমরখন্দ ফরগনার প্রতি। কিন্তু হুমায়ুনের কথা আলাদা। জিহন নদী থেকে সুদূর হিন্দুস্থান পর্যন্ত তাঁর ক্ষমতা পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত। খুশীতে ভরপুর সম্রাট বিবাকের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। দিল্লী শহরের হেন কোনও স্থান নেই যে সে চষে বেড়ায়নি। কিন্তু বৃথাই হয়েছে সেই ঘুরে বেড়ানো। গোপী বেপাত্তা। কোথায় যে হারিয়ে গেল... মোগল দরবারে আজ কাণায় কাণায় প্রজাদের ভিড়। বাদশা আজ সব্বাইকে দর্শন দিচ্ছেন। গোপী তাকে বলেছিল, দিল্লীর সম্রাট বাংলাদেশকে  চিরকালই মান্য করে এসেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। কেন জানিস? কথাটার মানে তখন বোঝেনি বিবাক। আজ বুঝল। যখন দেখল দিল্লীর সুপ্রসিদ্ধ লৌহস্তম্ভ যে বাঙ্গালী কর্মকারের অদ্ভূত নৈপূণ্য দেখানোর জন্য দন্ডায়মান সেই শিল্পীরই যোগ্য উত্তরাধিকারীদের সহস্তে তৈরী জনার্দন, জন্মেজয়, দল-মাদল, বিশ্বম্ভর জাহান্ কোষা, কালে খাঁ ফতে খাঁ প্রভৃতি কামান যেন বাংলাদেশরই সংস্কৃতির প্রতীক। রাজ দরবারে বাঙ্গালী শিল্পীর কদর থাকবে। গোপী নৃত্য শিল্পী। অথচ গৌড়ের রাজসভায় সংগীতের কদর নেই। হুমায়ুন বাদশা ‘রেওয়াজ’ বৃক্ষের ফুল দেখতে যাবেন বলে একদিন পুরো মোগল দরবারকে তাঁবু সুদ্ধ অন্যত্র উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ বৃক্ষে নাকি সচরাচর ফুল ধরে না, সুতরাং সেই ফুল দর্শন করে বাদশা অত্যন্ত খুশী হয়ে সমরখন্দ থেকে একদল গাইয়ে এনে সারারাত সংগীত শ্রবণ করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, সেই ফুলের নামে পুরো একটি শহরও  স্থাপন করেছিলেন।

বিবাক বলেছিল, চলো আমরা দুজনেই কাবুল যাই।
নাহ্! তোর আমার মত মানুষদের জন্য এই বাংলাদেশই উপযুক্ত। এখানে নিজের ভাষায় কথা ক’য়ে যে আরাম, তা আর কোথ্থাও নেই।  
তবে যে তুমি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করবে বলে এতগুলো দিন ধরে পথে পথে শুধুই ঘুরে বেড়িয়েছো সে কী জন্য?
হুম! ঘুরেছিলাম তো! কিন্তু এখন সেসব বদলে গেছে। সম্রাটের কাছে আর আমার কোনও দরকার নেই।
কেন?
সম্রাট আর কান দিয়ে দেখতে পান না, তাই!

এখন এই উন্মুক্ত মোগল দরবারে দাঁড়িয়ে বিবাকের সেই কথাটিই মনে পড়ল।  মনে হল রাজ সিংহাসনে চড়ে বসলে চোখ কান নাক সব কেমন বদলে যায় সেটা একবার চাক্ষুস করা দরকার। বাদশা হুমায়ুন আজ সবাইকে খেতাব দিচ্ছেন, পুরস্কার বিলোচ্ছেন, উদার হস্তে দান খয়রাত করছেন। বিবাকের পালা এল যখন, ডাইনে বাঁয়ে আর কিচ্ছু না দেখে সম্রাটের কাছে সটান বাদশাহী তখতটাই সোজা চেয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে বাদশাও তা মঞ্জুর করে দিলেন।

পূর্ণ দুই দিন হুমায়ুন দরবারে এলেন না। আমীর অমাত্যরা সম্রাটের এ হেন বাছপনায় বিরক্ত ও ক্রোধান্বিত কিন্তু বাদশার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারুর নেই। দিনের বেলা বিবাক হিন্দুস্থান শাসন করে, সন্ধ্যে থেকে নাচ গানের  মেহফিলে বসে পেস্তা বাদাম দেওয়া শরবৎ পান করে। এবং শরবৎ পান চলা কালীন বারংবার নিজের দুই কানে হাত দিয়ে দেখে সেগুলি কেমন রয়েছে।
তার মনে ছিল না মাধ্বী তাকে বলেছিল, তোমার কানে আমার নাম কে প্রথম...

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন