ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(ষষ্ঠ অধ্যায়)
(১৫)
শ্রীমন্ত
অতি নিবিষ্ট মনে তার মাষ্টারমশায়ের কাছে পাঠ নিচ্ছে। এ বিষয়ে সে অতি মাত্রায় সজাগ।
তার গুরুভক্তি ও পাঠে একনিষ্ঠ মনোভাবই তাকে মুকুন্দরামের কাছে স্নেহভাজন করে
তুলেছে। মনোযোগ সহকারে নিত্য পাঠ অভ্যাস করার সুফল এই যে তা উত্তরোত্তর ছাত্রের
মানসিক উত্তরণ ঘটায়। মুকুন্দরামের পূর্ব্বোক্ত ব্যাখাটি শেষ হওয়া মাত্রই শ্রীমন্তর মনে পুনরায়
যে প্রশ্নটির উদ্ভব হল, তৎক্ষণাৎ সেটি সে মাষ্টারমশায়কে জিজ্ঞাসাও করে ফেলল - কোন সময়ে বঙ্গের নাম বাঙ্গালা হয় মাষ্টারমশায়, একটু বুঝিয়ে বলুন!
মুকুন্দরাম
উত্তর দিল, ঠিক কোন সময়ে বঙ্গের নাম বাঙ্গালা হয় তা নিশ্চই ক’রে বলা যায় না।
বঙ্গদেশ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রর জলে প্লাবিত হত। উচ্চ বাঁধ বা আলি দিয়ে অধিবাসীরা
কোনওক্রমে জল প্লাবন থেকে নিজেদের বাসস্থান রক্ষা করত, তজ্জন্য বঙ্গ-আলি বা আল
থেকে বাঙ্গালা বা বঙ্গালা নাম সৃষ্ট। তবে মুসলমান আক্রমণের পূর্ব্বে বাঙ্গালা নাম বিদ্যমান ছিল একথা নিশ্চই ক’রে বলা যায়। কারণ
দাক্ষিণাত্যের চোল বংশীয় বিখ্যাত সম্রাট রাজেন্দ্র চোল বঙ্গ জয় করেছিলেন এবং তিরু মালয়ের শিলালিপিতে তার বিবরণ উৎকীর্ণ আছে। উক্ত লিপি মুসুলমান আক্রমণের পূর্ব্বেই উৎকীর্ণ।
বাংলাদেশের
আকৃতি তখন কিরূপ ছিল মাষ্টারমশাই?
বৎস
একটা কথা সব সময় খেয়াল রাখবে বঙ্গের নদী মাত্রকেই গাঙ্ বলা হয়। আবার গঙ্গা উহার
শাখা প্রশাখা সহ বঙ্গভূমির উপর দিয়েই প্রবাহিত। সুতরাং তৎসমুদায় নদ নদী কতৃক আনীত
মৃত্তিকা দ্বারা সম্পূর্ণ বঙ্গদেশ গঠিত। বাংলা দেশের নিম্নভূমি কতিপয় দ্বীপের
সমষ্টি মাত্র। সুবর্ণগ্রাম রামপাল বিক্রমপুর সাভার ও ঢাকা সমস্তই বঙ্গদেশের
প্রাথমিক জনপদ। প্রায় সাড়ে চার হাজার বৎসর পূর্ব্বে সমুদয় বঙ্গ সমুদ্র গর্ভে
নিমগ্ন ছিল। বর্ত্তমান যশোর ফরিদপুর বাখরগঞ্জ নোয়াখালি ইত্যাদি সমস্তই কতিপয়
দ্বীপের সমষ্টি মাত্র। টলেমী গঙ্গার যে পাঁচটি শাখার উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল - যমুনা ইচ্ছামতী মধুমতী মেঘনাদ (টলেমীর ভাষায় ‘ম্যাগনাম’) ও পদ্মা। পদ্মা বা
পদ্মাবতীর নাম সর্বপ্রথম ব্রহ্মান্ড পুরাণে দৃষ্ট হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত ও দেবী ভাগবতে পদ্মাকে স্বতন্ত্র নদী
বলা হয়েছে। কৌশিকী নদীর জলস্রোত প্রবলবেগে গঙ্গার সহিত একত্র হওয়ায় পদ্মা প্রবল
হয়ে ওঠে। তখন উহার উপর দিকের প্রবাহ ক্রমে
ক্ষীণ হয়ে যায়।
কিন্তু কথা কি জান, হিন্দুরা চিরকালই ভাগীরথীকে পবিত্র নদীরূপে বিবেচনা করে এসেছে।
পদ্মাকে নয়।
তবে
কি ঐ সময় বঙ্গদেশে বাঙালী বসবাস করত মাষ্টারমশায়?
না,
ঐ সময় চন্ডাল জাতীয় লোক এই সমস্ত অনূপ দেশে বাস করত। এই প্রদেশ তখন অশ্বরথ বিচরণ
যোগ্য ছিল না। ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আগত শত্রুকে বাধা দিতে হলে নৌ-সাধন ভিন্ন
অন্য উপায় ছিল না। দিল্লীর লৌহ স্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে যে গুপ্ত বংশীয় মহারাজ দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধার্থ বঙ্গবাসীকে পরাজিত করেন। এর কিছু বৎসর পর মহারাজ সমুদ্র
গুপ্তর শাসনাধীনে সমতট ও ডবাক রাজ্য গঠিত হয়। ডবাক-ই আজকের ঢাকা প্রদেশ।
শ্রীমন্ত
অত্যন্ত মনোযোগ পূর্ব্বক তার মাষ্টারমশায়ের কথা আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করছে। তার
মন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নিমগ্ন। কিছুক্ষণ পর বালোকোচিত কৌতুহলের সঙ্গে প্রশ্ন করল - আচ্ছা মাষ্টারমশায় আপনি যে বলছেন আর্যজাতি
পূর্ব্বে বঙ্গদেশের অধিবাসীদের অনার্য বলে মনে করত এতে বঙ্গজগণ অপমানিত বোধ করত
না?
নিশ্চই
অপমানিত বোধ করত। তবে ইতিহাস পুরাণাদিতে সেকথার বিস্তারিত উল্লেখ নেই। লোকে বলে, পান্ডবেরা মেঘনা নদীর পূর্বস্থ দেশের অবস্থা
পরিজ্ঞানার্থ ভীমসেনকে প্রেরণ করেছিলেন। ভীম মেঘনার পরপারে পদার্পণ করেই
ভ্রাতৃচতুষ্টয়কে গালি পাড়তে শুরু করলেন। বুঝলে শ্রীমন্ত, তদবোধি মেঘনার
পূর্ব্ব্স্থিত দেশ পান্ডববর্জিত নামে খ্যাত এবং বর্ত্তমানে এটি একটি প্রবাদ বাক্যে
রূপান্তরিত...।
এসব
কিছু বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা। মুকুন্দরামকে এখন
আর ছাত্র পড়াতে হয় না। কারণ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে শ্রীমন্ত বর্ত্তমানে সমুদ্র পথে
বাণিজ্যে গিয়েছে। তার বয়ঃক্রম সতের বৎসর। সে অত্যন্ত ধীর স্থির ও বুদ্ধিমান।
উপরন্তু নিত্য নতুন জীবন উল্লাসে তার অদম্য আকর্ষণ। দেশীয় লোকেরা সমুদ্রযাত্রাকে কিছু ভয়ের চোখে
দেখে। কলিতে সমুদ্রযাত্রা নিষেধ -
প্রথমে ব্রাহ্মণের পক্ষে, শেষে অসাধ্য হওয়ায় সকল বাঙ্গালীর পক্ষেই ঘটেছিল। চাঁদ
সওদাগরের উপাখ্যান এ যুগে আবার নতুন করে লেখার কোনও মানেই হয় না। শ্রীমন্তর শিক্ষা
ব্যবস্থায় বৈদ্যক জ্যোতিষ পাঠও দেওয়া হয়েছে।
মুকুন্দরাম মনে মনে ঠিক করল শ্রীমন্তর সমু্দ্র যাত্রা নিয়েই অন্য কিছু
লিখবে, নাম দেবে ধনপতি শ্রীমন্তর কাহিনী।
গভীর
চিন্তায় মগ্ন থাকলেও মুকুন্দরাম খেয়াল করল রাত ক্রমে গভীর হচ্ছে। গৃহপ্রাচীরের সন্নিহিত আম্রকাননে দুই একটি প্যাঁচা
কর্কশ শব্দে চীৎকার করে উঠল। দূরবর্তী অরণ্য থেকে বিভিন্ন নিশাচর প্রাণীদের ডাক
শোনা যায়। নিকটে পাকশালে আলো জ্বলছে ও
প্রচুর ধূম নির্গত হচ্ছে। এর অর্থ মুকুন্দপত্নী রাতের আহারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত। ভুর্জপত্রে মুকুন্দরাম লিখল
বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া
বেশম পিটালী
ঘন কাঠি।
ঘৃতে সন্তোলিল তথি,
হিঙ্গু জীরা দিয়া মেথি
শুক্তা
রন্ধন পরিপাটী।
পূর্ব্বে
এক জায়গায় খুব অধিক সময় মুকন্দরাম তিষ্ঠোতে পারত না। দামুন্যা গ্রামের দিনগুলো মনে
করলে আজও তার মস্তিষ্ক শুদ্ধ হয়ে ওঠে। বৈকালের ছায়াঘন নিভৃত মাঠঘাটে, রত্না নদীর
ধারে খেয়াল খুশীমত বিবাক আর মুকুন্দরাম ভ্রমণ করে বেড়াত। গৃহকর্ম অভ্যাসরত মা এজন্য তাকে কত ভৎসর্না করতেন। কত সকাল দুপুর সন্ধ্যে বিবাককে সঙ্গে নিয়ে মুকুন্দরাম
দিনভর টইটই করেছে। বিবাক - এই নামটা মুকুন্দের জীবন থেকে কবেই মুছে গেছে! নদী, নদী কিনারে মাঠে দুই দোসর মিলে তাই রে নাই
রে না - এখন ইতিহাস! সেসব দিনে এক
জায়গায় স্থির থাকলেই মনে হত কে যেন তার নিঃশ্বাস
প্রশ্বাসকে আটকে রেখেছে। আর এখন? একরত্তি এই কুশাসনটির ওপরে বসেই
মুকুন্দরাম যাবৎ ইতিহাসবেত্তা হয়ে ওঠে। চর্মচক্ষে মুল শিকড় সমেত ঘাসের মত কয়েক
হাজার বছরের অতীত ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরপর দেখতে পায়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এখন
একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
রাত্রিতে
আহারাদি সম্পন্ন করে মুকুন্দরাম পুনরায় নিজ কুশাসনটিতে এসে বসল। এইভাবে রোজ সে
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। বিশ্রাম চলাকালীন মনে মনে ভেবে নেয় আগামীকল্য সে কী কী
লিখবে। জমিদার বাঁকুড়া রায় রোজই তাকে প্রশ্ন করেন, “আজ কদ্দুর লেখা এগোলো কবি? কবে
শোনাবে আমাদের? তোমার কাব্যরস গ্রহণ
করব বলে অধীর অপেক্ষায় দিন গুনছি যে...”
বাঁকুড়া
রায় প্রাচীন দক্ষিণ রাঢ়ীয় বংশ। গ্রাম মধ্যে তাঁর সুরম্য প্রাসাদ। মহলটি মৃত্তিকা ও এক জাতীয় চূনমিশ্রিত লেপ দ্বারা প্রস্তুত।
মহলের চারিদিকে সুউচ্চ মাটির
প্রাচীর। এদেশে এরূপ মৃত্তিকা প্রাচীরকে ‘জাঙ্গাল’ বলে। মুকুন্দরামের গৃহটিও অনুরূপ জাঙ্গাল দিয়ে ঘেরা। কুশাসনে উপবিষ্ট
মুকুন্দরাম এখন সেইদিকেই নিবিষ্টমনে চেয়ে রয়েছে। কবি লেখকদের ভিড়ে মুকুন্দরাম একটু আড়ষ্ট বোধ করে। এটা তার বরাবরের অভ্যাস। গায়ে পড়ে
বিশেষ কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশা করে, ভালো মন্দ মিশিয়ে দুটো খেজুরে আলাপ করবে
এও তার স্বভাব বিরুদ্ধ। বাঁকুড়া
রায় বললেন, সংকলনের জন্য শ্রেষ্ঠ লেখার আহ্বান জানানো হচ্ছে, শব্দ সংখ্যা লেখকের
খুশীমতো। মুকুন্দরাম চুপ। কিছু বলে না। বাঁকুড়া রায় আবার
উচ্চারণ করলেন, এমন কিছু লেখো যাতে
বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু সংযোজন হয়। শব্দগুলো ভেবে চিন্তে নির্বাচন ক’রো। পড়লে
যেন মনে হয় ছবিটা অসমাপ্ত।
শিল্প
সাহিত্য নিয়ে মুকুন্দরামের বেশি লেখাপড়া নেই। লিখতে বসলে কী লিখবে ভেবে পায় না। সারাদিন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাই তোলা। অক্ষররা ছুটে
বেড়ায়। কানে বাজে ফেলে আসা গ্রামের মোরগের ডাক। চর্যাপদের কবিতাগুলো ভাল লাগে না।
শ্রীমন্ত একবার শুধিয়েছিল, চর্যাপদের কবিদের ভাষা অমন কেন মাষ্টারমশায়?
তখন
তো বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রচলন। সমতট বজ্রযোগিনী সুবর্ণগ্রাম যোগিডিহা ইত্যাদি
স্থানে প্রচুর বৌদ্ধ সংঘারাম। যতসব খেতে না পাওয়া গরীব ঊণপাঁজুরে লোকজনেরা এই সময়ে
ভীষণ কষ্টে দিনাতিপাত করত। ব্রাহ্মণরা নীচু জাতের মানুষদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে
দেখত। সংঘারামের বৌদ্ধ আচার্য্যরা সাধারণ মানুষের এইসব দুঃখকষ্ট নিয়েই কবিতা লিখত।
কবিতার মধ্যে নিজেদের সাধন ভজনের পদ্ধতির কিছু কিছু মিশেলও রাখত। হাড়িপা কালুপা
গোরখনাথ মীননাথ প্রভৃতি বৌদ্ধাচার্য্যগণের কবিতার ভাষা এতই দুর্বোধ্য যে ওটাকে সন্ধ্যাভাষা
নামেও অভিহিত করা যায়। গোবিন্দচন্দ্র যে সময়ে বাংলাদেশে রাজত্ব করতেন, ঠিক তখনই
সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে রাজা রাজেন্দ্র চোল এসে এ দেশ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে গোবিন্দচন্দ্রের পরাজয় হয়। গোবিন্দচন্দ্র আনুমানিক ১০০৫ থেকে ১০৩৯ খৃঃ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। সে সময়
প্রজারা কড়িতে রাজস্ব দিত। ডোম জাতীয় হাড়িপা রাজা গোবিন্দচন্দ্রের গুরু ছিলেন।
চর্যাপদের
ভাষা কি সেই জন্যই অত দুর্বোধ্য মাষ্টারমশায়?
হ্যাঁ।
বেদপন্থীদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধপন্থীরা সমাজের সব স্তরকে মান্যতা দান করতে চাইছিল।
এক কথায় তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল খুবই মহৎ। এবং কবিতার ভাষাও তাই ব্যঞ্জনাময় ও সুন্দর।
ছাত্রকে
উৎসাহ প্রদান শিক্ষকের প্রধান কর্ত্তব্য, কিন্তু সমাজের ভবিষৎ নাগরিককে কীভাবে সমাজের ভুল ভ্রান্তিগুলি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা যায় সে উপায় মুকুন্দরামের জানা ছিল না। সহর বাজারে অনেক প্রতারক, তাদের আচরণ আসলের
মতই। কাজেই ‘বেণে বড় দুষ্ট শীল, নামেতে মুরারী শীল’, যে পাওনাদার দেখলেই গা ঢাকা দেয়, বা লোক ঠকিয়ে
বেসাতি করে এমন মানুষ আকছার নজরে আসে। কিন্তু মুকুন্দরামের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তার
শিক্ষা বৃথা বিফলকর্মা হয়নি। অজয় ও ভাগীরথীর তীরে স্থাপিত অনেক স্থান শ্রীমন্ত ইতিপূর্ব্বেই
সনাক্ত ক’রে ফেলেছে। এবং তারপর
শিলে
সানায়ে বাঁশী পাটি চাঁচে রাশি রাশি
নানা ফুলে বিচিত্র কলস,
পিতা
পুত্রে দোঁহে আটি গজালে পরায় পাটি
গড়ে ডিঙা দেখিতে রূপস।
রাঢ়ীয়
মিস্ত্রী দিয়ে মধুকর প্রস্তুত করিয়ে শ্রীমন্ত ভ্রমরা গাঙ্ দিয়ে তার যাত্রা শুরু
করল। পুত্র গর্বে বাঁকুড়া রায় আনন্দেই রয়েছেন। সুতরাং শ্রীমন্ত বাণিজ্য করে না
ফেরা ইস্তক বাঁকুড়া রায়ের হাতে সেরূপ কোনও কাজ নেই, ইত্যবসরে তিনি মুকুন্দরামের
কাব্যখানি পাঠ করতে চান।
বাঁকুড়া
রায়ের সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে। এই লোকটাও লেখে। কিন্তু লেখার আগে লোকটা একটা ভীষণ
গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নিয়েছে। খুব হেসে টেসে বিনয় সহকারে রায় মহাশয়কে দন্ডবৎ করে
তারপর সঙ্গে আনা পুঁথি খুলে গড়গড় করে নিজের লেখা পড়তে শুরু করে দিয়েছে।
বাঁকুড়া
রায় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর লোকটাকে বললেন, তোমার লেখাটার পাঁচশোটা কপি
বানাও। একটা কপি টেলিভিশনের মেগা সিরিয়ালে যাবে, বাকি কপিগুলো আমার সামনের
ইলেকশনের সময় কাজে লাগাবো।
মুকুন্দরামের
মাথাতেই আসেনি লেখার সঙ্গে ব্যবসার একটা দারুণ টানটান সম্পর্ক আছে। প্রপার
মার্কেটিং না পেলে অনেক ভালো সৃষ্টি অকালে জনারণ্যে হারিয়ে যায়।
জালিয়াৎ
লোকটা প্রতিরাতে একটা ক’রে লেখা নামায় আর সকাল হলেই বাঁকুড়া রায়কে শুনিয়ে আসে। রায়
মহাশয় মন দিয়ে সবটা শোনেন তারপর হুকুম দেন এবার অন্য দলের খারাপ খারাপ দিকগুলো
নিয়ে লেখো। ওরা বলেছে আমরা নাকি গত ইলেকশনে প্রচুর জালিয়াতি করেছি, রিগিং হয়েছে।
একটু খোঁজ নাও তো মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে একটা জন সমাবেশ গড়ে তোলার জন্য ওরা ঠিক
কবে থেকে ‘জেলভরো’ আন্দোলনটা শুরু করছে!
তারপর
মুকুন্দরামের দিকে ফিরে আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন, বাপু তুমি তো সারা জীবনই হামা
টেনে গেলে। শুধু তাড়া খাওয়া আর ভয়। শিরদাঁড়া সোজা ক’রে কাউকে ভয় দেখাতে পারলে না!
মুকুন্দরাম বলল, আমার অস্তিত্বটা ঠিক কোনখানে বুঝতে পারি না। যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষায় লিখতে পারি না। আগে যেখানে উর্দ্ধতন চোদ্দ পুরুষের বাস ছিল, শেয়াল
কুকুরেরা তিষ্ঠোতে দিল না! “প্রজা
হইল ব্যাকুলি, বেচে ঘরের কুড়ালি / টাকার দ্রব্য বেচে দশ আনা।। / সহায় শ্রীমন্ত খাঁ, চন্ডীবাটী যার গাঁ, যুক্তি কৈলা মুনিব খাঁর সনে। / দামিন্যা ছাড়িয়া যাই, সঙ্গে রমানাথ ভাই, / পথে চন্ডী
দিলা দরশনে”।।
শেয়াল কুকুরদের ব্যাপারটা না হয়
বোঝা গেল কিন্তু ভাষাটার কেন গন্ডোগোল হচ্ছে?
বিড়বিড় করে মুকুন্দরাম বলল, লা ইল্লাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা..., কেন? কি? কোথায়? কবে?
এর অর্থ?
আজ্ঞে
ওটাই সমস্যা! কোন ভাষায় লিখব বুঝতে পারি না। লিখিয়েদের এক নায়কতন্ত্র চালু হলে খুশী হই। বাংলা ভাষার অতীত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভবিষৎও
অন্ধকার।
তাই দ্বন্দ্বে পড়েছি আমার সত্যিকারের ভাষা
কোনটা?
বাঁকুড়া
রায় হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেছেন। সভায় যারা উপস্থিত ছিল, সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
লোক মুখে শোনা গেছে গৌড়ে নাকি মোগল বাদশার হার হয়েছে। তিনি নাকি আফগান শাসক শের খানের কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে সুদূর
কাবুলে পলায়ন করেছেন। কাবুল দেশটা ঠিক কোথায় কারু জানা আছে?
রাত্তির ঘন হলে মুকুন্দরামের
কলম জীবন্ত হয়ে উঠতে চায়। তখন তার মনে নিরাকার ভাষা সাকার হয়ে ওঠে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এখন গভীর নিদ্রামগ্ন। শুধু নিশাচর পশু
পাখিদের নিঃশব্দ চলাফেরা। কুশাসনে
বসে মুকুন্দরাম এক মনে ভুর্জপত্রের ওপরে লিখতে শুরু করল। এবং লিখতে বসেই প্রথমে
তার যা মনে হল, লেখ্য ভাষার জন্য প্রাচীনতম লিপি ছিল ‘খরোষ্ঠী’ লিপি ও ‘ব্রাহ্মী
লিপি’। সময়ের দিক দিয়ে এরপর ‘অশোক লিপি’ ও ‘গুপ্ত লিপি’র
উদ্ভব। খরোষ্ঠীতে ডান দিক থেকে বাঁদিকে অক্ষর লেখার চল ছিল। কিন্তু অন্যান্য
অনুশাশনগুলিতে বাম থেকে ডান দিকে সাধারণ ভাবে অক্ষর লেখা হত। অশোক লিপি পরে পরিবর্ত্তিত হয়ে গুপ্ত সম্রাটগণের সময়ে
‘গুপ্ত লিপিতে পরিবর্ত্তিত হয়। আবার কালক্রমে গুপ্ত লিপি থেকেই ‘সারদা’ ‘শ্রীহর্ষ’ ‘কুটিল’ ইত্যাদি অক্ষরমালা
সৃষ্টিলাভ করে। শ্রীহর্ষ দেবনাগরী বর্ণমালার পূর্ব্বপুরুষ। মুকুন্দরাম বাংলা ভাষায়
অ্যাড লিখবে। অ্যাডটা কিসের হবে তা পূর্ব্ব পরিকল্পিত। সেবারে দামুন্যা থেকে
পালিয়ে আসার সময় পথে একটা গাছতলায় গভীর ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটা স্বপ্ন দেখেছিল ঘুমিয়ে
ঘুমিয়ে। অনাহার একরাশ দুশ্চিন্তা আত্মীয় বিয়োগ ইত্যাদির শোকের মধ্যেও স্বপ্ন মরে
নি। এবং যে স্বপ্ন ছিল তার আবাল্যের সঙ্গী। সেই স্বপ্নেরই একটা অ্যাড তৈরী করবে
মুকুন্দরাম। বাঁকুড়া রায় সেই কথাটাই আবার উল্লেখ করলেন। বললেন, আমি তোমাকে দিয়ে
আমার একটা কাজের অ্যাড বানাতে চাই’।
কী কাজ?
খুবই সাধারণ একটা কাজ। এখন যারা ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে
আলটিমেটলি তারা যখন একদম তলানিতে এসে ঠেকবে, বুঝতে হবে তুমি নিজের কাজে সার্থক।
মুকুন্দরাম বলল, এত বড় কাজের
অভিজ্ঞতা আমার নেই।
সে নাই থাকতে পারে। পারিশ্রমিকে
পুষিয়ে দেব।
আমি কিছুই জানি না। লেখা শুরু
করার আগে কী লিখতে হয়, কত ইনফরমেশন লাগে...,
হোর্ডিংও লাগাতে হতে পারে!
বাঁকুড়া রায় বললেন, তোমার কোনও
চিন্তা নেই। সব আমার দলের লোকেরা করবে। পার্টির হোল টাইমার হয়ে কাজ করছো জানলে
এমনিই তোমার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।
খুশী
হয়েছিলেন বাঁকুড়া রায়। লোকটাকে তাতানো
গেছে।
বললেন, টাকা পয়সার কথা ভেবো না। সব পুষিয়ে দেব। তুমি শুরু করে দাও। বাংলা ভাষা
নিয়ে অত মাথা খারাপ কোরো না।
লোকজন ওসব নিয়ে অত ভাবে না। যেটা জরুরী তা হল, লোকে পড়বা মাত্রই যেন চট্ ক’রে
বুঝতে পারে...
হুমায়ুন বললেন, আমরা যখন ছোট
থাকি ভাবি আমাদের নিজস্ব গন্ডীর কোনও সীমা নেই। জীবন মানে তো কিছু সময়ের জন্য
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস। শেষকালে সবই গলে যাবে।
বিবাক ভাবে ঐ সব ভেবে কার কী হয়েছে? দুদিনের রাজা, ক্ষমতার শীর্ষে, পরনে দামী
পোষাক, কব্জিতে হীরে বসানো বাহু বলয়,
অথচ মুখে বুলি জীবন মানে নাকি পন্ডশ্রম! এই ফালতু যুক্তি একদম ভাল লাগে না।
কুর্সি মানেই সামনে খুশীর বন্যা আর পশ্চাতে গুপ্ত উৎকোচ, দিনের আলোয় সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা রক্ত গোঙানি...
হুমায়ুন বললেন, এই কুর্সি জিনিষটা মোটেই সুবিধের না। একবার চড়ে বসলেই বোঝা যায় আগুনের তাপে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছি।
সে তো হবেই! সারা দেশ দেখছে,
দেখছে কুর্সির মধ্যে দেশপ্রেম নেই। যা আছে
তা হল লোভ। আর আকণ্ঠ ক্ষিদে।
হুমায়ুন বললেন, নিজের নিজের
রিয়েলিটি শো’তে সবাই স্টার। সাধারণ মানুষ যেদিন এটা বুঝবে, জানতে হবে দেশ সেদিন থেকে
সাবালক হয়েছে।
বিবাক
বলল, কুর্সিটা আপনি ছেড়ে দিন। আমি একবার
চড়ে দেখি!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন