শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস




অর্জুন


বাঁহাতি বোলার অর্জুন মাস্টার এখন আর মাঠে নামেন না।
পাশাপাশি দুটো গ্রাম।
মাঝে পলাশপুর মাঠ। 
এগ্রামের পাখি উড়ে যায় ওগ্রামে।
ফাল্গুন মাসের প্রথম পাতার ডগায় ফুলের কলি ফুঠলে, মাস্টার আঙুল উঁচু করে লাল-লাল বলে  উঠলেন।

হাত ভেঙে গেলো তীরন্দাজ-এর। 
 চুরচুর হাড়ের ডিস্কের আকৃতি ধারণ করলো ভারতের জাতীয় দলের অন্য প্লেয়ার।

এগ্রামের সব পাখি ওগ্রামে উড়ে গেলো।
বিহগ-এর বিসর্গে-এর দুটো ডানায় চেপে 'সখা' চলে গেলো অন্য অরণ্যে। 

মহাভারতের এপর্বে খোলাপাতার ওপরে নেমে এলেন বজ্রসেন। ঘোড়ার জিন দিয়ে  লিখলেন-
         
মাননীয়,  
যদি বিশ্বাস না হয় দেখবেন চলুন।
অর্জুন মন্ডলের দন্ডকারণ্যের একাকী বয়ে চলা শান্ত নদীর জলে এখন রাজা দুর্যোধন তার রাজপাটপর্বে নকল কেল্লার মাথার ওপরে একটা গাছ লাগিয়েছেন। দুঃশাসনের দম্ভের বারোমনি একবিঘের একফসলী ধানের চাল গণতন্ত্রের উৎসবের দু'-টাকিয়া এজেন্ডা! ইত্ববসরে বসন্তের ফেরিওয়ালার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী  গ্রীষ্মতলের কর্কটক্রান্তিরেখায় বসে একদিন অবিকল পলাশ হয়ে ওঠার মহড়ায় নেমেছে। 

      
চোখ যতদূর যায়
  
গাছের মত অবিকল নিঃসঙ্গ হয়ে গেছি। এই যে শেকড়ের চলন, যতদূর বনবাদাড়, ততদূর চেয়ে চেয়ে দেখা! চোখ যতদূর যায়! সে এক অন্যলোকের ওপরে আলোকসম্পাত। সেখানে বাবা ছিলেন। আঙুলে আঙুল জরানো বাঘের ভয়ের থেকে বেড়িয়ে আসার সাহস ছিলো। পাথর হয়ে আছে সেসব দিনকাল। কামরাঙাগাছের ওপারে সন্ধ্যা নেমে এলে গোরুর গোয়াল থেকে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ব্রম্মদৈত্যির পৈতার মত মহাপঞ্চমীর চাঁদ বারান্দার একপাশে এসে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়তো গরীবপুকুরের জলে।
এই দ্যাখ কাস্তে। এই দ্যাখ নিড়ানি। এসব কৃষিকাজের জিনিস। বড় হয়ে গিয়েছি কবেই। ফেলে আসা গৃহস্থালি থেকে বেরিয়ে আসছে ছানাপোনাসহ ফুটন্ত চাঁদ। জলের ওপরে মায়ার মত মা! যেন এক নিঃসঙ্গ তারা।  একা একাই আলো ফেলে গাছের ওপরে। গাছ কি আলো পায়? পায়নি কোনোদিন মা-এর তারা হয়ে ওঠা ফুটন্ত আলো! বাবার আঙুলের ভালোবাসা এখন স্টুডিওর দেওয়ালে বড় করে টাঙানো আছে।
ছবিগুলো এমনই! গাছের ওপরে পৃথিবীর রূপটান রোদ, এটুকুকে ভর করে একটি এবং কয়েকটি মানুষ চাষ করে। কারখানার ভেঁপু বাজায় আর হারমনিয়ামে গলা সেধে প্রমান করে যে, সে আছে। অনন্ত বিশ্বব্রম্মান্ডে হেমন্তের গান যেন গাঙচিল! গাছের শরীর থেকে অন্য এক জলের ওপরে নিঃসঙ্গতায় উড়ুক্কু ডানার ছবি। ডিসকভারি চ্যানেলের পাতায় পাতায় অভিমানী বাতাসের হু হু তান্ডবের দোলায় গাছ যখন কেঁদে ওঠে, কারও সাধ্যি নেই, সে কান্না থামানোর।  


ও যে মানে না মানা
  
কতদিনের সম্পর্ক। ভুলিনি জনাব। আপনার নির্দেশে শহর ছাড়িয়ে যে কোনো কথা বলা জীবনের শব্দ বাইসাইকেলে চেপে পরিব্রাজক হতো। তোতা, ময়নার দল ঝাঁক বেঁধে হেমন্তকালের ধানের ওপরে পালক ঝরিয়ে অতীতকে এক শালখুঁটির সাথে বেঁধে চলে যেত অন্য কোনো জলার ধারের উন্মুক্ত জলসায়। সারারাত গান ও বাজনা! সারারাত মেঘের ডাকের পাশে পাখিদের ভালোবাসার তরণী ভাসতো বিলের জলে!
ভুলিনি জনাব। জঙ্গল ছাড়িয়ে নলবন! তবুও তারই মাঝে একা একা তালগাছে বাবুই-এর বাসায় জোনাকির আলো! এসব সম্পর্কে আপনি আমার কাছে এসে বসেন মাঝে মাঝেই। দুজনের গল্পকথায় চরিত্রের প্রতিটি অংশে ভালোমন্দ, ইত্যাদি, নানাবিধ বিষয় নিয়ে কথা বলি আমরা।
সামনে এক নদী, নৌকো, মাঝি...   
প্রকৃতির সাথে বসবাস। বসবাসরত যত পাখি, যত গাছপালা, ওরা সব একদিন মানুষ ছিলো। বাসস্থানের ধোঁয়ায় জমির হলুদ ধান ভাত হয়ে বসন্তবাহার হয়ে যেতো। এরপর পাথরের দিনকালে মানুষ পাথর বুকে চেপে স্থিরচিত্রের মত গাছ হয়ে গেলে গাছের নীড়ে পাখিদের জলসায় বসন্তবাহার ফুল ফোটাতে ভুলে গেলো।
অরণ্যে যাইনি জনাব, বহুদিন! কী করে যাবো? শেকড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাটির গভীরে  যেখানে আদিম পলল মৃত্তিকা! সেখানে আঁটকে গেছি আমি। তবুও জনাব, জানি এটুকুই, পথের শেষ তো নেই! যেখানে রাস্তা ফুরিয়ে যায়, সেখানেই আরও এক রাস্তা এসে খুলে দেয় গোপন খিড়কি দুয়ার।
জনাব, এবার ভাবছি, অন্য এক উপবনে শেকড় ছড়াতে ছড়াতে চলে যাবো আমি। সম্পর্ক তো এমনই! ভাঙলেও ও যে মানে, মানা...                                                                                           


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন