লঞ্চের গল্প
আমি আগের জন্মে ঝড় ছিলাম। এই বলে তুমি নদীর জলে আস্তে করে
হাত বুলিয়ে দিলে। পাতাঝাঁঝির ওপর দিয়ে হালকা ঢেউ বয়ে গেল। সেদিকে না তাকিয়ে
হাসতে শুরু করলাম, মানুষ জন্মান্তরে পোকা পাখি কেঁচো বাঘ সিংহ এই সব হয়। তাই বলে
ঝড়!
কথায় কথায় এমন হাসলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না। আগে
হাসি শেষ করো, তারপরে আমার সাথে কথা বলবে। আমার মুখে হাসিটা লেগে থাকে। সরি বাবা, বলো। ঝড় না হবার কী আছে শুনি? কেঁচোর মতো না মরে সবকিছু উড়িয়ে
সরিয়ে নিয়ে যাওয়া!
পাতাঝাঁঝির পাতায় বসে থাকা শামুকটা জলের এই হালকা ঢেউয়ে
দুলতে থাকে। ঠিক। ঝড় হওয়াই তোমাকে মানায়।
এখন যেমন আমাকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছ।
যাঃ। তুমি খুব শান্ত। আমি বুঝতে পারি কে ঝড় আর কে পাতাঝাঁঝির
শামুক, এই বলে শামুকটাকে আঁজলা করে তোলার মতো ভঙ্গিতে দুটো হাত আমার বুকের ওপর হাত
রাখল। উচ্ছল
হয়ে বললে, শামুক দেখলে আমার খুব আদর করতে ইচ্ছে করে। কেমন স্থির চলা ফেরা। গম্ভীর,
নির্বিকার!
নিজের লাবডুব নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেতরটা ঘূর্ণি হয়ে
উঠছে। তুমি যদি আগের জন্মে ঝড় হয়ে থাকে এই জন্মেই বা কম কি!
কিছু একটা বলতে হয় তাই বললাম, তবে কি আমি গতজন্মে শামুক
ছিলাম?
তোমার চোখে একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল, শামুক না, গত জন্মে
তুমি ছিলে চাঁদ। আমার দ্বিতীয়ার চাঁদ।
আর সামনের ল্যাম্পপোস্টের এল ই ডি আলোটা হঠাৎ করে দ্বিতীয়ার
চাঁদের মতোই জ্বলে উঠলো। পাশে দড়ি বেঁধে রাখা অর্ধেক ডাঙার ওপর ছোট পরিত্যক্ত
লঞ্চটা চকচক করে উঠল। ঘাট ছেড়ে নড়ার ইচ্ছে কখনও তার হয়েছিল কিনা বোঝা যায় না। আলোটা
তার নিঃসঙ্গতা কিছুক্ষণ ভুলিয়ে দেয়। মনে হল শামুক হলেও মন্দ হতো না।
আমি একটা হাত আলতো রাখলাম তোমার কাঁধে। তুমি এগিয়ে এলে। একটা
ঝড়ের মতো।
কত সময় গড়িয়ে গেছে নদীর জলের ওপর দিয়ে। আমাদের ওপর দিয়ে।
এখন ঝড় উঠলে মনে পড়ে লঞ্চটার কথা। দড়িতে পচন ধরে গেছে। আরও হেলে গেছে একপাশে। একা।
তাকিয়ে থাকি নিজের দিকে। কোনোদিন তলিয়ে গেলে তুমি খবরই পাবে না।
গতজন্মের কথা মনে পড়ে না। মনে হয় এজন্মে আমি ঐ লঞ্চটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন