ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(পঞ্চম অধ্যায়)
(১৩)
পাথরের খাড়া দেওয়াল, মশাল গোঁজা
সেখানে, তার যত না আলো, ধূম নির্গত হচ্ছে অনেক বেশি। লম্বা লম্বা পা ফেলে উর্ধশ্বাসে সেখান দিয়েই দৌড়ে
যাচ্ছেন হুমায়ুন। তাঁর বাঁ হাতে হামিদাবানু বেগম। এভাবে নাঙ্গা পায়ে পথ চলতে কোনও
দিন সে অভ্যস্ত নয়। পাথরের হিম শীতল মেঝে, মাঝে মধ্যে কোথাও কোথাও এবড়ো খেবড়ো ঢিপ।
উত্তেজনায় তার হৃৎপিন্ড দ্রুত ওঠা নামা করছে। ইনশা আল্লাহ্! আপনাকে রজাবন্দি করবার হুকুম্ আছে জাঁহাপনা! - আপাদমস্তক
কালো কাপড়ের পোষাক পরা পাঠান সেনাপতিটির দুই চক্ষু রক্ত জবার মত লাল। হাতে উদ্যত
তারকাশ।
বৎস মির্জা হোসাইন তুমি আমার
পুত্র সম। আমি তোমাকেই আমার পক্ষ হয়ে সাইহোয়ানের এই দুর্গ রক্ষার ভার দিয়েছিলাম।
কিন্তু... নফর চাকরদের কুপরামর্শে এ তুমি কী শুরু করেছো? এমন দুর্ব্যবহার তোমার পক্ষে অনুচিত!
হাঃ হাঃ হাঃ! জাঁহাপনা আপনি
নেহাৎই...
ছিঃ! একটা কথা মনে রেখো, সেই নফর কিন্তু কোনও দিনই তোমার বন্ধু হবে না...
কিন্তু হুমায়ুনের আদেশে এবং
উপদেশে মির্জা হোসেইনের কোনও ভাবান্তরই হল না। শেরশাহ গোপনে কখন যে তাকে হুমায়ুনের
বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেছে! হামিদা নির্বাক। নিস্তব্ধ। দুর্ব্বল শরীর নিয়ে এত উত্তেজনা সে সইছে কী করে?... এবার কি সে বেঁহুশ হয়ে যাবে? পায়ের নীচে হিম শীতল পাথর, কোনও কোনও
স্থান তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মির্জা হোসাইন বাদশাকে প্রায় বন্দি করে ফেলেছে।
হামিদার নসীবে আজ কী লেখা আছে কা জানে! খিলানের অপর
পার থেকে হ্রেষাধ্বনি ভেসে এল, তরবারির ঠোকাঠুকির শব্দ - ছনাৎ ছনন্!
শেষাবধি বাদশা বললেন, বেশ তো এ
দুর্গ আমি এখনই ছেড়ে দিচ্ছি। রাজা মলদেবের আশ্রয়ে চলে যাব, আমার এ মুহূর্তে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মানসিকতা নেই...,
নিঃশব্দে হামিদা শুনে চলেছে বাদশার কাতর অনুনয়। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে কোথ্থেকে এক
উজবেগ বান্দা বেরিয়ে এল, রক্তাক্ত শরীর তার এবং দুর্বোধ্য গ্রাম্য ভাষায় চেঁচিয়ে
বলে উঠল - আলা হুজুর তাড়াতাড়ি কেটে
পড়ুন! কারণ আমি আপনাকে পরে বলব। কোনও কিছু বলার এখন সময় নেই...
এদিকে বাইরে তখন ঝিরঝির করে
মিহি তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে তীব্র হিমেল বাতাস। খাজা মোয়াজ্জেম নামে আর এক
প্রভুভক্ত অনুচর বাদশা সমীপে হাজির। খাজার ডান হাতে উদ্যত শামসের। হোসাইন মির্জা
চোখ ছোট করে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, আফিমখোর হুমায়ুন বাদশা তার সভাসদদের দিয়ে
কোনও দিনই ‘খোৎবা’ পাঠ করাতে পারবেন না...
শূন্যে তারকাশ শামসেরের ঝনঝনি নেচে উঠল। যুদ্ধ! যুদ্ধ! আজ তোর রক্ষে নেই...
মোগল শাহজাদাদের মির্জা নামে
ডাকা হয়। এটাই রেওয়াজ। মির্জা যখন অনেকগুলি পরগনা ও রাজ্যের মালিক হন এবং সভাসদদের
সামনে নিজের নামে ‘খোৎবা’ পাঠ করান, তখন তাঁকে সবাই ঐ এলাকার শাসনকর্তা
বলে মেনে নেয়। শাহীমহল থেকে একজন সাধা্ণ
ভিস্তিওলা তাঁকে স্বয়ং খোদার প্রতিভূ বলে মনে করে। একজন বাদশা বা
সম্রাটের হস্তে ক্ষমতা সোপর্দ থাকার অর্থ স্বয়ং খোদা তাঁকেই নিজের প্রতিভূ করে ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। মোগল বাদশা বাবর তাঁর আত্মচরিতে বলেছেনঃ “ভারত সাম্রাজ্য অধিকার করার স্বপ্ন ছিল
তাঁর ঊনিশ বছর ধরে”। ভারতবর্ষে সম্রাট বাবর তুর্কী নরপতিদের প্রথম শাসনকর্তা এবং ভুল আখ্যায়িত মোগল সাম্রাজ্যের প্রবর্তক।
উপন্যাস ইতিহাস নয়। ইতিহাসও
সত্যিকারের মানব জীবনের পুনঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয় না। দিতে পারে না, কারণ তা
দেওয়া সম্ভব নয় বলে। তবু ইতিহাসে অনেকানেক গল্প উপন্যাস পাতায় পাতায় আত্মগোপন করে
থাকে। আগ্রাসী পাঠক সেই গল্প আরও পরিষ্কার করে দেখতে চান। জানতে চান। উপন্যাস তখন
উপন্যাস থাকে না। ইতিহাস জলজ্যান্ত হয়ে চোখের
সামনে নড়েচড়ে ওঠে। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন
ত্বং নেমে জনাধিপাঃ
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে
বয়মতঃ পরম্।। (সাংখ্য যোগ)
পূর্ব্বে আমি কখনও ছিলাম না এমন
নহে; তুমি কখনও ছিলে না তাহা নহে, বা এই নৃপতিগণও ছিলেন না – ইহাও সত্য নহে। এই
দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মরূপে
বিদ্যমান ছিলাম...
.
আমরা সবাই সব সময়ই আছি। আমাদের পরিণতিই আমাদের আসল পরিচয়। সুতরাং কোনও
একটি দিক দিয়ে ভেবে দেখলে বলা যায়, আমরাও ভবিষ্যতের কোনও না কোনও উপন্যাসের
চরিত্র। আজকের জীবনে কোনও গল্প বা
উপন্যাস লিখতে বসলে দেখা যাবে,
প্রায় বেশির ভাগ সময় প্রায় প্রত্যেক চরিত্র জীবনের জটিলতা দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ বিরক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন মাত্রায় বেঁচে
থাকছে। এই মাত্রা প্রত্যেক যুগেই ছিল, আজও আছে।
প্রকৃত সত্য এইই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ
থেকে চরিত্রকে, মানুষকে কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায় তার বেঁচে থাকার অর্থময়তা বা
উদ্দেশ্য আমাদের নতুন করে কিছু ভাবাচ্ছে।
১৭ই নভেম্বর সম্রাট বাবর
শেষবারের মত হিন্দুস্থান আক্রমণের
জন্য কাবুল শহর থেকে রওনা দেন। সালটা ঠিক বলা গেল না কারণ তুজুক-ই-বাবরই যে পৃষ্ঠা নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলির পুনরুদ্ধার আর সম্ভব
হয়নি। বাবর বাগ আফাতে অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে মির্জা হুমায়ুন ৩রা ডিসেম্বর সৈন্য
সামন্ত নিয়ে পিতার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। তাঁর আসতে এত দেরী হয়েছিল বলে বাবর তাকে ভৎর্সনা করেছিলেন। মির্জা
হুমায়ুনের বয়স এ সময় মাত্র সতেরো বছর ছিল আর তিনি ১৫২০ সাল থেকে বদকশনের গভর্নর হয়েছিলেন।
১৫২৬ সালের জানুয়ারী মাসে বাবরের পক্ষ থেকে কাবুলবাসীর উদ্দেশ্যে একটি সুসংবাদ এল,
হিন্দুস্থান জয় সম্ভব হয়েছে। ঐ পত্রে বাবর আরও একটি সংবাদ লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা হল, ‘মালুত’
দুর্গের বহু মূল্যবান গ্রন্থাবলী তাঁর হস্তাগত হয়েছে। সেসব গ্রন্থ তিনি মির্জা হুমায়ুনকে দান করেছেন।’’
পাণিপথ যুদ্ধ বিজয়ের অব্যবহিত
পর পাঁচজন সুলতানের ধনাগার ও রাজকোষ একত্র করে যে সমস্ত অফুরান হীরে জহরৎ বাবর লাভ
করেছিলেন, তন্মধ্যে উক্ত গ্রন্থাবলীগুলিকে মনে হয় তিনি সর্ব্বোচ্চ মহত্ব দান করতে
পেরেছিলেন। নয়ত সেগুলির উত্তরাধিকার শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুনকেই কেন দিয়ে
গিয়েছিলেন, কে জানে?
সবে সকাল হচ্ছে। পূর্ব্বদিকে
সূর্যদেব উদয় হচ্ছেন ধীরে ধীরে। আকাশে লাল গোলাপী আভা। মাঝারি একটা নদী একবুক জল
নিয়ে কিছুদূর অব্দি গিয়ে সেই লাল আভার মধ্যে উধাও হয়ে গেছে। নদীটির দু’পাশে খাড়া পাহাড়। জায়গাটার নাম পাহালভি। এটি রাজা মলদেবের রাজত্বের আওতায়।
হামিদাবানু বেগম রাজা মলদেবকে
কস্মিন কালেও চোখে দেখেনি। দেখলে কী হত
বলা মুশকিল, কারণ পাহালভি পরগণায় উপস্থিত
হওয়া মাত্রই কী এক অজানা আশঙ্কায় তার মন বারবার কেঁপে উঠছে। হুমায়ুন বাদশার জন্য একরাশ
দুশ্চিন্তা ছাড়া এ মুহূর্তে হামিদার মস্তিষ্কে আর কিচ্ছু
নেই। হামিদাবানু গান গাইতে পারে না। পারত যদি তাহলে এমন সময়ে সে যে কোনও সুর গুনগুন করে গেয়ে
অস্বাভাবিক চিত্ত চাঞ্চল্যকে কিছুটা প্রশমিত করতে পারত।
রেশমের তৈরী ফিরোজা রঙের একটি
‘কালিন’এর ওপর হামিদা বসে। এ মুহূর্তে এটাই তার বিছানা। গত দু’রাত্তির সে এর ওপরেই শয়ন করেছে। তার শরীর অবসন্ন ও মন নানান দুশ্চিন্তায়
আশংকায় পরিপূর্ণ।
বাদশা এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি।
কারণ চাদর-ই-মেহের –এ এখনও ধীর লয়ে আহির ললিত গাওয়া চলছে। কে বা কারা এই সুমধুর
সংগীত পরিবেশন করছে জানা নেই, কিন্তু বাদশা হুমায়ুনের নিদ্রাভঙ্গ না হওয়া
পর্য্যন্ত এই সংগীত পরিবেশন চলতে থাকবে। তাঁবুর বাইরে দিগন্ত প্রসারিত এক ঢালু
উপত্যকা। উপত্যকার একদম প্রান্তে চূড়ো সমেত একটা দুর্গ মেঘের দিকে উঠে গেছে। ওই
দুর্গের মালিক রাজা মলদেব। তিনি নাকি বর্ত্তমানে যুদ্ধোপলক্ষে কোথায় গিয়েছেন। যদিও
কাসেদ মারফৎ তাঁকে জরুরী এত্তেলা দেওয়া হয়েছে যে হিন্দুস্থানের সম্রাট বাদশা বাবরের
জ্যেষ্ঠ পুত্র ইনসান-ই-কামিল হুমায়ুন বাদশা রাজা মলদেবের দ্বারপ্রান্তে সস্ত্রীক
আশ্রয়প্রার্থী। তবুও রাজা যতক্ষণ না স্বয়ং এসে উপস্থিত হচ্ছেন, হুমায়ুন কিছুতেই
দুর্গে প্রবেশ করতে পারেন না। সেটা বেরাদরী বহির্ভূত আচরণেরই প্রকাশ হবে। অগত্যা বাদশা সদলবলে খোলা আকাশের নিচেই গত দু’রাত্তির
পার করেছেন। তবে একটি সুখবর এই যে বাদশা হুমায়ুনের এত্তেলা পাওয়া মাত্রই রাজা
মলদেব একটি ভীষণ সুন্দর জরাবক্তার ও একথালি আশরফি ভেট হিসেবে প্রেরণ করেছেন। জরাবক্তারটি অতিশয় ধারালো এবং তার হাতলে সত্যিকারের
সোনা মুক্তোর কাজ। যে সে জিনিষ নয়! হুমায়ুনের কাছে এই মুহূর্তে আড়াইশোজন সৈন্য ও সত্তরটি ঘোড়া। এলাকায় একতিও ঘাস নেই। ফলে ঘোড়টগুলি গত চারদিন ধরে কিছুই না খেয়ে রয়েছে। কাছে
পিঠে কোনও জলাশয়ও নেই। উপরন্তু দীর্ঘ পথশ্রমে জন্তুগুলি বেশ ক্লান্ত। এ তো গেল
জন্তু জানোয়ারদের প্রসঙ্গ। হুমায়ুনের সঙ্গী ক’জন বিশ্বস্ত অনুচর, সমর কৌশলে যাদের
জুরি মেলা ভার ছিল, সাইহোয়ান থেকে পাহালভি আসবার পথেই নানান শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা
করতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছে। পদাতিক সৈন্যরা আজ নিয়ে তিনদিন হল সম্পূর্ণ
অনাহারে। কঠিন শীতে কয়েকজন মৃত্যু্মুখে। কারণ তাদের
অনেকেরই গায়ে ভালো পোষাক নেই। পা খালি। দীর্ঘ উপবাস সহ্য করতে না পেরে শ’খানেক
সৈন্য রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে গেছিল। কয়েকজন সেনাপতির নজরে পড়ে যায়। সেনাপতির আদেশে তাদের উঁচু পাহাড়ের ঢাল থেকে
গভীর খাদে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জানতে পেরে বাদশা একটা ঘোড়াকে জবাই করার হুকুম
দিয়েছিলেন। তারপর সেই ঘোড়াটাকে ছাল চামড়া ছাড়িয়ে মাংস বানানো হল। রান্না করবার বড়
পাত্র নেই, অগত্যা মাটিতেই কিছুটা গর্ত্ত করে কাঠের টুকরো টাকরা দিয়ে আগুন
জ্বালানো হল। অবিশ্রাম বরফ পাতের কারণে ভিজে মাটি, ভিজে কাঠে কিছুতেই অগ্নিসংযোগ
হয় না। যাইহোক বেশ কয়েক ঘন্টার অক্লান্ত চেষ্টায় সেই আধপোড়া
মাংসই সকলে মিলে আহার করেছিল। কিন্তু তারপর থেকে তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘোড়া
মেরে ফেলার হুকুম বাদশা আর দেন নি। সুতরাং পুরো দলই এখন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।
হামিদা এত কিছু জানে না। সব
ধরনের খাদ্যদ্রব্যে বহুদিনই তার রুচি চলে গেছে। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও তার
কিচ্ছু যায় আসে না। রুমালে বাঁধা খানিকটা
গুলকন্দ রয়েছে সঙ্গে। খুব ইচ্ছে হলে সে ওই বস্তুটি খুঁটে খুঁটে খায়। এতে তার কোনও
কষ্ট নেই। তার কষ্ট অন্য জায়গায়। এইরকম শীতে স্ফীত উদর নিয়ে কিছুতেই সে একটি মাত্র
‘কালিন’এর ওপর শয়ন করতে পারে না।
গর্ভস্থ শিশুটি শরীরের অভ্যন্তরে ওলট পালট করে, হাত পা ছুঁড়তে চেষ্টা করে। সুতরাং
গোটা রাত বলতে গেলে হামিদার ভালো করে ঘুমই হয় না। তার ওপর প্রবল শীতের কাঁপুনি তো
রয়েইছে।
হামিদার খুব ইচ্ছে করে ঢালু
উপত্যকার ওই পাশে অনেক দূরে বিশাল যে দুর্গটা রয়েছে সেখানে আশ্রয় নিতে। কারণ তাঁবুর
উপরিভাগে অনেকগুলি ছিদ্র দেখা দিয়েছে। রোজ রাত্তিরে তুষারপাতের সময় সেই ছিদ্র দিয়ে
কনকনে বরফ চুঁইয়ে পড়ে। দুর্গে আশ্রয় পেলে এই কষ্ট আর থাকবে না। কিন্তু কী জানি কেন ওই দুর্গটাকে দেখলেই অজান্তেই হামিদার বুক গুড়গুড় করে ওঠে।
আহির ললিত গাওয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে
গেল। এর অর্থ বাদশার নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। ওজু করার পানি যদি মেলে তো ভালো, নয়ত
বাদশা যেমন তেমন করে ও কাজটি সেরে নেবেন। গত রাত্তিরে এক টুকরো করে শুকনো ফল আহার
করার সুযোগ হয়েছিল। হামিদার সঙ্গে একটি দাসী। এই দাসীটিই কেবল জীবিত ছিল, নয়ত বাকি
সব দাসদাসী সেদিন সাইহোয়ানের দুর্গেই মারা পড়েছিল। দাসীটি অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক
কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। কোথ্থেকে সে একপাত্র গরম ধোঁয়া ওঠা সুরুয়া নিয়ে এসেছে। কী করে যে সে এটা যোগার করল কে জানে! কিন্তু
অতি সতর্ক চোখের ইশারায় সে হামিদাকে এটি খেয়ে নিতে অনুরোধ করল। খেয়েও নিল হামিদা।
স্বাদ অতি উত্তম। বেশ অবাক লাগল। কী হল? খাবারের প্রতি এত আগ্রহ এল কী করে? দাসী জানালো, খুব ভালো লক্ষণ এটি। এর অর্থ অতি শীঘ্রই হামিদার প্রসব হয়ে
যাবে।
বাইরে এখন তুষারপাত বন্ধ। আকাশ
পরিষ্কার হচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু পর হয়ত ঝকঝকে রোদ্দুর উঠবে। উপত্যকার নীচ থেকে ইয়াকের
ডাক শোনা যায়। রাজা মলদেব কি আজ দেখা দেবেন? যদি দেন তবে আজ রাত্তিরে একটু ভালো
ঘুম হবে সবার। একসার সবুজ তোতা ঝাঁক বেঁধে মাথার ওপর দিয়ে ঊড়ে গেল।
আপাদমস্তক কালো পোষাক পরা এক
ঘোড় সওয়ারকে তুরন্ত এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছিল। চাদর-ই-মেহের এ হুমায়ুন ততক্ষণে উঠে বসেছেন।
যথোচিত রাজকীয় ভঙ্গি। বিগত ছ’মাস আর তিনি অহিফেন সেবন করেন না। সুরাপান তো কবেই
ত্যাগ করেছেন। ঘোড় সওয়ারটি চাদর-ই-মেহের এর কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
লোকটির আপাদমস্তক ঢাকা। সম্ভবত কোনও উজবেগ সেনাপতি। কিন্তু কী তার উদ্দেশ্য, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। তরদী বেগ দৌড়ে গেল লোকটির কাছে। উভয়পক্ষ থেকেই
নানান জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। নিজের তাঁবুতে বসে হামিদা যেটুকু বুঝতে পারছে, আগন্তুক
উজবেগটি মোটেও ফেলনা শ্রেণীর নয়। তার কথা এবং সময় দুটোরই দাম আছে। গোলমাল শুনে বাদশা হুমায়ুন নিজেই চাদর-ই-মেহের
থেকে বাইরে এলেন। বাদশাকে দেখতে পাওয়া মাত্রই লোকটি ঘোড়া থেকে এক লম্ফে নেমে দৌড়ে
সোজা বাদশার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।
প্রথমে প্রথামত কুর্ণিশ করল ও পরে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ঝড়ের গতিতে বলে
গেল - আলা হজরত্! কস্মিন কালেও আর
সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করবেন না! এখান থেকে এক্ষুণি পালিয়ে যান! রাজা মলদেব
আপনাকে বন্দি করার ফিকিরে আছে। শের খানের এক দূত রাজা মলদেবের কাছে এখন এসেছে।
দুজনে শলা করছে কীভাবে আপনাকে পাকড়াও করা যায়!
হামিদা দেখতে পাচ্ছিল তার
স্বামী কেমন স্থির নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে লোকটির দিকে চেয়ে। হিমেল বাতাসে জোব্বার
প্রান্তটি একটু একটু কাঁপছে। বাদশার হাত দুটি ভাঁজ অবস্থায় কোমরের পেছনে। দু’হাত দূরে হাতে উদ্যত শামসের নিয়ে বৈরাম খান বাদশার হুকুমের অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে বাদশা উচ্চারণ করলেন-
কুছ খাফাজ্ কি
তিলীয়োঁ সে ছান্
রহা হ্যয় নুরসা-
কুছ ফিজা কুছ হাসরাতে
পরওয়াজ্ কি
বাঁতে করো!!
দ্যাখো জ্যোতির মতই জেলখানার
গরাদ থেকে কী যেন চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে
আসছে। এসো আমরা কিছু পারিপার্শ্বিকতা আর কিছু পালাবার ইচ্ছার কথা বলি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন