ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(পঞ্চম অধ্যায়)
(১২)
হামিদার সম্মুখে এখন একপাত্র
গোলাপ চূর্ণ মিশ্রিত সুগন্ধী জাফরানের শরবৎ রাখা। পাত্রটি সোনার তৈরী। সেটির গায়ে
ও হাতলে সবুজ নীল গোলাপি মিনা করা। ফাঁক ফোকরে শিশির বিন্দুর মত লাল চুনী।
সূর্য্যের আলো পড়ে চুনীগুলি সাপের চোখের মত জ্বলজ্বল করছে। আরও একটি পাত্রে, সেটিও
স্বর্ণ নির্মিত, সুস্বাদু ‘ইরাক’ রাখা রয়েছে। ইরাক অত্যন্ত পুষ্টিকর। পেস্তা বাদাম
বাটা, মগজ চূর্ণ ও রৌপ্য ভস্ম মিশ্রিত করে প্রস্তুত। মোগল নারীরা সন্তান সম্ভবা
হলেই এই বিশেষ ধরনের খাদ্য বস্তুটি গ্রহণ করে। কিন্তু হামিদার কথা পৃথক। সে কোনও কিছুই খাচ্ছে না। কোনও খাদ্য
সামগ্রীতেই তার রুচি নেই। পেয়ালা ভর্ত্তি সুস্বাদু ইরাক নিয়ে একজন মাঝবয়সী দাসী
তাকে সাধাসাধি করছে বটে, কিন্তু দু’ চুমুকের
বেশি হামিদা সেটি আর খায়নি। এ জায়গাটার নাম সাইহোয়ান। বিশাল এক দুর্গের ভেতরে জমিন
থেকে প্রায় চার মঞ্জিল উঁচু একটি গৃহে হামিদার শয়নকক্ষ। কক্ষটি খুবই সুন্দর করে সাজানো।
তিনটি পিষতোক, একটি সাধারণ তোষক। দু’খানি সুউচ্চ মঞ্চ জারদৌজী কারুকার্য মন্ডিত। মঞ্চগুলিতে শুধুমাত্র বাদশা যখন পত্নী সমব্যভিহারে আসেন তখনই ব্যবহার হয়। নতুবা সেগুলি পর্দা
ঢাকা থাকে। হামিদা এখন চার মাসের
অন্তঃসত্ত্বা। তার বয়ঃক্রম মাত্র বারো। বর্ত্তমানে বাদশাও দুর্গে নেই।
হামিদার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর বাদশা জননীকে জানিয়েছিলেন। তারপর বাকি ব্যবস্থা দিলদার বেগমই করে দিয়েছেন। কয়েকজন মাঝবয়সী দাসদাসী ও একজন নিপুণ দাই সহ প্রচুর খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়ে দিয়েছেন
সাইহোয়ানে।
একটি বড় উপাধানে মাথা রেখে
হামিদা শুয়ে। আরও একটি দেহ ধারক উপাধান তার ডান পাশে রাখা। হামিদার চক্ষু দুটি
অর্ধ নিমীলিত। কিছুক্ষণ আগেও সে বমি করেছে। বয়স্কা দাসীটি বেগমের পায়ে হাত বুলিয়ে
দিচ্ছিল। বাদশার হুকুম আছে দাসী যেন একটি মুহূর্ত্তের জন্যও হামিদাকে ছেড়ে না যায়। এমন কি রাত্রিতে হামিদা ঘুমোলে দাসী
শিওরে বসে পাহারা দেয়। একটি চতরশাহী থেকে কমলালেবু রঙের কারুকার্য্য করা কালিন(পর্দা) উপর থেকে ক্রমে ছড়িয়ে নিচে
নেমে গেছে মেঝের দিকে। এই চতরশাহীটিরই নিচে হামিদা শুয়ে। বাদশা এখন শিকারে বের
হয়েছেন। গত তিনদিন তিনি দুর্গে অনুপস্থিত। দু’জন হাবশি বংশদ্ভূত দাসী দরজার প্রান্তে দন্ডায়মান। বিকট তাদের অবয়ব। মুখশ্রীও
অত্যন্ত ভয়াল ও নিষ্ঠুর। যে কোনও ধরনের কাজে তাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। এসব
ব্যবস্থা হামিদা বানু বেগমের জন্য। বারো বৎসর বয়স্কা হামিদা এখন বাদশা হুমায়ুনের
জান প্রাণ।
সাইহোয়ানের এই দুর্গে আসবার মাস
দুয়েক পরই হামিদা আবিষ্কার করেছিল তার রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাসের ঐ ক’টি
দিনে তার মত মেয়েরা একদম ঘরের বাইরে বের হয় না। মাথা ভিজিয়ে স্নান করে না। কোনও
পুরুষ এমন কি স্বামীর মুখদর্শনও নিষিদ্ধ। এদিকে বাদশা পত্নী ব্যতীত একটি রাতও একলা
থাকেন না। ঘুমই আসে না তাঁর। রোজ রাত্তিরে হামিদার
বুকের ওপরে নিজের বাদামী বর্ণের শশ্রুগুম্ফ সমন্বিত মুখ মন্ডলটি রেখে
বাদশা এক আজব দেশের গল্প বলে চলেন। বলেন, আজব সেই দেশটি নাকি এখান থেকে অনেক দূর। হিমালয় পাহাড়টা পুরো ডিঙিয়ে যেতে হয়। যেতে যেতে পথে কত যে মন্দাকিনী অলকানন্দা সিন্ধু চেনাব পার হতে হয় সে দেখলে
অবাক কান্ড এক!
সেই কান্ড শেষ না হতেই আরও কত আশ্চর্য্য সুন্দর বনানী নির্ঝরিনী ঢালু উপত্যকা জুড়ে
আদিগন্ত রঙীন ফুলের বাগিচা... মনে হবে স্বয়ং খুদাহ্ বুঝি মর্ত্যে নেমে এসেছেন।
বেগম অধীর হয়ে ওঠে, ‘...তারপর? তারপর কী হল?’
‘তুমি কখনও সত্যিকারের নীল রঙ দেখেছ হামিদা? আমি
দেখেছি। হিমালয় পেরিয়ে গেলেই আশ্চর্য্য সেই দেশটার মাথার ওপরেই একেবারে ফিরোজা রঙের আশমান্। অমন রঙ দেখলে মনে হবে বৃষ্টি হলে বুঝি জলের সাথে নীল রঙ ঝরে পড়বে।
শুনে হামিদার হাসি পায়। তাই আবার হয় কখনও? সেবারে বালুচে কত তুষারপাত হল। টানা পনেরো দিন। পনেরো দিন পর
বরফ পড়া বন্ধ হল। তখন রোদ উঠল। দেখা গেল আকাশটা একদম পরিষ্কার আর ঝকঝকে।
ঢালু উপত্যকার এখানে সেখানে পাতলা বরফের আস্তরণ। ধবধবে সাদা সেগুলি। বরফও আশমান থেকেই ঝরে পড়ে। সেগুলি কই নীল হয়নি তো!
‘কী হল চুপ করে আছো কেন?’ প্রশ্ন করলেন বাদশা। হামিদা বানু বেগম তাঁর পত্নী ঠিকই কিন্তু তার চাইতেও
বেশি সে বাদশার এক পরম সুহৃদ। সুতরাং আলাপ করবার সময় একপক্ষ চুপ করে গেলে অন্য
পক্ষর কথা বলা ভার। তিনি বেগমের চিবুকে নিজের বাম তর্জনী ছুঁয়ে বললেন, ‘আমরা যখন সেই আজব দেশটায় যাব, দেখবে আমার কথা
সত্যি কিনা?’
‘বারে! আমি কি আপনার কথা অবিশ্বাস করছি? কিন্তু কবে
যাব আমরা সেখানে?’
‘যাব। দেখছ না চারিদিকে এখন কত অসুবিধা। তাছাড়া সেই
দেশটা বর্ত্তমানে শের শাহ দখল করে বসে আছে।
তাকে না তাড়ালে যাব কী করে?’
‘আপনি সৈন্য সংগ্রহ করুন আল্লাহতালা! খুদাহ্ সব সময়
আপনার সঙ্গে রয়েছেন’।
‘সে আমি জানি। কিন্তু আজ তোমাকে এত চিন্তিত
দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’
‘আমি আপনার কথাই ভাবছি হুজুরে আলম্! আপনি ব্যতীত
আমার দ্বিতীয় চিন্তা আর কিছুই নেই’।
কিশোরী পত্নীর মুখে এ হেন বাক্য
শ্রবণে হুমায়ুনের অন্তর খুশিতে ঝলমল করে উঠল। হামিদাকে তিনি পুনরায় তীব্র ভাবে
বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। বাইরে বরফ পড়ছে।
কিন্তু বাদশার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে উষ্ণতার ছোঁয়াচ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আজ পোষাক বদলাও নি?’
হামিদা জবাব দিল না। বাদশা
বললেন, ‘আজ নিয়ে প্রায় পাঁচমাস হল আমরা
সাইহোয়ানে এসেছি। এখানে আসার পর থেকে দেখছি তুমি বেশ হাসি খুশি ও প্রাণবন্ত হয়েছ। কাবুল পাহাড়ের এই উলটো দিকটায় আমিও বহু
বছর পর এলাম। তবে তুমি সঙ্গে আছো, নইলে একলা আমার একটুও ভাল লাগত না। সকালে যখন
সূর্য্য উদয় হয় পুব দিকটা কেমন রাঙা হয়ে ওঠে দেখেছো? আমার কিন্তু এসব দেখলে বারবার
হিন্দুস্থানের কথাই মনে পড়ে...’ এক
নাগাড়ে বলে চলেছেন বাদশা। হামিদাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বললেন, ‘সত্যি বলো, আজ নিশ্চই তোমার মন ভালো নেই?’
‘না হুজুরে আলম্, আমার মন ভালোই আছে’।
‘তবে আমি এত কথা বলছি তুমি চুপ করে আছ কেন? বুঝেছি
তুমি কী ভাবছ? বলব কি ভাবছ? তুমি ভাবছ
কবে আমরা হিমালয় ডিঙিয়ে হিন্দুস্থানে যাব!’
হামিদা মৃদু হাস্য করল। তারপর
শুকনো মুখে বলল, ‘জি জাঁহাপনা! আপনার খুশিই আমার
খুশি’।
বেশ আহ্লাদিত হয়ে হুমায়ুন বললেন, ‘কাঁচুলি
পরলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়, কিন্তু আমার সামনে শুধু ঐ পোষাকে তোমাকে আরও
আকর্ষণীয় লাগে!’ - বলে বাদশা হামিদার দুই স্তনের মাঝে শিশুর মত মুখ গুঁজে দিলেন। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তন্বী কটিদেশ। তারপর ধীরে ধীরে সেখানের পোষাকের বাঁধন আলগা করতে
শুরু করলেন। কক্ষটিতে এ সময় প্রচুর চন্দনের ধোঁয়া। সঙ্গে খশ্ ও গোলাপের সুবাস।
বাদশার কাজে যে কোনও প্রকার
বাধা দেওয়া না-জায়েজ। তবু
আস্তে করে
হামিদা জানাল, আজ তার তবিয়ত তেমন ভালো নেই।
‘কেন আজ কি তুমি শাহী গোস্ত আহার করোনি? এই প্রবল
শীতে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে’।
আবার হামিদা চুপ। কী করে বাদশাকে বোঝাবে তার ঠিক কি হয়েছে? তবু ধীরে ধীরে জানালো, আজ সে বেশ দুর্বল বোধ করছে।
দলে কোনও হাকিম নেই। বাদশা
বললেন,
আগামীকাল সকালেই ভাল একজন হাকিমকে জলদি তলব করা হবে। সুতরাং চিন্তার কোনও কারণ
নেই।
রাজবৈদ্য সব দেখে শুনে ঘোষণা করলেন, হুমায়ুন পত্নী হামিদা বানু বেগম আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পরম দয়াময় খুদাহর অসীম কৃপায় বাদশা এবার আওলাদের মুখ দর্শন করবেন।
কথাটা কানে যেতেই হুমায়ুন গভীর
চিন্তায় পড়ে গেলেন। সে অনেক দিন আগের কথা। লাহোর ত্যাগ করে হুমায়ুন দলবল সহ
অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না, কিন্তু যাচ্ছেন, কারণ লাহোরে তাঁর অধিষ্ঠান নিরাপদ নয়। পশ্চাতে শের শাহর সৈন্যরা ঝড়ের গতিতে ধেয়ে আসছে। ওদিকে মির্জা কামরান একবিন্দু
জমি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন। দুর্দিনে হুমায়ুনকে তিলমাত্র সাহায্য করবেন এমন
আশা করা ভুল এবং বাদশা তা আশাও করেন না। যাইহোক সবাই মিলে রাভি নদী পার হলেন। সবাই
বলতে বাদশা সহ তিনশ জন সৈন্য। তার মধ্যে মাত্র দেড়শো ঘোড়সওয়ার বাহিনী। রসদ বলতে খুবই সামান্য খাদ্যসামগ্রী ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র। রাত কাটানোর জন্য একটাই মাত্র তাঁবু।
চাদর-ই- মেহের। হুমায়ুন সেখানেই
রাত্রিবাস করছেন ও আপাতত সেটাই মোগল দরবার। একদিনের কথা। মনের অধৈর্য্য ও চঞ্চলভাব
দূর করার জন্য তিনি আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছিলেন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখলেন, আপাদমস্তক সবুজ পোষাক পরিহিত এক দিব্য পুরুষ তাঁর
সামনে দন্ডায়মান। পুরুষটি বাদশাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘হতাশ হয়ো না। পুরুষোজনোচিত ব্যক্তিত্ব ধারণ করো! কোনও চিন্তা কোরো না’। তারপর সেই দিব্য পুরুষটি তাঁর হাতের যষ্ঠিটি বাদশার হাতে ন্যস্ত করলেন এবং বললেন, ‘খোদা তোমাকে অচিরেই পুত্র সন্তান দান করবেন, তার
নাম রেখো জালালুদ্দীন মহম্মদ আকবর’।
তৎক্ষণাৎ বাদশা দিব্য পুরুষটিকে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। পুরুষটি বললেন, ‘আমার নাম জেন্দা ফিল আহমদ্ জাম্। তোমার সন্তান আমার
বংশদ্ভূত হবে।’
মনে আছে, স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাদশা অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন। হায় খুদাহ্ এমন ভাগ্য কি আর হবে? শিশু আকিকা সহ তিন পত্নীকে
শত্রুরা কবেই মেরে ফেলেছে! রাজ্য নেই সৈন্য নেই পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী নেই! খুদার
কী মর্জি তা শুধু তিনিই জানেন!
বয়স্কা দাসীটি আরও একবার ‘ইরাক’
ভর্তি পেয়ালাটি হামিদার মুখের সামনে এগিয়ে ধরল। যথারীতি হামিদা আবার সেটিকে
প্রত্যাখান করল। তুর্ক ভাষায় দাসী এবার বেগমকে কিছু পরামর্শ দিল। শুনে হামিদার
অর্ধনিমীলিত চক্ষু দুটি আপনা হতেই খুলে গেল। শরীর তার যথেষ্ট দুর্বল কিন্তু ওষ্ঠের
হাসিটি অমলিন। মৃগয়া থেকে বাদশা যে কোনও মুহূর্ত্তে ফিরে আসতে পারেন। এসে যদি তিনি দেখেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী
এভাবে ভূমি শয্যায় অনাহারে পড়ে রয়েছে, তৎক্ষণাৎ দাসীর গর্দান নিতে হুকুম দেবেন। ভবিষৎ মোগল সম্রাটের জননী হতে চলেছেন বেগম।
সুতরাং কোনও অনিয়ম কি তিনি সহ্য করবেন?
যাইহোক দাসীর পিড়াপিড়ীতে
হামিদা কোনও রকমে বস্তুটি গলাধঃকরণ
করল, করেই জিজ্ঞাসা করল, বাদশার কোনও খবর আছে কিনা! তিনি ফিরেছেন কিনা!
সবিনয়ে দাসী জানালো, না। তিনি
এখনও ফিরে আসেন নি বটে, তবে খুব শীঘ্রই ফিরবেন। কারণ
কে একজন দূত বাদশার সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এজন্য গভীর অরণ্যে
বাদশার উদ্দেশ্যে এক কাসেদকে তুরন্ত প্রেরণ করা হয়েছে।
রাত তত গভীর হয়নি। নিজের
কক্ষটিতে শান্ত হয়ে শুয়েছিল হামিদা। মৃগয়া থেকে বাদশা ফিরে এসেছেন সে খবর কানে
এসেছে বটে, কিন্তু ফেরা ইস্তক স্বামী যে বিশেষ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন সেটা সে
অচিরেই বুঝে নিয়েছে। এ একরকম ভালোই হয়েছে। এখন বাদশা যতই ব্যস্ত থাকুন রাত্রিতে
তিনি বেগমের সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতে আসবেন। না, পত্নী সম্ভোগের জন্য এখন তিনি তত আগ্রহী নন, বরং তিনি রয়ে সয়ে বেগমের একদম
কাছটিতে বসে তার কুশল মঙ্গলাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। হামিদা ঠিক মত খাওয়াদাওয়া
করছে কিনা, সে ব্যাপারেও তিনি খোঁজখবর
নেন। আজ হামিদার কেশদামটি একেবারেই অবিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। সে ভাবল রাত্রিতে বাদশা এ
কক্ষে আসবার আগে কিছু ঠিকঠাক করে নিতে পারবে। সে সময় হাতে রয়েছে। কিছুক্ষণ
পূর্ব্বেও বয়স্কা দাসীটি এখানে উপস্থিত ছিল, কিন্তু এই মুহূর্ত্তে তাকে এখানে দেখা যাচ্ছে না। ধারেকাছে কারুর সাড়া শব্দ নেই। হামিদার
একটু বিসদৃশ লাগল। কী হল হঠাৎ? বিছানার ওপর সে ধীরে ধীরে
উঠে বসল। উদরের নিম্নভাগ বেশ ভারী। ভারী পায়ের পাতা দুটিও। কী জানি কী মনে করে হামিদা নিজের বাম
হস্তটি অতি সন্তপর্ণে নাভির ওপর রাখল। কিছু কি স্পর্শ করতে পারছে হাত?
হঠাৎ সম্মুখে কার ছায়া! চমকে
উঠল হামিদা। স্বয়ং হুমায়ুন বাদশা? কখন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন! তাড়াতাড়ি উঠে
নতমস্তক হয়ে প্রথামাফিক কুর্ণিশ জানালো হামিদা। তার দীর্ঘকেশ আলুথালু, পোষাকের
প্রান্তদ্বয় ভূমিতে লুটোচ্ছে।
একরাশ দুশ্চিন্তায় থমথম করছে হুমায়ুনের
মুখ। এক পলকেই বুঝে ফেলল হামিদা, বলল, ‘জি জাঁহাপনা!’
সময় দিলেন না হুমায়ুন। এক ঝটকায়
বেগমকে কাছে টেনে নিলেন, বললেন, ‘এক্ষুনি
আমাদের এ দুর্গ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে
হবে! দুশমন হামলা করেছে’।
হাঁ হয়ে গেল হামিদা। দুশমন? কোন
দুশমন? শের শাহ সুরী? কিন্তু সে তো বর্ত্তমানে গৌড়ে... অতদূর থেকে...
‘বেগম লমহে জায়া মত্ করো! বাইরে কোকা নাদিম শত্রুকে
প্রাণপণ ঠেকিয়ে রেখেছে!’
দ্বিরুক্তি না করে ওড়না দিয়েই
মাথা মুখ ঢেকে নিল হামিদা। এখন বাদশা যেদিকে পা বাড়াতে বলবেন সেই দিকেই হামিদা
যাবে। এই শরীর নিয়ে এর বেশি কিছু ভাববার ক্ষমতা তার নেই। কক্ষের দ্বার প্রান্তে
সদা সর্বদা দন্ডায়মান হাবশী পাহাড়াওলাদের কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না। তবে সামান্য
একটু তফাতে হামিদা বেগমের বয়স্কা দাসীটিকে গলাকাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল।
কাঁচা রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে, সামান্য আঁশটে গন্ধ। দেখা মাত্রই শিউরে উঠল হামিদা।
গা গুলিয়ে বমি করে ফেলল।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন