লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক
: হুয়ান রুলফো
লাতিন আমেরিকার মেহিকোর বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুয়ান রুলফো। তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাসটি হচ্ছে 'পেদ্রো পারামো'। হুয়ান রুলফোর জীবৎকাল ১৯১৭ থেকে ১৯৮৬ সাল অব্দি। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো' নামক ক্ষীণকায় উপন্যাসটি। একুশ শতকের গোড়ার দিকে উরুগুয়ের বিখ্যাত পত্রিকা El Paris লাতিন আমেরিকার লেখক, সমালোচকদের কাছে ভোটিং পোলে জানতে চায় ওখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কোনটি? এই ভোটিংএ হুয়ান রুলফোর উপন্যাস 'পেদ্রো পারামো'র নাম উঠে আসে। এই উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। স্প্যানিশ সাহিত্যে দন কিহেতোর লেখক সার্ভেন্তেজের (১৫৪৭- ১৬১৬) পর সবচেয়ে প্রভাবশালী মৌলিক কথাশিল্পী-কবি ছিলেন আর্হেন্তিনীয় হোর্হে লুই বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬)। তাঁর অভিমত ছিলো, এটি লাতিন আমেরিকা তো বটেই গোটা বিশ্বেরই উল্লেখযোগ্য গুটিকতক ভালো কাজের একটি। একই মহাদেশীয় বিশ শতকের আরেক বিশ্বখ্যাত কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪) বলেন যে, এই বইটি পড়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে 'One Hundred Years of Solitude' বইটি লেখা সম্ভব হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে মার্কেজের এই বইটি একটা মাস্টারপিস। রুলফোকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার আরেক মহান কথাসাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তেস (১৯২৮-২০১২)। ফুয়েন্তেস উপন্যাসটি অবলম্বনে একই শিরোনামে ১৯৬৭ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন। স্পেনে 'দন কিহোতে' যেরূপ সম্মানজনক স্থানে অবস্থান করছে, মেহিকোতে সেই অবস্থানে 'পেদ্রো পারামো' এমন কথা বলাই যায়।
দান্তে (১২৬৫-১৩২১) রচিত মহাকাব্য 'ইনফারনো'তে এই অলীক এবং
বাস্তবতা যেভাবে মিশে একাকার হয়ে আছে, ঠিক তেমনি হুয়ান রুলফোর
উপন্যাসে ঘটেছে। উভয়
ক্ষেত্রেই অলীক আর বাস্তবতাকে আলাদা করা যায় না। অদ্ভুত এক কাহিনী যেখানে বাস্তবকে অলীক মনে হয়, আর অলীক সামগ্রিকভাবে যেন বাস্তব বলে অনুভূত হয়।
সমগ্র বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছিলেন ঔপন্যাসিক হুয়ান রুলফো। তাঁর উসন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে 'কমলা' নামে একটি গ্রামের। গ্রামটি মৃতদের গ্রাম। এ গ্রামে মৃতদের কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। হুয়ান প্রিসিয়াদো মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের পূর্ব নির্দেশ মতো এখানে তার বাবাকে খুঁজতে আসে। এ গ্রামে মানুষ আছে, কিন্তু তাঁরা যেন স্বাভাবিক নয়। সব কিছু বিবৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন স্মৃতির ভিন্ন এক স্তর, অন্য এক জগৎ। মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাতাসের শব্দ শুনে মনে হয় হুয়ানের এটা যেন জীবিত গ্রাম। সে জানতে পারে তার বাবা হুয়ান পারমার আগেই মারা গেছেন। গ্রামটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘sits on the coals of the earth, at the very mouth of hell।’ এখানে আসার আগে হুয়ান মায়ের কাছে জেনেছিলো এখানে সে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। মা তাকে কথা দিয়েছিলেন।
এখানে হুয়ান এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বৃদ্ধা হুয়ানকে দেখেই চিনতে পারে, সে সব কিছু হুয়ানের মায়ের কাছে তাঁর মৃত্যুর আগেই জানতে পারে। অথচ হুয়ানের গ্রাম এখান থেকে অনেক দূর। কাহিনীর বিস্তার এভাবেই চলতে থাকে। ত্রিকাল এখানে মিলে মিশে একাকার। মৃতদের গ্রাম অনবদ্য কৌশলে জীবিতের গ্রামের মত হয়ে যায়, স্থানিক দূরত্ব মিটে যায় অদ্ভুত এক মিশেলে। কোনটা বাস্তব, কোনটা অলীক বুঝতে পারা যায় না। এ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে যেন 'Magic Reality বা 'যাদু বাস্তবতা'।
উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে লেখা হলেও উত্তরাধুনিক (postmodern) উপন্যাসের নানা উপকরণ বা রচনাকৌশল এখানে বিদ্যমান। উপন্যাসের প্রথম দিকে ন্যারেটর হুয়ান প্রিসিয়াদো স্বয়ং। কিন্তু খুব শিগগিরই ন্যারেটরের ভূমিকায় অন্য একজন চলে আসে। আবার হুয়ানের মৃত মা বর্ণনাকারীর ভূমিকায়ও অংশ নেন। ন্যারেশনে এই ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতির জন্যই উপন্যাসের সময়টা সঠিকভাবে স্থির করা যায় না। এতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের নানা মুহূর্ত চলমান থাকে সক্রিয়তা সহকারে। ফলশ্রুতিতে সেটিং বলে কিছু থাকে না। কোনো-কোনো সমালোচক 'কমলা' গ্রামকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ক্লাসিক মহাকাব্য ইনফারনোতে যেমন ভার্জিল গাইড হয়ে মূল চরিত্র দান্তেকে নরকের পথ চিনিয়ে দেয়, এই উপন্যাসেও তেমনি আবানদিও চরিত্র হুয়ানকে 'কমলা' গ্রামে পৌঁছে দেয়। আরো অনেক অনেক ব্যাখ্যাও এই উপন্যাসের আছে। ১৯৫৫ সালে লিখিত এই উপন্যাসে উত্তরাধুনিক বা postmodern উপন্যাসের নানা উপকরণ তথা রচনাশৈলী উপস্থিত আছে বলা যায়। যে কারণে এই উপন্যাস পরবর্তীতে লিখিত কথাসাহিত্যে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে নানা প্রভাব বিস্তার করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এখানেই বিশ্ব কথাসাহিত্যে এই উপন্যাসের গুরুত্ব। আর রুলফোকে যে মাস্টার কথাসাহিত্যিক বলা হয় তার কারণ হচ্ছে তিনি স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে জাগতিক বাস্তবতাকে তুরীয় বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম ছিলেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প দুটি বিষয়েই তাঁর এই দক্ষতা দেখা যায়।
'পেদ্রো পারামো' উপন্যাসের পাশাপাশি রুলফো পনেরোটি গল্প নিয়ে লিখেছিলেন তাঁর একমাত্র ছোটগল্পের বই 'জ্বলন্ত প্রান্তর' (The Plain in Flames)। আর এসব দিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী লেখকদের শ্রেণীতে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গিয়েছে। এই দুটি বই তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৩ ও ১৯৫৫ সালে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবৎকাল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তেমন কিছু লেখেননি। তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য একটা অসমাপ্ত উপন্যাস পাওয়া গেছে। কিছু লোকসংস্কৃতি-বিষয়ক নিবন্ধ লেখেন তিনি, যেগুলি তিনি বেঁচে থাকতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই না-লেখার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘In my life there are many silences,’ তাঁর এই নীরবতা যেন একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো হয়ে তাঁর সব লেখাতেই উঠে এসেছে। আর বেশ কিছুটা তীব্র হয়ে উঠেছে ছোটগল্পগুলিতে। একটা অব্যক্ত হতাশা, জীবনের অর্থহীনতা তাঁর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয়। অল্পকথার মানুষ রুলফো কম কথাতেই কয়েক জীবনের কথা বলে দিতে পারতেন। শব্দ দিয়ে যতটা বলতেন, না-বলা (silence) দিয়ে বহুগুণ বেশি যেন বলে দিতেন। তাঁর আখ্যানের গতি অতি মন্থর, প্রায় নিশ্চল। অল্প চলে এদিক-সেদিক করে। গদ্য সর্বত্র উচ্ছ্বাসহীন, পুকুরের জলের মত উত্তালতাহীন কিন্তু একঘেয়ে নয়, কারণ তাঁর অব্যক্ত উচ্চারণ প্রায় প্রতিটি শব্দে বা বাক্যের পেছনে সংযুক্ত থেকে যেত নীরবে। অনেকটা যেন কবিগুরুর ভাষায় 'কত কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি...'। এমন মেদহীন-আভরণহীন গদ্যে ঢেউ তোলার শিল্প যেন একমাত্র তাঁরই রপ্ত ছিল, যার পরিমিত উপস্থিতি রুলফোর অগ্রজ ফরাসি কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) সাহিত্যে পাই।
রুলফোর ‘ভোরবেলায়’ গল্পটি ছোট পরিসরের গল্প, এক সকাল থেকে আরেক সকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। দারিদ্র্য এবং শোষণের ফাঁদে আটকা পড়েছে গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ এসেত্মবান। বৃদ্ধের বর্তমান যেন নেই, নেই স্মৃতিতে তার অতীত। ভবিষ্যৎ? তাকে জেলে যেতে হচ্ছে তার মালিককে খুন করার অপরাধে। গল্পের সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় – বৃদ্ধ মনে করতে পারছে না, খুনটি সে আদৌ করেছে কিনা। তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময় সে একটুও বিস্মিত-বিচলিত হয় না। আত্মপক্ষও সমর্থন করে না। স্মৃতিভ্রষ্টতার কী নিদারুণ অভিশাপে সে অন্যের অভিমতের উপর নির্ভরশীল।
‘আমরা ভীষণ গরিব’ এবং ‘মাকারিও’ গল্পে অবচেতন-কাম একটা উপলক্ষ হয়ে এসেছে; আর ‘ভোরবেলায়’ উপলক্ষ হয়ে এসেছে অবচেতন-ক্রোধ। বুড়ো এসেত্মবান নিজে খুন করার পেছনের গল্পটা সাজাতে চেষ্টা করে। আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-১৯৬০) The Stranger উপন্যাসের প্রধান চরিত্র Meursault-এর চেহারাটি তখন মনে পড়ে যায়। পার্থক্য হচ্ছে, Meursault জানে সে খুন করেছে, কিন্তু এসেত্মবান জানে না খুনটা করেছে কিনা। কিন্তু দুজনেরই নিরুত্তাপ অনুভূতি পাঠকের চেতনায় একইভাবে ধাক্কা দেয়।
নিজের চেনাজানা জগতের কথাই বলেছেন তাঁর লেখায় রুলফো, এর বাইরে তিনি কিছুই বলেননি। এজন্য রুলফোকে বুঝতে হলে তাঁর জীবনী ও সমসাময়িক মেহিকোর সমাজবাস্তবতা জানা জরুরি। রুলফোর জন্মগ্রাম হালিস্কোতে সবুজ তৃণভূমি বলে কিছু ছিল না। বন্ধ্যা জমি আর পরিত্যক্ত পোড়ো গ্রাম তাঁর দেশ। দেশের সাধারণ জনগণের ভবিষ্যৎ নিঃস্বতায় রুক্ষ কঠোর। রুলফোর বাবা রক্ষণশীলদের গুলিতে নিহত। জীবিতরাও মৃতবৎ হয়ে যায় তাদের অজান্তেই। সবাই যেন পেদ্রো পারামো উপন্যাসের বায়বীয় গ্রাম 'কমলা'-র বাসিন্দা হয়ে ওঠে। মরে ভুত হয়েছে বলেই হয়তো এরা মেহিকোর এই বিভীষিকার মধ্যে এখনো টিঁকে আছে!
‘ওরা আমাদের জমি দিয়েছিল’ এবং
‘লুভিনা’ গল্পে বৃষ্টিহীন যে প্রান্তরের কথা বলা
হয়েছে, সেই প্রান্তর
রুলফোর জীবনবাস্তবতারই অংশ। এই বিশেষ অর্থে রুলফোকে জাদুবাস্তবতার
আচ্ছাদনে খাঁটি বাস্তববাদী লেখক বলতে হয়। ‘ওরা আমাদের জমি দিয়েছিল’ গল্পে শুরুতে গল্পকথক ঘন্টার
পর ঘন্টা বৃক্ষের ছায়াহীন, চারাগাছ এমনকি শেকড়বাকড়হীন পথে হেঁটে
যাচ্ছিল। এতক্ষণে কুকুরের
ডাক শোনা গেল। তার মনে হচ্ছিল
ফুটিফাটা ধূ ধূ প্রান্তরের যেন শেষ নেই, যদি বা থাকে সেখানটায়
কিচ্ছু নেই। কিন্তু একটা
গ্রাম আছে, সেখানে কুকুর ডাকছে, মানুষের
গন্ধ মেশা ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে, যেন একটা আশা এখনো টিঁকে আছে। তবে গ্রামটি বেশ দূরে, ঝড়ো বাতাসের টানে কাছে বলে মনে হচ্ছে।
গল্পের সূচনার বুননশৈলী নিখুঁত, নিপাট এবং সুমিত। কথনে বাহুল্য নেই, আছে পরিমিতি ও শিল্প সৌকর্য। এখানেই নিহিত রয়েছে রুলফোর কুশলতা। আরো দেখা যেতে পারে।
অনেক মানুষের মাঝে মাত্র চারজন টিঁকে আছে। গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে চাষের জন্য এই মস্ত অকেজো প্রান্তরটি দেওয়া হয়েছে। সরকারি লোক এসে বলেছে, ‘এখান থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব জমিন তোমাদের।’ এই জমিতে বৃষ্টি হয় না কখনো। এভাবে গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকানো হয়েছে। গল্পকথক বলে –
তো, ওরা আমাদের এই জমি দিয়েছে। আর এই তপ্ত পৃথিবীপৃষ্ঠে ওরা চায় আমরা কিছু বুনি, দেখতে চায় কোনো কিছু আদৌ গজায় কিনা। কিন্তু এ মাটি থেকে কোনো কিছুই বের করে আনা সম্ভব নয়। এমনকি বাজপাখিও এখানে দেখবে না। তাদের তুমি দেখবে খুব উঁচুতে তড়িঘড়ি করে উড়ে যাচ্ছে, যত শিগগিরই সম্ভব এই অভিশপ্ত জমি থেকে পালিয়ে যেতে। এখানে তুমি এমনভাবে হাঁটো যেন পদে পদে পা পিছলে পেছনে ফিরে যাচ্ছে । উদ্ধৃত গল্পাংশে বড় নিদারুণভাবে হতদরিদ্র মানুষের নিঃস্ব জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আরো দেখানো হয়েছে কিভাবে নিরীহ গ্রামীণ মানুষদের ঠকিয়ে যাচ্ছে দেশের সরকার ও পুঁজিপতিগণ। মানবসমাজের একটা সার্বজনীন বঞ্চনা আর নিপীড়নের চিত্র এখানে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে এমন চিত্র দেখা যায়। তাই রুলফোর গল্পগুলির সার্ববজনীনতা স্বীকার করে নিতেই হয়।
গল্পের সূচনার বুননশৈলী নিখুঁত, নিপাট এবং সুমিত। কথনে বাহুল্য নেই, আছে পরিমিতি ও শিল্প সৌকর্য। এখানেই নিহিত রয়েছে রুলফোর কুশলতা। আরো দেখা যেতে পারে।
অনেক মানুষের মাঝে মাত্র চারজন টিঁকে আছে। গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে চাষের জন্য এই মস্ত অকেজো প্রান্তরটি দেওয়া হয়েছে। সরকারি লোক এসে বলেছে, ‘এখান থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব জমিন তোমাদের।’ এই জমিতে বৃষ্টি হয় না কখনো। এভাবে গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকানো হয়েছে। গল্পকথক বলে –
তো, ওরা আমাদের এই জমি দিয়েছে। আর এই তপ্ত পৃথিবীপৃষ্ঠে ওরা চায় আমরা কিছু বুনি, দেখতে চায় কোনো কিছু আদৌ গজায় কিনা। কিন্তু এ মাটি থেকে কোনো কিছুই বের করে আনা সম্ভব নয়। এমনকি বাজপাখিও এখানে দেখবে না। তাদের তুমি দেখবে খুব উঁচুতে তড়িঘড়ি করে উড়ে যাচ্ছে, যত শিগগিরই সম্ভব এই অভিশপ্ত জমি থেকে পালিয়ে যেতে। এখানে তুমি এমনভাবে হাঁটো যেন পদে পদে পা পিছলে পেছনে ফিরে যাচ্ছে । উদ্ধৃত গল্পাংশে বড় নিদারুণভাবে হতদরিদ্র মানুষের নিঃস্ব জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আরো দেখানো হয়েছে কিভাবে নিরীহ গ্রামীণ মানুষদের ঠকিয়ে যাচ্ছে দেশের সরকার ও পুঁজিপতিগণ। মানবসমাজের একটা সার্বজনীন বঞ্চনা আর নিপীড়নের চিত্র এখানে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে এমন চিত্র দেখা যায়। তাই রুলফোর গল্পগুলির সার্ববজনীনতা স্বীকার করে নিতেই হয়।
‘আমরা ভীষণ গরিব’ গল্পে গল্পকথকের পরিবার সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব। হঠাৎ বৃষ্টিতে পরিবারের শেষ অবলম্বন ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে। বোনের বিয়ের যৌতুক হিসেবে দাবি করা গরুটি বন্যায় ভেসে গেছে। এখন পরিবারের একমাত্র আশা হলো অবিবাহিত বোনটি। কারণ নিশ্চিত করে বলা যায় গরু যৌতুক ছাড়া কেউ তাকে বিয়ে করবে না। আর বিয়ে না হলে বড় দু’বোনের মতো সেও গণিকাবৃত্তি করে সংসারে সহায়তা করতে পারবে। ‘কোনো কুকুর ডাকে না’ গল্পে প্রাণহীন প্রান্তর ছেড়ে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে একটি বাসযোগ্য গ্রামের সন্ধানে পিতা মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে। ছেলে পথে ডাকাতের চাকুতে আহত হয়েছে, দ্রুত চিকিৎসা দরকার ওর। দীর্ঘক্ষণ চলার ফলে ছেলের পা বাবার কাঁধে গেঁথে গেছে। বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করছে কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছে কিনা। কারণ কুকুরের ডাক শুনতে পেলে তারা লোকালয়ের সন্ধান পাবে। যখন বাবা সত্যি-সত্যি কুকুরের ডাক শুনতে পায়, তখন ছেলে আর জীবিত নেই। অদ্ভুত সব কাহিনী, জনজীবনের বাস্তব সত্যের নিখুঁত চিত্রায়ন। মনে হয় রুলফোই বুঝি একমাত্র এমন লিখতে পারেন।
ছোটগল্পেও রুলফো কাল্পনিক গ্রামের প্রেক্ষিতে তাঁর সমসাময়িক চরম বাস্তবতার বেদনাবহ ছবি এঁকেছেন। তারই সাথে শিল্পবোধ সমৃদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টি ও মানবিক জীবনবোধের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহান কথাশিল্পী তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে কয়েক প্রজন্মের লেখকদের কাছে ‘ওস্তাদ’ কথাসাহিত্যিক হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও অমর হয়ে থাকবেন বলে বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন