নিষিদ্ধ কপাট
কলিংবেল। অনেকটা রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে এই প্রথম কলেজের মিহিরদার কোয়াটারে এলাম। বাইরে ঝড় উঠেছে।
একটু অপেক্ষা করতেই বৌদি দরজা খুললো।
- ‘আরে,
তুমি?’
- ‘মিহিরদাকে
একটা পত্রিকা দিতে এসেছিলাম।’
- ‘ও তো
বাড়ী নেই, অফিসের কাজে নাগপুর গেছে।’
আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না।
অজন্তা বৌদিই বললো - ‘এসেছো যখন ম্যাগাজিনটা
রেখে যাও।’
ততক্ষণে বাইরে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি নেমেছে। কী করে ফেরৎ যাবো - ভাবছি, অগত্যা ঘরের সোফায় বসে পড়লাম। মিহিরদার সাজানো গোছানো পরিপাটি সংসার।
বৌদি এগিয়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার কপাট দুটো খুলে দিলো। সরে গেলো
সামনের ভারী পর্দাটাও। এখান থেকে সামনেই
কোয়াটার্সগুলোর বারান্দায় কয়েকজন পড়শী, বিকেলের বৃষ্টিতে দৃশ্যপট
ঝাপসা দেখাচ্ছে। ওদের ওখান থেকেও
আমাদেরকে কি ঝাপসা দেখাচ্ছিলো?
এদিকে ঘরের হাট করে খুলে রাখা দরজাটা দিয়ে দামাল হাওয়া ভেতরে
ঢুকছে। সঙ্গে ভেজা ভেজা জলের
ছাট। ভাবছিলাম, এমন ঝড় বৃষ্টির সময়ে কপাট দুটোকে হাঁ করে
খোলা রাখাই কীই বা দরকার?
- ‘বসো
সুমন, চা আনছি।’
অজন্তা বৌদি আমার সামনে থেকে উঠে গেলো। ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা!
চারদিকে আতরের গন্ধ।
বৌদি সৌজন্যতামূলক চা এগিয়ে দিল। আমার সঙ্গে দু’একটা কথা। ক্রমশঃ বাইরের
হাওয়ার তেজ বেড়েই চলেছে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে ঘরটা ভরে গেলো আবছায়ায়। গুহাগাত্রে নিটোল
খোদাই করা ভাস্কর্যময়ী অজন্তাবৌদি আমার
মুখোমুখি! মনমুগ্ধকর ছায়াছবির একটা দৃশ্যের ভেতর বৌদি সোফা থেকে উঠে এলো, সামনে
এগিয়ে গেলো। আবার দরজাটা হাঁ করে খুলে দিলো! এবার কপাট দুটোর পায়ে রাবারের স্টপার।
ওটা আর বন্ধ হবে না। ঘরের ভেতরটা
আর্দ্রতায় ভিজে যাচ্ছিলো, তাতে তখনো আতরের গন্ধ।
কেউ কি শুনতে পারছিল আমাদের নিস্তব্ধতার কথা! দরজা বন্ধ থাকলে হঠাৎ করে কি
সুন্দরবনের জঙ্গল বেরিয়ে আসতে পারে? শুরু হয়ে যেতে পারে
যৌবনের ফিসফাস? উড়ে আসতে পারে সোঁদাল গন্ধ? বৃষ্টি একটু থেমে আসতেই আমিও ভিজতে ভিজতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
এরপরও অজন্তা বৌদির সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তার
দিকে তাকালেই মনে হয়েছে, আমাদের এই দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে পাথর হয়ে দেয়াল তুলে
রেখেছে সেদিনের সেই আতরমাখা বৃষ্টিদিন, সেদিনের সেই সাবধানী
ভারী দরজাটা, তার হাঁ-করে খুলে রাখা দু’দুটো নিষিদ্ধ কপাট!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন