শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




ধারাবাহিক উপন্যাস

          
প্রিয়দর্শিনী 



(পঞ্চম অধ্যায়)   


(১১)      


হাথ ফকিরো কো দিখানা অব্ জরুরী নহী!...
হামিদা বানু বেগমের শরীরটা ক’দিন হল ভালো নেই। মাথা ভার ভার। রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না, উপরন্তু সব সময় একটা বমি বমি ভাব। হামিদা বানুর জন্য আজকাল বিশেষ ধরনের খাদ্য দ্রব্য তৈরী করা হয়। বাদশা হুমায়ুন দুপুরে বা রাত্রে যে সমস্ত খানাপিনা গ্রহ করেন সেসব হামিদার ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করেনা। উলটে ওসবের খুশবু নাকে গেলে তার গা গুলিয়ে ওঠে। শাহী মহলের আরও যে সব মহিলা ও পুরুষ রয়েছেন তারাও দিনে রাতে বিভিন্ন সুস্বাদু মোগলাই খানা আহার করেন। বিভিন্ন ধরনের শরবৎ পেস্তা বাদাম দেওয়া গোলাপ পাপড়ি মিশ্রিত নানা ধরনের পানীয়, উটের দুধের পায়েস, পাঁঠার মাংসের ‘আস’ ইত্যাদি হরেক কিসিমের খানা মোগলাই রসুইকার তৈরী  করছেনতাছাড়া ঘোড়ার মাংস বকরী বা ইয়াকের নরম মাংস দিয়ে তৈরী কাবাব, বিভিন্ন রকমের মরশুমী ফল খেজুর আখরোট নারাঙ্গী বাদাম তরমুজ গীনা ইত্যাদি তো রয়েইছে। কিন্তু ওসবের গন্ধ নাকে একবার গেলে হামিদা বানুর বমনেচ্ছা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আছে নানা রকম সুগন্ধী বিরিয়ানি, মোতি পুলাউ, ফিরনি। কিন্তু হামিদা এসব ছুঁয়েও দেখেনা। বাদশা জননী দিলদার বেগম যখন জানতে পারলেন যে হামিদার খাদ্যদ্রব্যে অরুচি হয়েছে এবং সে প্রায় বমি করছে তখনি তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে হামিদা সন্তানসম্ভবা। আল্লাহর অসীম কৃপায় হামিদার গর্ভে হুমায়ুনের সন্তান জন্মলাভ করতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ তিনি হামিদার সংবাদবাহিকা দাসীটিকে দশটি আশরফি দান করলেন। হুকুম দিলেন রাজ্যে যত ফকির মিশকিন আছে তাদের জন্য যেন শাহী রসুই ঘরে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য তৈয়ার করা হয়। আজ সবাই পেট পুরে রাজভোগ খাবে। এবং এই  সুসংবাদ উপলক্ষে আগামীকাল দরবারে সাত হাজার লোককে রাজকীয় খেলাত প্রদান করা হবে। বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীদের স্বর্ণ নির্মিত পেয়ালা গোলাপ দান আফতাস ইত্যাদি উপহার দেওয়া হবে। সন্ধ্যেবেলা বাদশা যখন একান্তে বসে বিশ্রাম করবেন তখন যেন জমাটি জলসা বসানো হয়। এক কথায় হামিদা বানুর গর্ভসঞ্চার উপলক্ষে বিশেষ আনন্দোৎসব পালন একটি পবিত্র ঘটনা।
কিন্তু যার কারণে এই সব ব্যবস্থা, অর্থাৎ হামিদা, তার শরীর একটুও ভালো নেই। সর্ব্বদাই সে অলস ও উদ্যমহীন। স্নান করতে বা পোষাক বদলাতেও তার প্রবল অনীহা। তার কেশদাম এখন পূর্ব্বের চাইতেও আরও সুন্দর। স্নানের সময়  দাসীরা নানারকম সুগন্ধী তরলদ্রব্য সমস্ত শরীরে মার্জনা করে দেয়। তাতে তার গাত্রবর্ণ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। সব চাইতে আকর্ষক হামিদার চক্ষু দুইটি। দীর্ঘ অক্ষিপল্লবগুলি যেন হিন্দুকুশ পর্ব্ব্তমালার ওপরে পাইন দেওদার বৃক্ষের সারি। শাদীর পর হামিদার রূপ সৌন্দর্য্য যেন দ্বিগুণ হয়েছে। বাদশা হুমায়ুন তাই বেগমকে একটি মুহূর্ত্তের জন্য কাছছাড়া করতে চান না। তাঁর হুকুমের ওপর  আর কারুর কথা চলে না। বাদশা যখন যেখানে গমন করেন হামিদাও তাঁর সহগামিনী হয়। দিলদার বেগম প্রথমে একবার আপত্তি তুলেছিলেন। একে তো হামিদার বয়স অল্প। তার ওপর হুমায়ুন বর্ত্তমানে কাঁহা কাঁহা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর রাজ্যপাট খুবই অনিশ্চিত। ওদিকে আফগান শাক শের শাহ সুরী প্রায়  সমস্ত হিন্দুস্থান দখল করে বসে। মোগল রাজত্ব পুরোপুরি টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এ সময় শাহী মহলের জেনানাদের সঙ্গে রাখা অসমীচিন।

সোনালি জড়ির কাজ করা রক্তবর্ণের একটি মখমলের কার্পেটের ওপর জনা পাঁচেক সুন্দরী ইরানী যন্ত্রশিল্পীরা মধুর সংগীত পরিবেশন করছিল। এক মনে বাদশা সেই সুমধুর সংগীত শ্রবণ করছিলেন। মাত্র গতকালই হামিদার সঙ্গে তাঁর নিকাহ্ সম্পন্ন হয়েছে। তারপর রাত্রিতে যথা নিয়মে সুহাগ রাত কাটিয়ে মাত্র ঘন্টা খানেক হল বাদশা ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন। সুদর্শনা গায়িকাদের সংগীতের প্রত্যেকটি শব্দ ও সুর তিনি অতি একাগ্র চিত্তে শ্রবণ করছেন। পাশেই তাঁর জননী বসে। সম্মুখে সোনার পান দান। সোনার সুরাহী এবং দোলায়মান মোতি জহরতের গ্লা মা বললেন, বেটা আজ তো তুমি বালুচ ত্যাগ করছ! তা প্রথমে কোথায় যাবে কিছু ঠিক করেছো?
নিবিষ্টমনে সংগীত শ্রবন করলেও জননীর প্রত্যেকটি কথা বাদশার কানে গেছেসঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ মা। ঠিক করেছি এখান আমি সোজা ভক্করে যাব। তারপর সাইহোয়ান। সাইহোয়ানের দুর্গটা খুব মজবুত আর সুরক্ষিত। তাছাড়া স্থানটি অত্যন্ত নিরালা। ভেবে দেখলাম আসন্ন শীত ঋতুর জন্য ঐ মজবুত দুর্গটাই আমাদের জন্য উপযুক্ত।
আমাদের জন্য?
হ্যাঁ মা, আমি আর হামিদা বেগম।
হামিদাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও, কই এ কথা তো তুমি আগে আমায় বলোনি?
বাদশা মাথা নীচু করেই জবাব দিলেন, হ্যাঁ মা আমি মনস্থির করেছি হামিদা বেগম এবার থেকে সব সময় আমার সঙ্গেই থাকবে। যখন যে স্থানে অবস্থান করব, বেগম পাশে থাকলে আমার অতীত মনোবেদনা অনেক প্রশমিত হবে।
দিলদার বেগম সম্যকভাবে পুত্রের অন্তরের ব্যথা জানেন। চৌসার যুদ্ধে আফগানী শত্রুরা বাদশার তিন প্রিয়তমা পত্নী ও ছয় বৎসরের শিশু আকিকাকে গঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যা করেছিল। তার আগে তাদের বজরায় নির্মম ভাবে আগুন লাগানো হয়েছিল। কারুর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাদশা নিজেও তো ডুবতে বসেছিলেন। কিন্তু কে একভিস্তি অলা শেষমেষ তাঁকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু কন্যা ও বেগমদের হারানোর দুঃখ আজও তাঁকে প্রতি মুহূর্ত্তে দগ্ধ করে। তবু  দিলদার বেগম বললেন, সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু হামিদা আজ আবধি কোথ্থাও একাকী ভ্রম করেনি।। তুমি রাজকীয় কর্মে ব্যস্ত থাকবে, বেগমের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে কতক্ষণ?
মাননীয়া মাতাকে এবার বাদশা স্মিতহাস্যে জবাব দিলেন, ঠিক সেই জন্যই তাকে আমার সঙ্গে রাখতে চাই। আমি চাই হিন্দুস্থানের ভাবী বেগম সব দিক দিয়েই পারদর্শী হয়ে উঠুক।
তোমার কী মতলব বল তো বেটা?
হা হা করে এবার হেসে উঠলেন বাদশা। বললেন, মা তোমার ছেলেকে তুমি কী  ভাবো? তোমার আশীর্ব্বাদ থাকলে আবার আমি হিন্দুস্থানের বাদশা হব।
এ কথায় যার পর নাই খুশী হলেন দিলদার বেগম। বললেন, ছেলেমেয়ের দুর্দিনে বাপ-মায়ের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা উচিত। মা হিসেবে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে সমর্থন ও আশীর্ব্বাদ করছি।
পিতা হুজুরের আশীর্ব্বাদ তো আমি আগেই পেয়ে গেছি মা! সাইহোয়ানের ঐ মজবুত দুর্গটা আব্বা হুজুর তৈরী করে গেছিলেন। আপাতত আমরা এখন ওখানেই যাব।
কবে নাগা তোমরা যাত্রা শুরু করতে চাও?
আগামীকাল। আর দেরি করে ঠিক হবে না মা। বালুচ-এর এই স্থানটির সৌন্দর্য্য তীব্রভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছে, মনে হচ্ছে বরাবরের মত আমি এখানেই থেকে যাই।
মা এবার পুত্রের দিকে স্নিগ্ধদৃষ্টি দিয়ে বললেন, তা থাকো না! কে তোমায় এখানে বাধা দিচ্ছে?
না মা! তা হয় না! মির্জা কামরান চায় না আমি এখানে অধিষ্ঠান করি। আমাকে উৎখাত করবার জন্য সে সদা সর্বদাই প্রস্তুত। দেখলে না কাবুলেও সে আমাকে থিতু হতে দিল না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললেন, মির্জা কামরান তোমার ভাই বটে, কিন্তু সে যে  তোমার বৈমাত্রেয় ভাই সে কথা আমি নিজেও প্রায় ভুলে যাই। কিন্তু এখন আর ভুলি না। আমার মনে হয় কামরানকে গর্ভে ধার করে আমি ভুল করেছি।
মায়ের মুখে এ হেন বাক্য শ্রবণে অন্তরে প্রবল ব্যথা অনুভব করলেন হুমায়ুন।
না মা! কামরানকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি। তুমি বিশ্বাস করো, তার প্রতি আমার একটুও বৈরীভাব নেই। কাবুলে সেই বসবাস করুক, আমি হিন্দুস্থানে চলে যাব। তুমি শুধু আমায় আশীর্ব্বাদ করো!
এ কথার কোনও জবাব ফুটল না দিলদার বেগমের মুখে। তিনি চুপ করেই রইলেন। মির্জা কামরান তাঁর গর্ভজাত সন্তান। হুমায়ুন নন। অথচ হুমায়ুন কত আলাদা। কতই না তাঁর মাতৃভক্তি! ভ্রাতৃপ্রেম! ভাবতেই অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল তাঁর চক্ষুদুটি।

সেদিনের পর প্রায় একমাস অতিক্রান্ত। বালুচ ত্যাগ করে হুমায়ুন ভক্করে যান। সঙ্গে হামিদা ও জনা সাতেক সঙ্গীসাথী। বালুচ থেকে ভক্করে যাওয়ার পথ সুদীর্ঘ হলেও কষ্টদায়ক নয়। হামিদা এই প্রথম নৌকোয় চড়ল। স্বাত নদীর ওপর দিয়ে শাহী বজরায় বাদশা আর হামিদা বানু। চার দিন চার রাত সময় লেগেছিল বালুচ থেকে ভক্কর পৌঁছতে। এই কয়েকটি দিনের স্মৃতি মনে করলে এখনও হামিদার কর্ণমূল রাঙা হয়ে ওঠে। ছেলেমানুষের মত বাদশা হামিদাকে জড়িয়ে ধরে  রাখতেন সব সময়। পূর্ব্ব হতেই নৌকয় বেশ কিছু খাদ্যসামগ্রী ঘোড়া ও আরও নানান উপঢৌকন দিয়ে ভর্ত্তি করা হয়েছিল। তরদি বেগ ও মির্জা ইয়াদগার এরা দুজন সব সময় বজরার দুই প্রান্তে উদ্যত শামসের হাতে দন্ডায়মান। যে সমস্ত মাঝি মাল্লারা বজরা চালাচ্ছে তাদের দেখভাল করছে নাদিম কোকা খান ও তৈ্মুর সুলতান, খাজা গাজী। প্রত্যেকেই এরা হুমায়ুনের ভীষণ বিশ্বস্ত। রওশন কোকা নামে আরও একজন বিশ্বস্ত অনুচর দলের সঙ্গে রয়েছে। তার কাজ জলে ডাঙায় সর্বত্র তীক্ষ্ম নজর রাখা। মির্জা কামরান বা শের শাহর লোকজনেরা কেউ আক্রম করতে আসছে কি না! এলেই সে তুরন্ত যুদ্ধ ঘোষণা করবে। বজরার যে  অংশটিতে স্বয়ং বাদশা থাকবেন সেটিকে বিশেষ ভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। ছয় আসন ও কুঞ্জবিশিষ্ট নৌকর ওপরে ও নীচে ফুলের গাছ লাগানো। কিলফা, তাজে খেরাস ও নাফরমান বেলালা ফুলের গাছে সুসজ্জিত এ ধরনের নৌকো যখন চলতে শুরু করল, মনে হল, যেন সুন্দর একটি বাগান নদীর বুকে হেলে দুলে  উঠল। আল্লাহতালা বাদশার মাথায় এমন সব সৃজনী ক্ষমতা প্রকাশ পেল, দেখে শুনে হামিদা তাজ্জব না হয়ে পারে নি। নৌকর অদ্ভুত দুলুনি ওদিকে বাদশা  হামিদাকে একেবারে নিজের বক্ষস্থলে সংলগ্ন করে রেখেছেন। কিসে বেশি শিহরিত হবে তা বুঝতেই হামিদার কতক্ষণ সময় এমনিই পার হয়ে গেল।
একটি সূক্ষ্ম কারুকার্য্য করা ‘রোপাক’ রুমাল ধরা ছিল হামিদার ডান হাতে। সেটি দিয়ে হুমায়ুন বেগমের মুখ মুছিয়ে দিলেন। গাল চিবুক পরিষ্কার করে দিলেন। তারপর ফিসফিস করে উচ্চারণ করলেন, বলো!
আশ্লেষে হামিদার দুই চোখ তখন বন্ধ। মাত্র দুদিন আগে স্বামীর সঙ্গে তার  সুহাগ রাত সুসম্পন্ন হয়েছে। মানুষটাকে চিনতে এখনও অনেক বাকী। তবু এটুকু সে বুঝেছে, বাদশার মন শিশুর মত সুন্দর। হামিদাকে তিনি প্রাণতুল্য  ভালোবাসেন। তাঁর স্পর্শে কামনা বাসনা যত না আছে, প্রেম আছে অনেক বেশি। সুহাগ রাতের প্রথম চুম্বনে হামিদা এও উপলব্ধি করেছে, তার স্বামী কামুক নয়,  প্রেমিক। এখন তার বন্ধ চোখের পাতার ওপর বাদশা অতি সন্তপর্ণে চুম্বন এঁকে দিলেন। কী স্নিগ্ধ শীতল অনুভূতি হল হামিদার! বাদশা বললেন, তুমি চুপ করে  থেকো না বেগম! কিছু বলো! তোমার মুখ থেকে কিছু শুনব বলেই আজ আমরা অজানার দিকে যাত্রা করেছি। কিছু বলো...
কী বলবে হামিদা? একে তো স্বামী দেবতাটি তার চাইতে বয়সে অনেক বড়, তায়  আবার বাদশা। আবার নির্ব্বাক থাকাটাও নিতান্ত বেয়াদপি। অনেক ভেবেচিন্তে হামিদা বলল, আপনি আমায় কতটা ভালবাসেন?
কেন তুমি বুঝতে পারো না?
না। আপনি বলুন! 
তোমাকে না পেয়ে মনে মনে আমি কী রকম অশান্ত হয়ে উঠেছিলাম, তা তুমি  জানো না। কিন্তু এখন আর তা নেই। আমার মন এখন আগের চাইতে অনেক ভালো আছে।
একটু হাসল হামিদা। মনে মনে কিছুটা কৌতুক অনুভব করল। প্রত্যেক নারীই চায় তার পুরুষটি তাকে চোখে হারাক। তাই কৃত্রিম অভিমান করে বলল, ভালোই যদি বাসেন তো এতদিন দূরে রাখলেন কেন? আমি কিন্তু আপনাকে প্রথমবার দেখেই বুঝেছিলাম, আমার প্রতি আপনার আগ্রহ জন্মেছে।
বাদশা হাসলেন। বললেন, বুঝেছিলে বুঝি? কী করে বুঝলে? তোমার তো মাথায় নেকাব পরা ছিল!
এ কথার কোনও উত্তর দিল না হামিদা। বাদশার একদম বুকের কাছটিতে তার মুখটি রাখা। বেলালা ফুলের তীব্র সৌরভে ম’ ম’ করছে বজরার ভেতরটা। হলুদ একটি জামরুদখন্ড বসানো আংটি থেকে আলো পিছলিয়ে হামিদার মুখখানি এ মুহূর্ত্তে অপূর্ব্ব দেখাচ্ছে। বাদশা পত্নীর মুখ চুম্বন করলেন। তারপর ধীরে ধীরে  লাচক কাসাবাটি খুলতে শুরু করলেন। এটি বিবাহিতা মহিলাদের পোষাক। পোষাকটি পরতে ও খুলতে দাসীদের সাহায্য লাগে। হুমায়ুন সঙ্গে করে দাস দাসী  আনেন নি। হামিদার যা কিছু প্রয়োজন, ঠিক করেছেন, সব তিনি স্বহস্তেই করে  দেবেন। তাছাড়া জননীর পরামর্শবাক্য হুমায়ুনের স্মৃতিতে তো রয়েইছে।
হামিদা লজ্জা পাচ্ছিল। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাদশার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আচরণ করার অর্থ খোদার বিরুদ্ধাচার করা। সুতরাং সে চুপ করেই রইল। লাচক  কাসাবা খোলা হলে দেখা গেল হামিদার উন্মুক্ত শরীরের উর্ধাঙ্গে লোহিত বর্ণের মখমলের কাঁচুলি ও নিম্নাঙ্গে হাঁটু অবধি ঐ একই কাপড়ের টুকরোর আচ্ছাদন। সমস্ত বরতনু থেকে কস্তুরি গন্ধ বের হচ্ছে। বাদশা হামিদার চুলগুলির বাঁধনও খুলে দিলেন। তারপর বললেন, আমিই তোমার সঠিক স্বামী। বাদশার প্রেম লাভ করতে হলে অধিকার অর্জন করতে হয়। তুমি সেটা করতে পেরেছো হামিদা! কই দেখি তোমার হাত!
বাদশা পত্নীর ডান হাতের মধ্যে নিজের গোলাপ বর্ণ সদৃশ দক্ষিণ হস্ত স্থাপিত করলেন। হামিদার সমস্ত শরীর জুড়ে তখন স্বাত নদীর কুলুকুলু ধ্বনি।

আমার হাতে আলতো একটা আঙুল
ছুঁয়ে, সে মিষ্টি আহ্বান করল, কই
দেখি আপনার হাত।
আমি চোখ না খুলেও দেখলাম তাকে
শান্ত হাতটা দিলাম এগিয়ে
দূর্ব্বাঘাসের পেলব স্পর্শ ছুঁয়ে রইল
আমার আঙুল।
ধমনীর মধ্য দিয়ে স্বাতের কুলুধ্বনি
এক কল্প পর চোখ খুলে দেখলাম তার
হাওয়াটা তখনও আমার পাশে
স্থির।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন