প্রতিবেশী সাহিত্য
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর গল্প
(অনুবাদ : অদ্বয় চৌধুরী)
লেখক পরিচিতিঃ
কলম্বিয়ার অধিবাসী এবং নোবেল
পুরষ্কারপ্রাপ্ত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্ভবত সর্বোচ্চ পঠিত স্প্যানিশভাষী
লেখক। তাঁর লেখার যে বিশেষ বৈশিষ্টটি তাঁর লেখার সঙ্গে ওতোঃপ্রতভাবে জড়িত তা হল
জাদুবাস্তবতা। কিন্তু এখানে অনূদিত গল্পটিতে (যে ইংরেজিতে অনূদিত গল্পটি থেকে
এখানে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে তার নাম ছিল ‘ওয়ান অফ দিজ ডেজ’) সেই জাদুবাস্তবতা
নেই, বরং আছে শাসকের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বন্ধীয় এক বলিষ্ঠ এবং প্রত্যক্ষ
রাজনৈতিক বক্তব্য। কিন্তু তারপরেও এতটুকুও মেদবহুল অথবা আরোপিত হয়ে পড়েনি সেই চড়া
রাজনৈতিক দ্যোতনা। এটাই সম্ভবত এই গল্পটির একাধারে
বাস্তবতা এবং জাদু!
এর মধ্যে একদিন
সোমবারের
ভোর ছিল ভালোই গরম আর শুকনো। অরেলিও এসকোভার, এক ডিগ্রিহীন দাঁতের ডাক্তার, বরাবরের
অভ্যাস মতো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল
এবং সকাল ছ’টা বাজতে না বাজতেই তার চেম্বার খুলে বসে পড়েছিল। চেম্বারে
এসেই সে মুঠোয় করে কিছু যন্ত্রপাতি আর পলস্তারার ছাঁচের মধ্যে তখনও আটকানো কতগুলো নকল দাঁত
কাচের বাক্স থেকে বার করে এনে টেবিলের উপরে সাজিয়ে রেখেছিল। সাজানোর সময় সে তাদের আকার অনুযায়ী পরপর এমনভাবে সাজিয়েছিল যেন তাদের
প্রদর্শনী চলছে! গলায় সোনালি বোতাম লাগানো কলারহীন ডোরাকাটা জামা আর ফিতে দিয়ে ঝোলানো প্যান্ট পরেছিল ডাক্তার। তার চেহারাটা একহারা হলেও
বেশ খাড়া। তবে সেদিন তার দৃষ্টি ছিল আনমনা—
বধির লোকেদের দৃষ্টির মতো।
সব জিনিসপত্র টেবিলের উপরে সাজানো হয়ে গেলে
সে ড্রিলটাকে তার
চেয়ারের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে নকল দাঁতগুলোকে পালিশ করতে বসেছিল। একভাবে কাজ করে গেলেও কাজে তার মন ছিল না পুরোপুরি— যখন দরকার নেই তখনও বেখেয়ালে
পা দিয়ে ড্রিলটাকে চালিয়ে যাচ্ছিল।
আট’টা বাজার
পরে সে অল্পক্ষণের জন্যে কাজ থেকে মুখ তুলে তাকায় জানলা দিয়ে বাইরে। তখন দু’টো মনমরা চিল পাশের
বাড়ির ঢালু ছাদের উঁচু প্রান্তে বসে নিজেদের রোদে শুকোচ্ছিল। ফের কাজে বসতে বসতে
তার মনে হয় দুপুর বেলা খেতে যাওয়ার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হবে। কাজের তাল কাটে তার
এগারো বছরের ছেলের তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে।
‘বাবা।’
‘কিরে?’
‘মেয়র জানতে চাইছেন তুমি তাঁর দাঁত তুলবে
কিনা।’
‘ওঁকে বলে দাও আমি
এখানে নেই।’
সেই
সময় সে একটি সোনার দাঁত মাজাঘষা করছিল। এক হাত দূরে সেটাকে ধরে আধবোজা চোখে সে
খুঁটিয়ে দেখতে লাগে। ছোট্ট বসার ঘরটা থেকে তার ছেলের গলা আবার শোনা যায়।
‘মেয়র বলছেন তুমি
এখানে আছো কারণ তিনি তোমার গলা শুনতে পাচ্ছেন।’
কাজ
বন্ধ করে না ডাক্তার। দাঁত মাজাঘষা শেষ হলে সেটাকে টেবিলের উপরে রাখে এবং উত্তর
দেয়।
‘যত বেশি শুনতে পান
ততোই ভালো।’
সে
আবার ড্রিল চালাতে শুরু করে। কাজ বাকি থাকা জিনিসপত্র যে কার্ডবোর্ডের বাক্সটাতে রাখা থাকে
তার মধ্যে থেকে সে দাঁতের ব্রিজের অনেকগুলো টুকরো বার করে এনে সোনা পালিশ করতে
লাগে।
‘বাবা।’
‘কী?’
ডাক্তারের মুখের
ভাবে কোনো বদল ঘটে না তখনও।
‘মেয়র বলছেন যদি তুমি তাঁর দাঁত না তুলে দাও, তিনি তোমায়
গুলি করবেন।’
খুব
ধীরস্থির ভাবে ডাক্তার ড্রিল চালানো বন্ধ করে সেটাকে চেয়ার থেকে দূরে ঠেলে দেয়,
তারপর টেবিলের নীচের দেরাজটা টেনে পুরোটা বার করে আনে। সেখানে একটা পিস্তল রাখা
ছিল। এই সব কাজগুলো করা হয়ে গেলে তারপর সে উত্তর দেয়, ‘ঠিক আছে। ওঁকে বল ভিতরে এসে আমায় গুলি
করতে।’
ডাক্তার
হাতটাকে দেরাজের কানায় রেখে চেয়ারটা ঘুরিয়ে দরজার মুখোমুখি বসে। মেয়রকে দরজায় দেখা
যায়। তার বাঁ গালটা কামানো ছিল, কিন্তু যন্ত্রণায় ফুলে ওঠা ডান দিকের গালে পাঁচ
দিনের দাড়ি দেখা যায়। তার নিস্তেজ চোখেও একাধিক রাত জাগার ছাপ ফুটে উঠেছে।
দেরাজটাকে আঙুলের আলতো চাপে বন্ধ করে ডাক্তার নরম স্বরে বলে:
‘বসুন।’
‘সুপ্রভাত’।
মেয়র উত্তর দেয়।
‘হুঁ’।
যন্ত্রপাতিগুলো
যেসময় ফুটছিল সেইসময়টা মেয়র নিজের মাথাটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে একটু কষ্ট লাঘবের চেষ্টা
করে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল বরফের মতো ঠান্ডা। ডাক্তারখানাটা খুব সাধারণ। একটা
পুরোনো কাঠের চেয়ার, প্যাডেল করা ড্রিল, চীনেমাটির বোতলভর্তি একটা কাচের বাক্স।
চেয়ারের উলটো দিকে কাপড়ের পর্দা টাঙানো কাঁধ-সমান উঁচু জানলা। যখন মেয়র বোঝে
ডাক্তার তার কাছে আসছে, সে পা দু’টো জড়ো করে মুখটা বড়ো করে হাঁ করে।
অরেলিও
এসকোভার মেয়রের মাথাটা আলোর দিকে ঘুরিয়ে ধরে বিষিয়ে যাওয়া দাঁতটা পরখ করে, তারপর
আঙুলের সাবধানী চাপে মুখটা বন্ধ করে দেয়।
‘দাঁত
তোলার সময় ওখানে অ্যানাস্থেসিয়া করা যাবে না’।
‘সেকি!
কেন?’
‘কারণ
আপনার ফোঁড়া হয়েছে।’
ফ্যালফ্যালে
চোখে ডাক্তারের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে কোনোরকমে ‘আচ্ছা’ বলে
মেয়র একটু হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু ডাক্তার হাসি ফিরিয়ে দেয় না। সে গরম জলে
ডোবানো যন্ত্রপাতির পাত্রটা টেবিলের উপরে এনে ধীরেসুস্থে এক-জোড়া ঠান্ডা চিমটে
দিয়ে যন্ত্রগুলোকে জল থেকে তুলতে লাগে, তারপর পিকদানিটাকে জুতোর ডগা দিয়ে মেয়রের
দিকে সরিয়ে দিয়ে হাত ধুতে চলে যায়। এইসব কাজগুলো করার সময় সে মেয়রের দিকে একবারও
তাকায় না। মেয়রের দৃষ্টি কিন্তু সারাক্ষণ ডাক্তারের উপরেই স্থির থাকে।
ওটা নীচের
পাটির একটা আক্কেল দাঁত ছিল। ডাক্তার পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গরম সাঁড়াশি দিয়ে
দাঁতটাকে চেপে ধরলে মেয়র দুটো হাত দিয়ে চেয়ারের হাতল দু’টো জোরে আঁকড়ে ধরে আর
সমস্ত শক্তি দিয়ে পা দু’টোকে জড়ো করে মাটিতে চেপে রাখে। তার তলপেটে ছড়িয়ে পড়ে এক
হিমশীতল শূন্যতা। কিন্তু তারপরেও সে কোনো আওয়াজ করে না মুখে। ডাক্তার শুধুমাত্র
তার কব্জিটাকে সামান্য একটু মোচড় দিতে দিতে এক বিদ্বেষহীন তেতো সহানুভূতির স্বরে
বলে:
‘এখন আপনি
আমাদের কুড়িটা লাশের হিসেব চোকাবেন।’
মেয়রের মনে হয়
চোয়ালের হাড়গুলো গুঁড়ো হয়ে গেল। তার চোখ দিয়ে জলে ঝরে পড়ে। কিন্তু সে ততক্ষণ
দমটাকে আটকে রাখে যতক্ষণ না দাঁতটাকে বার করা হয়। কান্না ভেজা চোখে উপড়ানো
দাঁতটাকে দেখে তার যন্ত্রণার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কহীন মনে হয় মেয়রের। সে গত পাঁচ
রাতের কষ্টের কারণ বুঝতে পারে না।
ঘামে ভিজে
ওঠা, হাঁপাতে থাকা মেয়র পিকদানিটার উপরে ঝুঁকে পড়ে। তার উর্দির সব বোতাম খুলে দিয়ে
প্যান্টের পকেটে রুমাল হাতড়ায়। ডাক্তার তাকে একটা পরিষ্কার কাপড় বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘চোখটা মুছে
নিন’।
মেয়র
তাই করে। সে কাঁপছিল। যখন ডাক্তার হাত ধুচ্ছিল, সে ঝুলে পড়া ছাদ এবং সেই ছাদ থেকে
মাকড়সার ডিম আর মরা পোকা-মাকড় আটকে থাকা এক ধুলো-জড়ানো মাকড়সার জাল দেখছিল।
ডাক্তার হাত মুছে ফিরে আসে।
‘বিশ্রাম নিন, আর
নুন-জল দিয়ে কুলকুচি করবেন।’
উর্দির বোতাম খোলা
অবস্থাতেই মেয়র উঠে দাঁড়িয়ে হালকা সামরিক সেলাম ঠুকে দরজার দিকে এগোয়। বাইরে
বেরিয়ে সে ডাক্তারকে বলে,
‘বিলটা
পাঠিয়ে দেবেন’।
‘কোথায়?
আপনার কাছে, না দপ্তরে?’
মেয়র
তার দিকে চোখ না ফিরিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দেয় এবং আড়াল থেকেই বলে:
‘ধুর!
একই তো ব্যাপার।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন