ফুলে উঠছে
করুণা রাত্রি দুটোয় উঠেছিল প্রকৃতির ডাকে। বাথরুমের দরজায় আরশোলা। চটির আঘাতে
চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল তাকে। পরদিন সকালে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো। একটা উলঙ্গ মানুষের
মৃতদেহ। পাশের বাড়িতে ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে কে যেন মারা গেছে। সম্ভবত চুরি করতে
এসেছিল। ‘ডেসোলেট সিটি’! ‘ক্যালকাটা নাও অ্যান অ্যাবানডন্ড প্লেস’! মহাপ্রলয়ের কথা
ছাইমাখা নিঃসঙ্গ স্বামী বলেছিলেন ভক্তদের, আইআইটির অধ্যাপকরা গবেষণা করে নানারকম
তত্ত্ব দিয়েছিলেন, কাব্যে ছড়ায় বলা হয়েছিল কলিকাতা একদিন নড়িতে নড়িতে চলে যাবে
বহুদূরে। এখন কলকাতার পথ জুড়ে রাশি রাশি মৃতদেহ। নগ্ন, চিহ্নহীন। নাইন্টিন ফর্টিথ্রিতে
যুদ্ধের বাজারে নাকি এরকম লাশ ডিঙিয়ে ঘরে ফিরত বাঙালি। একাত্তরে ঠেলাগাড়ি করে
মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাশীপুর বরানগর থেকে। আজ ক্ষুধা নেই, হাতিয়ার নেই, রুণু গুহনিয়োগী
নেই তবু শহর জুড়ে এত মৃতদেহ কোথা থেকে এল? উপড়ে নেয়া গাছের জায়গায় ফুলের টবে মুখ
থুবড়ে পরে থাকা আলসে মরা। মানুষের কার্নিশ পরিচ্ছন্ন রাখতে ফেলে দেয়া কাকের বাসার
মধ্যে থেকে উঁকি মারা মৃত শিশু, ভ্রূণ। প্রতিটি মাংসের দোকানে মানুষের মাথা,
রক্তের গন্ধ, নাড়িভুঁড়ি। ঠিকরায় চর্বি, আঙুলের টুকরো, বিচ্ছিন্ন নাক, কান, গলা। গতকাল
মেডিক্যাল কলেজের ভিতর বিপজ্জনক ষোলটি কুকুরের বাচ্চাকে থেঁতলে খুন করা হয়েছিল।
ষোলটা মাথাফাটা বাচ্চা যেন ফেসবুকে আপলোড করা সিরিয়ার ফটোগ্রাফ। এই মৃত্যুর গন্ধমাখা
শহর থেকে প্রথমে কেটে পড়লো অর্থবানরা, যাদের চিরকালই তিনচারটে জায়গায় বাড়ি থাকে।
তারপর অস্বাস্থ্যকর এই শহর থেকে পাত্তারি গোটায় সুখী মধ্যবিত্ত। আবার কলোনি জীবন।
আবার লড়াই। মাভৈ! সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর ক্রমাগত যে জনস্রোত এসেছে এই শহরে
আশ্রয়ের টানে তারা ঘটি, বাটি, পুঁটলি নিয়ে
শেয়ালদা হাওড়া সহ সমস্ত রেলওয়ে স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা বিভ্রান্ত! মাটি
ফুলে উঠছে। মাটির তলায় পুঁতে ফেলা প্রাণীদের মৃতদেহগুলো ফুলে উঠছে। ভাঙা মৌচাকের
নিচে পুড়ে যাওয়া মানুষের বীভৎস দৃশ্য – আউশউইটসের নরক। বিকেলের রোদ্দুরমাথা সূর্য
হাঁ মুখে দেখছে এই রক্তমাখা শহর। ছিঁড়ে ফেলা ফুল সব কাটা পা, ছিন্ন আঙুল, উপরে
নেয়া চোখ। গা গুলিয়ে ওঠে সাংবাদিকের। করুণা মধ্যরাতে গিয়ে যে আরশোলাটিকে হত্যা করে
তার ঘিলু পরিষ্কার করতে এক বালতি জল লাগে। বস্তার ভিতর থেকে মরা বিড়ালের লাশ
মানুষের মুখ হয়ে যায়। অতঃপর শহরে পরে থাকে ভিখিরি ও পাগলেরা। গরীবেরা ভিন দেশে
পারি দেয় একে একে। কেউ কেউ মারা যায় পথে। আকাশের দিকে হাঁ করে মরে যাওয়া কুকুরের
মতো তাদের দেহগুলো পরে থাকে। খাওয়ার শেষ হওয়া, জল বিষিয়ে যাওয়া, রেবিজের গন্ধ
মাখা, সোয়াইন ফ্লু অধ্যুষিত শহরে, ম্যালেরিয়ার শহরে ভীত মানুষেরা খাবারের জন্য,
পরিচ্ছন্ন বাসস্থানের জন্য একে ওপরকে খুন করে। মৃতদেহ বারে সংখ্যায়। জন্তুর অভাবে
মানুষ মানুষের মাংস খায়, মৃতদেহ খায়। ভূতগ্রস্ত এই শহরে শীতকালে হঠাত বৃষ্টি নামে।
রক্ত ধুয়ে ধুয়ে জমা হয় নদী নালায়, বয়ে চলে সমুদ্রের দিকে, নীলগ্রহের ভবিষ্যৎ
লক্ষ্য করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন