পদাবলি - ২
(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায়
আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে
পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।
পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন
না। গরীব নয়,
কিন্তু গরীব সেজে থাকে।
বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে
বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে
কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা
চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ
বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায়
এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)
বিশ্বকাপ
ফুটবল চলছে তখনও। জমজমাট আড্ডা আর রসিকতা চারদিকে তাই নিয়ে। বাঙালির তো ফুটবলে
অরুচি হয় না। বর্ষাকাল। এইরকম বিচ্ছিরি ভ্যাপসা গরম আর টিপটিপে বৃষ্টিতে
রাতে পদা আবার এল। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটনো, কাদায়,ঘামে,
জলে ওর দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। এসেই বললো,
'বুঝলি, ভেবে
দেখলাম তিনটে ক্লাস এখন বজায় রয়েছে। এক হল, জনপ্রিয়
নামীদামীদের, যেমন ব্রেজিল, আর্জেন্টিনা,
যারা খেলুক/লিখুক আর যাই করুক, পাবলিক
ওদের সাপোর্ট করবেই করবে। আরেক হল উচ্চ বর্ণের, নাক
উঁচু, যেমন জার্মান, ইতালি,
যারা আত্মগর্বে আর কৌলীন্যের অহং এ শেষ হয়ে গেল। কেউ পুঁছল কী
না পুঁছল, তাতে তাদের কিচ্ছুটি যায় আসে না। বাকি পড়ে রইল
নমশূদ্র বেলিজিয়াম, সুইডেন, জাপান
আর তোদের মত যারা। ভাল খেললেও/লিখলেও কেউ পাত্তা দেয় না।' দরজা থেকে ওকে বিদেয় করতে করতে
প্রার্থনা করলাম, কাল থেকে যেন পদার মুখ আর বচন সহ্য
করতে না হয় প্রভু! আমাকে বাঁচতে দাও!
কিন্তু ওই যাকে বলে
জন্মশত্তুর। ও তাই আবারও এল একদিন। সেদিন ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। কাজান-এ খেলা হবে,
সেই নিয়ে টানটান উত্তেজনা সকলের। লুঙ্গি আর প্লাস্টিকের চটি পরে,
সক্কাল সক্কাল নিম দাঁতন সহ পদা এসে হাজির। বুঝলাম,
আজ দিন খারাপ যাবেই যাবে। ওকে বললাম, দেখ
তোর ভ্যাজরভ্যাজরের জন্য এই এফবি পাড়ায় আমি একটু কাব্য করতেও সুযোগ পাই না আর।
কিছু লিখলেই লোকে পদাকে টেনে আনে। তারচেয়ে তুইই একটা আইডি খোল আর লিখতে থাক। সঙ্গে
সঙ্গে বলল, তাই কী আর হয় রে! আমার এই বোতাম টেপা ফোন,
কথা শুনতে গেলে আবার ফোনের পিঠটা কানে চেপে ধরতে হয়। যাক,
আজ তো কোয়ার্টার ফাইনাল!
তো?
কী হবে রে?
কী আর হবে, দু’দল বাড়ি যাবে।
কা জানে কী হয় আজ!
‘কা জানে’ আবার কী? কী জানি লিখতে শেখ।
কাজানে কী যেন লিখে রেখেছে কার কপালে!
এই বলে থুথু করে নিমের ছিবড়ে ফেলে বিদেয় হল পদা।
আজ তো কোয়ার্টার ফাইনাল!
তো?
কী হবে রে?
কী আর হবে, দু’দল বাড়ি যাবে।
কা জানে কী হয় আজ!
‘কা জানে’ আবার কী? কী জানি লিখতে শেখ।
কাজানে কী যেন লিখে রেখেছে কার কপালে!
এই বলে থুথু করে নিমের ছিবড়ে ফেলে বিদেয় হল পদা।
কিন্তু বিদেয় কী সে হওয়ার পাত্র!
যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হল। ঠিক ব্রাজিলের খেলার আগে পদা উপস্থিত।
বলল, দেখলি, দেখলি? আমি বললাম, কী আর দেখব! চোখ হেজে গেল দেখতে দেখতে... পদা শুরু করল, শোন, দর্শন তোর কম্ম না জানি। তবুও তো
দুটো চোখ আছে। দেখিস না খেলা? শুধু লেখা দেখিস! ছিঃ! আমি অধোবদনে কিছু বলতে চেষ্টা করলাম..
পদা শুনলোই না। শুরু করল ওর ডায়লগ- লেখা হল লেখা। আর খেলা হল খেলা। খেলায় হারজিৎ
স্পোর্টিংলি মানতে হয়। আর লেখায় কোন হার নেই বুঝলি? বড় জায়গায় ছাপলে বড় নাম হয়, আর ছোটতে ছোট। তুই তো ছোটই, পুঁচকে। মেসি, রোনাল্ডো, ইনিয়েস্তা বাড়ি চলে গেছে, নেইমার আজ নয় কাল যাবে। তুই তো
ছোট হয়েও যাচ্ছিস না কোথাও!
এই প্রথম পদার ওপর আর রাগ করতে পারলাম না। ওকে ভালবেসে ফেললাম! আর তাই সোনা মুখ করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ রে পদা, যে সব বন্ধুদের আমাকে শুধু তাদের পেজ ইনভাইট করার সময় মনে পড়ে, তাদের লাইক দেওয়া উচিত নাকি না? পদা পান করার পর পান খায়। একমুখ পিক নিয়ে বলল, ' আয়না দেখেছিস? খাঁটি বেলজিয়ামের?' যাহ বাবা! এর সঙ্গে আয়নার কী সম্পর্ক? পদা পিচিক করল তিন হাত দূরে। একটু ছিটে এল কি? যাই হোক- যাক, যাক, আপদটা যাক এবার। তখন মুখ খুলল ও আবার। 'যত স্পষ্ট হবে প্রতিচ্ছবি, ততই জানবি বেলজিয়ামের দিকে সরে যাচ্ছিস। মানে আয়না থেকে বেলজিয়াম তোকে ডাকবে আর বলবে, প্লিজ প্লিজ আয় না, আয় না! বুঝলি এবার?' আমি তো আরও গুলিয়ে ফেললাম। তবে বুঝলাম ওই লাইকটা দিতেই হয় বোধহয়। কী লেখায়, কী খেলায়। আপনারা কিছু বুঝলেন?
অবশ্য আপনাদের বোঝাবুঝির আগেই লাঠি ঠুকতে ঠুকতে মাদাম
তুভোঁর উপস্থিতি টের পেলাম আমরা। অদ্য
উনি অত্যন্ত শান্ত চিত্তে আমাদিগের গৃহে উপবেশন করিলেন। আমরা মনে মনে সন্ত্রস্থ
হইলাম এই রূপ দেখিয়া। বুঝিলাম, তুফান আগত প্রায়। তাহারই আগমন বার্তা বহন করিতেছে
এই মুহূর্তের শান্ত, স্তব্ধ বাতাস। তাঁহার মুখমণ্ডলের প্রতি আমরা হাঁ করিয়া
তাকাইয়া রহিলাম। এই বুঝি, বোমার ন্যায় শব্দ নিক্ষেপিত হইল। অন্তরাত্মার কাঁপুনি
সামলাইতে সামলাইতে প্রায় জ্ঞান হারাইতে বসিয়াছি—সেই ক্ষণে মাদাম ঈষৎ গলা প্রক্ষেপণ
করিয়া আমাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। বলিলেন, ‘শোন বাছারা। আজ আমার মন প্রসন্ন
হয়ে আছে। তোমরা খেলা আর লেখা নিয়ে আর গোল কর না। গোল যে দেবার সেইই দেবে। কিছুক্ষণ
আগে বৃটিশ দলের গোল দেখলাম। গোলটা হল এক পিকচার
পার্ফেক্ট ফ্রিকিক থেকে। আর সেটা কোন নীলকুঠীর সাহেব দেয়নি! খেলাটা ইতিহাসে হয় না, মাঠে ময়দানে হয়। তোমরা শুধুশুধু
লেখার সময়ে ইতিহাস নিয়ে খেলা কর! এবার আমায় এক কাপ কালো কফি খাওয়ালে আমি যেতে
পারি।‘ এইরূপ বলিয়া তিনি মুখ বুজিলেন। আমি
ছুটিয়া চলিলাম রন্ধনশালায় দিকে, আর পদা আশ্রয় লইল কলঘরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন