ইতিহাসের জেরোনিমো
(৩)
লীসেরিয়োঁ
জেরোনিমো
ইতিহাস
অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায়, সাম্রাজ্যবাদ যখনই উপনিবেশীয় জনগণের উপর অত্যাচারের মাত্রা
বাড়িয়ে তোলে, সাধারণত তখনই দানা বাঁধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং সেই
আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন কোনো নির্ভিক বিপ্লবী, যাঁকে সকলে মান্য করে
এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে আবালবৃদ্ধবনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহের অনলে। এমনই
এক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন লীসেরিয়োঁ জেরোনিমো (Licerio
Geronimo)।
বহুযুগ ধরেই ফিলিপিন্স ছিল নিষ্ঠুর তথা অত্যাচারী
স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদের দখলে। দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদের দাপটে দখলীকৃত দেশগুলি
কার্যত হারিয়ে ফেলে তার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বা। স্থান-কাল-পাত্র
সর্বক্ষেত্রেই এমনকি নামকরণের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে বিদেশী প্রভাব। এমন
ঘটনা ঘটেছিল ফিলিপিন্সেও। সেই মর্মে লীসেরিয়োঁ নামটিও সেই স্পেনীয় সংস্কৃতিরই
অবদান।
১৮৫৫ সালের ২৭শে অগাস্ট, ম্যানিলা অন্তর্গত
‘সাম্পালোক’ (Sampaloc) নামে একটি
জায়গায় এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে লীসেরিয়োঁ জেরোনিমোর জন্ম। বাবা গ্রেসিয়ানোঁ ও মা
ফ্লেবিয়ানা দারিদ্র্যতার কারণে জেরোনিমোকে কোনো বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারেননি। ছোটবেলা
থেকেই ঘাসকাটা, জ্বালানী সংগ্রহ ও ক্ষেতের কাজে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতেন তিনি।
কিন্তু বাল্যকাল থেকেই তাঁর মনে ভর করেছিল, কিছু একটা করে দেখাবেন। দুরন্ত
ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই কাজের ফাঁকে তিনি স্কুল পড়ুয়াদের কাছ থেকে শিখে নিলেন
লেখাপড়া। ১৪ বছর বয়সে তাঁর ঠাকুরদার বাসস্থান বুলাকান-এর সান মিগুয়েল গ্রামে স্বাধীনভাবে শুরু করলেন চাষাবাদের কাজ। প্রথম
স্ত্রী মোডেস্টা ডি লা ত্রুজ-এর অকালমৃত্যুর পর তিনি সান মাটেয়োঁ গ্রামের কায়েটানা
লিংকার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং
পাঁচটি সন্তান হয় তাঁদের। পরবর্তীকালে নিজের পরিবার প্রতিপালনের জন্য তিনি যাত্রী
খেয়া পারাপারের কাজও শুরু করেন। ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে দানা বেঁধেছে
সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। কাটিপুনান নামে পরিচিত এক মুক্তি
আন্দোলনের নেতা ছিলেন বোনিফেসিয়োঁ। তিনি আন্দোলনের একটি শাখা
মাল্টানবানে প্রতিষ্ঠা করেন। লীসেরিয়োঁ জেরোনিমো
আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই শাখার সাধারণ সদস্য রূপে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই
তাঁর নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা, দক্ষতা এবং নির্ভীকতা সকলের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে
দাঁড়ায়। সকলেই তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেন।
মুক্তি সংগ্রামের নেতা
বেনিফেসিয়োঁর নির্দেশমতো ১৮৯৬ সালে জেরোনিমো বালিনটায়ক নামক স্থানে স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের নিয়ে গঠিত এক সৈন্যদলসহ মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে
১৮৯৬ সালের ৩০ আগস্ট সানজুয়াল ডেল মোনটের
ঐতিহাসিক সংগ্রাম শুরু হয়। এরপর তিনি মোন্টালবান নামক স্থানে এক নতুন গেরিলা
সৈন্যদল গড়ে তোলেন ও মাউন্টপুরের পার্বত্য অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল ফ্রান্সিসকো মাকাবুলস (General
Farncisco Maka bulus)এর নেতৃত্বে ফিলিপিন্সে স্পেনীয় সৈন্যদের
বিরুদ্ধে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়। এই লড়াইতে প্রচুর ক্ষতি হয় স্প্যানিশ সৈন্যদের। এই
যুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন জেরোনিমো। তাই একদিকে যেমন তাঁর পদোন্নতি ঘটে,
অপরদিকে জনপ্রিয়তাও দারুণভাবে বেড়ে যায় তাঁর। ফিলিপিন্সের অধিবাসীরা তাঁকে জেনারেল
সেরিয়োঁ (General Cerio)
নামে আখ্যায়িত করেন।
স্প্যানিশদের সাথে যুদ্ধে জেরোনিমো একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করে সৈন্যদলকে রক্ষা
করেছিলেন। পরিকল্পনা মাফিক স্পেনীয় শত্রুদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদের ভান্ডার
লুন্ঠন করে সংগ্রামীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় শত্রুপক্ষের উপরে তা প্রয়োগ করার জন্য।
১৮৯৮ সালে মার্কিন সৈন্যদল ফিলিপিন্স আক্রমণ করলে এই
পরিস্থিতির মোকাবিলায় স্পেনীয় সৈন্যদল
কিছুটা বাধ্য হয়েই স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে মার্কিনীদের
সঙ্গে রণে মেতে ওঠে, কিন্তু স্পেনের সৈন্যসামন্ত ম্যানিলা বে-তে (Manila
Bay) মুখ থুবড়ে পড়ে।
ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে ফিলিপিন্সের
আরেক মহান বিদ্রোহী নেতা এগুইনাল্ডো (Aguinaldo) ফিলিপিন্সে
ফিরে এসে পুনরায় স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এই সময় জেরোনিমো জেনারেল পিও
ডেল পিলর (General Pio Del Pilar)এর নেতৃত্বে গঠিত সৈন্যদলে
যোগ দিয়ে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে বছরের (১৮৯৮) নভেম্বর মাসে
এগুইনাল্ডো জেরোনিমোকে ডিভিশনাল জেনারেল পদে উন্নীত করে সান মাটিও’রিজাল নামক
স্থানে পাঠিয়ে দেন। এরপর যখন ফিলিপিন্স
মুক্তিবাহিনী এবং মার্কিনী সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় তখন ম্যারিকিনার (Marikinar)
রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল জেরোনিমোর কাঁধে এবং তিনি তা দুর্দান্তভাবে
পালন করেছিলেন। যুদ্ধর জন্য সংগ্রামীদের সংগঠিত করে, ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সানজুয়ান (San
Juan) ও ম্যান্ডালুয়াঁয় (Mandaaluyong) অত্যন্ত সাহসিকতার
সঙ্গে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়।
জেরোনিমোর এই নির্ভিকতা ও সফলতার পুরস্কারস্বরূপ অ্যান্টোনিয়োঁ লুনা (Antonio
Luna) তাঁকে তৃতীয় মিলিটারি জোনের কমান্ডিং জেনারেল পদে ভূষিত করে
ম্যানিলা ও রিজালে যুদ্ধ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব দেন।
১৮৯৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর
সানজুয়ানে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। আগ্রাসী মার্কিন সৈন্যদলের ওপর জেরোনিমো এবং তাঁর
হাতে গড়া গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান ১৩জন মার্কিন অফিসার সমেত
আমেরিকান জেনারেল হেনরি ডবলু লোটন (General Henry W. Lawton)। বলা যেতে পারে, কার্যত মুখ থুবড়ে
পড়ে মার্কিনীরা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯০০ সালে জেরোনিমো এবং তাঁর গেরিলাবাহিনী
মার্কিনী সৈন্যদের কাছ থেকে এক বিশাল ভূখন্ড ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। চপেটাঘাত
খাওয়া এই সমস্ত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরোনিমোকে ঘৃণা করতে শুরু করে এবং এই
ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে জেরোনিমোর নাম বা শব্দটি তাদের কাছে হয়ে ওঠে ঘৃণার
প্রতীক।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন