প্রতিবেশী সাহিত্য
জয়শ্রী রায়-এর গল্প
(অনুবাদ : মিতা দাশ)
লেখক পরিচিতি :
জয়শ্রী রায়ের জন্ম তৎকালীন
বিহার রাজ্যের (বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্য) হাজারীবাগে। জন্ম তারিখ ১৮ মে ১৯৬৬। তিনি
হিন্দী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। হিন্দী ভাষাতেই তিনি
সাহিত্যচর্চা করেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘তুম্মারে লিয়ে’, গল্প সংকলন
‘অনকহী’ ও ‘তুমহে ছু লু জরা’ এবং উপন্যাস ‘ইকবাল’।
এবার আর নয়
ভুল করে সে নিজের গন্তব্য থেকে দশ কি পনেরো কিলোমিটার আগেই নেমে পড়েছিল আর এখন দিগন্তে
মিশে যাওয়া এই রাষ্ট্রীয় রাজপথের ঠিক মাঝমাঝি দাঁড়িয়ে গরম হাওয়া ও ধূলোর কঠোর ঝাপটা সহ্য করছিল। এখন সন্ধ্যার সূর্য বালির সোনালী চরে'র
পেছন পিছলে গেছে, বাতাসের আগুনও আস্তে আস্তে নিভে যেতে
প্রস্তুত। ছাই হয়ে যাওয়া ক্ষিতিজের সামনে খেন্জরের
(মরুভূমিতে পাওয়া যায় এই নামের একটি গাছ) শ্যামবর্ণ
পাতার ছায়ার অন্ধকার বেড়ে উঠতে লাগলো।
এখন জানি না যে এরপর আবার
কখন বাস আসবে। রুমাল দিয়ে ঘামেভেজা
চিপচিপ মুখে বালির কণাগুলি মুছতে মুছতে সে নিজের ডান দিকের বস্তির দিকে ফিরে
তাকালো ... আট-দশটি মোট কাঁচাঘর-বাড়ি আর গরম হওয়ায় দুলছে কতগুলি কালশিটে
তাঁবু ও এদিক ওদিক উঠছে বসছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে বিচ্ছিরি তাদের আকৃতি, কোথাও কোথাও আবার জানালায় বা দেয়ালে জ্বালানো প্রদীপের আবছা চমক।
এখন কিছু একটা তো করতেই হবে, না
করলে কী বা উপায়! রাত ঘন হয়ে আসছে। সন্ধ্যের আলো আকাশকে
ঘন নীলে পরিবর্তিত করে তুলেছে। ঠিক সেই সময় সে দেখা
দিল, সেও কিছুই না ভেবেই এগিয়ে খৈরী সন্ধেতে
দুলতে থাকা রংচটা লাহাঙ্গা'র কাপড়টাকে আটকে নিল। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দুটি চোখ সন্ধ্যা তারার মত
জলে উঠলো, তার উপর একটি মৃদু হাসি আর মুচকি ভাষায় ... "কেনো আটকাছো বাবুজী..."
"আরে না!" ও সে একটু ঘাবড়ে গেল। এটি তারজন্যে একটি অজানা বস্তি ও সে এখানে একজন ভিনদেশি মানুষ ... কোনো ঝঞ্ঝাটে যেন সে না জড়িয়ে পড়ে! তক্ষুনি
কেউ যেন কেশে উঠলো। তারপর ওই রংচটা লাহাঙ্গা'র কাপড়ের পেছন থেকে একটি বুড়ো ঠাকুরের মত প্রকট হয়ে উঠলো। সাদা চুল আর মুখটা এমন কোঁচকানো যেন শক্ত করে কষে বাঁধা কোনো পুঁটলি। পিটপিট করা চোখে ছানি
ও জখম। ওই বুড়োটা একটু এগিয়ে
এসে ছানি পরা চোখ দিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখল ... বলল ... "কি গো বাবু, কি চাও?"
"না না কিছু না, আমি জঙ্গিপুর
যাবার রাস্তা খুঁজছিলাম, বোধহয় ইনি আমায় ভুল বুঝেছেন।
"না কোনো ভুল বোঝাবুঝি না, যদি
তোমার ওকে পছন্দ তাহলে যাও সামনের কুঁড়েঘরে। এক রাতের কিন্তু তিনশো টাকা লাগবে। তার সাথে খাবার ও মদ ও
..."
"হাঁ"... সে একটু চমকে উঠলো, "আর আপনি?"
"ধুমল, এই ছুঁড়ি'র বাপ"
"হাঁ!"
"এডভান্স"... বিরাট পাগড়ি'র নিচে থেকে দুটো জলন্ত চোখ যেন শক্ত পাথর, আর সামনে পাতা বিরাট হাত। কেন জানি না কেন সে কিছু না ভেবেই তার শক্ত হাতে তিনশ টাকা রেখে দিল। সেটা বোধহয় সে রেহাই পাবার তাগিদেই তুলে ধরেছিল ওই বুড়োটির হাতে।
"ঠিক আছে। রুক্মা এবার সামলা এই বাবুটিকে"। তারপর সে না থেমেই টলতে টলতে সামনের মদের আড্ডার
দিকে এগিয়ে গেল। সে’ও মন্ত্রমুগ্ধের মত সাত রঙের রাঙ্গানো লাহাঙ্গা'র
পিছু নিল। সেই সময় ওর চোখের
সামনে শুধু তার লাহাঙ্গা'র
ডুরেকাটা রং ও দুটি পায়ের পায়েল ও ফাটা পায়ের গোড়ালি দুটি। শ্যামলা পা।
একটি ছোট্ট কুঠরির ভেতর ঢুকেই সেই কিশোরী মেয়েটি ওকে
একটি দড়িওলা খাটে বসিয়ে একটি বাতি জেলে আনলো। বাতি থেকে বেশ কালো কালো ধোঁয়া উড়তে লাগল। সেই বাতির হলুদ আলো'য় এক এক করে দেয়ালে যে সব পশুপাখি'র ছবি জেগে উঠলো। নিজের দু’চোখ কচলাতে কচলাতে সেগুলি বিস্ফারিত চোখে দেখল। একটি গোটা দেয়াল শুধুই ঠাকুর দেবতার
ছবি দিয়ে সাজানো। আর তাদের সামনের দেয়ালের খাঁচায় নিভে যাওয়া প্রদীপ ও ধূপের ছাই স্তুপাকারে জমানো। চারিদিকে ময়লা কালো কাঁথা আর মাটির ধোঁয়ায়
কালো হয়ে যাওয়া বাসন-কোসন। ছাদে ধোঁয়া জমে একটি কালো দাগের মত দেখাচ্ছিল, মনে হয় বাতিটা নিরন্তর জ্বলতে থাকায় তার শিখা
দিয়ে তৈরী হয়েছিল।
এখন সেই কিশোরীটি নিজের কোঁচকানো আলখাল্লাটি নামিয়ে তার পায়ের কাছে মাটিতেই এসে বসল আর দু’চোখে কৌতুক ভরে মিটমিট করে তাকিয়ে রইলো। বাতির হলুদ আলোতে ওর
গোল চেহারাটা কাঁসার থালার মত ঝলসে উঠলো। কাজল ছড়ানো বড় বড়
ঝাপসা চোখ, বাদামী রঙের ঠোঁট আর ভরাট চিবুক। ওর চেহারাটা একদম একটি গ্রাম্য আদিম সৌন্দর্য-এর মত লাগলো। সে মুগ্ধ। আর সেই সৌন্দর্যের আকর্ষণে তার আদিম ক্ষুধা অজান্তেই জেগে উঠলো। এই অপরিচিত পরিবেশে সে একটু একটু করে উত্তেজনায় ভরে উঠতে
লাগলো। ওর পাকা গমের মত
গেহুয়া রং-এ রাঙ্গা শরীর ঘামে ভিজতে লাগলো। লাল ছিটের ব্লাউজের বগল ভিজে গেল। পায়ের গোড়ালি থেকে লাহাঙ্গা সরে যাওয়ায়
ঝলকে উঠলো।
হঠাত সে ওই কিশোরিটিকে কাছে টেনে নিজের কাছে বসালো। সেও কোনো সংকোচ না করে ওর গা সেঁটে বসে পড়ল, কিন্তু সে কিছু বলার বা
কোনো কিছু করার আগেই হঠাত দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। সে এগিয়ে দরজা খুলে দিল। একটি ছোট্ট মেয়ে একটি
শিশুকে নিয়ে এসে কিশোরীটির কোলে তুলে দিল। শিশুটি কাঁদছিল। ‘এক মিনিট বাবুজী’ বলে সে কুঠরির এক কোণে বসে ওর দিকে পীঠ করে
শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে লাগলো। ওর দড়ি দেয়া ব্লাউজের
বাইরের খোলা পীঠ ঝলসে উঠলো। দুধ খাওয়ার
চুসুর-চুসুর শব্দে গোটা কুঠরী ভরে উঠলো।
সে রীতিমতো শিউরে উঠলো। গোটা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দুধ খাইয়ে রুক্মা শিশুটিকে সেই মেয়েটির কোলে দিয়ে এলো। দোরে খিল দিয়ে ওর পাশে এসে বলল - "বাচ্চার শরীর খারাপ বাবুজী! অনেক দিন যাবৎ ওর জ্বর
নামছে না। এদিকে তিনচার দিন ধরে
কোনো গ্রাহকও আসেনি। তাই হাত খালি। আজ তুমি এসেছো, কাল
ওকে সকাল সকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, যদি বাপু সব
টাকা মদ খেয়ে উড়িয়ে না দেয়"। কথা শেষ করতে করতে ওর
গলা রুদ্ধ হয়ে উঠলো।
"তাহলে কি তোমার বিয়ে হয়েছে?" কথাটি জিজ্ঞাসা করতেই তার নজরে পড়ল যে কিশোরীটির আঁচল দুধ পড়ে এক্কেবারে ভিজে একসা। "আরে না না! আমি জানিনা কারটা পেটে ধরে বসেছি। জানিনা কোন গ্রাহক। সময় থাকতে ফেলতেও পারিনি" - বলতে বলতে সহজেই সে
ব্লাউজের দড়ি খুলতে লাগল। কিন্তু কে জানে তার কী যে হল, গোটা শরীর মোচড় দিয়ে উঠলো। বেশ কাছ থেকে দেখলে
রুক্মা'র চেহারাটা হঠাত তার নিজের ছোটবোনের মত মনে হল। বহু বছর আগে তার বাবা ব্যবসা'র দরুণ জঙ্গিপুর যেতে আসতে এই পথ দিয়ে অনেকবার এসেছে গেছে। বাবার মুখে এখানকার অনেক গল্পই ওর শোনা, এই
রুক্মাও কি সেই গল্পেরই কোনো এক গল্পের নায়িকা তো নয়! হে ভগবান!
"জানিনা কার পেটে ধরে বসেছি, জানিনা কোন গ্রাহক!" ... চুসুর চুসুর দুধ খাচ্ছিল শিশুটি। "সময় থাকতে ফেলতেও পারিনি!"
হঠাত সে উঠে দোরের দিকে এগিয়ে গেল -- না না! আর একটা
এমন শিশু না না, একটি আরো রুক্মা না না! রুক্মা আশ্চর্য চোখে তার পেছন পেছন ছুটে এলো। কিন্তু সে তীব্র বেগে বাইরের বেরিয়ে এলো, না
জানি কোন দিশায় যাবে বলে! সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই জায়গা থেকে দূরে কোনো গভীর রাতের
অন্ধকারে মিশে যেতে চায়। পেছন থেকে ভেসে আসা ডাক তাকে বেশ ভীত করে তুলছিল। সেই ডাকে যেন সেই শিশুটির শব্দও সম্মিলিত। মনে হয় সেই শিশুটি আবার জেগে কাঁদতে শুরু করেছে!
অনুবাদক পরিচিতি :
জন্মতারিখ ১২ জুলাই ১৯৬১ মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে। বর্তমানে বসবাস ছত্তিশগড়ের ভিলাই শহরে। একাধারে কবি, গল্পকার,
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। হিন্দি ও
বাংলা দুই ভাষায় সমানভাবে
লেখালেখি ও অনুবাদ করেন। হিন্দিতে তাঁর অনুবাদ সংকলন ‘কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রতিনিধি কবিতা’। বাংলায় নিজস্ব কবিতা সংকলন ‘অন্তরমম’। এছাড়া হিন্দি কবিতার বাংলায় অনুবাদের সংকলন ‘ভারতীয় ভাষার অঙ্গনে’। সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন হিন্দি ভাষায় খুবচাঁদ বাঘেল সম্মান, মহাত্মা গান্ধী রাষ্ট্রীয়
ভাষা প্রচার-প্রসার সম্মান এবং বাংলা ভাষায় কবি রবীন সুর সম্মান (শিলিগুড়ি)।
হঠাৎ করে চোখে পড়ল এই গল্প | গল্পের মূল গল্পের লেখিকা ঝাড়খন্ডের জেনে পড়া আগ্রহ একটু বেশী রকম হল ৷
উত্তরমুছুনহতাশ করে নি লেখিকা | মহিলাদের ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষন বেআব্রু লেখিকা নিপুন হাতে করেছেন ৷
অনুবাদের সাবলীলতা গল্পের ঝাঁঝ বজায রেখেছে ৷