ভৈরব
গাড়িতে উঠলে রেবেকার ভৈরবকে মনে পড়বেই। ভৈরব বারুই – সাধারণ খর্বকায়, মাঝারি চেহারা, পাতলা হয়ে আসা চুল। টুপি নামিয়ে লম্বা একটা সেলাম ঠুকে দিয়ে বলত,
-নেমস্তে মেডাম। গাড়ি মেঁ পধারিয়ে।
টিয়াকো ঠিক ব্যঠাও।
লজ্জা আর খুশি মিলিয়ে হেসে ফেলত রেবেকা। তখন ডাক্তার
বরের সঙ্গে সবে গেছে অখণ্ড বিহারে। কোলে তিয়াস। সেসব গতজন্মের কথা। রেবেকা দারুণ
ফর্সা, সাহেবি চামড়ার জন্যে রেবেকা নাম
হয়েছিল। আড়ষ্ট গলাতে বলত,
-তুম বাংলাতে বলো ভৈরব। আমি হিন্দী
পারিনা ভালো। আসলে তুম তো বাঙালিই হোতা হ্যায় না?
-হাঁ মেডাম, আমি বাংগালি হচ্ছি। বহুতদিন এদেশে থাকছি, হিন্দীটা পহেলে আসে
পড়ছে।
সরকারি হাসপাতাল, কাজের চাপ কম থাকলে
সফর ভালবাসত অনুপম। ভৈরবকে ডাকতে হত না, চলে আসত। একলা মানুষ, বিয়ে-থা করেছিল বা করেনি জানা হয়নি রেবেকার।
কতবার বিরক্ত হয়েছে অনুপম,
-লোকটার জ্বালায় ড্রাইভিং ভুলে যাব! স্টিয়ারিং ছুঁতে দেয়না!
-থাক্না, দূরের রাস্তা—প্রফেশ্যনাল লোক।
টেরিয়ে হাসত,
-হুঁ সুন্দরী মালকিন— সঙ্গী জাম্বুবান।
-কীসব বাজে!
দেড়শ-দুশো কিলোমিটার
রাস্তা হাল্কা ঢেউয়ের মাথায় নৌকো ভেসে চলত। স্পীডোমিটারের কাঁটা কখন একশ ছাড়িয়ে
যেত টের পাওয়া যেতনা। তখন রাস্তাঘাট তত ভালোও নয়। ভৈরবের অনায়াস মুঠোতে স্টিয়ারিং
জীবন্ত, নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাসী চোখ। পেছনে
জানালার বাইরে চোখ-ফেলা রেবেকার পাশে ত্বরিতগতিতে
দৃশ্যান্তর।
চালাতে চালাতে বকবক করত, মূলত দেশীয় রাজনীতি নিয়ে। সেটা রাজ্য ভাগাভাগির অশান্ত সময়। গাড়ি তীক্ষ্ণ
মোড় নিলে সতর্ক করত অনুপম,
-আঃ কেয়ারফুল!!
-চিন্তা নহীঁ সাহেব।
-তবু—!
-দেখবেন সাহেব আলাদা আদিবাসী স্টেট হলে, ইয়ে জামশেদপুর কেপিটল হয়ে যাবে।
-তোমার কি ফায়দা? তুমি তো এখানকার নও!
-বাঁকুড়ায় ঘর ছিল সাহেব। কবে এখেনে চলে
এসেছি।
-ভালো। দেখ কী হয়।
অভিজ্ঞতার কাহিনির খুচরো কানে ঢুকত রেবেকার। আলগা
মন্তব্য করে ফেলে অনুপমের দিকে তাকাত। হয়ত সমীচীন নয়, রীতিবিরুদ্ধ - যতই হোক ড্রাইভার! তবু রেবেকার মনে হত লোকটা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারে।
-বাঁকুড়ায় যাওনি আর কখনও?
-গেছি মেডাম, ভালো লাগেনি। বচপনে যা দেখেছি তার কত বদলে গেছে।
-আচ্ছা।
-শহর-বাজার হয়ে গেছে
মেডাম, মানুষজন আপনাপন হারিয়ে ফেলেছে। ব্যাস
ধান্দা—।
-এখানে?
-এখেনে ভী ওহী, তবু থোড়াসা আলাদা।
-সত্যি?
-দেখবেন মেডাম, আগে যে পাখপাখালি দেখা হমেশা যেত, কেমন কমে গেছে। এইযে
ছাইয়ের মতো রঙের পাখিগুলো আজকাল, আগে কোনোদিন দেখেছেন?
-পাখি?
রেবেকা হাসত। বিজ্ঞানের বিলুপ্ত আর লুপ্তপ্রায় জীবের
তত্ব না বুঝিয়ে চুপ করে ভৈরবের পাঁচালি শুনত।
রাজ্য আলাদা হলই। রেবেকা-অনুপম জামশেদপুরে বছরতিন, তারপরে নানা ঘাটে।
অনুপমের পদোন্নতি আর বদলি, জার্নি থামেনি। ইদানিং তাড়াহুড়োর সকালে
সোনা রোদের কাঠি টুং করে ঘুম ভাঙায়। অনুপম বেরিয়ে গেলে রেবেকার এন-জি-ও অফিসে যাওয়ার নির্দিষ্ট গাড়ি এসে
দাঁড়ায়। টিপটপ অবাঙালি ড্রাইভার যথোচিত সৌজন্য দেখিয়ে দরজা খুলে দেয়।
ভারিক্কি ম্যাডাম চশমা আর শাড়ির আঁচল সামলে পেছনের সীটে বসে। মিনিট পনেরোর
নিঃশব্দ জার্নি। কোন্ এক জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে নির্ভেজাল হাসিমুখ একখানা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন