ঘড়িদের
বাড়িঘর
পুরো সপ্তাহ একা একা কাটায় মা। ছুটির দিনে
সকাল থেকেই তাই কথার ঝাঁপি খুলে বসে। ভাল লাগুক না লাগুক সেসব সময় নিয়ে শুনি। এই
যে এখন সকাল দশটা। ছুটির সকাল দশটা মানে আমার কাছে ভোর। অথচ ঘুম লাগা চোখে জেগে
আছি। একটানা বকবক করে চলেছে মা। আর দুমদুম। সোফা পেটাচ্ছে, জানলার পর্দা,
ফার্নিচার। ধুলো ঝাড়ছে। বাবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। হাতে একটা পার্কার
কলম। কলমটা ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে বলল, জানিস, এটা তোর বাবাকে কে দিয়েছিল? উত্তরের
অপেক্ষা না করে নিজেই বলল, অমিতের বাবা। তোর সুমিতকাকু। যেবারে তোর বাবা
রিটায়ারমেন্টে গেল সেবছর সুমিতদা এই কলমটা দিয়েছিলেন। তোর মনে নেই? আরে তার পরের
বছরই তো বৌদির সেরিব্রাল এ্যাটাক। তখনও অমিতের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ হয়নি। সুমিতদার কাণ্ডটা একবার ভাব, ওইটুকু ছেলেকে কেউ বিয়ে দেয়! অমিতটার জন্য খুব
কষ্ট হয় রে...
অমিত আসলে আমার বন্ধু।
প্রতিবেশীও। কিছুদিন আগেও দেখতাম সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে গলির মুখে ওকে দাঁড়িয়ে
থাকতে। মুখে উদ্বেগ। চুলগুলো অবিন্যস্ত। আর ঘনঘন হাতঘড়ি দেখত ও। ইচ্ছে হত দু’দণ্ড দাঁড়াই। কিন্ত অফিস ফেরত পেটে তখন খিদে এমন - কী রে কেমন আছিস, চলছে,
বলতে বলতেই ছুট বাড়ির দিকে। অথচ আগে যখন অমিতের বউ বা আমার চাকরি কোনোটাই ছিল না, কত
অঢেল সময় আমরা একসাথে শেয়ার করতাম। ব্যক্তিগত কত কী কথা! কেবল তখন অবধি যে কথাটা জানতাম না - অমিত ঘড়ি হতে চেয়েছিল।
সানিয়াকে দেখতে খুব সুন্দর।
আর অভিনয় ছিল তার নেশা। বিয়ের পরপর আমাদের পাড়ার নাটক দলে নাম
লিখিয়েছিল। রোজ রিহার্সাল শেষে বাড়ি ফিরত সন্ধ্যায়। হঠাৎ শুনলাম সানিয়া সিনেমাতে চান্স পেয়েছে। পাল্টে যাবার শুরু তখন
থেকেই। আগে দেখা হলে তবু কথা বলত। আজকাল কাউকে চেনে না। পাড়ায় তাকে ঘিরে ফিসফিস চলে। এক রাতে মাকে নিয়ে মামার বাড়ি থেকে ফিরছি। ওদের বাড়ির সামনে দেখি ট্যাক্সি থেকে নামছে সানিয়া। টপ জিন্সে সানিয়াকে ড্যাম স্মার্ট লাগছিল।
মা নিচুস্বরে বলল, কী পরিবারে কী বউ! মুখে অবশ্য বলল, নতুনবৌমা না? এত রাত্তিরে কোথা থেকে? সানিয়া উত্তর না দিয়ে গটগট চলে
গেল বাড়ির গেটের দিকে। মা আমার হাতটা ধরল। বললো, কী সাহস দেখলি!
এভাবেই রাত করে বাড়ি ফেরাটা
সানিয়ার রুটিনে দাঁড়াতে অমিতেরও ঘড়ি কেনা শুরু হলো। আর সানিয়া যখন
মাঝরাত্তিরে ফিরতে শুরু করলো অমিত মন দিলো দেয়ালঘড়িতে। একদিন সানিয়া আর ফিরলো না। অমিত শহর চষে কিনে
আনলো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। ঘরভর্তি
ঘড়ি। দেয়াল ভর্তি ঘড়ি। বাড়িটা এখন ঘড়ির মিউজিয়াম।
যা বলছিলাম, ঘনঘন ঘড়ি দেখত অমিত। হরেকরকম ঘড়ি কিনতেও শুরু করেছিল।
জানতাম না কেবল, অমিত কেন ঘড়িই হতে চেয়েছিল। অথচ নানারকম দেয়ালঘড়ির মাঝে
সেকেন্ড মিনিট ঘন্টার ফাঁকে কোন ঘড়িটা অমিত, অন্য কেউ না চিনলেও আমি কিন্তু ঠিক
চিনে নিতে পারি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন