ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(চতুর্থ অধ্যায়)
(৮)
বালিঘড়ি (দ্বিতীয় অংশ)
তার বাবার ছবি আঁকার নেশা।
তাঁতঘরের সম্মুখে বসে সূক্ষ্ম কাপড়ের ওপর নকশা এঁকে চলছে। সেই অবস্থাতেই
বলল, ‘আদর দিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে তুমি
অন্ধ বোবা কালা করে তুলছো। ছেলে হবে ডাকাবুকো। শক্ত সমর্থ জোয়ান। গুণরাজ দাদার
ছেলে মুকুন্দকে দেখেছ? ও-ও তো আমাদের ছেলেরই বয়সী। অথচ কেমন সুস্থ সবল। যা বিবাক
বাইরে গিয়ে তোর মুকুন্দদাদার সঙ্গে খেল্।’
তার মা এরপর আর কিছু বলে না।
আরও একবার দুচোখ বন্ধ করে
বিবাক। দেখতে পায় রত্না নদীতে পালতোলা নৌকো ভেসে যাচ্ছে। নৌকো ভর্ত্তি কাপড় নুন ময়ূরের পালক তুলো। বড় গাঙে গিয়ে এসব নৌকো সোজা সপ্তগ্রাম
যাবে। সেখান থেকে সমুদ্রে। মধুকর ডিঙা তাদের নেই। সমুদ্রে যাওয়ার তাদের দরকারই পড়ে
না। বস্ত্র বিক্রি করেই খুব সচ্ছ্বল ভাবে তাদের সংসার চলে যায়।
মুকুন্দদাদা বিবাককে একদিন
বলেছিল, আমাদের জমিতে কত ধান হয় জানিস? আমার বাবা নিজে লাঙ্গল দেয় ক্ষেতে। তোকে
নিয়ে যাব একদিন – দেখবি কেমন ধান।
বন্ধ চোখটা এবার খুলে নেয়
বিবাক। চারিদিকে হলদে রঙের ঝকঝকে রোদ। বাতাসে শুকনো ধুলো আর খেজুরের গন্ধ।
মেহেরৌলীর দিকে আজ সন্ধ্যায় একটা বাজার বসে রোজ। আরব তুরস্ক ইরান ইত্যাদি নানান
স্থান থেকে অসংখ্য বাঁদী আর গোলাম নিয়ে এসে বিক্রি করা হয় সেই বাজারে। বাঁদীই বেশী বিক্রি হয়। সন্ধ্যের পর আজ সেখানে একবার
ঘুরে আসবে বিবাক। হাজার হাজার লোক লস্করের ভীড়ে গোপীকে ঠিক চিনে নিতে পারবে সে যদি
না গোপী ইতিমধ্যে দিল্লি শহর পরিত্যাগ না করে থাকে।
আকাশের দিকে চোখ তুলে চায়
বিবাক। তারপর নকাবটা ভাল করে মুড়ে নেয় মাথার চারপাশে গলায় বুকে। ১৮ রবিউল আউয়াল।
বিবাকের বালিঘড়ির বালি ঝড়ে পড়ে
নিজস্ব নিয়মে।
রাত্রে ঘুমিয়ে ভীষণ সেই ভয়ংকর
স্বপ্নটা আবার দেখল বিবাক। তার মা আলুথালু, প্রায় বিবস্ত্র... ঘরদোরে দাউদাউ করে
আগুন জ্বলছে। চতুর্দিকে কালো ধোঁয়া ও বিষবাষ্প। ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। বাবাকে
কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। একজন তস্কর মায়ের চুলের গোছা ধরে হিড়হিড় করে উঠোনে
নামিয়ে দিচ্ছে। গোয়াল ঘরে দু তিনটি দুধেল গাই...
সেগুলি অগ্নিতে পুর্নদগ্ধ প্রায়। তাঁতঘরটা সম্পুর্ণ ভস্মীভূত। অদূরে শিশু ও
মহিলাদের অস্ফূট ক্রন্দন ধ্বনি ও আর্ত্তনাদ। হতবিহ্বল বিবাক কী করেবে বুঝতেই পারছে না। এমনি অবস্থায় সাহায্যের জন্য কাকে ডাকবে জানা নেই। এমন দুর্ঘটনা ইতিপূর্বে কোনও দিনই সে প্রত্যক্ষ করেনি। কে এমন করে তাদের বসত বাটীতে আগুন ধরিয়ে দিল? পাড়া
প্রতিবেশিরাও সবাই উদ্ভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করছে। কেউ বা শোকে মাটীতে পড়ে গড়াগড়ি
দিচ্ছে। প্রত্যেকেই একই অবস্থার শিকার। অত্যাচারী ডিহিদার মাসুদ খান কাউকেই রেহাই
দেয় নি। বাংলাদেশকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে তবে তার শান্তি...!
ধড়মড় করে উঠে বসল বিবাক। উঃ কি
দুঃস্বপ্নটাই না দেখছিল এতক্ষণ... রাত এখন কত কে জানে! পথে কেবল কোতয়ালের
মুহুর্মুহু চীৎকার ধ্বনি। মনে হল নয় বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার দুঃস্বপ্ন আজও পিছু
ছাড়ে নি। রাতের অন্ধকারে দামুন্যায় গ্রামে মাসুদ খানের পোষা গুন্ডারা আগুন লাগিয়ে
দিয়েছিল। সিদ্ধাই অসোম রামানন্দ মুকুন্দদাদা সব্বার বাড়িই সেদিন আগুনে জ্বলেছে। কিন্তু মুকুন্দ
দাদা চীৎকার করেনি, একফোঁটা চোখের জল পড়তে দেখেনি কেউ। গুণরাজ দাদু তখন অনেক বুড়ো।
দস্যুদের কেউ একজন দাদুর গায়ে জলন্ত পাটকাঠি ছুঁড়ে দিয়েছিল। তারপর বিবাক ঐ অত চেঁচামেচি হৈ হল্লার মধ্যেও দেখতে পেয়েছিল দাদুর শরীরটা কেমন গলে গলে মাতির সঙ্গে মিশে গেল। মাসুদ খান এক নিমেষে তাদের সব্বাইকে সাত পুরুষের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে
দিয়েছিল। কেন এই শত্রুতা অনেক ভেবেও কোনও কূল কিনারা পায়নি বিবাক। মানুষ তার সাথেই
শত্রুতা করে যা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু তারা তো মাসুদ খানের কোনও
ক্ষতি করেনি। তবে?
মুকুন্দ দাদা বলেছিল, নতুন শাসক গৌড় থেকে দামুন্যা এসেছেন। উনি নাকি এদেশকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। এখানের সব কিছুই ওনার চর্মচক্ষে বিষবৎ।
বিবাক অবাক হয়ে শুধিয়েছিল, এমন
কেন? নতুন শাসক যদি মানুষের উন্নতির কথা না
ভাবে, তবে মানুষও তাকে খুব বেশীক্ষণ
পছন্দ করবে না।
মুকুন্দরাম বিবাককে বোঝায়, এটাই
জীবন। জীবন মানে ঘন ঘন পট পরিবর্ত্তন হওয়া। জীবন
মানে কিছু দৃশ্যের কুচকাওয়াজ। দামুন্যা থেকে গৌড়, গৌড় থেকে দিল্লী।
জমিদারের নিজস্ব দেশ যদি বদলায়
তো বদলাক, কিন্তু সে জন্য আমাদের মত সাধারণ লোকজন যারা, তাদের ভিটেমাতি মাতৃভূমির রঙ রূপ বদলে যাবে কেন?
তুই বুঝলি না বিবাক ইতিহাসে
মাত্র দুটো জাত। একটা ঘাতক অন্যটা শহীদ। যে কোনও একটা রাস্তা তোকে বাছতেই হবে। তোর
পছন্দ হলে যা না, আজই গিয়ে মাসুদ খানের দলে নাম
লিখিয়ে নে। তারপর দ্যাখ্ কেমন ওরা তোকে মাথায় তুলে নাচে! কিছু কিছু এলাকা শাসন করবার ক্ষমতাও তোকে দিয়ে দেবে। তখন ইচ্ছে করলে শাসনের
নামে তুই শোষণও করে নিতে পারবি।
উত্তরে বিবাক শুধু কোনও রকমে
বলল, সে আবার হয় নাকি? মানুষ চাইলেই অন্য মানুষের ওপর যেমন খুশী আচরন করতে পারে?
পারে বৈ কি?... এই যে নতুন
জমিদার মাসুদ খান গৌড় থেকে এসেছে সে কি তোর আমার কিসে উন্নতি হয় সেই দেখতে শুনতে
এসেছে? একদম না। জানবি এটা একটা হীন ষড়যন্ত্র। উনি কথা বলেন উর্দু ভাষায়। আমরা বলি
বাংলা। কেউ কারুরটা বুঝি না।
এই ব্যাপারটা সব সময় মাথায় রাখিস। তোর ক্ষমতা থাকলে গিয়ে মাসুদ খানের বিরুদ্ধে লড়। দেখ সঙ্গী সাথী পাস কি না?
বিবাক হাঁ করে শোনে। এত জটিলতা
মাথায় আসে না। তার বয়স মাত্র ষোলো। এবং এ বয়সে অন্যান্য ছেলেপুলেরা যা যা করে সেও
শুধুমাত্র সেইগুলোকেই এতদিন শিক্ষা করে এসেছে। নদীতে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার
দেওয়া, কুস্তি লড়া, গাছে চড়া, নৌকা বাওয়া ইত্যাদি। মারামারি লাঠালাঠি
করবার প্রয়োজন কোনওদিন হয়নি, ওসব সে পারবেও না। তবে হ্যাঁ আরও একটা কাজ নিকট অতীতে
সে খুব ভাল করে রপ্ত করেছে, তা হল তুলোর খন্ড থেকে সুতো প্রস্তুত করা ও সেই সুতো
দিয়ে কাপড় বোনা। গ্রামে ইতিমধ্যেই তার বোনা সূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছে।
মুকুন্দদাদার বিবাহ উৎসবে সে গ্রামের মেয়ে বউদের জন্য অনেক বস্ত্র স্বহস্তে তৈরী
করে দিয়েছিল। সক্কলেই এই মতামত প্রকাশ করেছিল খুব শীঘ্রই এরপর বিবাকেরও বিবাহ
অনুষ্ঠান পালন করা হবে। নতুন বধূ সুন্দর বস্ত্র পরিধান পূর্ব্বক দামুন্যার
সুবিখ্যাত শিব মন্দিরে গিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে স্বামী ও সংসারের কল্যাণ কামনায়
ব্রত পালন করবে। মুকুন্দরামও তাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিল, ‘আর মাত্র দুটো কি তিনটে বছর! এর মধ্যে বিবাক তুই বুটিদার জামদানী তৈইয়ারটা
রপ্ত করে নে দেখি! তবেই বিবাহের জন্য ভাল মেয়ে পাওয়া যাবে।’ আজ সন্ধ্যায় নির্জন
নদীচরে ঠিক এই কথাটারই পুনরুক্তি করল মুকুন্দরাম। বলল, ‘বিবাহ হয়ে গেলে বিবাক তুই তোর তৈরী বস্ত্র সম্ভার নিয়ে বিদেশে
পাড়ি দিস। বাংলাদেশের বাইরে বাংলার তৈরী সুতোর পোষাকের খুব চাহিদা এ কথা
এর পূর্ব্বেও আমি তোকে কয়েছি’!
মুকুন্দদাদার সঙ্গে সেটাই ছিল
বিবাকের শেষ বাক্যালাপ। দুজনে একসঙ্গে নির্জন নদীচরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ওপারে নীল
চক্রবাল রেখা। এদিকে মাঠের পারে কেয়া ঝোপ। মাঝে মাঝে হোগলা বন। টিয়ারা ঝাঁক বেঁধে
বাসা করেছে সেখানে। ময়না বুলবুলি শ্যামা খঞ্জনার মিষ্টি কিচির মিচির। সন্ধ্যার বাতাসে শাল কুসুমের গন্ধ..., ভারি ভাল
লাগছিল বিবাকের, মুকুন্দদাদা কবি মানুষ। কত রকম
রকম ভাব, সে যেন এক অন্য পৃথিবী। বাসক ফুলের ঝাড় থেকে সুমিষ্ট গন্ধ বয়। মৌমাছি ও কাচপোকার গুঞ্জনে নদীঘাট যাওয়ার পথটি কেমন
মায়াময়! উলুখড় বোঝাই গোরুর গাড়ি চলে যায় ধীরে দূর রাস্তা দিয়ে।
মুকুন্দদাদার কথা শুনতে শুনতে
সন্ধ্যা নামে। লাল পশ্চিমাকাশের দিকে পেছন ফিরে দুজনে বাড়ি ফেরার পথ ধরছিল। সেদিনের পর থেকে এই সবই স্মৃতি। আর কোনও দিনই
তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। সেই
রাতেই গ্রামে সবার বাড়িতে আগুন লাগে।
রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে বিছানায়
বসে বিবাকের মনে হয় কী অদ্ভূ্ত সব
আজব কথ! যা তার জীবনের অংশ অথচ জীবন
তাকে ছাড়িয়ে হেঁটে চলে এসেছে আজ এতদূর। ঘটনাগুলো অমনি না হলেও তো তার জীবন এমনই থাকত! কী এমন পার্থক্য হত? উটের চামড়ার বানানো
ছাউনির নীচে আজ যেমন ঘুমোচ্ছিল, হয়ত তেমনই ঘুমতো। একথা ভাবতেই তার হঠাৎ হাসি পায়। মনে হয় তবে কি সে হেরে গেল? হুমায়ুন বাদশা বলেছিলেন, ‘সব সময় জেতা যায় না। যখন জিতছি না তখন পালাতে হবে। যেমন আমি পালিয়েছিলাম।
প্রথমে গৌড় থেকে দিল্লী, তারপর দিল্লী থেকে কাবুল। কাবুলেও জায়গা হল না দেখে পালালাম সাইহোয়ান। আবার সেখান থেকে দিল্লী’।
বিছানা থেকে উঠে জল খেল বিবাক।
বিছানা বলতে অবশ্য চামড়ার শতরঞ্চ। তার পরনে এখন একটি সাদামাটা কাপড় দুই ফেরতা দিয়ে পরা। উর্ধাঙ্গে আরও একটি কাপড়। অনেক বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, অনেক ঝড় বিপর্যয়
পার করে এসেছে। তবু এই সাধারণ
কাপড়খানি সে আজও কাছ ছাড়া করেনি। এই কাপড় দু’খানি তার নিজের হাতে বোনা। অতি সাধারণ সুতোর কাপড়, যে সুতোর জন্ম সেই সুদূর বাংলাদেশ। বাং-লা-দে-শ!
মানুষের সত্যকার ইতিহাস কোথায়
লেখা থাকে? বাদশাহদের যুদ্ধে? সম্রাটের সোনালি জড়ির পোষাকে? প্রথমবার তার বাবা যখন
হাট থেকে লাল বর্ণের সুন্দর একটি ঘোড়া কিনে এনে পল্লীর মধ্যে গৃহস্থ সকলের মনে
আনন্দের ঢেউ তুলে ছিল, কিংবা দামুন্যা ছেড়ে আসবার পর সহায় নেই, সম্বল নেই, পথের ধারে আমগাছের ডালে পুঁটুলি বাঁধা ছাতু ও গুড়
সহযোগে জল খেয়ে রাতে সেখানেই ঘুমনো, পাশের তাঁবুতে জনা পাঁচেক তাতার কি কিরঘিজ
শ্রমিক ঘুমোচ্ছে- তাদের সুখ দুঃখ, আশা নিরাশার গল্প - সেও তো অনেকটা এই রকমই। যে জীবন হাজার হাজার বছর ধরে প্রতি
সকাল প্রতি সন্ধ্যায় যাপিত হচ্ছে, মানুষ সেইটুকুই জানতে চায়। প্রতিদিনের তুচ্ছ
বেঁচে থাকা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনকথা। এরই মধ্যে রয়েছে সত্যিকারের আনন্দ। বাংলার জল
হাওয়ার একটি প্রধান গুণ সেটি এই যে ভাবালুতা, আবেগময়তা, যা সচরাচর আর কোথাও চোখে
পড়ে না। বাংলার নদী নালা মাঠঘাট আকাশ বাতাস পাখির কলকাকলিও সেই আবেগময়তার কথাই
অহরহ বলে চলে।
মুকুন্দদাদা বলত, পাখির গান,
আকাশের নীলাভ নদীর জলের কলতানের ভাষা একবার যদি তুই বুঝতে পারিস বিবাক, জানবি তোকে
আর কেউ কোনওদিন দুঃখ দিতে পারবে না। তোর মন তখন শুধু এদেরই সঙ্গ পেতে চাইবে,
‘তুমি এত কিছু ভাব মুকুন্দদাদা? কই আমার মাথায় তো
এসব ভাবনা আসে না!’
‘হাঃ হাঃ হাঃ! ওরে আমিও এসব ভাবি না, কিন্তু ভাবনা নিজেই চলে আসে। শুধু তখনই তাই গান গেয়ে উঠি বা কবিতা লিখি’।
‘তুমি হলে স্বভাব কবি! তাছাড়া কত লেখাপড়া জানো।
কিন্তু তুমি যেসব কবিতা লেখো সেগুলো সংস্কৃতে না লিখে কেমন একটা ভাষায়
লেখো। কেন এমন লেখো?’
মুকুন্দরাম উত্তর দেয় না, মুচকি
মুচকি হাসে। বিবাক আবার বলে, ‘সেইজন্য
তোমার লেখা কবিতা কেউ পছন্দ করে না’।
‘তুই কি করে জানলি যে আমার লেখা কবিতাগুলো সংস্কৃত
ভাষায় লেখা নয়, এ যাবৎ আমি তো কাউকেই আমার রচনা শোনাইনি’।
বিবাক বলল, ‘আমি জানি। গুণরাজদাদু অবশ্য তোমার লেখার সুখ্যাতি করেন, কিন্তু সনাতন পন্ডিত দু’চক্ষে তোমার রচনা সহ্য করতে পারেন না’।
‘ওনার তো আমার ওপর বিদ্বেষ হবেই। উনি সংস্কৃত
পারদর্শী। টোলের মহা পন্ডিত। ছেলেবেলায় উনি আমার পিঠে ক’খানা বেত ভেঙে ছিলেন তা
জানিস? লেখাপড়ার জন্য তখন বাধ্য হয়ে শ্লোক মুখস্থ করতাম, কিন্তু কথা বলার সময়ও যদি
ঐ শ্লোকের ভাষাতেই কথা বলি তবে মনে শান্তি পাই না। সংস্কৃত দিয়ে কথা বলার অর্থ প্রাচীন চিন্তার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকা। তাছাড়া
আমার জননী সংস্কৃত একবর্ণ বুঝতে পারেন না। গৃহে তবে মায়ের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা
কইব? বুঝলি বিবাক, আমি তাই সংস্কৃত নয়, আমার মায়ের ভাষাতেই কথা বলতে ও ঐ ভাষাতেই
কবিতা লিখতে বেশী পছন্দ করি’।
বিবাক বলল, ‘সনাতন পন্ডিত বলে, ওটা নাকি প্রাকৃত ভাষা। যত
রাজ্যের গরীব, না খেতে পাওয়া উণ পাঁজুরেরা ঐ ভাষায় কথা কয়। ভদ্রলোকদের ভাষা ওটা নয়’।
‘বলে বুঝি? তা বলতে দে! পন্ডিতরা ঐ রকমই বলে। তবে
এটা ঠিক এই প্রাকৃত ভাষা নদী আকাশ আর পাখ-পাখালির ভাষা থেকে তেমন কিছু আলাদা নয়। প্রাকৃতের জন্ম অনেক আগেই হয়ে
গেছে। সংস্কৃতের আড়ালে কখন যে এই ভাষা গোপনে ডানা মেলেছে কেউ বলতে পারে না। অনেকগুলো
স্তর বা পর্যায় পার হয়ে এসেছে প্রাকৃত। আর এখন আমরা প্রাকৃতের যে স্তরে রয়েছি তার
নাম অবহটঠ্আ অপভ্রংশ’।
বিবাকের খুব ভাল লাগছিল। কে
জানে এসব শুনলে কখন যে অজান্তেই মন ভাল হয়ে যায়, হৃদয় আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। মুকুন্দরাম বলে চলেছে, ‘অনেক
গুলো অবহটঠ্ রয়েছে। তার মধ্যে একটা হল মাগধী অপভ্রংশ। মাগধী অপভ্রংশের আবার তিনটি
শাখা ১)পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ ২)মধ্য মাগধী অপভ্রংশ ৩) পশ্চিম মাগধী অপভ্রংশ। আমরা দুজনে এখন যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি সেই বাংলা
ভাষার জন্ম পূর্ব্ব মাগধী থেকে। তুই জানিস বিবাক, খুব জোরে বৃষ্টি হলে আমরা বলি, ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার মা বলেন, উপ্রঝান্তে বৃষ্টি। আমরা বলি, আঙিনায় কানাই বলাই। আমার মা বলেন, পিড়েতে কানাই
বলাই। আমরা বলি প্যান্ডেল, মা উচ্চারণ করেন ম্যারাপ। আমি আমার মা’কে
খুব ভালবাসি বিবাক! আমাদের সমাজে মা বোন স্ত্রী এদের যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন
করার কেউ নেই। এদের মুল্য শুধু গৃহকর্মে ও সন্তান উৎপাদনে... বলতে বলতে
মুকুন্দরামের চক্ষু দুটি সজল হয়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে বিবাক জবাব দিল, ‘ঠিক বলেছো তুমি। আমাদের সমাজে নারীর জায়গা এখনও অনেক নীচে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি তো রয়েইছে,
তার ওপর মেয়েরা শরীর শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই পুরুষ অপেক্ষা অনেক পশ্চাতে’।
‘তুই জানিস বিবাক, এই অপভ্রংশ ভাষায় কবিরা কত সুন্দর সুন্দর পদ রচনা করে গেছেন! পদ-এর ভাষা যেমন অভিনব, এগুলি
শুনতেও মনোহরণ’।
‘তুমি কি সেই সব কবিদের চেন মুকুন্দদাদা?’
‘চিনি তো! আমি জানি ওগুলো। কবি অনেক কাহ্ণ-পা,
লুই-পা, কুক্কুরী-পা, ভুসুকু-পা, সরহ-পা, বিরু-আপা। তবে সবচেয়ে
বেশি পদ লিখেছেন কাহ্ণ-পা। যাঁর অন্য নাম কৃষ্ণাচার্য্য বা কৃষ্ণাচার্য্যপাদ বা
কৃষ্ণবজপাদ। তিনি লিখেছেন তেরোটি গান। আর ভুসুকু-পা লিখেছেন আটটি গান। তবে এসব গান
বা পদ কোনওটাই তোর আমার মত সাধারণ শ্রোতার জন্য নয়। এগুলো আসলে তান্ত্রিকগাথা। মণি
মাণিক্যের মত কবিতাকে তাঁরা সাজিয়েছেন উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষায়। এ হল গিয়ে জন্মকালের
বাংলাভাষা। এবং শুধু এই জন্যই এইসব পদ ভীষণ দামী। এবার বল্ আমার মায়ের ভাষা কি
তুচ্ছ করার জিনিষ?’
বিবাকের মুখে কোনও কথাই যোগাল
না। সে এক্কেবারে চুপ। মুকুন্দরাম আরও বলল, চর্যাপদের কিছু কিছু শব্দ শোনাই তোকে, মন দিয়ে শোন্! দেখ শুনতে কেমন লাগে!
গনঅ (আকাশ), গুহাড়া (অনুরোধ), ঘলিলি (নিলাম), জানহুঁ (জানি), জোহা (জ্যোৎস্না), ণাণা (নানারকম), ণাবড়ি (ছোটনৌকো), মরণ অঅণা (মরণ ও জীবন), নঈ (নদী), সাসুঘরে( শ্বশুরঘর)...’
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন