পরিত্যক্ত
বিকেলবেলা
দক্ষিণের বারান্দায় বসে জঙ্গলের হাতছানি দেখতে ভালোবাসেন শ্রীময়ী। সুখি চা
দিয়ে যায়। চা খেতে
খেতে শেষ আলোয় ভিজতে থাকা ঘন
সবুজদের প্রেমালাপ শোনেন। মাথার ওপরে ধূ ধূ ঢেউ, মেঘ ছড়ানো
আকাশের। চলে যাবার আগে দিনের সঙ্গে তাদের সমবেত মাতন দেখতে
দেখতে দিব্যি লাফ দিয়ে পেরিয়ে যান গোটা দিনের জড়তা। যাবার সময় তাঁরও হয়েছে। তাকে ভিজিয়ে দেবার আলোরা নিজস্ব সবুজ
খুঁজে নিয়েছে।
দু’বছর
হয়ে গেছে তিনি এই আশ্রমে এসেছেন। স্বরাজ চলে যাবার পর মাত্র একটা বছর, ছেচল্লিশ বছরের যাপনের হাত তখনো শুকোয়
নি, কী যে হল! বুঝতে বুঝতেই তার স্বপ্নের
পৃথিবী সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভেঙেছে। কুচিকুচি ফেনার রাশি বুকে ভাসিয়ে
ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা থেকে বীরভূম। আদিবাসী গ্রামের কাছাকাছি,
রবীন্দ্রনাথের কোপাই নদীর গন্ধমাখা এই আশ্রয়ে সেই ফেনার সাথেই দিনযাপন। নিধি আর
বুলানের এই পছন্দটুকুকে তারিফ করতেই হয়। না হলে
হয়তো দিনগুলো অনেক বেশি হাওয়াশূন্য লাগতো।
কী থেকে কী
হল আজও বুঝে উঠতে পারেন না শ্রীময়ী। স্বরাজ বলতো বটে বুলান বউয়ের আঁচলধরা, তিনি পাত্তা দিতেন না।
ভালোবাসার বিয়েতে অমন গা ঘেঁষাঘেঁষি হয়।
তাঁরই তো ছেলে, বউ। অত ধরলে চলে! পিকু তো ঠাম্মি বলতে পাগল ছিল। এখানকার অবসরে দিনভোর পিকুর মুখের
বুজকুড়ি। তখন মনের জলে সকালের রোদ চিকমিক। ঐ যে জঙ্গলের আগে শুয়ে থাকা মাঠ,
সেখানে ছেলেপুলেদের হুটোপুটি। এইসময় ওদের ভেতর এক একটা জ্যান্ত
পিকু ঢুকে পরে। পিকু লাফায়, চেঁচায়, দৌড়ায়, পিকু ডিগবাজি খায়। শুধু একবারও ঠাম্মি
করে ডাকে না। শ্রীময়ীর চোখের কোণে ফ্যাকাশে চাঁদ।
রোজ একবার
করে অতীতের ঐ কয়েকটা দিন ঘুরে আসেন শ্রীময়ী। তন্ন তন্ন করে ছেঁকে তোলেন মুহূর্ত।
পরাভূত চেতনায় তাঁর নৌকোর ছিদ্রটি খুঁজে পেতে চান। স্বরাজ চলে যাবার পর বুলান তাঁকে জড়িয়েই
তো ছিল! আর নিজের ভাসমান বেদনায় পিকুকে
আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। গাঢ় অবিছিন্ন নীরবতার ছবিতে সংসারের দায়িত্ব নিধির হাতে চলে
যাওয়া আর নিধির মায়ের ঘন ঘন বেড়াতে আসা।
এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমশ বুলানের তিরিক্ষি হয়ে ওঠা মেজাজ। ব্যাস এটুকুই! আর তো কিছুই
খেয়াল হয় না।
- চল দিদা! নতুন বোডার আসার কতা ছিল
না! এসে পরেচে। দাদাবাবু সবাইকে হলে ডাকছে।
- যাচ্ছি! তুই যা! আবার কারো
ডিঙ্গিতে জল ঢুকে পড়েছে। মেরামত অযোগ্য ফুটোদের আজকাল রমরমা বাজার।
এখানে
সন্ধ্যেতে হলে জমাটি গানবাজনা হয়। সুখি চা মুড়ি সাপ্লাই দেয়। সারাদিন এত কাজ করে, তবুও ওর মুখে হাসি লেগেই
থাকে। মেয়েটার ওপর মায়া পরে গেছে। তাপ্পি
দেওয়া পরিত্যক্ত চপ্পল গলিয়ে টুক টুক করে হলের দিকে এগোলেন। কোথাও বীরেনবাবুর গলায়
মহালয়ার পাঠ চলছে মাইকে। আরো একটা পুজো এসে গেল!
হলে
ঢুকতেই শ্রীময়ীর পায়ের তলায় চুম্বক। হাত দশেক দূরে নিধির মা, তাকে ঘিরে আবাসিকদের ভীড়। ছ’মাস
আগেই বোধহয় ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন