কী যে বলি!
বধূমাতার আদি বাপের বাড়ি পূর্ব
বর্ধমানের খাটুন্দিতে তাঁদের আদি
পিতৃগৃহের আড়াই-তিনশো বছরের পুরনো দুর্গাপুজায় গিয়েছিলাম। তিনশো বছর ধরে এক
মন্ত্রগুরুদের গ্রামে ভট্টাচার্য আদি পুরোহিতের গৃহজামাতাদের দৌহিত্রবংশ
চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি-মুখুজ্জেরা সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা করে আসছেন। প্রশস্ত সিমেন্টের
পঁচিশ বাই কুড়ি একচালা ঘিরে পাশাপাশি ছটি দুর্গাপুজো হয় ও হচ্ছে। আগে ছিল সাতটি। পরে কালক্রমে আরো একটি জেলাশহরে
স্বাতন্ত্র্য সন্ধানে সরে যাওয়ার পরে ছটিই আছে। তাদের মধ্যে একটি বৈষ্ণব
মতাবলম্বী। সেখানে পশুবলি নিষেধ। বাকিগুলিতে মণ্ডপের সামনে হাড়িকাঠ পোঁতা হয়। সাময়িকভাবে। কারণ ছটি দুর্গামণ্ডপই কৃষ্ণরায়ের
অধীন। তাঁর একটিই মন্দির। সেখানে স্বভাবতঃ নিরামিষ কৃষ্ণসেবা হয় সারা বৎসর। কেবল দুর্গাপুজার
আগে কৃষ্ণকে চার দিনের জন্যে মাঝে মাঝে
ঘুম পাড়িয়ে সারা বচ্ছর ধরে ফাঁকা থাকা ছটি চণ্ডীমণ্ডপে রেখে দুর্গাকে আনা হয়
মাত্রই চারদিনের জন্যে। তাতে কিবা আসে যায়! সমগ্র বাংলাতেই দুর্গা বাড়ির বাইরে
মণ্ডপে, প্যান্ডালে অতিথি। কালী বা লক্ষ্মীর মতো নিত্যসেবার মন্দির নেই তাঁর। এখানে
থাকে ফাঁকা বাড়ি, গৃহস্থের নিরামিষাশালয়ে আমিষাশী মেয়ের কদিন আসার জন্যে!
এই দুর্গার জমিদারি বা বারোয়ারি
পুজো শুরু সেই অষ্টাদশ শতক থেকেই যখন জমিদারদের
তরফে একদিকে মুঘল এবং নবাবদের আরোপিত হিন্দুদের উৎসব কর ১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল
ওয়ারেন হেস্টিংস রদ করে দেওয়ায় গণ উৎসবের উপর নিষেধাজ্ঞা ওঠায় জমিদারদের খুশির
প্রকাশ, অন্যদিকে ব্রিটিশদের সহযোগী এক
মুৎসুদ্দি শ্রেণি হিসেবে তাঁদের নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, এতৎকাল অবধি মুসলিমদের দমন ও তাদের সম্পর্কে অধরিকতার বোধের মোচন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পরে কোম্পানির অডিটরদের হাতে
নিজেদের হিসাব পড়ে যাওয়ার পরে একটু করছাড় পাওয়া ব্যয়ের সুযোগ (যেটার নিদর্শন
ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে দেওয়া দিনাজপুরের
রাজা বৈদ্যনাথের চিঠি থেকে পাওয়া যায়), আর শেষতঃ নিজেদের মধ্যে একটু প্রতিযোগিতার লোভ, ইত্যাদি কারণে জমিদারি দুর্গাপুজোর ধুম পড়ে যায়। ফলে ১৫৮৩-তে রাজশাহীতে তাহেরপুরের
রাজা কংসনারায়ণ, ১৬১০ সালে সাবর্ণ চৌধুরীদের
পিতৃপুরুষ বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত গাঙ্গুলি আর নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র,
১৭৫৭ সালে, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব
ইত্যাদি দুর্গাপুজার প্রচলন করেন। অষ্টাদশ ও উণবিংশ শতাব্দীতে
জমিদারি পুজোয় যে ভক্তির চেয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য ও ভূমিস্বত্ব
সম্পর্কে নবধনীদের সায়েবদের সঙ্গে সখ্য ও বৈভব দর্শনের ক্ষেত্র ছিল সে কথা বরেণ্য
ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন। প্রথম সাধারণ বাঙালি হিন্দুদের পুজো যদি হয়ে
থাকে ১৯১০ সালে উত্তর কলকাতার বলরাম বসু ঘাট রোডে, তবে প্রথম বারোয়ারি পুজো হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০-তে।
পুত্রবধূর পিতৃগৃহে যদি আড়াই-তিনশো
বছর ধরে দুর্গাপুজা হয়ে থাকে, তবে তা এই
প্রবণতারই ‘ডিফিউশন’। কিন্তু আমার এই পূজার জাঁক ও নিষ্ঠা সমানভাবে ভালো লেগেছে। গ্রামটিতে কোনো অজ্ঞাত কারণে পূজক
অধিবাসীরা তাঁদের বাড়িগুলোকে মূলতঃ আলকাতরা লেপা মাটির একতলা, দু’তলা রেখে
দিয়েছেন। আমার আধুনিক পদার্থবিদ্যার ছাত্র
বেয়াই কেবল এই মৃৎসাম্রাজ্যের মধ্যে তাঁদের শরিকি বাড়িটিতে একটি আধুনিক সিমেন্টের
কিচেন ও দুটি ঘর যোগ করেছেন স্ত্রীর সুবিধার্থে। ছটি পুজোর পাঁচটিতে প্রত্যেকটিতেই
সপ্তমী থেকে নবমী অবধি অন্ততঃ একটি ছাগবলি হয়! পূজার ও বলির আগে ও বলির পরে
কিছুক্ষণ কৃষ্ণরায়কে কানে তুলো গুঁজে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়! একবার তাঁর ঘুম ভাঙানো
হয়, যাঁদের এবার সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে পুজোর ‘পালা’ পড়েছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে
নিরামিষ ভোগ খেয়ে আসতে। আবার তাকে ঘুমে
পাঠানোর পরই কেবল নবমীর ছাগবলি আর ছাগমাংস ভক্ষণ হয়, তাও পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া আদা-জিরেবাটার
‘নিরামিষ’ মাংস। বলির পরেই হাড়িকাঠ উপড়ে তুলে নেওয়া হয়, যাতে কোনোভাবেই ঘুম থেকে
উঠে কৃষ্ণরায় রক্তের আলপনা না দেখতে পান! শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের এই সহাবস্থান এই
গ্রামের দুর্গাপূজাগুলিকে কেবল বিশিষ্টতা দেয়নি, বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতার
দ্যোতনাও দিয়েছে।
ছয় বাড়ির ছয় পুজো ঘিরে এক এলাহি ব্যাপার হয়। ফাস্টফুডের বহু দোকান, চপ-কাটলেট-রোল-ডিমসেদ্ধ-ঘুঘনি
থেকে চাউমাউখাঁউ সব! তার সঙ্গে যাত্রা-কবিগান থেকে কবির লড়াই! গ্রামের সকল ভদ্রলোক বিভিন্ন পালাবাড়িতে সপ্তমী
থেকে নবমী পালার দিন পংক্তিভোজে আসেন। এরকম আগে কম দেখেছি। একমাত্র বসিরহাটের অদূরে
আমার স্ত্রীর আদি বাপের বাড়িতে ওঁদের বাড়ির দোল উৎসব ঘুরে গোটা গ্রামের মেলা
দেখেছি, যাতে সার্কাস থেকে ‘এক্সরে গার্ল’ সব ছিল!
তো, যে কারণে এই লেখার অবতারণা! এই
পূজার বেশ কিছু ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে গিয়ে বলির একটি দৃশ্যের একটি অংশ উঠে গেল
যাতে একচালার উঠোন থেকে মন্দির অবধি রক্তের আল্পনা ছিল। এক পরম ফেবুবন্ধু প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, ‘এত রক্ত কেন’?
এই সম্ভাব্য প্রশ্নের কারণেই
আমার আরেক অতি নিকটাত্মীয়া ছবি ফেবুতে
বলি-র ছবি আপলোড করা সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কারণ ফেসখাদের অধিকাংশই
অত্যন্ত সূক্ষ্ম, স্পর্শকাতর। এখন ‘এত রক্ত কেন’ প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি উপন্যাসে হাসি-তাতার তরফে উঠে যাওয়ার পর, আমাদের অনেককেই ভাবিয়েছে। তিনি এই প্রশ্ন করতেই
পারেন, কারণ ছবিটা কতকটা রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি উপন্যাসের সেই দৃশ্যের মতো—
‘কাল রাত্রে অমাবস্যা ছিল, কাল ভুবনেশ্বরীর পূজা হইয়া গিয়াছে। যথাসময়ে হাসি ও তাতার হাত ধরিয়া রাজা
স্নান করিতে আসিয়াছেন। একটি রক্তস্রোতের রেখা শ্বেতপ্রস্তরের
ঘাটের সোপান বাহিয়া জলে গিয়া শেষ হইয়াছে। কাল রাত্রে যে এক-শো-এক মহিষ বলি হইয়াছে
তাহারই রক্ত।
হাসি সেই রক্তের রেখা দেখিয়া সহসা একপ্রকার
সংকোচে সরিয়া গিয়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কিসের দাগ বাবা!”
রাজা বলিলেন, “রক্তের দাগ মা!”
সে কহিল, “এত রক্ত কেন!”
এমন একপ্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা
করিল “এত রক্ত কেন”, যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে
ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল, “এত রক্ত
কেন!” তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন। বহুদিন ধরিয়া প্রতি বৎসর রক্তের স্রোত দেখিয়া আসিতেছেন, একটি ছোটো মেয়ের প্রশ্ন শুনিয়া তাঁহার মনে উদিত হইতে লাগিল, “এত রক্ত কেন!” তিনি উত্তর দিতে ভুলিয়া গেলেন। অন্য মনে স্নান করিতে করিতে ঐ প্রশ্নই
ভাবিতে লাগিলেন।’
আমিও ভাবতে লাগলাম কেন এই প্রশ্নটা
আমাদের ভাবায়। আমাদের মানে সেই শহুরে, সূক্ষ্ম মানুষদের যাঁরা প্রতি রবিবার
খাসি-পাঁঠা, আর অধুনা স্বাস্থ্য-সচেতনতার কারণে নিত্য মুরগির, কোয়েলের মাংসের সেবা
করেন। সেই মাংস, যা আমাদের শৈশবে জানা
সন্নিষ্ঠ পণ্ডিত মিছরিলাল শাস্ত্রী ‘বৃথামাংস’ হিসেবে ছুঁয়েও দেখতেন না! মিছরিলাল
শাস্ত্রী হয়তো (ঠিক জানি না) বছরে কয়েকবার মাত্র বলির মাংস, পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া
আদা-জিরেবাটার ‘নিরামিষ’ চেহারায় ছুঁয়ে দেখতেন।
বন্ধু, আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় বলির
ছবি ছাপতে ভয় পাওয়ার কথা। কারণ বন্ধুদের সূক্ষ্ম, আধুনিক নান্দনিক দৃষ্টিতে বা বিবেকে
ধাক্কা লাগতে পারে। কিন্তু কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের
অজস্র বাজারে, রোজ, বিশেষতঃ শনি-রোব্বার-ছুটির দিনে লক্ষ লক্ষ অ-ধর্মীয় পশুবলি
হচ্ছে, তাদের হাঁ-করা, মাথা আমরা রোজ দেখছি দোকানে দোকানে। ব্রেন-কারির জন্যে
ছাড়িয়ে কিনেও আনছি! খাসি-পাঁঠা ছেড়ে শিক্ষিত বাঙালি গরু-শুওরের দিকেও বেশি বেশি
করে ঝুঁকছে। হরিণঘাটা পোল্ট্রি-ফার্মিং খাসি-পাঁঠা ছাড়াও ভেড়া, টার্কি, চাষ-করা
দেশি বনমুরগি (অক্সিমোরন কি?), হরিণ, কোয়েল ইত্যাদির মাংস গাড়ি করে এনে দিচ্ছে
তাদের জন্যে। এত মাংস আমরা বাঙালিরা আগে খেতাম?
এত মাংস খাওয়ার দরকার আছে? ভাবুন তো! দেখুন! চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বীরনায়ক ব্যাধ
কালকেতু কী খেতেন, কবিকঙ্কনের বয়ানে? দেখুন—
বোঁচা নারিকেলেতে পুরিয়া দিল জল
করিল ফুল্লরা তবে ভোজনের স্থল।
চরণ পাখালি বীর জল দিলা মুখে।
ভোজন করিতে বৈসে মনের কৌতুকে।
সম্ভ্রমে ফুল্লরা পাতে মাটিয়া পাথরা।
ব্যঞ্জন খাইতে দিল নূতন খাপরা।
মোচড়িয়া গোঁফদুটি বান্ধিলেন খাড়ে।
এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।
চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।
ছয় হান্ডি মুসুরি সুপ মিশ্যা তথি লাউ।
ঝুড়ি দুই তিন খায় কচু ওল পোড়া।
কচুর সহিত হায় করঞ্জা আমড়া।
স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত এই কবিতাংশে
কিছু শব্দের প্রমাদ থাকতেও পারে! কিন্তু সেই ব্যাধ কালকেতু, মহাবীর, যাঁকে
পৃথিবীতে নিজের পূজা প্রচারের জন্য স্বয়ং চণ্ডী বেছে নিয়েছিলেন মনসার ধরণে চাঁদ
সদাগরের মতো, তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় মাংস কই? তবে তিনি কি পেশার কারণে পশুবধ
করতে বাধ্য হলেও নিজে মাংস কম খেতেন? আর যদি অতিবীরের খাদ্যতালিকায় মৃগমাংস
নাই থাকে, তবে আমরা ‘পুঁয়ে-পাওয়া’
ক্ষীণজীবী বাঙালিরা এত মাংস-মাংস করি কেন?
যদি করি তবে আমাদের অবস্থা কি রোল্ড ডালের (Roald Dahl)‘Pig’ গল্পের সেই বাপ-মা-মরা ছেলেটি লেক্সিংটন(Lexington)-এর মত নয়, যে একই রাত্রে পুলিশের অবুঝ গুলিতে মা, বাপ দুজনকেই
হারিয়ে, সত্তর বছরের নিরামিষাশী পিসি,
বিশাল নিরামিষ রাঁধিয়ে গ্লস্প্যান (Aunt Glosspan)-এর কাছে প্রতিপালিত হয়ে, সতেরো বছরেই ন’হাজার রকমেরও বেশি
অসাধারণ, মৌলিক নিরামিষ রেসিপি তাঁর কাছেই
শিখে, ন্যুইয়র্ক শহরে এসে, শস্তা রেস্তরাঁয় শস্তা মাংসের চপ খেয়ে তার স্বাদে এত
মজে গেল যে মাংস কাটার বুচারি বা কসাইখানায় ঢুকে মাংস কাটার পদ্ধতি দেখতে দেখতে
কসাইখানার কনভেয়ার বেল্টের চেনে পা আটকে
গিয়ে নিজেই মাংস হয়ে গেল? ডাল সেখানে কসাইখানার যে বর্ণনা দিয়েছেন নিজেই কাটা হতে
থাকা লেক্সিংটনের চোখ দিয়ে, তা কি আমাদের পাঁঠার
দোকানের চেয়ে অনেক ভয়াবহ নয়?
বহুদিন আগে এক ছাত্রর বাড়ির কাছে
মাইথনের কল্যাণেশ্বরীর মন্দিরে গিয়ে দুর্গাকালীর পূজা ছাড়াও এক সাধারণ দিনে প্রচুর
পাঁঠাবলি দেখেছিলাম। এই পশুবলিপ্রথার বিরুদ্ধে ওই ছাত্র নান্দনিক-বিবেকী আপত্তি জানিয়েছিল। পরে একটি মুসলিম ছাত্র ও আরেক মুসলিমবন্ধু জানিয়েছিলেন যে তাঁরা কুরবানি ঈদে
অংশ নেন না, এই বলির কারণে। দু’দলকেই শুধিয়ে জেনেছিলাম যে তাঁরাও ভালো রকমের মাংশাষী। তাহলে
বলিতে/কুরবানিতে এত আপত্তি কেন? জাতকে মোট
কত কত বার বোধিসত্ত্ব প্রাণীদের অভয় দিয়েছেন! তা বলে অবশ্য ভাবলে ভুল হবে যে তার
প্রাধান্যের কালেও বৌদ্ধধর্ম পশুহত্যা এমনকি
গো-বধকেও নির্মূল করতে পেরেছিল। খাদ্যাভ্যাস বড় কঠিন ব্যাপার। ডি. এন.ঝাতাঁর The Myth of the
Holy Cow (London: Verso, 2004) বইতে দেখিয়েছেন থেরাবাদী বৌদ্ধধর্ম যেখানে
প্রবল, এমনকি সরকারি ধর্ম, ভারতীয়
উপমহাদেশের সেইসব দেশে/রাষ্ট্রে, যেমন মিয়ানমার
(বর্মা), শ্রীলঙ্কা, সেখানেও
গো-মাংস ভক্ষণ আইন সত্ত্বেও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, যদিও মাংস তালিকায় তার স্থান খুব নিচে। নির্মূল হবে কী করে? কথিত আছে ভগবান
বুদ্ধ নিজে অহিংসার প্রচারক হয়েও শূকর-মাংসের অন্ন (‘শূকর-মাদ্দব) খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অশোকের অ-নিধন তালিকায় প্রাণীদের মধ্যে
গাভীর উল্লেখ নেই। ভারতের ভিতরে ও বাইরে, যেমন লাহুলে গোপনে আর তিব্বতে বৌদ্ধরা বহুদিন অন্যান্য পশুমাংসের
সঙ্গে গবাদি পশু খেয়ে জৈনদের তীব্র বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন। বুদ্ধ মাংস খেতেন বা খেয়েছিলেন, বৌদ্ধরাও, তবু কিন্তু আমি মনে মনে কতকটা বৌদ্ধ। কারণ তাঁদের চেয়ে হিংস্র নিরামিশাষী আছেন। বাদশাহ
হূমায়ুন দিল্লি পুনরুদ্ধার করার সময়ে সাময়িকভাবে মাংসাহার বর্জন করেছিলেন। তাঁর
ছেলে জাহাঙ্গীর ১৬১৮-১৬২২ এই চার বছর পশুহত্যা না করার শপথ রক্ষা করেন। তাছাড়া
পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ সপ্তাহে কয়েকদিন মাংসাহার করতেন না। নিরামিষাহারকে অবশেসনের
পর্যায়ে নিয়ে আসেন আকবর। বলতেন, নিজের শরীরকে
পশুদের কবরস্থান করতে চান না! রাজসভাতেও নিরামিষাহার চালু করেন সাবধানে। কিন্তু
শিকার ছাড়েন নি। যদিও শিকারকালেই তিনি এক ভাবাবেশে মগ্ন হয়ে শিকারে ধরা সব পশু
ছেড়ে দেন, আর সেই শিকারস্থানটিকে ক্ষুদ্র মক্কা বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু তবুও নিজে
শুক্রবারে, প্রতি সৌর মাসের অষ্টাদশ দিনে, উপবাসের দিনগুলিতে, সূর্য এবং
চন্দ্রগ্রহণের দিনগুলিতে, নিজের জন্মদিনে, নিজের সিংহাসনারোহণের দিনের
প্রত্যেকটিতে কেবল মাংসাহার করতেন না। কিন্তু জাহাঙ্গীর,
হূমায়ুন, আকবর রণক্ষেত্রে বা অন্যত্র অজস্র নরবলি দিয়েছেন। নররা কি পশুও নয়?
রণক্ষেত্রে তাদের কাটামুন্ডু কি মাংসের দোকানে, বা পূজার মন্দিরে হাড়িকাঠে ছাগলের কাটামাথা
থেকে দেখতে ভালো?
অন্য
রকমের বলির কথা বলি! কত লোক রোজ রাজনীতির বলি হন কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে,
ভারতে, লেবাননে, সিরিয়ায়, ইয়েমেনে,
আরো কত জায়গায়? আর দিল্লিতে নির্ভয়ার, পশ্চিমবঙ্গে কামদুনির, ধূপগুড়ির মতো হাজার
হাজার ঘটনায় দেশের লোক আমরা রোজ দেখছি
নারীমাংস কিভাবে আমাদের বহু মানুষের মেনুতে জায়গা করে নিচ্ছে! আদিবাসী বধূর গণধর্ষণের
পরেও যৌনাঙ্গে ঢোকানো হচ্ছে লোহার রড! কেরালার এক নান-এর গণধর্ষণের প্রধান সাক্ষী
রহস্যময় ভাবে মারা গেলেন। আমরা চুপ করে থাকছি। হয়তো বলছিও ‘এত রক্ত কেন’? কিন্তু তাতেও তো থামছে না কিছুই! সেখানে চারদিন কৃষ্ণরায়কে কানে তুলো গুঁজে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার পরে কিছু পাঁঠাবলিতে এত কথা সত্যি উঠতে পারে? জানি না! তা বলে
আমি সম্প্রতি যেভাবে আমাদের দৈনিক খাদ্যতালিকায় মাংসভোজনকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে
তারও সমর্থক নই! যদিও পশুমাংস আমার প্রিয়তম আমিষ নয়!
এই কয়েকদিন আগে আমার নিজের দেশের
সংস্কৃতিকে বিদেশিরা ও রুশরা কিভাবে দেখেছেন তা নিয়ে বলতে রাশিয়া ঘুরে এলাম। সেখানে বেশ কিছু মানুষকে দেখলাম ভারতীয় হঠযোগ,
নিরামিষ ইত্যাদিকে সম্বল করেছেন। কিন্তু সব রকমের পশুমাংসের তালিকায় ভর্তি হোটেলের
প্রাতরাশের খাদ্যতালিকা। অধিকাংশই ভালো রকমের মাংশাষী। কেবল কোথাও কলকাতার মত
মাংসের দোকানে পশুর কাটামুণ্ডু দেখতে পাই নি। কিন্তু এই বিপুল মাংসাহারের দেশে বুচারিগুলোর
চেহারা কিরকম? দুপুরে লাঞ্চের সময় এক খদ্দেরকে বিফস্টিক অর্ডার করার সময়ে একজনকে
জিজ্ঞাসিত হতে শুনলাম রক্তসহ, মাঝামাঝি, না শুকনো। তিনি বেশি স্বাদের কারণে রক্তসহ
বলায় খেতে খেতে আমার বমি পেলো! অথচ পাঁঠার মাংসের দোকানে কাটামুন্ডু দেখে আমার
ভাবান্তর হয় না। পূজার বলিতে প্রথমে সামান্য হয়! কিন্তু যে লোকগুলি ওই সময়ে প্রবল
আওয়াজ তুললেন তাঁদের কাউকে কাউকে অনামিষাষী বলে জানি। তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ ওই
পশুর নিরামিষ মাংস খান। কারণ ওটি নিজের বলিপ্রদত্ত পশুপ্রবৃত্তির প্রতীক। সত্যি
সত্যি আমার নিজের দেশের সংস্কৃতিকে আমি নিজেই ঠিকঠাক দেখতে পাই? আসুন একটা শপথ
নিই! আমাদের মধ্যে যাদের যাদের মনে হাসির ‘এত রক্ত কেন’ শব্দ তিনটি এখনও অনুরণন
তোলে তারা সব পশুকে কিছু কিছু জাতকের বোধিসত্ত্বের মতো সব প্রাণীকে অভয় দিই! যে
শপথ গান্ধীর নিরামিষ আহারের শপথের মতো দৃঢ়, যাতে বুদ্ধের ‘শূকর-মাদ্দব’ ভক্ষণের
স্থান নেই। এছাড়া আমরা দ্বিচারিতা থেকে মুক্ত হতে পারবো না!
কামাখ্যায় বলি দেখেছি মোষের। কি বীভৎস!! বলি দেবার যে আবহসঙ্গীত ছিল ঢোল কর্তালের সেটা বহুদিন ধরে আমাকে তাড়া করতো। এমনি মাংস খাওয়া আর ধর্মের নামে মাংস খাওয়া য় পার্থক্য আছে। শরীরের প্রয়োজন ও রুচির কারণে মাংস খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ধর্মের নামে বলি একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।
উত্তরমুছুন