খোঁপায় কামিনীফুলের গন্ধ
“আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয়
জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ
ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর
রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস
ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের
হাসি
তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে
বালক তার
পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের
অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে”
রণজিৎ দাশ, কবি,
তাই চিরসজাগ, নিরন্তর দেখে চলেন ঈশ্বরের চোখে, সমাজ, পৃথিবী, সেই সমাজ ও পৃথিবীর
ভিতরের চক্রান্ত, চাঁদ, রক্ত, ক্রিমি, কীট, রাক্ষস, মুখোশ, নাচ, মদ, এবং বেশ্যা। এই
দেখা এক বাস্তব প্রক্রিয়া— প্রতিক্রিয়াও। এবং, প্রবণতাও বটে। পৃথিবীর কদর্যতম বাস্তবের
মধ্যেও যদি একজন কবি বাস করেন, তিনি সেই কুৎসিত বাস্তবকে নিরীক্ষণ করেন, নিরন্তর,
অবিরাম। এ হল সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী কবিসত্তা, যা ঐশ্বরিক সত্তাও বটে। শুধু কবি নয়, এই
সত্তা প্রতিটি শিল্পীর। একজন প্রাবন্ধিকেরও।
ঠিক এই জায়গাতে
এসে আমরা কবি রণজিৎ দাশকে আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে প্রাবন্ধিক রণজিৎ দাশের প্রতি
দৃষ্টি নিক্ষেপ করব। ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’। এই প্রবন্ধে, এক নিদারুণ মায়াময় ইন্দ্রজাল
বিস্তারের মাধ্যমে তিনি এগিয়েছেন, ধীরে ধীরে, প্রতিটা পদক্ষেপে এক নতুন কুহক রচনার
মধ্যে দিয়ে। হ্যাঁ, কুহকই রচনা করেছেন তিনি। শিল্পীসত্তার অমোঘ প্রবণতা মেনে
বাস্তব বিষয়বস্তুই উঠে এসেছে তাঁর রচনায়, কিন্তু এক ধাঁধার মাধ্যমে, যেখানে সত্য ও
মিথ্যার মাঝে সদাজাগ্রত প্রাচীরটি ক্রমশ ধূসর হতে হতে একসময় অবলুপ্ত হয়ে যায়, এবং
এই অবলুপ্তি ঘটে পাঠকের অজান্তেই। আবিষ্ট পাঠক কিন্তু তখনও সেই সত্য ও মিথ্যার
গভীরে প্রবেশ করে তাদেরই উৎস অনুসন্ধান করে চলেছে। সমগ্র প্রক্রিয়ায় মুছে যায়
কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে বিরাজিত সীমারেখাটিও। এই ভানুমতীর খেলই প্রাবন্ধিক রণজিৎ
দাশের অবিশ্বাস্য দক্ষতা। এই দক্ষতা প্রদর্শনকেই তাঁর প্রবণতা হিসাবে ধরা যায়। এই প্রবণতাকে
তাঁর আপন সুদক্ষ কৌশল রূপে গণ্য করা যায়। এবং এই সুদক্ষ কৌশল জাগিয়ে তোলে প্রবল কৌতূহল,
পাঠকের মনে।
কৌতূহল জেগেছিল
প্রাবন্ধিকেরও — অপরিসীম কৌতূহল। ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’টি শুরুই হচ্ছে
প্রাবন্ধিকের সেই অপরিসীম কৌতূহল প্রকাশের মাধ্যমে:
“পৃথিবীতে প্রথম যে মেয়েটি
খোঁপায় ফুল গুঁজেছিল, তার সম্পর্কে আমার কৌতূহল অপরিসীম। আমার চোখে এই আদি-মানবী
এক অপার রহস্যের প্রতীক।”
এই রহস্যময়ী
আদি-মানবী প্রাবন্ধিকের নন্দন-চিন্তার কেন্দ্রীয় মোটিফ। তাঁর মতে, “দর্শনের এবং
নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় এই নারী পণ্ডিতদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল”। তারপরেই
আসে সেই বিস্ফোরক বিজ্ঞপ্তি, অথবা ইন্দ্রজাল বিস্তারের প্রথম মন্ত্র উচ্চারণ:
“সেই ভাবনা থেকেই, অবশেষে, বর্তমান লেখাটি সেই আদি পুষ্প-সুন্দরীর
বিষয়ে একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক রচনা।”
এখানে দ্রষ্টব্য
হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ শব্দবন্ধটি। এই বিবৃতির মাধ্যমে লেখক যেন লেখাটির উপর
থেকে তাঁর সর্বদর্শী সত্তার আরোপিত ছায়ার অপসারণ ঘটানোর এক প্রয়াস রেখেছেন। এবং
সফলও হয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে। পাঠক শুরুতেই নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় — লেখাটির
সত্যাসত্য বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুইই তার নিজের হাতে, প্রাবন্ধিক এখানে কোনকিছু
আরোপ করছেন না। ঠিক এই স্থানেই, এই মুহূর্তেই পাঠক নিজে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়
অংশগ্রহণে লিপ্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের মোহাবিষ্ট হওয়ার এটাই প্রথম পদক্ষেপ, এবং এখানেই
প্রাবন্ধিকের অতুলনীয় ভানুমতীর খেল শুরু হয়। প্রবন্ধ এগোতে থাকে। উঠে আসে
সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে আলোচনা। সৌন্দর্য কি সত্যের প্রকাশ? নাকি, মূলত সত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী
— এক প্রতিসত্য? নাকি, সৌন্দর্য এক নিরপেক্ষ সত্তা? এই আলোচনায় উঠে আসে কিছু
সম্ভাবনা, কিন্তু কোন মীমাংসা আরোপিত হয় না। বরং, প্রবন্ধের প্রথম অংশের শেষে,
তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে, আবার ফিরে আসে সেই অমোঘ বিজ্ঞপ্তি:
“এই রচনায় উল্লিখিত লেখকদের এবং গ্রন্থের নাম,
উদ্ধৃতি এবং বিতর্ক, সমস্তই, বলা বাহুল্য, সম্পূর্ণ কাল্পনিক। – লেখক।”
আবার, আরও একবার,
প্রাবন্ধিক তাঁর আরোপিত সত্তাটি প্রত্যাহারের মাধ্যমে, সেই প্রত্যাহার স্মরণ
করানোর মাধ্যমে, পাঠকদের বাধ্য করেন এই বিতর্কে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, বাধ্য করেন
এই লেখার, আলোচনার, তর্ক-বিতর্কের কাল্পনিক সত্তা ও পরিচিতিতে বিশ্বাস করতে। এই
মুহূর্তে পাঠক সম্পূর্ণ স্বাধীন — সে তার আপন চিন্তা অনুসারে এই বিতর্কের মীমাংসা
নির্ধারণ করে নেয়, অথবা করে না। কিন্তু প্রবন্ধের প্রথম অংশ শেষ হয়।
প্রবন্ধপাঠ আরও
অগ্রসর হয়। দ্বিতীয়
অংশে উঠে আসে পরমানন্দ, সেই পরমানন্দ সন্ধান, এবং সেই সন্ধানে ব্যর্থতা নিয়ে
আলোচনা। আলোচনা শেষ হয়, কিন্তু, আশ্চর্যজনক ভাবে, এই অংশের শেষে কোন বিজ্ঞপ্তি আর
আসে না! তাহলে কি এই অংশটি ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ নয়? বাস্তবে, তাই। এই অংশটি
সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক নয়। এই অংশে আলোচিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, এবং সেই পরীক্ষা
থেকে উদ্ভূত সিদ্ধান্ত বাস্তব সত্য। পাতা উলটিয়ে প্রবন্ধের একেবারে শেষে দৃষ্টি
নিক্ষেপ করলে দেখা যায় সেখানেও আর কোন বিবৃতি নেই। তাহলে কি প্রবন্ধের বাকি সমগ্র
অংশটাই বাস্তবের উপর আধারিত? এবার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি প্রবন্ধের বাকি অংশে
প্রাবন্ধিক, তাঁর সর্বজ্ঞ সত্তাসহ, বিরাজ করছেন? তাহলে প্রবন্ধের একেবারে শুরুতে
যে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল তার অর্থ কি? বিশেষ করে যখন সেই খোঁপায় ফুলযোজনার
বিষয়টি, এবং সেই খোঁপাধারী আদি-সুন্দরী আবার ফিরে আসে প্রবন্ধের তৃতীয় এবং চতুর্থে
অংশে? ধাঁধা সৃষ্টি হয়। মায়াজাল বিস্তার লাভ করে। পাঠকের মনে জেগে ওঠে দোলাচল।
কোনটা সত্য? কোনটা মিথ্যে? সত্য-মিথ্যার মাঝখানে প্রাচীরের অবস্থান কোথায়?
“প্রাণীজগতে মিথ্যার বোধে মানুষ অনন্য।”
প্রবন্ধের তৃতীয়
অংশ শুরু হয়। পাঠকের প্রতি ইঙ্গিত ভেসে ওঠে। এক দুর্দমনীয় কুহক বিস্তৃত হয়। ধীরে
ধীরে জেগে ওঠে প্রাবন্ধিকের সর্বজ্ঞ সত্তা।
“অর্থাৎ মনুষ্যজীবনে মিথ্যার ভূমিকা বিশিষ্ট, এর প্রভাব
গভীর। মিথ্যা স্বয়ং একটি জ্ঞান।... কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনায় কেন মিথ্যাকে একটি
বিশিষ্ট শ্রেণি বা উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয় না, এটা খুব স্পষ্ট নয়। হয়তো অবচেতনে কাজ
করে সূক্ষ্ম অপরাধবোধ, মিথ্যার স্বীকৃতিতে বা বিশ্লেষণে অনীহা আসে।”
লেখক কিন্তু কোন
অপরাধবোধে ভোগেন না। তিনি মিথ্যা নিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করেন।
“এতে কোন সন্দেহ নেই যে মেধা ও মিথ্যা সমানুপাতিক।
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি যত উন্নত হয়েছে, তার মিথ্যাকে সৃজন করার ক্ষমতাও তত উন্নত
হয়েছে।”
এখানে,
সৃজনশীলতার প্রেক্ষিতে, ভীষণ গুরুত্বসহকারে আপন অস্তিত্বের ধ্বজা স্থাপন করে
‘মিথ্যা’। সৃজনশীলতায় মিথ্যাও এক অনিবার্য অংশ, এক তীক্ষ্ণ হাতিয়ার। এখানে, ক্রমশ,
ধীরে ধীরে, আভাসিত হয় অসম্ভব মেধাসম্পন্ন প্রাবন্ধিকের প্রবণতা— অবয়বী ছদ্মবেশ
ধারণ। মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক নিজেই সেই ইঙ্গিত দেন—
“কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে এই অনৃতচেতনার উদ্ভব ও
বিকাশ— সে এক রহস্য। এ প্রসঙ্গে প্রাণীজগতের ক্যামুফ্লাজ বা অবয়বী ছদ্মবেশ একটি
সম্ভাব্য আদিসূত্র।”
অবয়বী ছদ্মবেশ
ধারণকারী প্রাবন্ধিক সত্য এবং ছলনার মধ্যে নিরন্তর যাতায়াত করেন, ভেঙে দেন সত্য ও
মিথ্যার প্রাচীর। চতুর্থ অংশে বর্ণিত ঠিক সেই আদি-সুন্দরীর মতোই যে তাঁর আপন খোঁপায়
প্রথম ফুল গোঁজার সাথে সাথেই “সাধারণ নারী রইল না সে, হয়ে উঠল মায়ালোকের মাতাহারি।
তার অস্তিত্ব হয়ে উঠল এক ছদ্মবেশ, সত্য এবং ছলনার মধ্যে তারা যাতায়াত হয়ে উঠল
অবাধ, অশরীরী”।
প্রবন্ধের
দ্বিতীয় অংশের শেষে পাঠকের মনে যে প্রশ্ন উঠেছিল— সত্য-মিথ্যার মাঝখানে প্রাচীরের
অবস্থান কোথায়?— তার উত্তর পাওয়া যায় এবার, সমগ্র প্রবন্ধটির শেষে। আদতে সত্য ও
মিথ্যের মাঝে কোন প্রাচীরই নেই। প্রাবন্ধিক রণজিৎ দাশ অশরীরীর মতো নিরন্তর যাতায়াত
করেন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে; তিনি খেলা করেন সত্য ও মিথ্যা নিয়ে, বাস্তব ও কল্পনা
নিয়ে। তিনি হয়ে ওঠেন একজন সফল ঐন্দ্রজালিক যিনি প্রথমে এক অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে
ফেলেন তাঁর পাঠকদের, তারপর সেই মায়াজাল ছিঁড়ে বার করে আনেন তাদের। এটাই তাঁর
প্রবণতা— তিনি অশরীরী ঈশ্বরের চোখ দিয়ে দেখেন সবকিছু, প্রকাশ করেন তাঁর সেই বাস্তব
অভিজ্ঞতা, কিন্তু এক মায়াবী প্রক্রিয়ায়।
এবারে প্রশ্ন
জাগে তাঁর এই প্রহেলিকাময় প্রবণতার উদ্দেশ্য কি? তার উত্তর, একাধিক প্রশ্নের
আকারে, সর্বজ্ঞ প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি নিজেই দিয়েছেন এই প্রবন্ধে—
“প্রকৃতির মায়াদর্পণে মুখ দেখেছে মানুষ। দেখেছে সেই
মুখে অভিব্যক্তি এবং অভিনয় একাকার। কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সে জানতে চেয়েছে
তার স্রষ্টা কে, তার জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী, বিশ্বসৃষ্টির মূল সত্যটিই বা কী? কোনও
উত্তর পায়নি। তার মনে ক্ষোভ জেগেছে, কেন সবকিছু এত হেঁয়ালিময় এবং চিরদুর্জ্ঞেয়?
ঈশ্বর যদি আছেন তবে তিনি সহজে প্রকাশ্য নন কেন, সত্য যদি আছে তবে তা সহজে প্রাণে
বোধ্য নয় কেন? কিসের এত তত্ত্ব, পুঁথি, পাণ্ডিত্য, ব্যাখ্যা, বিতর্ক, ভাবসমাধি,
ধর্মযুদ্ধ? হয়তো এই বিদ্রূপাত্মক প্রহেলিকাই মানুষের অভিমানকে মিথ্যাশ্রয়ী হতে
ইন্ধন জুগিয়েছে?”
এই সমস্ত
প্রশ্নের কোন উত্তর তিনি দেন নি, তিনি শুধু দেখেছেন সবকিছু, ঈশ্বরের মতোই, এক
সর্বদর্শী সত্তা হিসাবে, আর প্ররোচনা জুগিয়েছেন প্রশ্ন করতে। অথবা নিজে প্রশ্ন
করেছেন, হ্যামলেটের মতো— এক ‘আধুনিক ব্যক্তিমানুষের সংশয়ী, অবিশ্বাসী এবং বেদনার্ত
চোখে’ বুঝতে চেয়েছেন ‘অনির্দেশ্য’ যাবতীয় সবকিছু, কোন উত্তর ব্যতিরেকে। এখানেই তিনি
ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন একজন প্রাবন্ধিকের যাবতীয় শপথ, এবং হয়ে উঠেছেন কবি।
“কামিনীফুলের
গন্ধে সত্য আছে, ছলনাও আছে...
...রাত্রি যত
বাড়ে, তত কামিনীফুলের
উগ্র গন্ধে লুপ্ত
হয় পৃথিবীর সমস্ত শপথ।”
ঋণ স্বীকার:
১) ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’, খোঁপার
ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ
২) ‘হ্যামলেটের উন্মাদনা: কবিতার
মুক্তি’, খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ
৩) ‘ঈশ্বরের চোখ’, ঈশ্বরের চোখ
৪) ‘কামিনীফুলের গন্ধে’, ঈশ্বরের
চোখ