রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬১  


ছত্তিশগড়ের ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ে বাংলা সাহিত্যের চর্চা দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত আছে সেখানকার অত্যন্ত আগ্রহী এবং সচেতন বাংলাভাষাপ্রেমীদের একান্ত উৎসাহে ও সক্রিয় উদ্যোগে। এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর সরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হওয়ার প্রাক্কালেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন এসে উপস্থিত হয়েছেন এই কর্মক্ষেত্রে। সুদূর বাংলা থেকেও এসেছেন শিক্ষিত ও শিল্পদক্ষ বাঙালিরা। আর এ তো আমাদের সবারই জানা আছে যে, যেখানে পাঁচজন বাঙালি একত্রিত হন, সেখানে যে তিনটি প্রতিষ্ঠান অনিবার্য ভাবে গড়ে ওঠে, তা  হচ্ছে কালীবাড়ি, ক্লাব ও সাহিত্যসভা। বলা বাহুল্য, ভিলাইতেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। সম্প্রতি সাহিত্যের কারণেই আমাকে ভিলাই যেতে হয়েছিল। জানতে পারলাম, বিগত ১৯৫৯ সালের ২৫শে অক্টোবর জন্ম হয়েছিল বঙ্গীয়  সাহিত্য সংস্থার। এবছর সেই সংস্থা পদার্পণ করল ৬০ বছরে। আর এই উপলক্ষ্যেই আয়োজিত হয়েছিল হীরক জয়ন্তী উৎসব গত ২৮শে অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। যাঁরা এই সংস্থার জন্ম দিয়েছিলেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁদের মধ্যে অনেকেই আর জীবিত নেই। কিন্তু তাঁদের সৃষ্ট বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থা আজ রীতিমতো যৌবনাবস্থায় আছে, ৬০ বছরের টগবগে যুবকের মতো। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে এখন আর মাত্র কয়েকজন প্রবীণ সদস্য জীবিত আছেন। যথা শিবব্রত দেওয়ানজী, ডা. ভবানীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ফণী রায়, ক্ষিতীশ দেবসিকদার, রবীন্দ্র গুহ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণপদ চক্রবর্তী এবং কমলেশ রায়। তবে পরবর্তীকালের সদস্যদের মধ্যে চন্দ্রনাভ  দাশগুপ্ত, প্রতুলকৃষ্ণ চক্রবর্তী, দীপককুমার সরকার, সমরেন্দ্র বিশ্বাস, দুলাল সমাদ্দার, বাণী চক্রবর্তী, আরতি চন্দ, মনোরঞ্জন দাশ, মিতা দাশ, গোবিন্দ পাল, দীপালী দাশগুপ্ত, প্রকাশ মন্ডল, মাধুরী চক্রবর্তী, মধু ভট্টাচার্য – এঁরা সবাই সক্রিয় ভাবে কাজ করে চলেছেন।

বস্তুতপক্ষে ভিলাই ইস্পাত কারখানায় প্রথম উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী। আর মজার ঘটনা, ঠিক সেই তারিখেই ছত্তিশগড়ের (তৎকালীন  মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত) প্রথম বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘অংকুর’ও প্রকাশিত হয় শিবব্রত দেওয়ানজীর সম্পাদনায়। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য হাতেলেখা পত্রিকা ছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার প্রথম মুখপত্র ‘অংকুর’ এরপরে ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় মুদ্রিতাকারে। প্রায় ১০ বছর পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে সংস্থার মুখপত্র রূপে প্রকাশ করা হয় বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘মধ্যবলয়’, যা নিয়মিত ভাবে এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে এবং দেখতে দেখতে তারও বয়স হয়ে গেল ৩৫ বছর।
বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার হীরক জয়ন্তী উৎসবে আমি মুখ্য অতিথির সম্মানে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছিলাম। সারাটা দিন একটি রম্য প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা, স্বরচিত কবিতাপাঠ এবং সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যে আমার প্রাপ্তি ছিল ব্যাপক। আমি মুখ্য অতিথির ভাষণে মূলত বক্তব্য রেখেছিলাম বাংলা ছোটগল্প বিষয়ে। বাংলা কবিতা বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন সমরেন্দ্র বিশ্বাস এবং আমন্ত্রিত কবি ও ‘খনন’ পত্রিকার সম্পাদক সুকুমার চৌধুরী। এছাড়া সংস্থার সভাপতি চন্দ্রনাভ দাশগুপ্ত, ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকার সম্পাদক শিবব্রত দেওয়ানজী, ডা. ভবানীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও দুলাল সমাদ্দারও বক্তব্য রাখেন। সামগ্রিক অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংস্থার সচিব আরতি চন্দ এবং সহ সভাপতি বাণী চক্রবর্তী।

মূল বাংলা ভূখন্ড থেকে অনেক দূরে বসবাস করে এভাবেই বাংলা সাহিত্যের নিবিড় চর্চা চলেছে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে। তথাকথিত প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যচর্চাকে বহির্বঙ্গ বা বাদবঙ্গ অথবা যে বিশেষণেই সম্বোধিত করা হোক না কেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলার মূল সাহিত্যের নিরন্তর সেবা করে চলেছেন। এবং সেইসঙ্গে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ করে চলেছেন বাংলা সাহিত্যকে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁদের এই দায়বদ্ধতার জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।  


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
KajalSen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




কী যে বলি! 





বধূমাতার আদি বাপের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের খাটুন্দিতে  তাঁদের আদি পিতৃগৃহের আড়াই-তিনশো বছরের পুরনো দুর্গাপুজায় গিয়েছিলাম। তিনশো বছর ধরে এক মন্ত্রগুরুদের গ্রামে ভট্টাচার্য আদি পুরোহিতের গৃহজামাতাদের দৌহিত্রবংশ চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি-মুখুজ্জেরা সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা করে আসছেন। প্রশস্ত সিমেন্টের পঁচিশ বাই কুড়ি একচালা ঘিরে পাশাপাশি ছটি দুর্গাপুজো হয় ও হচ্ছেআগে ছিল সাতটি। পরে কালক্রমে আরো একটি জেলাশহরে স্বাতন্ত্র্য সন্ধানে সরে যাওয়ার পরে ছটিই আছে। তাদের মধ্যে একটি বৈষ্ণব মতাবলম্বী। সেখানে পশুবলি নিষেধ। বাকিগুলিতে মণ্ডপের সামনে হাড়িকাঠ পোঁতা হয়।  সাময়িকভাবে। কারণ ছটি দুর্গামণ্ডপই কৃষ্ণরায়ের অধীন। তাঁর একটিই মন্দির। সেখানে স্বভাবতঃ নিরামিষ কৃষ্ণসেবা হয় সারা বৎসর। কেবল দুর্গাপুজার আগে  কৃষ্ণকে চার দিনের জন্যে মাঝে মাঝে ঘুম পাড়িয়ে সারা বচ্ছর ধরে ফাঁকা থাকা ছটি চণ্ডীমণ্ডপে রেখে দুর্গাকে আনা হয় মাত্রই চারদিনের জন্যে। তাতে কিবা আসে যায়! সমগ্র বাংলাতেই দুর্গা বাড়ির বাইরে মণ্ডপে, প্যান্ডালে অতিথি। কালী বা লক্ষ্মীর মতো নিত্যসেবার মন্দির নেই তাঁর। এখানে থাকে ফাঁকা বাড়ি, গৃহস্থের নিরামিষাশালয়ে আমিষাশী মেয়ের কদিন আসার জন্যে! 

এই দুর্গার জমিদারি বা বারোয়ারি পুজো শুরু সেই অষ্টাদশ শতক থেকেই যখন  জমিদারদের তরফে একদিকে মুঘল এবং নবাবদের আরোপিত হিন্দুদের উৎসব কর ১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রদ করে দেওয়ায় গণ উৎসবের উপর নিষেধাজ্ঞা ওঠায় জমিদারদের খুশির প্রকাশ, অন্যদিকে ব্রিটিশদের সহযোগী এক মুৎসুদ্দি শ্রেণি হিসেবে তাঁদের নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, এতৎকাল অবধি মুসলিমদের দমন ও তাদের সম্পর্কে অধরিকতার বোধের মোচন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পরে কোম্পানির অডিটরদের হাতে নিজেদের হিসাব পড়ে যাওয়ার পরে একটু করছাড় পাওয়া ব্যয়ের সুযোগ (যেটার নিদর্শন ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে  দেওয়া দিনাজপুরের রাজা বৈদ্যনাথের চিঠি থেকে পাওয়া যায়), আর শেষতঃ নিজেদের মধ্যে একটু প্রতিযোগিতার লোভ, ইত্যাদি কারণে জমিদারি দুর্গাপুজোর ধুম পড়ে যায়। ফলে ১৫৮৩-তে রাজশাহীতে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, ১৬১০ সালে সাবর্ণ চৌধুরীদের পিতৃপুরুষ বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত গাঙ্গুলি আর নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, ১৭৫৭ সালে, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ইত্যাদি দুর্গাপুজার প্রচলন করেন। অষ্টাদশ ও উণবিংশ   শতাব্দীতে জমিদারি পুজোয় যে ভক্তির চেয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য ও ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে নবধনীদের সায়েবদের সঙ্গে সখ্য ও বৈভব দর্শনের ক্ষেত্র ছিল সে কথা বরেণ্য ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন। প্রথম সাধারণ বাঙালি হিন্দুদের পুজো যদি হয়ে থাকে ১৯১০ সালে উত্তর কলকাতার বলরাম বসু ঘাট রোডে, তবে প্রথম বারোয়ারি পুজো হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০-তে।

পুত্রবধূর পিতৃগৃহে যদি আড়াই-তিনশো বছর ধরে দুর্গাপুজা হয়ে থাকে, তবে তা  এই প্রবণতারই ‘ডিফিউশন’। কিন্তু আমার এই পূজার জাঁক ও নিষ্ঠা সমানভাবে  ভালো লেগেছে। গ্রামটিতে কোনো অজ্ঞাত কারণে পূজক অধিবাসীরা তাঁদের বাড়িগুলোকে মূলতঃ আলকাতরা লেপা মাটির একতলা, দু’তলা রেখে দিয়েছেন।  আমার আধুনিক পদার্থবিদ্যার ছাত্র বেয়াই কেবল এই মৃৎসাম্রাজ্যের মধ্যে তাঁদের শরিকি বাড়িটিতে একটি আধুনিক সিমেন্টের কিচেন ও দুটি ঘর যোগ করেছেন স্ত্রীর সুবিধার্থে। ছটি পুজোর পাঁচটিতে প্রত্যেকটিতেই সপ্তমী থেকে নবমী অবধি অন্ততঃ একটি ছাগবলি হয়! পূজার ও বলির আগে ও বলির পরে কিছুক্ষণ কৃষ্ণরায়কে কানে তুলো গুঁজে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়! একবার তাঁর ঘুম ভাঙানো হয়, যাঁদের এবার সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে পুজোর ‘পালা’ পড়েছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরামিষ ভোগ খেয়ে আসতেআবার তাকে ঘুমে পাঠানোর পরই কেবল নবমীর ছাগবলি আর ছাগমাংস ভক্ষণ হয়, তাও পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া আদা-জিরেবাটার ‘নিরামিষ’ মাংস। বলির পরেই হাড়িকাঠ উপড়ে তুলে নেওয়া হয়, যাতে কোনোভাবেই ঘুম থেকে উঠে কৃষ্ণরায় রক্তের আলপনা না দেখতে পান! শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের এই সহাবস্থান এই গ্রামের দুর্গাপূজাগুলিকে কেবল বিশিষ্টতা দেয়নি, বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতার দ্যোতনাও দিয়েছে।

 ছয় বাড়ির ছয় পুজো ঘিরে এক এলাহি ব্যাপার হয়ফাস্টফুডের বহু দোকান, চপ-কাটলেট-রোল-ডিমসেদ্ধ-ঘুঘনি থেকে চাউমাউখাঁউ সব! তার সঙ্গে যাত্রা-কবিগান থেকে কবির লড়াই!  গ্রামের সকল ভদ্রলোক বিভিন্ন পালাবাড়িতে সপ্তমী থেকে নবমী পালার দিন পংক্তিভোজে আসেন। এরকম আগে কম দেখেছি। একমাত্র বসিরহাটের অদূরে আমার স্ত্রীর আদি বাপের বাড়িতে ওঁদের বাড়ির দোল উৎসব ঘুরে গোটা গ্রামের মেলা দেখেছি, যাতে সার্কাস থেকে ‘এক্সরে গার্ল’ সব ছিল!





তো, যে কারণে এই লেখার অবতারণা! এই পূজার বেশ কিছু ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে গিয়ে বলির একটি দৃশ্যের একটি অংশ উঠে গেল যাতে একচালার উঠোন থেকে মন্দির অবধি রক্তের আল্পনা ছিল। এক পরম ফেবুবন্ধু  প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, ‘এত রক্ত কেন’? এই সম্ভাব্য প্রশ্নের কারণেই আমার  আরেক অতি নিকটাত্মীয়া ছবি ফেবুতে বলি-র ছবি আপলোড করা সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কারণ ফেসখাদের অধিকাংশই অত্যন্ত সূক্ষ্ম, স্পর্শকাতর। এখন এত রক্ত কেন প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি  উপন্যাসে হাসি-তাতার তরফে উঠে যাওয়ার পর, আমাদের অনেককেই ভাবিয়েছে। তিনি এই প্রশ্ন করতেই পারেন, কারণ ছবিটা কতকটা রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি  উপন্যাসের সেই দৃশ্যের মতো—

কাল রাত্রে অমাবস্যা ছিল, কাল ভুবনেশ্বরীর পূজা হইয়া গিয়াছে যথাসময়ে হাসি ও তাতার হাত ধরিয়া রাজা স্নান করিতে আসিয়াছেন একটি রক্তস্রোতের রেখা শ্বেতপ্রস্তরের ঘাটের সোপান বাহিয়া জলে গিয়া শেষ হইয়াছে কাল রাত্রে যে এক-শো-এক মহিষ বলি হইয়াছে তাহারই রক্ত
হাসি সেই রক্তের রেখা দেখিয়া সহসা একপ্রকার সংকোচে সরিয়া গিয়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কিসের দাগ বাবা!”
রাজা বলিলেন, “রক্তের দাগ মা!”
সে কহিল, “এত রক্ত কেন!” এমন একপ্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল এত রক্ত কেন”, যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল, “এত রক্ত কেন!” তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন বহুদিন ধরিয়া প্রতি বৎসর রক্তের স্রোত দেখিয়া আসিতেছেন, একটি ছোটো মেয়ের প্রশ্ন শুনিয়া তাঁহার মনে উদিত হইতে লাগিল, “এত রক্ত কেন!” তিনি উত্তর দিতে ভুলিয়া গেলেন অন্য মনে স্নান করিতে করিতে ঐ প্রশ্নই ভাবিতে লাগিলেন

আমিও ভাবতে লাগলাম কেন এই প্রশ্নটা আমাদের ভাবায়। আমাদের মানে সেই শহুরে, সূক্ষ্ম মানুষদের যাঁরা প্রতি রবিবার খাসি-পাঁঠা, আর অধুনা স্বাস্থ্য-সচেতনতার কারণে নিত্য মুরগির, কোয়েলের মাংসের সেবা করেনসেই মাংস, যা আমাদের শৈশবে জানা সন্নিষ্ঠ পণ্ডিত মিছরিলাল শাস্ত্রী ‘বৃথামাংস’ হিসেবে ছুঁয়েও দেখতেন না! মিছরিলাল শাস্ত্রী হয়তো (ঠিক জানি না) বছরে কয়েকবার মাত্র বলির মাংস, পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া আদা-জিরেবাটার নিরামিষ চেহারায় ছুঁয়ে দেখতেন।

বন্ধু, আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় বলির ছবি ছাপতে ভয় পাওয়ার কথা। কারণ বন্ধুদের সূক্ষ্ম, আধুনিক নান্দনিক দৃষ্টিতে বা বিবেকে ধাক্কা লাগতে পারে কিন্তু কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের অজস্র বাজারে, রোজ, বিশেষতঃ শনি-রোব্বার-ছুটির দিনে লক্ষ লক্ষ অ-ধর্মীয় পশুবলি হচ্ছে, তাদের হাঁ-করা, মাথা আমরা রোজ দেখছি দোকানে দোকানে। ব্রেন-কারির জন্যে ছাড়িয়ে কিনেও আনছি! খাসি-পাঁঠা ছেড়ে শিক্ষিত বাঙালি গরু-শুওরের দিকেও বেশি বেশি করে ঝুঁকছে। হরিণঘাটা পোল্ট্রি-ফার্মিং খাসি-পাঁঠা ছাড়াও ভেড়া, টার্কি, চাষ-করা দেশি বনমুরগি (অক্সিমোরন কি?), হরিণ, কোয়েল ইত্যাদির মাংস গাড়ি করে এনে দিচ্ছে তাদের জন্যেএত মাংস আমরা বাঙালিরা আগে খেতাম? এত মাংস খাওয়ার দরকার আছে? ভাবুন তো! দেখুন! চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বীরনায়ক ব্যাধ কালকেতু কী খেতেন, কবিকঙ্কনের বয়ানে? দেখুন

বোঁচা নারিকেলেতে পুরিয়া দিল জল
করিল ফুল্লরা তবে ভোজনের স্থল।  
চরণ পাখালি বীর জল দিলা মুখে।
ভোজন করিতে বৈসে মনের কৌতুকে।
সম্ভ্রমে ফুল্লরা পাতে মাটিয়া পাথরা।
ব্যঞ্জন খাইতে দিল নূতন খাপরা।
মোচড়িয়া গোঁফদুটি বান্ধিলেন খাড়ে।
এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।
চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।
ছয় হান্ডি মুসুরি সুপ মিশ্যা তথি লাউ।
ঝুড়ি দুই তিন খায় কচু ওল পোড়া।
কচুর সহিত হায় করঞ্জা আমড়া।

স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত এই কবিতাংশে কিছু শব্দের প্রমাদ থাকতেও পারে! কিন্তু সেই ব্যাধ কালকেতু, মহাবীর, যাঁকে পৃথিবীতে নিজের পূজা প্রচারের জন্য স্বয়ং চণ্ডী বেছে নিয়েছিলেন মনসার ধরণে চাঁদ সদাগরের মতো, তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় মাংস কই? তবে তিনি কি পেশার কারণে পশুবধ করতে বাধ্য হলেও নিজে মাংস কম খেতেন? আর যদি অতিবীরের খাদ্যতালিকায় মৃগমাংস নাই  থাকে, তবে আমরা ‘পুঁয়ে-পাওয়া’ ক্ষীণজীবী বাঙালিরা এত মাংস-মাংস  করি কেন? যদি করি তবে আমাদের অবস্থা কি রোল্ড ডালের (Roald Dahl)‘Pig’ গল্পের সেই বাপ-মা-মরা ছেলেটি লেক্সিংটন(Lexington)-এর মত নয়, যে একই  রাত্রে পুলিশের অবুঝ গুলিতে মা, বাপ দুজনকেই হারিয়ে, সত্তর বছরের  নিরামিষাশী পিসি, বিশাল নিরামিষ রাঁধিয়ে গ্লস্প্যান (Aunt Glosspan)-এর  কাছে প্রতিপালিত হয়ে, সতেরো বছরেই ন’হাজার রকমেরও বেশি অসাধারণ,  মৌলিক নিরামিষ রেসিপি তাঁর কাছেই শিখে, ন্যুইয়র্ক শহরে এসে, শস্তা রেস্তরাঁয় শস্তা মাংসের চপ খেয়ে তার স্বাদে এত মজে গেল যে মাংস কাটার বুচারি বা কসাইখানায় ঢুকে মাংস কাটার পদ্ধতি দেখতে দেখতে কসাইখানার কনভেয়ার বেল্টের  চেনে পা আটকে গিয়ে নিজেই মাংস হয়ে গেল? ডাল সেখানে কসাইখানার যে বর্ণনা দিয়েছেন নিজেই কাটা হতে থাকা লেক্সিংটনের চোখ দিয়ে, তা কি আমাদের পাঁঠার  দোকানের চেয়ে অনেক ভয়াবহ নয়?





বহুদিন আগে এক ছাত্রর বাড়ির কাছে মাইথনের কল্যাণেশ্বরীর মন্দিরে গিয়ে দুর্গাকালীর পূজা ছাড়াও এক সাধারণ দিনে প্রচুর পাঁঠাবলি দেখেছিলাম। এই পশুবলিপ্রথার বিরুদ্ধে ওই ছাত্র নান্দনিক-বিবেকী আপত্তি জানিয়েছিল। পরে একটি মুসলিম ছাত্র ও আরেক  মুসলিমবন্ধু জানিয়েছিলেন যে তাঁরা কুরবানি ঈদে অংশ নেন না, এই বলির কারণে। দু’দলকেই শুধিয়ে জেনেছিলাম যে  তাঁরাও ভালো রকমের মাংশাষী। তাহলে বলিতে/কুরবানিতে এত আপত্তি কেন?  জাতকে মোট কত কত বার বোধিসত্ত্ব প্রাণীদের অভয় দিয়েছেন! তা বলে অবশ্য ভাবলে ভুল হবে যে তার প্রাধান্যের কালেও বৌদ্ধধর্ম পশুহত্যা এমনকি গো-বধকেও নির্মূল করতে পেরেছিল খাদ্যাভ্যাস বড় কঠিন ব্যাপার ডি. এন.ঝাতাঁর The Myth of the Holy Cow (London: Verso, 2004) বইতে দেখিয়েছেন থেরাবাদী বৌদ্ধধর্ম যেখানে প্রবল, এমনকি সরকারি ধর্ম, ভারতীয় উপমহাদেশের সেইসব দেশে/রাষ্ট্রে, যেমন মিয়ানমার (বর্মা), শ্রীলঙ্কা, সেখানেও গো-মাংস ভক্ষণ আইন সত্ত্বেও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, যদিও মাংস তালিকায় তার স্থান খুব নিচে নির্মূল হবে কী করে? কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ নিজে অহিংসার প্রচারক হয়েও শূকর-মাংসের অন্ন (‘শূকর-মাদ্দব) খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন অশোকের অ-নিধন তালিকায় প্রাণীদের মধ্যে গাভীর উল্লেখ নেই ভারতের ভিতরে ও বাইরে, যেমন লাহুলে গোপনে আর তিব্বতে বৌদ্ধরা বহুদিন অন্যান্য পশুমাংসের সঙ্গে গবাদি পশু খেয়ে জৈনদের তীব্র বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন বুদ্ধ মাংস খেতেন বা খেয়েছিলেন, বৌদ্ধরাও, তবু কিন্তু আমি মনে মনে কতকটা বৌদ্ধকারণ তাঁদের চেয়ে হিংস্র নিরামিশাষী আছেন। বাদশাহ হূমায়ুন দিল্লি পুনরুদ্ধার করার সময়ে সাময়িকভাবে মাংসাহার বর্জন করেছিলেন। তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীর ১৬১৮-১৬২২ এই চার বছর পশুহত্যা না করার শপথ রক্ষা করেন। তাছাড়া পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ সপ্তাহে কয়েকদিন মাংসাহার করতেন না। নিরামিষাহারকে অবশেসনের পর্যায়ে নিয়ে আসেন আকবর। বলতেন, নিজের  শরীরকে পশুদের কবরস্থান করতে চান না! রাজসভাতেও নিরামিষাহার চালু করেন সাবধানে। কিন্তু শিকার ছাড়েন নি। যদিও শিকারকালেই তিনি এক ভাবাবেশে মগ্ন হয়ে শিকারে ধরা সব পশু ছেড়ে দেন, আর সেই শিকারস্থানটিকে ক্ষুদ্র মক্কা বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু তবুও নিজে শুক্রবারে, প্রতি সৌর মাসের অষ্টাদশ দিনে, উপবাসের দিনগুলিতে, সূর্য এবং চন্দ্রগ্রহণের দিনগুলিতে, নিজের জন্মদিনে, নিজের সিংহাসনারোহণের দিনের প্রত্যেকটিতে কেবল মাংসাহার করতেন নাকিন্তু জাহাঙ্গীর, হূমায়ুন, আকবর রণক্ষেত্রে বা অন্যত্র অজস্র নরবলি দিয়েছেন। নররা কি পশুও নয়? রণক্ষেত্রে তাদের কাটামুন্ডু কি মাংসের দোকানে, বা পূজার মন্দিরে হাড়িকাঠে ছাগলের কাটামাথা থেকে দেখতে ভালো?

অন্য রকমের বলির কথা বলি! কত লোক রোজ রাজনীতির বলি হন কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, ভারতে, লেবাননে, সিরিয়ায়, ইয়েমেনে, আরো কত জায়গায়? আর দিল্লিতে নির্ভয়ার, পশ্চিমবঙ্গে কামদুনির, ধূপগুড়ির মতো হাজার হাজার ঘটনায়  দেশের লোক আমরা রোজ দেখছি নারীমাংস কিভাবে আমাদের বহু মানুষের মেনুতে জায়গা করে নিচ্ছে! আদিবাসী বধূর গণধর্ষণের পরেও যৌনাঙ্গে ঢোকানো হচ্ছে লোহার রড! কেরালার এক নান-এর গণধর্ষণের প্রধান সাক্ষী রহস্যময় ভাবে মারা গেলেন। আমরা চুপ করে থাকছি। হয়তো বলছিও এত রক্ত কেন’? কিন্তু তাতেও তো থামছে না কিছুই! সেখানে চারদিন কৃষ্ণরায়কে কানে তুলো গুঁজে ঘুম পাড়িয়ে রাখার পরে কিছু পাঁঠাবলিতে এত কথা সত্যি উঠতে পারে? জানি না! তা বলে আমি সম্প্রতি যেভাবে আমাদের দৈনিক খাদ্যতালিকায় মাংসভোজনকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে তারও সমর্থক নই! যদিও পশুমাংস আমার প্রিয়তম আমিষ নয়! 



এই কয়েকদিন আগে আমার নিজের দেশের সংস্কৃতিকে বিদেশিরা ও রুশরা কিভাবে দেখেছেন তা নিয়ে বলতে রাশিয়া ঘুরে এলামসেখানে বেশ কিছু মানুষকে দেখলাম ভারতীয় হঠযোগ, নিরামিষ ইত্যাদিকে সম্বল করেছেন। কিন্তু সব রকমের পশুমাংসের তালিকায় ভর্তি হোটেলের প্রাতরাশের খাদ্যতালিকা। অধিকাংশই ভালো রকমের মাংশাষী। কেবল কোথাও কলকাতার মত মাংসের দোকানে পশুর কাটামুণ্ডু দেখতে পাই নি। কিন্তু এই বিপুল মাংসাহারের দেশে বুচারিগুলোর চেহারা কিরকম? দুপুরে লাঞ্চের সময় এক খদ্দেরকে বিফস্টিক অর্ডার করার সময়ে একজনকে জিজ্ঞাসিত হতে শুনলাম রক্তসহ, মাঝামাঝি, না শুকনো। তিনি বেশি স্বাদের কারণে রক্তসহ বলায় খেতে খেতে আমার বমি পেলো! অথচ পাঁঠার মাংসের দোকানে কাটামুন্ডু দেখে আমার ভাবান্তর হয় না। পূজার বলিতে প্রথমে সামান্য হয়! কিন্তু যে লোকগুলি ওই সময়ে প্রবল আওয়াজ তুললেন তাঁদের কাউকে কাউকে অনামিষাষী বলে জানি। তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ ওই পশুর নিরামিষ মাংস খান। কারণ ওটি নিজের বলিপ্রদত্ত পশুপ্রবৃত্তির প্রতীক। সত্যি সত্যি আমার নিজের দেশের সংস্কৃতিকে আমি নিজেই ঠিকঠাক দেখতে পাই? আসুন একটা শপথ নিই! আমাদের মধ্যে যাদের যাদের মনে হাসির ‘এত রক্ত কেন’ শব্দ তিনটি এখনও অনুরণন তোলে তারা সব পশুকে কিছু কিছু জাতকের বোধিসত্ত্বের মতো সব প্রাণীকে অভয় দিই! যে শপথ গান্ধীর নিরামিষ আহারের শপথের মতো দৃঢ়, যাতে বুদ্ধের শূকর-মাদ্দব ভক্ষণের স্থান নেই  এছাড়া আমরা দ্বিচারিতা থেকে মুক্ত হতে পারবো না!



সুনীতি দেবনাথ




কতিপয় চিল শুধু বলেছিল শুভ জন্মদিন



কবি বিনয় মজুমদার মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বিপিনবিহারী মজুমদার, মা বিনোদিনী। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট। ১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের কিংবদন্তি কবি তিনি মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে  (বর্তমান) চলে এসে এখানেই বাল্যশিক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশবিভাগের জন্য ১৯৪৮ সালে সপরিবারে তাঁরা কলকাতা চলে আসেন। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বিনয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে রেকর্ড নম্বর পান কিন্তু  পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হয়েও সারাজীবন কাটিয়েছেন কবিতার সাধনায়

অকৃতদার এই কবির শেষ জীবন বড় দুঃখের, অসুখে-নিঃসঙ্গতায় মৃত্যুর বছর খানেক আগে তাঁকে দুটি বড় পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার এবং একাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। ষাটের দশকের পরে অসুস্হতার জন্য কবিতা লেখা কমে গিয়েছিল মোট কাব্যগ্রন্থ কুড়ির কাছাকাছি, যার মধ্যে 'ফিরে এসো চাকা' তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত একে 'গুপ্ত ক্লাসিক' বলেছেন এর নামহীন  কবিতাগুলি সংখ্যাক্রমে চিহ্নিত, নিচে তারিখ দেওয়া 'মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত  সারস উড়ে যায়', প্রবাদসম এই পংক্তি সেই বইয়েরই মৌলিক প্রতিমা নির্মাণ,  বিশিষ্ট অন্বয় এবং ভাবের ও আবেগের তীব্রতা ও নিবিড়তা তাঁর কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে অল্পস্বল্প প্রবন্ধও লিখেছেন, পাশাপাশি কিছু অনুবাদগ্রন্থও রুশ ভাষা শিখেছিলেন যা অনুবাদের কাজে লেগেছিল। জীবনানন্দের কবিতার কথা  যেমন তরুণ কবিদের শিক্ষা ও প্রেরণা দেয়, বিনয়ের নির্বাচিত প্রবন্ধও তেমনি হয়ে উঠতে পারত, যদি আরও একটু যত্নের সঙ্গে সংকলিত হতইঞ্জিনিয়ারিং পেশা ত্যাগ করলেও, বিজ্ঞানের শিক্ষাকে ভোলেননি তিনি। তাঁর চোখে, 'গণিত ও কবিতা একই জিনিস' আমৃত্যু গণিত ও কবিতার দ্বারা তাড়িত'ফিরে এসো চাকা' ছিল তাঁর অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ।

বৌলতলি হাই-ইংলিশ স্কুলের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর স্থির করেন শুধুই কবিতা লিখবেন। লেখা শুরু করেন 'ফিরে এসো চাকা' এই সময় তিনি দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টেও কিছুদিন কাজ করেন। তখন থেকেই মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে লিখতে শুরু করেন 'আঘ্রাণের অনুভূতিমালা' 'ঈশ্বরীর  স্বরচিত নিবন্ধ'বিশটির কাছাকাছি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন। যার মধ্যে ‘ফিরে এসো চাকা’ তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে। এছাড়াও নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, আমাদের বাগানে, আমি এই সভায়, এক পংক্তির কবিতা, আমাকেও মনে রেখো - ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে বিনয় মজুমদার হাংরি আন্দোলন-এ যোগ দেন এবং তাঁর কয়েকটি কবিতা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিলপরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে তিনি শক্তি  চট্টোপাধ্যায়  এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে একটি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করে কলকাতা কফিহাউসে বিলি করার পর হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন নিঃসঙ্গ জীবনে শারীরিক ও মানসিক চরম ভোগান্তির পর তিনি ২০০৬ সালে পরলোক গমন করেন।



এখানে বিনয় মজুমদারের দুটি কবিতা তুলে দেওয়া হলো-


আর যদি নাই আসো

আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন। বহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে


ফিরে এসো চাকা  

ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ'রে যায়
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত সহজতম এই দান - শুধু অঙ্কুরের
উদ্গমে বাধা না দেয়া, নিষ্পেষিত অন্যলোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না-ক'রে শ্যামল হতে দেয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে 
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রর মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি 
'লে যাবে, ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।




                                 


অদ্বয় চৌধুরী




খোঁপায় কামিনীফুলের গন্ধ




আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয়
জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ

ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস
ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি

তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার
পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের 
অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে
      
রণজিৎ দাশ, কবি, তাই চিরসজাগ, নিরন্তর দেখে চলেন ঈশ্বরের চোখে, সমাজ, পৃথিবী, সেই সমাজ ও পৃথিবীর ভিতরের চক্রান্ত, চাঁদ, রক্ত, ক্রিমি, কীট, রাক্ষস, মুখোশ, নাচ, মদ, এবং বেশ্যা। এই দেখা এক বাস্তব প্রক্রিয়া— প্রতিক্রিয়াও। এবং, প্রবণতাও বটেপৃথিবীর কদর্যতম বাস্তবের মধ্যেও যদি একজন কবি বাস করেন, তিনি সেই কুৎসিত বাস্তবকে নিরীক্ষণ করেন, নিরন্তর, অবিরাম। এ হল সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী কবিসত্তা, যা ঐশ্বরিক সত্তাও বটেশুধু কবি নয়, এই সত্তা প্রতিটি শিল্পীর। একজন প্রাবন্ধিকেরও

ঠিক এই জায়গাতে এসে আমরা কবি রণজিৎ দাশকে আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে প্রাবন্ধিক রণজিৎ দাশের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করব। ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’। এই প্রবন্ধে, এক নিদারুণ মায়াময় ইন্দ্রজাল বিস্তারের মাধ্যমে তিনি এগিয়েছেন, ধীরে ধীরে, প্রতিটা পদক্ষেপে এক নতুন কুহক রচনার মধ্যে দিয়ে। হ্যাঁ, কুহকই রচনা করেছেন তিনি। শিল্পীসত্তার অমোঘ প্রবণতা মেনে বাস্তব বিষয়বস্তুই উঠে এসেছে তাঁর রচনায়, কিন্তু এক ধাঁধার মাধ্যমে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার মাঝে সদাজাগ্রত প্রাচীরটি ক্রমশ ধূসর হতে হতে একসময় অবলুপ্ত হয়ে যায়, এবং এই অবলুপ্তি ঘটে পাঠকের অজান্তেই। আবিষ্ট পাঠক কিন্তু তখনও সেই সত্য ও মিথ্যার গভীরে প্রবেশ করে তাদেরই উৎস অনুসন্ধান করে চলেছে। সমগ্র প্রক্রিয়ায় মুছে যায় কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে বিরাজিত সীমারেখাটিও। এই ভানুমতীর খেলই প্রাবন্ধিক রণজিৎ দাশের অবিশ্বাস্য দক্ষতা। এই দক্ষতা প্রদর্শনকেই তাঁর প্রবণতা হিসাবে ধরা যায়এই প্রবণতাকে তাঁর আপন সুদক্ষ কৌশল রূপে গণ্য করা যায় এবং এই সুদক্ষ কৌশল জাগিয়ে তোলে প্রবল কৌতূহল, পাঠকের মনে।

কৌতূহল জেগেছিল প্রাবন্ধিকেরও — অপরিসীম কৌতূহল‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’টি শুরুই হচ্ছে প্রাবন্ধিকের সেই অপরিসীম কৌতূহল প্রকাশের মাধ্যমে:

“পৃথিবীতে প্রথম যে মেয়েটি খোঁপায় ফুল গুঁজেছিল, তার সম্পর্কে আমার কৌতূহল অপরিসীম। আমার চোখে এই আদি-মানবী এক অপার রহস্যের প্রতীক।”

এই রহস্যময়ী আদি-মানবী প্রাবন্ধিকের নন্দন-চিন্তার কেন্দ্রীয় মোটিফতাঁর মতে, “দর্শনের এবং নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় এই নারী পণ্ডিতদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল”। তারপরেই আসে সেই বিস্ফোরক বিজ্ঞপ্তি, অথবা ইন্দ্রজাল বিস্তারের প্রথম মন্ত্র উচ্চারণ:

“সেই ভাবনা থেকেই, অবশেষে, বর্তমান লেখাটি সেই আদি পুষ্প-সুন্দরীর বিষয়ে একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক রচনা।”

এখানে দ্রষ্টব্য হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ শব্দবন্ধটি। এই বিবৃতির মাধ্যমে লেখক যেন লেখাটির উপর থেকে তাঁর সর্বদর্শী সত্তার আরোপিত ছায়ার অপসারণ ঘটানোর এক প্রয়াস রেখেছেন। এবং সফলও হয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে। পাঠক শুরুতেই নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় — লেখাটির সত্যাসত্য বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুইই তার নিজের হাতে, প্রাবন্ধিক এখানে কোনকিছু আরোপ করছেন না। ঠিক এই স্থানেই, এই মুহূর্তেই পাঠক নিজে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণে লিপ্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের মোহাবিষ্ট হওয়ার এটাই প্রথম পদক্ষেপ, এবং এখানেই প্রাবন্ধিকের অতুলনীয় ভানুমতীর খেল শুরু হয়। প্রবন্ধ এগোতে থাকে। উঠে আসে সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে আলোচনা। সৌন্দর্য কি সত্যের প্রকাশ? নাকি, মূলত সত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী — এক প্রতিসত্য? নাকি, সৌন্দর্য এক নিরপেক্ষ সত্তা? এই আলোচনায় উঠে আসে কিছু সম্ভাবনা, কিন্তু কোন মীমাংসা আরোপিত হয় না। বরং, প্রবন্ধের প্রথম অংশের শেষে, তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে, আবার ফিরে আসে সেই অমোঘ বিজ্ঞপ্তি:

“এই রচনায় উল্লিখিত লেখকদের এবং গ্রন্থের নাম, উদ্ধৃতি এবং বিতর্ক, সমস্তই, বলা বাহুল্য, সম্পূর্ণ কাল্পনিক। – লেখক




আবার, আরও একবার, প্রাবন্ধিক তাঁর আরোপিত সত্তাটি প্রত্যাহারের মাধ্যমে, সেই প্রত্যাহার স্মরণ করানোর মাধ্যমে, পাঠকদের বাধ্য করেন এই বিতর্কে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, বাধ্য করেন এই লেখার, আলোচনার, তর্ক-বিতর্কের কাল্পনিক সত্তা ও পরিচিতিতে বিশ্বাস করতে। এই মুহূর্তে পাঠক সম্পূর্ণ স্বাধীন — সে তার আপন চিন্তা অনুসারে এই বিতর্কের মীমাংসা নির্ধারণ করে নেয়, অথবা করে না কিন্তু প্রবন্ধের প্রথম অংশ শেষ হয়।

প্রবন্ধপাঠ আরও অগ্রসর হয়দ্বিতীয় অংশে উঠে আসে পরমানন্দ, সেই পরমানন্দ সন্ধান, এবং সেই সন্ধানে ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা। আলোচনা শেষ হয়, কিন্তু, আশ্চর্যজনক ভাবে, এই অংশের শেষে কোন বিজ্ঞপ্তি আর আসে না! তাহলে কি এই অংশটি ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ নয়? বাস্তবে, তাই। এই অংশটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক নয়। এই অংশে আলোচিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, এবং সেই পরীক্ষা থেকে উদ্ভূত সিদ্ধান্ত বাস্তব সত্য। পাতা উলটিয়ে প্রবন্ধের একেবারে শেষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় সেখানেও আর কোন বিবৃতি নেই। তাহলে কি প্রবন্ধের বাকি সমগ্র অংশটাই বাস্তবের উপর আধারিত? এবার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি প্রবন্ধের বাকি অংশে প্রাবন্ধিক, তাঁর সর্বজ্ঞ সত্তাসহ, বিরাজ করছেন? তাহলে প্রবন্ধের একেবারে শুরুতে যে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল তার অর্থ কি? বিশেষ করে যখন সেই খোঁপায় ফুলযোজনার বিষয়টি, এবং সেই খোঁপাধারী আদি-সুন্দরী আবার ফিরে আসে প্রবন্ধের তৃতীয় এবং চতুর্থে অংশে? ধাঁধা সৃষ্টি হয়। মায়াজাল বিস্তার লাভ করে। পাঠকের মনে জেগে ওঠে দোলাচল। কোনটা সত্য? কোনটা মিথ্যে? সত্য-মিথ্যার মাঝখানে প্রাচীরের অবস্থান কোথায়?

       “প্রাণীজগতে মিথ্যার বোধে মানুষ অনন্য।”

প্রবন্ধের তৃতীয় অংশ শুরু হয়। পাঠকের প্রতি ইঙ্গিত ভেসে ওঠে। এক দুর্দমনীয় কুহক বিস্তৃত হয়। ধীরে ধীরে জেগে ওঠে প্রাবন্ধিকের সর্বজ্ঞ সত্তা।

“অর্থাৎ মনুষ্যজীবনে মিথ্যার ভূমিকা বিশিষ্ট, এর প্রভাব গভীর। মিথ্যা স্বয়ং একটি জ্ঞান।... কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনায় কেন মিথ্যাকে একটি বিশিষ্ট শ্রেণি বা উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয় না, এটা খুব স্পষ্ট নয়হয়তো অবচেতনে কাজ করে সূক্ষ্ম অপরাধবোধ, মিথ্যার স্বীকৃতিতে বা বিশ্লেষণে অনীহা আসে।”

লেখক কিন্তু কোন অপরাধবোধে ভোগেন না। তিনি মিথ্যা নিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করেন।

“এতে কোন সন্দেহ নেই যে মেধা ও মিথ্যা সমানুপাতিক। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি যত উন্নত হয়েছে, তার মিথ্যাকে সৃজন করার ক্ষমতাও তত উন্নত হয়েছে।”

এখানে, সৃজনশীলতার প্রেক্ষিতে, ভীষণ গুরুত্বসহকারে আপন অস্তিত্বের ধ্বজা স্থাপন করে ‘মিথ্যা’। সৃজনশীলতায় মিথ্যাও এক অনিবার্য অংশ, এক তীক্ষ্ণ হাতিয়ার। এখানে, ক্রমশ, ধীরে ধীরে, আভাসিত হয় অসম্ভব মেধাসম্পন্ন প্রাবন্ধিকের প্রবণতা— অবয়বী ছদ্মবেশ ধারণ। মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক নিজেই সেই ইঙ্গিত দেন—

“কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে এই অনৃতচেতনার উদ্ভব ও বিকাশ— সে এক রহস্য। এ প্রসঙ্গে প্রাণীজগতের ক্যামুফ্লাজ বা অবয়বী ছদ্মবেশ একটি সম্ভাব্য আদিসূত্র।”

অবয়বী ছদ্মবেশ ধারণকারী প্রাবন্ধিক সত্য এবং ছলনার মধ্যে নিরন্তর যাতায়াত করেন, ভেঙে দেন সত্য ও মিথ্যার প্রাচীর। চতুর্থ অংশে বর্ণিত ঠিক সেই আদি-সুন্দরীর মতোই যে তাঁর আপন খোঁপায় প্রথম ফুল গোঁজার সাথে সাথেই “সাধারণ নারী রইল না সে, হয়ে উঠল মায়ালোকের মাতাহারি। তার অস্তিত্ব হয়ে উঠল এক ছদ্মবেশ, সত্য এবং ছলনার মধ্যে তারা যাতায়াত হয়ে উঠল অবাধ, অশরীরী”।

প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশের শেষে পাঠকের মনে যে প্রশ্ন উঠেছিল— সত্য-মিথ্যার মাঝখানে প্রাচীরের অবস্থান কোথায়?— তার উত্তর পাওয়া যায় এবার, সমগ্র প্রবন্ধটির শেষে। আদতে সত্য ও মিথ্যের মাঝে কোন প্রাচীরই নেই। প্রাবন্ধিক রণজিৎ দাশ অশরীরীর মতো নিরন্তর যাতায়াত করেন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে; তিনি খেলা করেন সত্য ও মিথ্যা নিয়ে, বাস্তব ও কল্পনা নিয়ে। তিনি হয়ে ওঠেন একজন সফল ঐন্দ্রজালিক যিনি প্রথমে এক অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে ফেলেন তাঁর পাঠকদের, তারপর সেই মায়াজাল ছিঁড়ে বার করে আনেন তাদের। এটাই তাঁর প্রবণতা— তিনি অশরীরী ঈশ্বরের চোখ দিয়ে দেখেন সবকিছু, প্রকাশ করেন তাঁর সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা, কিন্তু এক মায়াবী প্রক্রিয়ায়।
এবারে প্রশ্ন জাগে তাঁর এই প্রহেলিকাময় প্রবণতার উদ্দেশ্য কি? তার উত্তর, একাধিক প্রশ্নের আকারে, সর্বজ্ঞ প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি নিজেই দিয়েছেন এই প্রবন্ধে—

“প্রকৃতির মায়াদর্পণে মুখ দেখেছে মানুষ। দেখেছে সেই মুখে অভিব্যক্তি এবং অভিনয় একাকার। কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সে জানতে চেয়েছে তার স্রষ্টা কে, তার জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী, বিশ্বসৃষ্টির মূল সত্যটিই বা কী? কোনও উত্তর পায়নি। তার মনে ক্ষোভ জেগেছে, কেন সবকিছু এত হেঁয়ালিময় এবং চিরদুর্জ্ঞেয়? ঈশ্বর যদি আছেন তবে তিনি সহজে প্রকাশ্য নন কেন, সত্য যদি আছে তবে তা সহজে প্রাণে বোধ্য নয় কেন? কিসের এত তত্ত্ব, পুঁথি, পাণ্ডিত্য, ব্যাখ্যা, বিতর্ক, ভাবসমাধি, ধর্মযুদ্ধ? হয়তো এই বিদ্রূপাত্মক প্রহেলিকাই মানুষের অভিমানকে মিথ্যাশ্রয়ী হতে ইন্ধন জুগিয়েছে?”

এই সমস্ত প্রশ্নের কোন উত্তর তিনি দেন নি, তিনি শুধু দেখেছেন সবকিছু, ঈশ্বরের মতোই, এক সর্বদর্শী সত্তা হিসাবে, আর প্ররোচনা জুগিয়েছেন প্রশ্ন করতে। অথবা নিজে প্রশ্ন করেছেন, হ্যামলেটের মতো— এক ‘আধুনিক ব্যক্তিমানুষের সংশয়ী, অবিশ্বাসী এবং বেদনার্ত চোখে’ বুঝতে চেয়েছেন ‘অনির্দেশ্য’ যাবতীয় সবকিছু, কোন উত্তর ব্যতিরেকে এখানেই তিনি ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন একজন প্রাবন্ধিকের যাবতীয় শপথ, এবং হয়ে উঠেছেন কবি

“কামিনীফুলের গন্ধে সত্য আছে, ছলনাও আছে...
...রাত্রি যত বাড়ে, তত কামিনীফুলের
উগ্র গন্ধে লুপ্ত হয় পৃথিবীর সমস্ত শপথ।”



ঋণ স্বীকার:


১) ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’, খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ
২) ‘হ্যামলেটের উন্মাদনা: কবিতার মুক্তি’, খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ
৩) ‘ঈশ্বরের চোখ’, ঈশ্বরের চোখ
৪) ‘কামিনীফুলের গন্ধে’, ঈশ্বরের চোখ