সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিশ শতকের শেষার্ধে জীবনানন্দ পরবর্তী প্রথিতযশা
বাংলা সাহিত্যিকদের অন্যতম সাহিত্যিক তথা কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৩৪ সালের ৭
সেপ্টেম্বর বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ
ভারত অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের
ফরিদপুরের মাদারিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কবি, ঔপন্যাসিক,
ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এই
সাহিত্যিক ছিলেন আধুনিক ও রোমান্টিক। ২০১২ সালে প্রয়াণের পূর্ববর্তী চারটি দশক
বিশ্ব বাংলাভাষী জনগণের কাছে এই সাহিত্যিক
একাধিপত্য করে গেছেন বললে ভুল বলা হবে না। জন্মের চার বছর পরে তিনি কলকাতায় চলে
আসেন। কলকাতাতেই তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। তাঁর ছদ্মনাম ছিলো নীললোহিত,
সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায় ইত্যাদি। একসময়
এবং এখনো কবিতাপ্রেমীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় তাঁর কবিতার পংক্তি।
সুনীলের পিতা ছিলেন বিদ্যালয় শিক্ষক। শিক্ষকদের
নিম্ন হারের বেতনের জন্য সুনীলের মা তাঁর ছেলে এই পেশায় ভবিষ্যতে যুক্ত হোক, তা
চাইতেন না। সুনীল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাশ করে অপিসে
চাকরি শুরু করেন। তারপর তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন
কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় হয়। সেই সূত্রে মার্কিন মুলুকে গেছিলেন
সুনীল ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে।
ডিগ্রি অর্জন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল।
বাবার হাত ধরেই সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন সুনীল।
তাঁর বাবা টেনিসনের একটি কবিতার বই তাঁর হাতে দিয়ে সেটি থেকে প্রতিদিন দুটি করে
কবিতা বাংলায় অনুবাদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুনীল বেশ কিছুদিন নিষ্ঠার সঙ্গে সে
কাজ করেন। এরপর নিজে কবিতা লেখা শুরু করেন। এসব কবিতার মধ্যে ছোটবেলার প্রেমিকাকে
নিয়ে লেখা একটি কবিতা দেশে পাঠালে তা প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা তাঁকে এই
কাজ দিয়েছিলেন যাতে সুনীল বন্ধুদের সঙ্গে
আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করেন। ফলটা কিন্তু সুনীলের জন্য শুভদায়ক হয়েছিল। বাংলার
কাব্যপ্রেমী সমাজে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জনপ্রিয়তার নিরিখে নিঃসন্দেহে এখনও অব্দি
ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৫৩ সাল থেকে ‘কৃত্তিবাস’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। তাঁর সম্পাদনায় ‘কৃত্তিবাস’
বাংলা সাহিত্য পত্রিকার জগতে দীর্ঘদিন
একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'একা এবং কয়েকজন', ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ' প্রকাশিত
হয়। স্মরণীয় সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উন্নত মানের অজস্র
লেখা মেলে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল 'আমি কী রকম ভাবে
বেঁচে আছি', 'যুগলবন্দী'(শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), 'হঠাৎ নীরার জন্য', 'রাত্রির রঁদেভূ', 'শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা',
'অর্ধেক জীবন', 'অরণ্যের দিনরাত্রি', 'অর্জুন', 'প্রথম আলো', 'সেই
সময়', 'পূর্ব পশ্চিম', 'ভানু ও রাণু',
'মনের মানুষ' ইত্যাদি। উল্লেখনীয় তিনি ‘কাকাবাবু-সন্তু’
নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের
কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’
উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া গোয়েন্দা সিরিজের কাকাবাবু চরিত্রের দুটি
কাহিনী ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’, ‘মিশর রহস্য’
চিত্রায়িত হয়েছে।
নীললোহিত ছদ্মনামে লিখে তিনি নিজের একটা আলাদা সত্তা
সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন। নীললোহিতের সব কাহিনীতেই
নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনীটি
বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনীতেই
নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তার
বয়েস বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনীতে দেখা যায় নীললোহিত
চির বেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশিদিন টেঁকে না।
তার বাড়িতে মা, দাদা, বৌদি রয়েছেন।
নীললোহিতের বহু কাহিনীতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়, যেখানে
বহু শিক্ষিত সফল কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ মানুষ একাকী জীবন যাপন করেন।
সুনীল যদিও চার বছর বয়সেই চলে আসেন কলকাতায়, কিন্তু
তাঁর জন্মভূমির প্রতি টান থেকে গিয়েছিল। আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে যে
শব্দটি বেশ জনপ্রিয়, তা এপার বাংলার মানুষেরা প্রথম পান সুনীলের ‘সেই সময়’ উপন্যাস
থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসটির এলাকা বিরাট, তার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভূগোল অনেক
ব্যাপ্ত, অনেক জটিল সমস্যা সেখানে ভিড় করে আছে। তার মধ্যে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা বড় স্থান পেয়েছে। সুনীল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
‘পূর্ব-পশ্চিম লেখার সময় আমার মাথায় ছিল দেশভাগ এবং দুদিকের
বাঙালিরা। তারা যে ভাগ হয়ে গেছে এটা। এটা একটা পূর্ব-পশ্চিম, আরেকটা পূর্ব-পশ্চিম হচ্ছে ১৯৬০ থেকে ৭০-এর দশকে শুরু হলো। এ দেশের যারা
ভালো ভালো ছেলেমেয়ে তারা সব পশ্চিমে চলে যেতে লাগল বাবা-মাকে ফেলে। সেখানেও একটা
পূর্ব-পশ্চিম ভাগ হয়ে যায়। এটাই ছিল থিম।’ (সাক্ষাৎকার,
বিনোদন বিচিত্রা, জুন ১৯৯৮ সংখ্যা।)
বাংলা উপন্যাসের একালীন পাঠকমাত্রই জানেন, সুনীলের
কথাসাহিত্য রচনা পরম্পরায় ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত আশির দশক থেকে ‘সেই সময়’,
‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’ এই তিনটি উপন্যাসে, এ
ব্যাপার সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘সেই সময়’ দুই খণ্ডে তিনি উনিশ শতকের সেই
অধ্যায় তুলে ধরেন যা নবযুগ নামে
খ্যাত। এ উপন্যাসে, লেখকের কথায় ‘মূল
নায়কের নাম সময়।’ ‘পূর্ব-পশ্চিম’ দুই খণ্ডে বিন্যস্ত ১৩৭৮ পৃষ্ঠার উপন্যাস, যার কালসীমানা ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭, উপন্যাসের
চলিষ্ণুতায় তা ১৯৩৭-এ গেছে, ৫২ ও ৭৫-এর মধ্যবর্তিতা যুক্ত হয়েছে। প্রথম খণ্ডে স্বদেশ বৃত্তান্ত (পূর্ব
ও পশ্চিমবঙ্গ) দ্বিতীয় খণ্ডে ইউরোপ ভূখণ্ড প্রধান হয়ে
ওঠে। আর জড়িয়ে থাকে নকশাল পর্ব ও মুক্তিযুদ্ধ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত 'সেই সময়’
উপন্যাসটির মূল
বিষয়বস্তু উনিশ শতকের নবজাগরণ।
এই উপন্যাসের দুটি ঐতিহাসিক চরিত্র
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘দেশ’ পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত
হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে এই উপন্যাস
বঙ্কিম পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়। এছাড়া সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের আর একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পুরস্কার হচ্ছে আনন্দ পুরস্কার (১৯৭২)। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভারতের সাহিত্য
প্রতিষ্ঠান 'সাহিত্য আকাদেমি' এবং 'পশ্চিমবঙ্গ শিশু কিশোর আকাদেমি'র
সভাপতি ছিলেন।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি
পরলোক গমন করেন। তিনি মরণোত্তর দেহদান করে গেলেও তাঁর একমাত্র পুত্রের ইচ্ছেয় এবং
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় তাঁর মরদেহের সৎকার করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন