সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৫৫)


এই সব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কতবার। জন্মান্তরের সব ঘাট-আঘাটা। যাতায়াতের গতিপ্রকৃতি থেকে তো কিছু একটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। বেঁচে থাকবার চৌহদ্দী থাকে যার ভিতরে আকাশমাটির বাতাস-তাতাসের এক জীবন। শীত ঘন হতে থাকে। কাঁপন লাগে হাড়ে হাড়ে। আসারিকান্দির দিকে বগরিবাড়ির দিকে পিলখানার দিকে লাওখাওয়ার বিল পেরিয়ে হাওয়ার শব্দ ও শীত বিছিয়ে পড়লে বসন্ত মালির চেতনায় ঘা পড়লে সে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে থাকলে গদাধরের উপর  পাখিদের ছায়া পড়ে। বসন্ত মালি টলমল পায়ে তার জন্মান্তরের ঢোল, ঢোলের কাঠির কাছেই আশ্রয় নেয়। যাপনের টুকরো টাকরা দিয়ে কি আর গোটা এক জীবনযাপনকে স্থিরতর করে দেওয়া যায়! বসন্ত খুঁজতে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রের ছোট ছোট চর, হ্যাজাকবাতির আলোয় ভরভরন্ত সব গানবাড়ি, নাচুনির দলবল। চরাঞ্চল বনাঞ্চল বাইচের নাও জাফর ব্যাপারির ধনদৌলত পান্তাভাত আর শুটকীসিদোলের আখ্যানগুলি দিয়ে বসন্ত মালি কেমন দূরাগত হয়ে উঠতে থাকে আর নিজেকে এগিয়ে দেয় মস্ত এক উপকথার স্মৃতিবিস্মৃতির ভিতর! শীতরাত ভোরের দিকে গড়ায়। পাছা রাত্তিরের মোরগ ডেকে উঠলে বসন্তের তো আর কিছু করার থাকে না। দূরদেশ থেকে যুবতী কইন্যার গান উড়ে আসে-

   ‘গনেশ হাতির মাহুত রে
   মোক নিয়া যান বাপভাইয়ের দ্যাশে’




(৫৬)


‘খুটার বন্দুক ফোটে না’

সে কি আসলে ভয় দেখাতে চাইছে! আতঙ্কিত হবার সুযোগ সেভাবে না থাকলেও পূর্ববর্তী দিনকালগুলিকে উদাহরণযোগ্য মনে হতেও পারে। হরিচরণ আর বুড়াবাবুর দ্বন্দ্বসংঘাতকে উচ্চমার্গীয় স্তরে নিয়ে গেলেও আসলে কোথাও কোন গুলির শব্দ নেই। তবে বন্দুক আছে।বন্দুকবন্দনার জন্য ফাঁকা মাঠের জুলুস আছে। বুড়াবাবুর কেশর ফোলানো ঘোড়া কখন যেন ছুটে আসে পাটখেতের অন্তরাল থেকে। ‘বন্দুক হাতে রায়সাহেব’ - মহার্ঘ ছবি হয়ে ঘুড়ে বেড়ায় জোতজমির সুজলা সুফলার প্রাকৃতিক প্রাত্যহিকতায়। রহস্যের মায়ামাখা সেই বন্দুক প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠতে উঠতে বর্ষা-শীত-হেমন্তের দিনগুলিকে আত্মগত করতে থাকলে বিলখালের মাছেরা  পাশ ফেরে নুতন খাতে প্রবাহিত জলধারায় আকুলিবিকুলির জেগে থাকবার দৃশ্যময় বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনবার প্রয়াসটুকুন নিয়ে পুরাকালীন কোন যুদ্ধক্ষেত্র যেন জীবন্তভাবেই জীবিত হয়ে ওঠে! হরিচরণের হাতে হাতে হেন্তালের লাঠি। উলটে যাওয়া কচ্ছপকে সোজা করতে করতেই তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে। বুড়াবাবুর টাড়ির দিকে বিকেলের শেয়ালেরা।

বন্দুকের জং ধরা ট্রিগারে ক্ষয়াটে আঙ্গুল রাখলেও হরিচরণকে মোটেও বয়োবৃদ্ধ মনে হয় না। বন্দুকের রহস্য ভেঙ্গে দিতে চাইলেও কোথাও বুঝি কপট এক আড়াল।  রক্তপাত হাহাকার পলায়নের তাড়সে কাঁপতে থাকলেও বন্দুক কিন্তু ফোটে না।  ফাটে না। গুলির শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনি মিথ্যে মনে হয়। বন্দুকের গল্পটিও হরিচরণ তার উত্তরকালের হাতে বাধ্যতই সঁপে দেন!




(৫৭)


‘কি গান শোনালু বাপই রে’

হাহাকার ভরা পাথারবাড়ি থেকে ধুতুরার ফুল নিয়ে ফিরছে আলিজান মিঞা। নয়ারহাট জোড়শিমুলি কেশরীবাড়ি টপকে টপকে কন্ঠে গান গান নিয়ে সর্বাঙ্গে নাচ নিয়ে জলঢাকার চরে শেষতক তাকে প্রবেশ করতে হবে আর খন্ড অণুখন্ড দিয়ে  আলিজান মিঞা নিজের মতন সাজিয়ে নিতে থাকবেন বৃত্তান্তের পর বৃত্তান্তই!

















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন