ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(তৃতীয় অধ্যায়)
(৫)
দৃশ্যমানতা...
মীর আলিকা আজ সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। উঠেই
তড়িঘড়ি সে ছুট দিয়েছে দুর্গ অলিন্দের দিকে। তারপর গবাক্ষে দুই চোখ রেখে
তীক্ষ্ণ নজর ফেলে বুঝতে চেষ্টা করেছে হুমায়ুন
বাদশা আজ কদ্দুর এগিয়ে এলেন। দুর্গের বাইরেটা যদিও হিমহিম কুয়াশাচ্ছন্ন, দেবদারু ওক ইত্যাদি বৃক্ষরাজির
ওপরে মিহিন বরফের আস্তরণ, তবুও দিনের আলো যেহেতু
ফুটেছে, চারিদিকের প্রকৃতির দৃশ্যমানতা একটু খেয়াল করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
মির্জা কামরান তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
ভিসিবিলিটির মানে জানিস? দৃশ্যমানতা? এটা সবায়েরই থাকে। একজন সাধারণ নফর চাকর থেকে
শুরু করে হিন্দুস্থানের বাদশা পর্যন্ত!
ভিসিবিলিটি হল এমন এক কৌশলগত
বিষয় যা এক বান্দাকে, বান্দার প্রোডাক্টের সাথে জুড়ে দেয়।
মীর আলিকা কিছুই বোঝেনি। বোঝবার
কথাও নয়। এই দুর্গের সে একজন সাধারণ ভৃত্য মাত্র। খুবই মজবুত এই দুর্গের খাড়া
পাথরের দেওয়ালে মাত্র কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অলিন্দ রয়েছে। প্রত্যেক অলিন্দে
সশস্ত্র প্রহরী দন্ডায়মান। এই সব প্রহরীরা এক মুহূর্তের জন্য কাজে ফাঁকি দেয় না।
দুর্গের আশেপাশে যে সমস্ত গাছগাছালি আছে সেখানেও কোনও পাখি তাদের বাসা বাঁধে না। উপত্যকার চতুর্দিক জুড়ে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘাচ্ছন্ন
পাহাড়। কাছে পিঠে দুই একটি ঝর্ণা রয়েছে যদিও, কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময়ে সেগুলি
ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে থাকে। জায়গাটির নাম সাইহোয়ান। ভক্কর থেকে বেশ খানিকটা দূর।
সাইহোয়ানের এই দুর্গটার এত খাতিরদারির কারণ মাত্র একটাই, এটার মত শক্ত দুর্গ আর
একটিও নেই। মীর আলিকা এ জন্য বেশ গর্ব বোধ করে মনে মনে।
মির্জা কামরানের হুকুমে বহু বছর
ধরে দুর্গটার পাহারাদারী করে আসছে সে এবং এই দুর্গ পাহারাদারীর কাজটি ছাড়া বাকি পৃথিবীর
কোনও খবরই সে রাখে না। পরশু মাঝরাতে কাসেদ মারফৎ খবর এসেছে হুমায়ুন বাদশা
নাকি মুলতান থেকে ভক্করে এসেছেন এবং যে কোনও দিন যে কোনও মুহূর্তে তিনি সাইহোয়ানের এই মজবুত দুর্গটার দখল নিতে আসতে
পারেন। কামরান তাকে বুঝিয়েছিল, ভিসিবিলিটি বা দৃশ্যমানতা তৈরী হওয়ার পেছনে কাজ করে
একটা যে কোনও দল।
মীর আলিকা উত্তর দিয়েছিল, আমি
জান প্রাণ দিয়ে হুজুরের আদেশে এতদিন সাইহোয়ানের এই দুর্গ রক্ষা করে এসেছি এবং
ভবিষ্যতেও তাই করব। যে কাজ আমাকে দেওয়া হয়েছে হুজুরে আলম্, তাতে কোনও গাফিলতি
থাকবে না।
হুম্! সে তো বুঝলাম, কিন্তু যে
ভিসিবিলিটির উল্লেখ আমি করছি, সেটার অংশ তুইও।
আমি? আমি তো নেহাতই একজন সাধারণ বান্দা হুজুর!
তুই ধর... এই যে সুদূর মূলতান
থেকে বাদশা এখানে দৌড়ে আসছেন সেটা কী
জন্য?
কী জন্য?
আরে বাদশা তো হিন্দুস্থানের
তখত্ থেকে কবেই উৎখাত হয়ে গেছেন। আফগানী শেরশাহ বাদশাহকে আগ্রা পর্যন্ত ধাওয়া করে
হিন্দুকুশ পর্ব্বতমালার এইপারে ছুঁড়ে দিয়েছেন। হুমায়ুন আজ এখানে কাল ওখানে, আজ
কাবুলে তো কাল মূলতানে কাঁহা কাঁহা ঘুরে মরছেন! বাদশার বাদশাহী এখন ফক্কা! আমরা
বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা কেউই চাইনি হুমায়ুন বাদশা হোক। এজন্য কাবুলে ওনাকে আমি থিতু হতে
দিইনি। বুঝলি, হুমায়ুনের এদিকে বাদশা হবার খুব শখ। এবার দেখ খেলটা কেমন জমে উঠেছে।
মীর আলিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে
থাকে।
মির্জা কামরান তার দিকে চেয়ে
বলতে থাকে, তোকে ঐ ইমেজটা আনতে হবে। হুমায়ুন বাদশার বাদশাহীকে চিরতরে খতম করবার যে
ইমেজ আমরা বাকি ভাইরা তৈরী করে নিতে চাইছি, সে খেলায় তুইও একজন অংশীদার। শোন্! এই
দুর্গটা যদি হুমায়ুন একবার কব্জা করে নিতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই। হুমায়ুনের
অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। খানিকটা ভালো মানুষ গোবাচারা টাইপের। মা ভাই বোন
অন্যান্য সবার প্রতি একটু বেশী সহানুভূতিশীল। অল্পেই কেঁদে ভাসায়। আবার অন্যদিকে
বাদশা হবার চূড়ান্ত শখ। কিন্তু নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে যুদ্ধ করবার কৌশল জানে না...’ একটানা বলে যাচ্ছে মির্জা... একটা জিনিষ সব সময়
খেয়াল রাখিস, এ দুর্গটায় বেশ কটা ভাল কামান রাখা আছে। একবার যদি হুমায়ুন ওগুলো
কব্জা করতে পারে তো আমাদের ভিসিবিলিটি ওখানেই শেষ। হুমায়ুন বাদশার ভিসিবিলিটির শুরু।
সুতরাং সাবধান ! বুঝতে পারলি?
এরপর
মীর আলিকা আর কোনও কথা বাড়ায়নি। সে বুঝেছে। মির্জা কামরানও একেবারে চুপ করে গেছিল।
দুর্গের অভ্যন্তরে রাখা পরপর চোদ্দটা লৌহ কামান সেই সম্রাট বাবরের আমলের। কামানগুলো যেমন ভারী তেমনই ভালো।
৯৩৭ হিজরী, জমদিয়াল আউওয়ালের পাঁচ তারিখ, সোমবার ছিল দিনটা। ইন্তেকাল হয়ে গেল বাবরের। পিতা হুজুরের মৃত্যুতে মির্জা কি কাঁদেনি, না কি পিতা হুজুর হুমায়ুনের তুলনায় মির্জাকে কম ভালবাসতেন! এত
জটিল তত্ব কামরান ঠিক বুঝতে পারে না। মনে আছে কামরানের খুব ছোটবেলায় সে পিতা
হুজুরের কোলে চড়ে ঘোড়ায় উঠেছিল। কাবুলের চারবাগে তারা সব ভাই বোনেরা
রং বেরং ফুলে ভরা বাগিচায় ছুটেছুটে খেলা করত। কত সুন্দর ছিল সেই সব দিন। পিতা
হুজুরের কাছেই প্রথম শুনেছিল হিন্দুস্থান নামের একটা দেশ, খুব দূরে সেই দেশ, যেখানে নাকি একসঙ্গে অনেকগুলো নদী জড়ামড়ি করে পরপর
প্রবাহিত। তখনই ঠিক করে রেখেছিল মির্জা একটু বড় হয়েই পিতা হুজুরের সঙ্গে সেও
হিন্দুস্থান জয় করতে যাবে। এও নাকি শোনা গেছে সেই দেশটা নাকি দারুণ শস্য শ্যামলা। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হল কই?
মৃত্যুকালে বাবুর হুমায়ুনকেই তামাম রাজত্বের
বাদশা বানিয়ে দিয়ে গেলেন। অথচ বাদশা হবার সমস্ত গুণাবলী মির্জা কামরানের মধ্যেও
বিদ্যমান। একজন উঠতি নওজোয়ানের মতই তার শরীর বাহ্-খুদাহ্ তন্দুরস্ত! শামসের তারকাশ
খঞ্জর ইত্যাদি অস্ত্র চালনায় সে ভয়ংকর রকমের পারদর্শী। উপরন্তু মির্জা হিন্দাল,
বারবুল মির্জা, ফারুক মির্জা অন্যান্য ভাইএরাও মনে মনে চায় তামাম হিন্দুস্থানের
বাদশা মির্জা কামরানই হবেন। হুমায়ুন নিতান্তই অযোগ্য। তার ওপর হামিদা বানুকে শাদী করার পর থেকে বাদশা একেবারেই কেমন যেন বদলে
গিয়েছেন। হরবক্ত কীসব আকাশ পাতাল ভাবছেন, ভেবেই
চলেছেন। শাদী করেও মনে শান্তি নেই। হুমায়ুন বাদশার দিমাগ এক্কেবারে চড়ে গিয়েছে।
চড়বে নাই বা কেন? রাজত্ব নেই, সৈন্য
সামন্ত নেই, খাদ্য সামগ্রী নেই। কয়েকটা
পোষাক আর খান কতক ঘোড়া নিয়ে আজ ন’মাস ধরে এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাও আবার
একলা না, নতুন বেগমও রয়েছেন সঙ্গে। সুখের একেবারে চোদ্দ পোয়া! শাদীর তিন দিন পরই
মূলতান ত্যাগ করে ভক্করে চলে গেলেন। মাস খানেক কাটল সেখানে। এবার তিনি সদলবলে
আসছেন সাইহোয়ান। সাইহোয়ানের এই দুর্গটাকে যদি বাদশা তাঁর শীতকালীন আবাসস্থল
বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলেন ইতিমধ্যে...
আর
ভাবতে পারল না মির্জা কামরান। দিমাগ আগুন হয়ে উঠল। সম্মুখে দন্ডায়মান মীর আলিকাকে
তীব্র কন্ঠে হুকুম দিয়ে উঠল, না
লায়েক হুমায়ুন বাদশা যেন কোনও মতেই দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে।
মীর
আলিকা যুদ্ধ বিশারদ নয়। শাহী সৈন্য সামন্ত কস্মিন কালেও সে চোখে দেখেনি। খুব
ছোটবেলায় বাদশা বাবুরকে একবার চাক্ষুস করবার সৌভাগ্য তার হয়েছিল। সাইহোয়ানের এই
দুর্গটার ঠিক পেছনেই সুর নদী।
বরফ কুচি মিশ্রিত টলটলে নীল জল বয়ে যায় সারা বছর ধরে। সেই জলের মধ্যেই এদিক ওদিক
কয়েকটা নুড়ি পাথর জেগে। সেই দিকেই আপন মনে চেয়ে নীরব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাদশা
বাবুর। ধারে কাছে তাঁর কোনও নফর চাকর কোনও শাহী ফৌজ কিচ্ছু ছিল না। দিগন্তে হিমেল
বাতাসের মধ্যে কয়েকটা আকাশ ছোঁয়া ধূসর বর্ণের পাহাড়। নীচে দেবদারু সারি। ডান পাশে
বহমান সুর। তার জলে ছায়া ফেলে চলে যাচ্ছে কয়েক খন্ড মেঘ। একলা এক বাদশা, যাঁর
জরদৌজী জোব্বাটার কিনারা বাতাসে একটু একটু কাঁপছে। মীর আলিকার এ যাবৎ জীবনে দেখা
শ্রেষ্ঠ দৃশ্যমানতা।
এই রকম ভিসিবিলিটি কী রকম, কোন পরিপ্রেক্ষিতে তৈরী হয়, তার জানা নেই। মির্জা কামরানের ধমকানিতে সে
বুঝতে পারে আসলে দৃশ্যমানতা বলে কিছু হয় না। বাস্তব থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে
বাস্তবকে মুছে দিলে যা পড়ে থাকে তা পরিমাপহীন। স্মৃতি। এই স্মৃতি আর স্মৃতিচিহ্ণ
সত্ত্বাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়। বাদশা বাবুর সেবারে সাইহোয়ান থেকে ফিরে গেলে
আলিকা এই সুর নদী আর নদী কিনারে নির্জন এই দুর্গটা ছেড়ে ভবিষ্যতে আর কোথ্থাও চলে
যাবার পরিকল্পনা করেনি। এখন তার মনে হচ্ছে, একজন যে কোনও মানুষের দৃশ্যমানতার
তৈরীর পেছনে প্রবলভাবে সক্রিয় থাকে অন্যান্য আরও মানুষের সক্রিয় উপস্থিতি।
জী হুজুর ! আমি জান প্রাণ দিয়ে
দুর্গ রক্ষা করব।
শুধু দুর্গ রক্ষা করলেই তো হবে
না! তোকে জান বাজী রেখে এ কাজটা করতে হবে।
জী!
দুর্গ পরিখার ওপারে কেউ একজন এ
সময় এসে দাঁড়লো। কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্য ভাল করে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। জনা দশ
বারো ভৃত্য আলিকার সঙ্গে এ দুর্গে থাকে। তাদের কাজ আলিকার হুকুম মত নির্দেশ পালন
করা। তাদেরই একজন দৌড়ে গেল এবং মিনিট সাতেকের মধ্যেই ফিরে এসে আলিকাকে জানালো, পরিখার ঐ পারে যে বান্দাটি এসে উপস্থিত, স্বয়ং
বাদশা হুমায়ুন তাকে পাঠিয়েছেন। দূত মারফৎ বলা
হয়েছে অতি
সত্বর যেন দুর্গের প্রধান ফটক উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। হুমায়ুন বাদশা আর কিছুক্ষণের
মধ্যেই এসে উপস্থিত হচ্ছেন। সুতরাং দুর্গরক্ষক মীর আলিকা যেন অক্ষরে অক্ষরে এই
নির্দেশ পালন করে।
মীর মনে মনে বলল, আমার আর কী? আমি তো শুধু দুর্গ রক্ষা করব। সেটাই আমার কাজ। যে দৃশ্যমানতা একান্তই আমার, শুধু মাপমত আমি মরতে দম তক্ কাজটুকু
করে যাব। দূতকে পাঠিয়ে বাদশা নিজের ইমেজ তৈরী করতে পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কি
বাদশার ইমেজ যা তৈরী হবার ইতিমধ্যে তা হয়ে গিয়েছে। যেটা মির্জা কামরান শত চেষ্টা
করেও এখনও তৈরী করতে পারেনি। মির্জা বুঝে গেছে রাজত্ব খোয়ালেও হুমায়ুন বাদশা,
হুমায়ুন বাদশাই! তখত্ শুধু তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছে।
আলিকা শামসের উঁচিয়ে দুর্গের
প্রধান ফটকের দিকে ছূটে গেল।
- খুদাহ্ কসম! কীসি কো ঘুঁসনে নেহী দেঙ্গে!
তার ছুটে যাওয়া দেখে বাকিরা
সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দুজন ভৃত্য দৌড়ে গিয়ে বিশাল সাতমনী শেকল ধরে
ঝুলে পড়ে। - লা –ইল্লালাহ্! বে – খিমদ্! ঝুলে থাক ঐখানে তোরা! কিছুতেই শেকল ছাড়বি
না!’
বলা মাত্রই আরও তিনজন প্রহরী
প্রথম দুই জনের ঘাড়ের ওপরে চামড়ার জুতো শুদ্ধ পা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং চক্ষের পলক
না পড়তেই তাদেরও ঝুলতে দেখা গেল সাতমনী সেই শেকলের প্রান্তে। প্রধান ফটককে
সুরক্ষিত করে রাখে এই প্রকান্ড শেকল। ঝালর ঘেরা শেরওয়ানী দুলিয়ে এক থাপ্পড় মারল
আলিকা পঞ্চম প্রহরীকে। এই প্রহরী দৌড়ে আসতে কিঞ্চিৎ দেরী করে ফেলেছে।
-বত্-তমিজ্! জান জাদা প্যারা
হ্যায় কেয়া? জলদি কর!
চারপাশ থেকে ঝপাঝপ জ্বলে উঠল
বেশ কয়েকটা বড় বড় মশাল। একটা মশাল নিয়ে মীর আলিকা ছুটে গেল বড় চবুতরার দিকে।
চবুতরাটা পার হলেই বড় খিলান ঘেরা বারান্দা। সেখানেই রাখা দুর্মূল্য সেই কামানগুলি।
এগুলোর গায়ে অনেকানেক শব্দ, মহা শব্দ, অতি জাগতিক ভীষণ সব শব্দ একটা নির্দিষ্ট শূন্যতায় বদ্ধ হয়ে আছে। দুর্গ রক্ষার দায়িত্বভার অর্পণ করে মির্জা কামরান এখন কাবুলে অবস্থান করছেন। সুদূর কাবু্ল থেকে
সাইহোয়ানের এই দুর্গ কম করেও ছ’ মাসের পথ। নানান পাহাড়ী উপত্যকা, গিরি কন্দর,
লাদাখের মত শীতল মরুভূমি ইত্যাদি বিস্তর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই দুই স্থানের মধ্যে।
অনন্ত এক দৃশ্যমানতার ক্রমাগত জন্মমৃত্যু বুনে বুনে ইতিহাসে ব্যক্তি মানুষের যে
ইমেজ তৈরী হয় তার সাথে মীর আলিকার দুর্গ পাহাড়া দেবার সম্পর্ক কী? বুঝতে হবে এ কাজের জন্য বিশেষ ভাবে শুধু
তাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।
বুম্-ম্-ম্!
-জী বন্দেগী হুজৌর! পরিখার একটা সেতু এই মাত্র বাদশার
সেনারা তোপ মেরে উড়িয়ে দিয়েছে! – হাঁফাতে হাঁফাতে এক বান্দা এসে খবর জানাল মীর
আলিকাকে। সর্ব্বনাশ! কী হবে এবার? শত্রুপক্ষের লোক দুর্গ দখল করে নিল বলে! যুদ্ধ
অথবা চাতুর্য্য যে ভাবেই হোক সাইহোয়ানে হুমায়ুন বাদশার প্রবেশ আটকাতেই হবে! একজন
কোনও কালে তখতে না বসা বাদশার থেকে তখত্ হারানো বাদশার সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক বেশী
গর্বের বিষয় মীর আলিকার কাছে। যুদ্ধের এই কৌশল মীরকে মীরের প্রোডাক্টের সাথে
অবিচ্ছিন্নভাবে জুড়ে দেবে। ফলে সৃষ্টি হবে বিশেষ এক ভিসিবিলিটি। অনুশাশনহীন এক
যুদ্ধের ছবি সারাজীবনের মত জুড়ে যাবে মীরের ভৃত্য জীবনে।
এখানেও আরও একটা দৃশ্যমানতা
রয়েছে।
দেশ আর দেশপ্রেম কি এক জিনিষ
হল?
আমার দেশ আর দেশপ্রেম কি আলাদা?
দেশ মানে তো কিছু অল্প সংখক
মানুষ, যার অধিকাংশই নিম্নবর্গীয়। কিছু জেলে চামার মুটে তল্পিবাহক এবং রাজা অথবা
জমিদারের বন্দুকধারী সৈন্য সামন্ত। তাদের দেশ আর আমার
দেশ তো একই। শাসকশ্রেণী ভগবানের সমগোত্রীয়। অন্যদিকে দেশপ্রেম বস্তুটা হল একটা
সংঘাতমূলক প্রতিক্রিয়া। মাহমুদ খানের দেশপ্রেম তাই মুকুন্দের দেশপ্রেম থেকে
একেবারেই পৃথক।
বিকেলের আবছা রোদে মাঠের পাকা
ধানের সোনালি ছ্বটার দিকে একটানা চেয়ে থাকলে চোখ ঝলসে যায়। দিগন্তে যতদূর চোখ যায়
রাঢ়-এর উঁচুনিচু সমভূমি। তাল খেজুর গাছ, অদূরে অজয় বয়ে যাচ্ছে কুলুকুলু শব্দে। মাঠে উড়ে বেড়াচ্ছে এক
ঝাঁক মেঠো চড়াই। চমকে উঠল মুকুন্দ। কেউ তার কানের কাছে তীক্ষ্ন শব্দে চেঁচিয়ে উঠল
– তফাৎ যাও!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন