কলকাতার ইতিকথা
তিলোওমা কলকাতা নগরী, তাকে নিয়ে বাঙালীর উন্মাদনার শেষ নেই৷ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে গিয়ে বাঙালী পরিচয় দিলেই লোকের চোখ গোলগোল হয়ে যায়৷ কলকাতা নিয়ে আমাদের ভালোবাসার শেষ নেই ৷ মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গল কিংবা ঘটি বাঙালের বিবাদ এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে চলেই আসছে৷ ইলিশ, গলদার বিবাদ যেমন থাকবে; থাকবে ভিক্টোরিয়া, ময়দানের প্রতি আসক্তি৷
পুরনো কলকাতার ইতিহাস আমাকে আকৃষ্ট করেছে বারবার৷ কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে (চব্বিশ পরগণা জেলায় এবং কলকাতা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব দিকে একদা ভাগীরথী নদীর অন্যতম প্রবাহ বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান) প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, এই অঞ্চলটি বিগত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়। সে যুগে টালির নালা (মারহাট্টা ডিচ) বা আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়ো বড়ো জাহাজগুলি এখন যেখানে গার্ডেনরিচ, সেই অঞ্চলে নোঙর ফেলত। কেবল মাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলিই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করত। সরস্বতী নদী ছিল এই সময়কার আরও একটি জলপথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে৷
কলকাতা নামকরণ কেন কলকাতা হয়েছে, মানে কলকাতা নামকরণের পিছনে কারণ কী, তা আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানি না৷ তবে সুষ্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি কলকাতার নামকরণের ইতিহাস। কলকাতা হল সব জাতির প্রাণকেন্দ্র, তা অতীত কিংবা বর্তমান উভয় সময়েই৷ সেই কারণেই অতীতেও বারবার কলকাতায় আক্রমণ হয়েছে বৈদেশিক শক্রর। ভৌগলিক পরিস্থিতির অবস্থান কলকাতাকে কল্লোলিনী শিরোপা দিয়েছে৷
‘কলিকাতা’ বা ‘কলকাতা’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে নানা মতান্তর রয়েছে।
সতেরশ শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷
অপর একটি মত হল, ‘কালীক্ষেত্র’ (হিন্দুদেবী কালীর ক্ষেত্র) নামটি থেকে ‘কলিকাতা’ বা ‘কলকাতা’ নামটির উৎপত্তি। মতান্তরে, বাংলা ‘কিলকিলা’ (অর্থাৎ ‘চ্যাপ্টা এলাকা’) কথাটি থেকে ‘কলিকাতা’ নামটির উৎপত্তি হয়। অন্য এক মতে বাংলা খাল ও কাটা শব্দ দু’টির বিকৃতির ফলে কলকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে।
অপর মতে, এই অঞ্চলটি কলিচুন ও কাতা (নারকেল ছোবড়ার আঁশ) উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। সেই থেকেই কলিকাতা নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়৷ ২০০১ সালে নামের বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে ইংরেজিতেও শহরের নাম কলকাতা (ইংরেজি: Kolkata) রাখা হয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে বলা হত হোয়াইট টাউন এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে বলা হত ব্ল্যাক টাউন।
১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে।
এরপর শুরু হয় কলকাতায় বাঙালি কালচার। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্যবাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর।
কলকাতার নগরায়ন শুরু হওয়ার পরও ‘পালকি’ সম্ভ্রান্ত ও অর্থবান বাঙ্গালিদের ও সাহেবদের কাছে ছিল খুব আদরের। তখনকার দিনের পালকি মর্যাদার চিহ্ন বহন করত৷ পালকির উল্লেখ আমরা অনেক বইয়ের মধ্যে পাই৷
এ ছিল আদি ‘নগর কলকাতা’র বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান চিহ্ন। সওয়ারি হত দুজন, বইতো ৬জন বেহারা, মালপত্র বওয়ার জন্য কুলি আর রাতের পথে একজন মশালচি। সাহেবরা কলকাতা নগরীর পত্তন করলো মানে দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে চললো, এমন নয় মোটেই। পত্তনের পর আরো একশ বছর কলকাতার চেহারাটা প্রায় একই রকম ছিল। যাতায়াতের জন্য কয়েকটা সরু কাঁচা রাস্তায় গোরুর গাড়ি আর পালকি ভরসা। প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাঁধানো রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৮/৯৯ নাগাদ৷ ফলে তখন থেকেই ছুটতে লাগল দ্রুত গতির ঘোড়ায় টানা গাড়ি । ঘোড়া মানেই গতি, দ্রুত গতির প্রতীক।
কলকাতার সবচেয়ে ‘নস্টালজিক হেরিটেজ’ হল ঘোড়াটানা গাড়ি। ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউন বেরি’ নামে ঘোড়াগাড়ি। সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললো এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭এ । ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘন্টায় চোদ্দ আনা, পরের প্রতি ঘন্টায় আট আনা আর সারা দিনের জন্য নিলে চার টাকা। নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল সে সময়। সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি, সাধারণ কর্মচারিদের জন্য আলাদা গাড়ি। নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি। চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম। অনেক বড় বড় কোম্পানী হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করার জন্য সে সময়। এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মত হয়ে গেছে। এককালে কলকাতার ‘বাবু’রা ফিটনে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতেন। আর সেই ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এই সেদিনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সারি দেওয়া ফিটন গাড়ি দেখা যেত ময়দানে শখের হাওয়া-ভ্রমণের জন্য।
এরপর ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হল। মার্চ ১৮৭০ থেকে তোড়জোড় শুরু করে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বউবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার স্ট্রান্ড রোড হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত পাতা হল ট্রাম লাইন আর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি চলা শুরু করলো । দুটো বলিষ্ঠ ঘোড়া দিয়ে চালানো হত ট্রাম। এরপর অনেক রাস্তায় ট্রাম লাইন পাতা হল, কলকাতা ট্রামওয়েস কোম্পানী গড়ে উঠল। ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠলো কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা। ১৮৯০-৯১ সনে কলকাতায় ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার সংখ্যা ছিল একহাজারl সবই শীতপ্রধান দেশ থেকে নিয়ে আসা বেশ বলবান ঘোড়া। প্রায় ত্রিশ বছর চালু ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবস্থা। ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হল ১৯০২এ পৌছে। ২৭শে মার্চ ১৯০২এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করলো ধর্মতলা–খিদিরপুর পথে।
পথ ক্রমশ বাড়তে লাগল ... কলকাতা ধীরে ধীরে ব্যস্ত হল। তিলোত্তমা কলকাতা ঘিরে মানুষ গতিশীল হয়ে উঠল। বনেদী গন্ধ, সাবেকী মানসিকতা কোথায় যেন ফিকে হয়ে গেল৷ তবু কলকাতা আজও ভালোবাসার শহর হয়েই থাকল৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন