বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

শিবাংশু দে



কুশারিবাগান ৫




নিভৃত  নীলপদ্ম লাগি


তিনি সতত নির্জনতা খুঁজতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র, ভোগসুখ বিষয়প্রবৃত্তির শীর্ষে থাকা মোকাম কলকাতার এক নম্বর পরিবারের ঐতিহ্যধারক, খুঁজে যেতেন ঈশ্বর নামের এক প্রহেলিকাকে। নির্জনতা তাঁর কাছে ঈশ্বরের আরেক নাম। রামমোহন তাঁকে ডাকতেন বেরাদর, পুত্র রমাপ্রসাদের বন্ধু ছিলেন তিনি। তিনি  কেশব সেন ছিলেন না, তাঁর ঈশ্বরচর্চা ছিলো অন্তর্মুখী। ঊনবিংশ শতকের বাঙালির হাজার ভালোমন্দ, শাদাকালোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনিও ছিলেন পরিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বভাবতই স্ববিরোধের একটি স্তম্ভ। বাড়িতে দুর্গোৎসব হতো, তিনি পৌত্তলিকতার বিরোধী বলে প্রতিবাদে পাহাড়ে চলে যেতেন। অনেকদিন লেগেছিলো তাঁর এই মূর্তিপূজা নিবারণ করতে। একদিকে সংসারে নির্লিপ্ত, অন্যদিকে অতি সংলিপ্ত। ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর জুড়ি সেকালের বঙ্গীয় নক্ষত্রসমাজে আর কেউ ছিলো না। কিন্তু যেমন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বলেছিলেন, "বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা", তিনি ছিলেন তাই। পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্মৃতিকথায় খুব সরলভাবে লিখেছিলেন, " মার শ্বশুরমশায় তো কলকাতায় থাকতেন না। তিনি হিমালয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াতেন।" কেন বেড়াতেন? কী প্রয়োজন ছিলো তাঁর, কোন আকুলতা? লোকজন রামায়ণের সংসারী ঋষি বিশ্বামিত্রের প্রতি প্রযুক্ত আখ্যাটি ধার করে তাঁকে বলতো 'মহর্ষি'। রাজা জনকের অনুকরণে 'রাজর্ষি' বলতো না। এটাও একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। তাঁর সংসারী সত্ত্বাটিকে অনেক বেশি ছেয়ে থাকতো তাঁর অতিসংসারী সত্ত্বা, সেটাই কি কারণ?

ভুবনডাঙ্গার মাঠে দেবেন্দ্রনাথের ছাতিমগাছ আবিষ্কার, বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ইতিহাসে একটা অন্যযুগের বীজবপন বলা যায়। তিনি কীভাবে, কখন এই গাছটিকে ধ্যানের আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তা নিয়ে পন্ডিতজনের নানা মত রয়েছে। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা প্রমথনাথ বিশী, সবাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। তবে প্রশান্তকুমার পাল মশায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত। দেবেন্দ্রনাথ গুসকরায় এক নির্জন প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে ধ্যান করতেন। সেখান থেকে একদিন তাঁর সুহৃদ রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহমশায়ের আমন্ত্রণে পাল্কিতে দিগন্তবিস্তৃত ভুবনডাঙ্গার মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর বাড়ি। পথে তাঁর চোখে পড়ে ঐ ছাতিমগাছটি। তিনি পাল্কি থামিয়ে কিছুক্ষণ ঐ গাছের ছায়ায় বসে ঈশ্বরচিন্তা করলেন। তাঁর মনে হলো এই স্থানটিই নির্জনে ঈশ্বরকে স্মরণ করার উপযুক্ত ঠিকানা। ফিরে গিয়ে ১৮৬৩ সালের পয়লা মার্চ সেখানকার জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহের থেকে বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসি পট্টা নিলেন ভুবনডাঙ্গা গ্রামে বাঁধপারের বিশ বিঘে জমি। উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে ব্রাহ্ম উপাসনা ও চর্চার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা।

এই প্রান্তরে ১৮৬৩ সালেই মহর্ষির নির্মিত প্রথম অট্টালিকাটির নাম ছিলো শান্তিনিকেতন গৃহ। তার নামেই সমগ্র ভূখন্ডটির নাম হলো 'শান্তিনিকেতন'। ১৮৯০ সালে উপাসনা গৃহ নির্মিত হবার আগে পর্যন্ত এখানেই ব্রহ্ম-উপাসনা হতো। ১৯০১ সালে কবি যখন পাঁচ জন ছাত্রকে নিয়ে ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তখন তিনি সস্ত্রীক এই ভবনটিতেই থাকতেন। গীতাঞ্জলির অধিকাংশ কবিতা এখানেই রচিত। পাশেই ছাতিমতলায় ধ্যানের বেদী। তাঁর প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। শান্তিনিকেতন গৃহ একটি দোতলা সুরম্য ভবন। আইওনিক স্তম্ভ, ত্রিকোণ কর্নিশ আর সবুজ খড়খড়ি দেওয়া দীর্ঘ  জানালারা। বাড়িটির পিছন দিকের বিস্তারটি ক্রমশ কমে গেছে। কপালে লেখা "সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং"। এখানে এখন একটি জাদুঘর। শৈশব থেকে কবি এসে এখানেই থাকতেন। বাড়িটির ঠিক সামনেই প্রতিষ্ঠিত রামকিঙ্করের বিমূর্ত ভাস্কর্য 'অনির্বাণ শিখা'। একটু এগিয়েই ডানদিকে সেই বিখ্যাত বিপুল বটবৃক্ষটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার নীচে কোনকালে একটি ছোটো জলাশয় ছিলো।  আর ছিলো পাথর জমিয়ে তৈরি করা বালক রবীন্দ্রনাথের তিনটি ঢিবি, যেজন্য তার নাম তিন পাহাড়। রাস্তার ওপারেব উপাসনাগৃহ বা ব্রাহ্মমন্দির, যার ডাকনাম কাচঘর।

অনেক সুখে অনেক দুখে তোমার বাণী নিলেম বুকে
ফাগুনশেষে যাবার বেলা আমার বাণী যাবো বলে
আমি যাবো না গো অমনি চলে ...

আমার বাবা প্রথম শান্তিনিকেতনে যেতেন গত শতকে চল্লিশ দশকের শেষদিক থেকে। তখন তিনি কলকাতায় কলেজছাত্র। ততোদিনে সূর্য ডুবে গিয়েছে, কিন্তু গোধূলির কিছু লালিমা তখনও আকাশে বেঁচে ছিলো, যথেষ্ট উজ্জ্বল। শান্তিনিকেতনের পথেঘাটে খালিপায়ে, কখনও চটি পরে, টোকা বা ছাতা মাথায় বহু ডাকসাইটে মানুষেরা ঘোরাফেরা করতেন। দর্শনধারী কিস্যু ঠাহর হবে না, কিন্তু নামটাম শুনলেই চমকে যেতে হতো। বাবা বলতেন ওখানে রিকশাচালকদেরও একটা অন্যস্তরের জানাবোঝার জগৎ ছিলো। বাইরের লোকজন তো চিরকালই সেখানে আসেন নিয়মিতভাবে। শান্তিনিকেতনে তাঁদের জন্য পান্ডার ডিউটি করতেন ঐ রিকশাচালকেরা। আসলে শান্তিনিকেতনে পর্যটকের লিস্টিটি প্রথম তৈরি হয়েছিলো রিকশাচালকদের দৌলতেই।

নতুনবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলুম ছায়ায়। এক রিকশাসওয়ার দম্পতিকে চালক প্রশ্ন করছেন, বলুন তো রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর আসল নাম কী? তাঁরা এদিকওদিক ভেবে বললেন, মৃণালিনী না? এই তো, জানেন না তো, উনার নাম ছিলো ভবতারিণী। তাই...? হমম, তিনি হলেন যশোরের মেয়ে। এই বাড়িটায় থাকতেন, হুই যে ওদিকের ঘরটা, উনার রান্নাঘর (এই কথাটা যদিও সত্যি নয়, কারণ ঐ বাড়িতে তাঁর থাকার সুযোগ হয়নি)। পর্যটকেরা চমৎকৃত হয়ে শুনতে থাকেন। খানিক পরে সেই রিকশাচালককেই দেখি কলাভবনের সামনে দেওয়ালের অলংকরণ দেখিয়ে সেই দম্পতিকেই বলছেন, ঐ যে দেওয়ালের আঁকা, ওটা মানিদা'র করা। মানি'দা কে? সে কী, নাম শোনেননি? খুব বড়ো আটিস। তাঁরা মাথা নাড়েন। কে জি সুব্রামনিয়ান বেশ ভারি নাম, রিকশাচালকের সব সময় মনে থাকে না হয়তো।

কলকাতায় ছিলো 'বাবু' কালচার, শান্তিনিকেতনে শুরু থেকেই 'দাদা' কালচার। সম্ভবতঃ কবি নিজে, অবনীন্দ্রনাথ আর দু'য়েকজন 'কড়া' শিক্ষক (যেমন জগদানন্দ প্রমুখ) ছাড়া সবাই 'দাদা'গিরির অংশ ছিলেন।

শান্তিনিকেতনের গৌরব ছিলো না ইঁটকাঠ, ধুলোমাটি, কুবেরযক্ষের মেহরবানি। সেখানে ছিলো শুধু একদল মানুষ, যারা দায়িত্ব নিয়েছিলো সারা বিশ্বে বাংলাভাষায় বেঁচে থাকা মানুষদের জীবনে একটা নতুন ধরনের সেরিব্রাল মাত্রা যোগ করার। এই মাত্রাটির দৌলতেই বাংলাভাষীরা দীর্ঘদিন ধরে বোধবুদ্ধির জগতে অন্যান্য দেশবাসিদের থেকে নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার অহংকার করে  এসেছে। প্রাথমিকভাবে উৎসটি ছিলো দ্বারকানাথের দুই পুত্রের দেহকোষে ওয়াটসন-ক্রিক সাহেবের নক্শায় আঁকা কিছু প্রোটিনের কারিকুরি। কালক্রমে সেই সব সংক্রামক প্রোটিনশৃঙ্খলের জাদু ছড়িয়ে পড়েছিলো যতসব মরা গাছের ডালে ডালে, আকাশে হাততোলা আগুনের মতো। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে, কোনও জাতির সমগ্র সাংস্কৃতিক চেতনায়, একটি মাত্র পরিবার থেকে স্ফূরিত এই জাতীয় বন্ধহীন প্রভাবী দিগদর্শনের নমুনা আর দেখা যায় না । সেই পরিবারটির বাইরে আরো যে সমস্ত মহৎ মননশীল অস্তিত্ত্বগুলি সেই ধারাটিকে শুধু ধরে রেখেছিলো তাই নয়, তাকে ক্রমাগত পরিবর্ধন, পরিমার্জনও করেছিলো, তাঁদের সিংহভাগ একসময় এই ছোট্টো ভূখন্ডটিতেই নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরাই ছিলেন শান্তিনিকেতনের আসল সম্পদ, বুনো রামনাথের ব্রাহ্মণীর হাতে লালসুতোর মতো গর্বিত অলঙ্কার। সেই আর্ষরীতির অনুগামী হয়তো এখন অনেক কমে এসেছে, তবু রয়ে গেছেন বেশ কিছু মনস্বী মানুষজন।

এমন একজন মানুষ, ড. অশোক কুমার দাস। বর্ষীয়ান শিল্প ইতিহাসবিদ, আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত জাদুঘর বিশারদ, মুঘল ও অন্য ভারতীয় লঘুচিত্র বিশেষজ্ঞ এবং কলাসমালোচক। অনেক পালকই আছে তাঁর মুকুটে। দীর্ঘদিন জয়পুর প্রাসাদ জাদুঘরের অধিকর্তা ছিলেন। তার পর বিদ্যাচর্চার সূত্রে সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেন নিয়মিত। সারস্বত সাধনা জীবনচর্যার অংশ। প্রেসিডেন্সি থেকে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, ভারতীয় জাদুঘর থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ম, মেট্রোপলিটান থেকে খুদাবক্শ, সর্বত্র তাঁর ঘর বাঁধা আছে। বিশ্বভারতীর সত্যজিৎ রায় অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তার পর থেকে গত  বাইশ বছর এখানেই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা।
বাগানপাড়াতেই তাঁর সুরম্য বাড়িটিতে বসে নানা আড্ডা। ইতিহাস থেকে হয়তো শুরু, তারপর সেখান থেকে উদ্যানচর্চা, ভোজনবিলাস বা সাহিত্যসহকার, কিছুই অস্পৃশ্য থাকে না। তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী শ্যামলী দাসের গবেষণা ও বিশেষ চর্চা রয়েছে ঐতিহ্যজাত ভারতীয় বয়নশিল্প ও তার বিবর্তনধারার ক্ষেত্রে।
শান্তিনিকেতন এখনও 'শান্তিনিকেতন' হয়ে রয়েছে এই স্তরের আশ্রমিকদের বোধিব্রত ও জীবনচর্চার সুবাদে।
স্মৃতির সিন্দুক এভাবেই ক্রমে ভরে ওঠে।
এ পথে আমি যে গেছি বারবার...

ছোটবেলা থেকে বাবার থেকে জায়গাটার নানা গল্প শুনতুম। আমাদের তাপদগ্ধ, সবুজবন-পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে আকাশছোঁয়া চিমনি থেকে বৈকুণ্ঠের দিকে  উড়ে যাওয়া শাদা-কালো ধোঁয়ার মেঘ। পরিপাটি কালো রাস্তার  সীমারেখা পেরোলেই ঘাসজমিতে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দু’চার জন শাল্মলী  দেবতা। তাদের শিরপল্লবে আটকে যাওয়া আমাদের ছেঁড়া ঘুড়িগুলি। তোপমার কি চৌরঙ্গি, চাঁদমারিও হতে পারে। মহান্তিস্যারের কাছে শেখা পাটিগণিত আর পাত্রস্যারের কাছে ইংরিজি। ঐকিক নিয়ম কিংবা মেনসুরেশনের অঙ্ক ভুল হলেই হাত পেতে কঞ্চির সপাং। আমাদের লেখাপড়া এরকমই। ক্লাস নাইন স্পেশালে ওঠার পর ইংরিজি বই ফ্রি ইণ্ডিয়া রিডার। মাখনরঙের মলাটে হার্কিউলিসের গ্রিক দেওয়ালচিত্রের আদলে লাইন ড্রইং আঁকা। প্রথম লেখাটিই শান্তিনিকেতনের আমবাগানে বসে পাঠশালার গল্প। অবাঙালি বন্ধুরা সবাই ভাবতো শান্তিনিকেতন মানেই মাঠেঘাটে খাতাবই নিয়ে বসে পড়া। শিক্ষক আসেননি এক পিরিয়ড। সবাই পিছনের ঘাসমাঠে গাছতলায় বসে , "আজ হমলোগোঁ কে শান্তিনিকেতন হ্যাঁয়।" ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয় স্থাপনের পর সত্তর বছরের বেশি হয়ে গেছে ততদিনে। কবি যে বলেছিলেন উচ্চশিক্ষা মানে মাথার ভিতর শুধু তথ্য বোঝাই করা নয়। প্রকৃতির ভিতর নিজের আসল জায়গাটা চিনে নেওয়াটাই উচ্চশিক্ষা। ক'জন বুঝেছিল সেসময় তাঁর বক্তব্যটা জানা নেই। আচার্য যদুনাথ সরকারকে যখন কবি অনুরোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করার জন্য, যদুনাথ শিক্ষা বিষয়ে কবির ধারণাটিকে এক কথায় নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। তার কতদিন পরে আমাদের সময়েও দেখতুম 'রুচিশীল, সম্পন্ন' মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মায়েরা মেয়েদের শান্তিনিকেতন পড়তে পাঠাতেন। 'পড়তে' কি না বলা মুশকিল। আমার ধারণায় সাহেবদের অনুকরণে 'গ্রুমিং' করতে পাঠাতেন মেয়েদের। গান শিখবে, আঁকা শিখবে, সাজতে শিখবে, সূক্ষ্মভাবে কথা বলতে শিখবে। অর্থাৎ একজন ভাবী বড়োসাহেবের পত্নী হয়ে ওঠার গুণগুলি অর্জন করবে। সুইজারল্যান্ডের বদলে শান্তিনিকেতন। কিন্তু ছেলেরা কখনও যাবে না। তারা 'ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র' হবে। ওসব শান্তিনিকেতনি হ্যাংওভার তাদের জন্য নয়।

অন্য জায়গার কথা হয়তো বলতে পারবো না। তবে আমাদের শহরে সেরকমই হতো। সেখানে বাংলা ভাষাসাহিত্যের অধ্যাপকদের পুত্রকন্যা  'বাংলা' মাধ্যমে পড়তো না। সত্যি কথা বলতে কি কখনও বানান করে আনন্দবাজার পড়তে পারাই মস্তো সাফল্য ছিল তাদের। কিন্তু বাংলাভাষার 'দুরবস্থা' নিয়ে মিটিং মিছিলে তাঁরা সবার আগে বক্তব্য রাখতেন। এরকম একটি সভায় আমি যখন এই রূঢ় সত্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলুম, সভায় কর্ণবিদারী নীরবতা নেমে এসেছিল। সন্তানের 'দুধেভাতে' থাকার ব্যবস্থা না করে দিতে পারলে কীসের মাতৃভাষা? এমতাবস্থায় ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের তপোবন বা আদি পাঠভবন কেউই ধোপে টেকেনি। কিন্তু প্রথম যখন দেখেছিলুম আমগাছের ছায়ায় বেতের কি ঘাসের চাটাই পেতে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, বেদনার মতো কিছু বেজেছিল কোথাও। 'ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়রে'র জীবন বড়ো কাছে থেকে, স্পর্শ করে চিনেছি আমরা। শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছোয় তা, তাও জানি। কিন্তু ঐ আমবনের ছায়ায় বসে রোদে হাওয়ায় নেওয়া পাঠ পরে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, তা জানতে পারিনি। হয়তো এটা জানার জন্যই আবার জন্মাতে হবে।

যখনই যাই ঐ চত্বরের গাছের ছায়ায় গোল ঘেরা ছেলেদের বেঞ্চি, রাখালরাজের সিংহাসনের মতো শিক্ষকের বেদি, ঝরা আমপাতার নরম রঙিন কালিন দেখলে তেলতেলে, ঘামেভেজা, খালিপা, দুই হাঁটুতে ক্ষতচিহ্ন আমাদের শৈশব নীরবে ভিতরে কড়া নাড়ে। হারায়নি তা হারায়নি...

(ক্রমশ)

২টি মন্তব্য: