ঘূর্ণিপাক
অস্তিত্ব জুড়ে মাতন তুলেছে ঘূর্ণিপাক
ঘুরছে জগৎ ঘুরছো তুমি ঘুরছি আমি।
আমরা কি বদলে যাবো?
বলো বদলে যাওয়া কি এতোই সহজ?
বিশ্বাস তো হয় না
বিশ্বাস তো হয় না!
তোমার সবুজ প্রাণের প্রতিটি বিন্দুকণা
সবুজ ক্লোরোফিল, আমার মৃত কোষে
ঝড়ের দুন্দুভি বাজিয়ে মত্ত বোশেখীর
কাল বোশেখীর অদ্ভুত নাচন জাগাতো
ভুলে যেতাম আছে দুঃখ আছে সুখ
মৃত্যুর মৃদুল হাতের অনিবার্য ছোঁয়া।
পুরনো আস্তানা ছেড়ে অন্য বসতির
অন্য এক নতুন পথ হাতছানি দিতো।
সব কিছু মিথ্যাচার মনে তো হয় না,
তবু ঘূর্ণির ঘূর্ণন ওঠে অস্তিত্ব জুড়ে।
সুখের মিহিন আঁচল আমার ঘরদোরে
কোনোদিনই আলতো আহ্লাদে উড়েনি
সে তুমিও জেনেছিলে বলিনি যদিও
দুঃখের আদিগন্ত পশরা আমার
তুমি নিতে চেয়েছিলে ঝেড়ে পুছে
কী করে উজাড় করে দিই বলো?
সুখ নেই দুঃখ নেই থাকে শুধু শূন্য
অনুভূতির দ্রোহহীন দাহহীন অন্তহীন
বিবর্ণ আকাশের বিস্তীর্ণ প্রসার
আমাকে এমন নিঃস্ব করে দেবে তুমি?
তুমি সব বিষ কণ্ঠে নিয়ে নীলকণ্ঠ পাখি
তাও কি হতে পারে, হয় কোনোদিন?
জানি তুমি মুক্ত ছন্দ আন্দোলিত ঝড়
পুরনোকে ভেঙ্গেচুরে গড়ে নিতে চাও
নতুন আরেক পৃথিবী, নষ্টদের নত করে
আরেক আকাশে মেলে দেবে সৃষ্টির
উদ্দাম ডানা, সবল উড়ালে মেঘেদের
ঘরবাড়ি পেরিয়ে সন্ধ্যা এলে যাবে
নক্ষত্রের আলোর নিশানায়
সারারাত আলোর ভাষায় কথা বলে
পুবের ভোরালি রোদ গায়ে মেখে
মুঠোভরা রোদ নিয়ে আমার জানালায়
হাসির ফোয়ারা ঝরিয়ে কুশল শুধোবে।
আজ এই দ্রোহকালে, আজ এই প্রমত্ত
ঝড়ের আদিগন্ত আক্রোশের ঘূর্ণির
উদ্ভ্রান্ত সময়ে, আলোর পাখি তুমি
গান থামিয়ো না, মন্দ্র ভৈরবের তান
প্রবল বন্যার মত ছড়িয়ে দাও মাটিতে
আকাশে বাতাসে ঊর্ধ্বে মহাকাশে।
আমি মৃত্তিকার কন্যা আলো আলো
চোখ মেলে সব ভুলে তোমাকে দেখে
সুখ দুঃখ যাপিত জীবনের গ্লানি ভুলে
সব ভুলে বিস্ময়ের হাসি হেসে যাবো।
কালান্তরের কন্যারা
সে তো বহুকাল আগে
বিরহী শাপগ্রস্ত যক্ষ প্রিয়তমাকে
মেঘদূতের হাতে পাঠায় প্রেমপত্র,
পৌঁছেনি পত্র তবু চিরন্তন হয়ে
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহী অন্তরে
মাতন তুলেই যায়।
যক্ষ আর যক্ষপ্রিয়া শাশ্বতের ঘরে
চিরায়ত বিরহী যুগল স্থানু হয়ে আছে।
সুনীলবাবু তোমার নীরার কথা বলছি -- বহুদিন বাঙালি যুবক নীরাকে দিয়েছে প্রেমাঞ্জলি আর বাংলার যুবতীরা মনে মনে নিজেকে নীরা ভেবে চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়েছে লাজুক।
আজ তুমি অতীতের প্রান্তরে অতিকায় ক্যানভাসে
বর্ণিল প্রস্তরখন্ডে খোদাই করা আকাশ ছোঁয়া প্রতিমূর্তি!
বিস্ময়ে মাথা উঁচু করে দেখে সেই সময়ের তোমাকে
আজকের নিরীখে বহুমাত্রিক অতিমানব মনে হয়।
তোমার যৌবনবতী গহীনা নীরা বহু পথ হেঁটে
আজো কোনো রহস্য ছুঁয়ে রোমাঞ্চে উষ্ণতা ছড়ায়
উঁচু পর্বত শিখরবাসিনী চর্যাপদের শবর বালিকা
চুলে গুঁজে ময়ূরপাখ গুঞ্জামালা গলায় নিরবধি
কালের প্রাঙ্গণে যেমন করে রহস্যে ঘোরপাঁক খায়। নাটোরের বনলতা সেন এখনো বেতের ফলের মত
শান্ত চোখে চেয়ে কাকে যেন বলে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
ফুল্লরার বারমাস্যা বেহুলার ভেলা লহনা খুল্লনা
গীতিকার মহুয়া মলুয়া আরো সব যুবতী কন্যা
আজো যেন সুখ দুঃখ হাসি কান্না প্রেম নিয়ে
বাংলার চিরন্তনী নারীরা সব আম কাঁঠাল শেওড়ার ছায়ায়
ছায়া ছায়া মায়াবী বৃত্তে লঘু ছন্দে ধ্রুপদী ঝংকারে হেলেদোলে হেসেখেলে প্রেমে অপ্রেমে ভাসে শুধু।
সেই সব মধুরা কন্যারা এপারে ওপারে সেপারে
কোনো পারে আজ আর নেই, পাবে না খোঁজে কোনোদিন।
বেদরদী এই কালে সেসব কন্যাদের মত যাপনের রীতি নীতি নেই,
দ্রৌপদীর বস্ত্র আর কোনো সংবেদী সখা বাড়ানোরও নেই —
দুঃশাসনেদের সংখ্যা গেছে বেড়ে পথে ঘাটে ঘরে। আজকের কন্যারা রক্তাভ আকাশতলে প্রতিবাদী মিছিলে হাটে,
স্লোগানে স্লোগানে আত্মার বিদ্রোহ ঘোষণা করে,
রক্ত তাদের আলপনা আঁকে প্রকাশ্যে রাজপথে।
ইঁট পাথর ভাঙ্গে, কলে কারখানায় স্বল্প মূল্যে খিদমত খাটে,
তবু সন্তানের অনন্ত ক্ষুধা, যাপনের নিষ্ঠুর গ্লানি
সারাদিন সারারাত সারাটি সময় দংশন করে শুধু।
গ্রামে গঞ্জে আরো সব পুঁতিগন্ধময় নিরক্ত জীবন কান্না ভুলে জেনে গেছে এমনি হয়, এর নাম বেঁচে থাকা।
ভিন্ন চিত্রে বহুতলের খাঁচায় বন্দি সোনার ময়নারা
অদৃশ্য শেকলের জ্বালায় জ্বলে ছটফট করে,
স্ট্যাটাস বাঁচাতে স্বদেশী দেহে বিদেশী পোশাক
হাই স্পিডে ড্রাইভ ঝাঁ চকচকে শপিং মল স্যুইমিং পোল
সুরা হাতে শাকী অন্তঃসারশূন্য আমদানির ভিন্নতর
জীবনালেখ্য!
আল্ট্রা কনট্রাস্টের বিকট পাঞ্চিং একুশের প্রগতি!
স্বপ্নের কন্যারা হারিয়ে যায় প্রেম কাঁদে নীরবে নিভৃতে।
দেখছি শুনছি ভাবছি —
ক্রোধ আমার চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলতে চায় — হেই, হচ্ছেটা কী? থামাও এসব,
উপর নিচের সব জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো।
সমান তালে একসাথে মেলাও পা, বাঁচার জন্য জোরসে চলো!
অবেলা কালবেলা
আমার দেহকে ঘিরেছে লকলকে নীলাভ
আগুনের শিখা খোলা ময়দানে
ধীরে ধীরে আমি পঙ্গু হয়ে যাই
পায়ের নীলচে শিরাগুলো জট পাকিয়ে
পলায়নের শক্তি অপহৃত হয়
মেরুদণ্ড বেঁকেচুরে কিম্ভুতকিমাকার
আমার সমগ্র অস্তিত্ব বিশ্বাসঘাতক
এই আগুনে খেলায় কালবোশেখী ঝড়
মাতাল উদ্দাম হয়ে ওঠে
বহুকালের পৈত্রিক বসত ভিটে নড়বড়ে দাপুটে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে
ভিটেমাটি থরথর কেঁপে ওঠে
মৃত্যুর করাল উপস্থিতি
বহুদূরে পালিয়ে খলখল হাসে
উঠোন ফাটলে একটি দোলনচাঁপার ঝাড় এলোমেলো কাঁপে
সাদা সাদা ফুলগুলো দুমড়ে মুচড়ে
বিকট গন্ধে হা হা অট্টহাসি হাসে
পেছনে গড়িয়ে পালাতে চাই
অতীতের পিতা মাতা দু’বাহু মেলে
বড় ক্ষিধে এক দলা
পচাগলা ভাত নাহয় দে
অত্যন্ত স্নেহের সন্তান তুই এতো স্বার্থপর
সামনে তাকিয়ে স্তম্ভিত
হাড় জিরজিরে আমার সন্তানেরা
এলুমিনিয়ামের ভাঙ্গা থালা চাটছে কেবলই
কষ্ বেয়ে রক্তধারা মেঘনার স্রোতে মেশে
আকাশ পিঙ্গলবর্ণ তার মাঝে
বিকলাঙ্গ আমার স্বপ্ন সব হাহাকার করে
এই অবেলায় কালবেলায় বারুদগন্ধী
আণবিক বোমাটাই ভীষণ আক্রোশে ফাটুক!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন