ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(প্রথম অধ্যায়)
(৩)
হুমায়ুন বাদশা বিমূঢ়
চিন্তান্বিত অবস্থায় বসে আছেন । বিগত দুই রাত্রি তাঁর ঘুম হয়নি । এক টুকরো মসলিন
দিয়ে তিনি বারবার চোখ মুখ মুছে নিচ্ছেন । গাঢ় মেহাদী রঙের শশ্রু গুম্ফ সমন্বিত
মস্তকে তিনি ভেবে চলেছেন প্রায় কুড়ি বৎসরের কাছাকাছি হতে চলল এখনো যেন পুরপুরি
নির্ধারিত হয়নি ভারতবর্ষ দেশটা ঠিক কাদের ! হিন্দুরা মনে করে দেশটি পুরোপুরি তাদের
। কারণ তাদের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে আর্য রক্ত । মুসলমানরা তাদের কাছে বহিরাগত । তাদের ধর্মে
আরবী গন্ধ । মুসলমানরা যদি বহিরাগত হয় তবে আর্যরাও তো তাই । ভারতবর্ষে কেউ কিছু
সময় আগে এসেছে, কেউ বা কিছুদিন পরে । মাটির আকর্ষণ কি সময় দিয়ে নির্দিষ্ট করা যায় ?
হুমায়ুন বাদশার সভায় প্রায় সকলেই বৃদ্ধ । এক মাত্র বৈরাম খাঁ অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক । যেন
অতীতের সব কিছুই মরতে দম তক একই রকম ভাবে বজায় থাকবে, এই রকম মুখ নিয়ে ঐ বৃদ্ধরা
সভায় বসে থাকেন । সম্রাটও আজ অবধি কখনও কারুর সামনে একটিমাত্র অহংকারের বাক্য
উচ্চারণ করেন নি । প্রজারা আসে । এসে তাঁকে নিজেদের নানা রকম অভাব অভিযোগ শোনায় ।
তিনি মাথা নাড়েন । ফারসীতে হুকুম দেন । তারপর তারা দীর্ঘ সেলাম জানিয়ে সভা থেকে
প্রস্থান করে । কখনো কখনও সম্রাট খুলে বসে তার আব্বাজানের জীবন চরিত । জহিরুদ্দিন
মহম্মদ বাবুর সুদূর ফরগনা থেকে এ দেশে ছুটে এসেছিলেন কিসের টানে তা স্বয়ং খোদাই
জানেন । কত ঝড় ঝঞ্ঝা বিপদ তাঁকে যে এজন্য সইতে হয়েছে – ভাবতে গিয়ে হুমায়ুন বিভোর
হয়ে যান । কিন্তু আজ তিনি অন্য চিন্তায় মগ্ন
। খবর এসেছে রোটাসগড় দুর্গে যে সমস্ত মোগল আমীর ওমরাহরা ছিল, দুর্বৃত্ত শের শাহ তাদের বধ
করে দুর্গ দখল করেছে । একজন তাতার দেশীয়
সুন্দরী নর্ত্তকী সম্রাটের সামনে নৃত্য পরিবেশন করছিল । ইশারা করতেই সে কুর্নিশ
করে মল ঝমঝমিয়ে দরবার থেকে সরে গেল ।
আবেগের সঙ্গে সম্রাট বললেন,
হিন্দুস্থানে সন্ত্রাসবাদীদের স্বার্থ কিছুতেই কায়েম হওয়া চলবে না । আমি আজই
মসজিদে গিয়ে দোয়া করব ।
একজন ওমরাহ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
কিন্তু শুধু দোয়া করলেই তো হবে না হুজুর, সেই সঙ্গে নিজেরও কিছু মদত দিতে হবে ।
মোগল সৈন্য এখন কোথায় অবস্থান
করছে ?
আজ্ঞে দশ লক্ষ সৈন্য লোহার বর্ম
আচ্ছাদন পূর্ব্বক এখন চৌসা নামক স্থানে অবস্থান করছে জাঁহাপনা ! জলপথে বাদশাহী
নৌ-সেনাও সেখানে পৌঁছল বলে –
বেশ ! সন্ত্রাসবাদীরা আর যেন
এগোতে না পারে । আমাদের কামানগুলি নদীর ধার বরাবর সজ্জিত রাখা আছে তো ?
তা আছে জাঁহাপনা ! কিন্তু
উগ্রপন্থীরা কখন কোথা থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে কোনও ঠিক নেই । এই একটু আগে খবর
এসেছে উগ্রবাদীরা আমাদের প্রায় শ’খানেক মোগল সৈন্যকে হত্যা করে তাদের মুন্ডগুলি
আলাদা কেটে পথের দুপাশে যত বড় বড় বৃক্ষ আছে সেখানে ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে । শকুন আর
হাড়গিলেতে জায়গাটা ভর্তি ।
ওমরাহর এহেন বাক্য শ্রবণে বাদশা
অন্তরে প্রবল ব্যথা অনুভব করলেন । যুদ্ধের সংবাদ অপেক্ষা যুদ্ধভীতি অধিকতর ভয়ংকর ।
তিনি বাঁ হাঁটুর ভাঁজ বদল করে বললেন, আমি আজই যুদ্ধক্ষেত্রে যাব । এক্ষুনি !
সন্ত্রাসকে কিছুতেই মাথা চাড়া দেওয়া চলবে না !
- হিন্দুস্থানমে কুছ্ শাগির্দ কুছ্ দোস্ত, কুছ আজীজ মিলে থে / উসসে খতম্
নহী হোনী চাহিয়ে !
বাদশা সৈন্য সাজাতে হুকুম দিলেন
।
মোগল সৈন্য গঙ্গার তীর ধরে
দক্ষিণ দিকে কুচ আরম্ভ করল । ডাঙায় পদাতিক ও অশ্বারোহী । জলে বাদশাহী নওয়ারা । সে
আমলের সর্ব প্রধান যুদ্ধ জাহাজ ‘ঘুরাব’ এবং দ্রুতগামী ‘বলিয়া’ নৌকা । তীরস্থ মুঘল
সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে তীর মেরে শত্রুকে দুর্বল করতে শুরু করল । কিন্তু চতুর শের
শাহ পূর্বের রণনীতি বদলে নিয়েছিলেন । উন্মুক্ত গঙ্গাবক্ষ থেকে শের শাহর সৈন্যরা
মোগল সৈন্যদের উদ্দেশ্যে তোপ বর্ষণ করতে লাগল । মুঘল তীরন্দাজরা এই ভীষণ আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে নৌকো ছেড়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে
কোনক্রমে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করল । একখানা মহলগিরি নৌকো থেকে সম্রাট নিজে যুদ্ধ
পরিচালনা করছিলেন । কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । প্রায় বিশ হাজার মোগল সৈন্য
গঙ্গাবক্ষে নিমজ্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় একখানি তোপ থেকে সম্রাটের নৌকোয় গোলা
বর্ষিত হল । দুইজন প্রভুভক্ত অনুচর শুদ্ধ সম্রাট জলে ঝাঁপ দিলেন । শুষ্কভূমির দেশে
আজন্ম লালিত রাজকুমার গঙ্গার মত নদীতে সন্তরণে অক্ষম । জুলাই মাসের গঙ্গা । নদীতে
প্রবল স্রোত । মুহূর্তের মধ্যে অনুচর দুজন কোথায় ভেসে গেল । সম্রাট কিছুক্ষণ হাত পা ছুঁড়ে বেঁচে থাকার নিষ্ফল চেষ্টা
করলেন । কিন্তু একসময় তিনিও ডুবতে শুরু করলেন । পাঠান সৈন্য ততক্ষণে কুচ করে
অনেকটা এগিয়ে চলে গেছে । জলে ডাঙায় সর্বত্র শুধু মৃতদেহের ছড়াছড়ি । সূর্য মাঝগগনে
। সম্রাটের চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হয়ে মিশে যেত লাগল নদীর জলে । তাঁর প্রিয়তমা
বেগম আট মাসের অন্তঃসত্বা ছিল। বেগম নিঁখোজ । শিশুকন্যা আকিকা বেগম ও আরো দুই বেগম এদেরও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি ।
শেরশাহর সৈন্যরা তাদের বজরাকে তিনদিন পূর্বেই গঙ্গায় ডুবিয়ে দিয়েছে । যুদ্ধ
বিগ্রহের সময় শাহী মহল সঙ্গে রাখার নিয়ম নেই কিন্তু বেগমদের কার কাছেই বা হুমায়ুন
রেখে আসতেন ! ভ্রাতা মীর্জা কামরান সব সময় ওত পেতে থাকে । কিন্তু আজ থেকে সেসবের
আর কোনও দরকার পড়বে না !
ঠিক এমনি সময়ে হুমায়ুনের সিক্ত
কামিজে জোরে টান পড়ল এবং কে যেন মস্তকের কেশ ধরে শক্ত মুঠিতে টান মারল । সেই
অবস্থাতেই লোকটা তাঁকে জল থেকে টেনে ধরে বসাতেই তিনি বুঝলেন জায়গাটা একটা ডিঙি
নৌকোর ছোট পাটাতন । তাঁর শ্বাসনালীতে প্রচুর জল ঢুকে গেছে । ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে
দ্রুত ওঠানামা করছে বুক । সেই অবস্থাতেই হুমায়ুন বললেন, বহোৎ খুব ! আমার সৈন্যরা
বোধকরি কাছে পিঠেই আছে !
তুই কে ?
(দ্বিতীয় অধ্যায়)
আবার লেখা...
সবে ভোর হচ্ছে । পূব আকাশে লাল ও ফিরোজা রঙ । দিবাকর
এখনও দৃশ্যমান হননি ।
চারিদিকে বইছে শীতের ধারালো বাতাস । প্রিয়ার কপালের উজ্জ্বল টিপের মত শুকতারাটি
জ্বলজ্বল করছে । তখনও তার ঝিকিমিকি আলো । শোক ও সংশয় নিয়ে নিবিষ্টমনে সেইদিকে চেয়ে
রয়েছেন চৌত্রিশ বৎসর বয়স্ক হিন্দুস্থানের সম্রাট বাদশা হুমায়ুন । সময় ৯৪৮ হিজরি
জামদিয়াল আউয়াল মাস । কালস্রোত নিমেষের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে মানুষকে হাতছানি দিয়ে
ডাকছে । অন্তরের প্রবল চিত্তচাঞ্চল্যের জন্য সম্রাটের শীতবোধ প্রায় নেই । তাঁর
পরিধানে কেবল মাত্র একটি শেরওয়ানী । মসৃণ পায়ের পাতা থেকে গোলাপী আভা ঠিকরে বের হচ্ছে । ইতিমধ্যে কয়েক ফোঁটা শিশিরবিন্দু জমা হয়েছে সেখানে কিন্তু
সম্রাটের কোনও হুঁশ নেই । সামান্য দূরে সারিবদ্ধ কয়েকটি নাতিউচ্চ পাহাড় । সেগুলি
অবশ্য এখনও ভাল করে পরিদৃশ্যমান হয় নি । কয়েকটি ক্ষীণতোয়া নির্গত হয়েছে ঐ পাহাড়গুলি থেকে । জল তাদের সোনালী হলুদ । তাতে স্নান করলে
যে কোনও মানুষের গায়ের রঙ প্রথমে যাই থাক, বদলে গিয়ে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ ধারণ করবে ।
সম্রাট যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেটি
এমনই এক স্রোতস্বিনীর কিনারে, স্থানটি একটি মনোরম বাগ । বাগ–ই–খোশ্ । হলুদ ঘন নীল
আকাশী বেগুনী বিভিন্ন বর্ণের ফুল ফুটে আছে বাগিচা ভর্তি করে । সুগন্ধে ভরপুর
চারিদিক । পায়ের পাতা ডুবে যায় এমন ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা । দুষ্প্রাপ্য কিছু
পাহাড়ী লতা, ঝাড়বাতির মত দুলছে সেগুলি বাতাসে । অথচ বিষণ্ন সম্রাট সেগুলির দিকে তাকিয়েও দেখছেন না । তাঁর হাতদুটি বুকের ওপর
আড়াআড়ি ভাঁজ করা । একজন তাতার দেশীয় নফর সোনার ঝারি হাতে কাছেই দাঁড়িয়ে । ফজরের
নমাজের সময় চলে যাচ্ছে , সম্রাট ওজু করবেন কখন ?
কিচ্ছু ভাল্লাগছে না হুমায়ুনের
। কিচ্ছু না । মনটা বুকটা থম মেরে আছে । নিঃশ্বাসে শুধু একটি মাত্র শব্দ – হামিদা
। সমস্ত রাত বিছানায় বিনিদ্র শুয়ে শেষে অসহ্য বোধ হওয়াতে উঠে তাঁবুর বাইরে এসেছেন
। চাদর–ই–মেহের। সম্রাটের ব্যবহারের জন্য মণিমুক্তো খচিত বিশেষ তাঁবু । ভারী জারদৌজী ও বুটিদার সিল্কের কাপড় দিয়ে আগাগোড়া
মোড়া । ওপর থেকে ঝুলছে দেড়শো মোমের ঝাড়বাতি । মেঝেয় ছড়ানো কাশ্মিরী গালিচা, তাতে আসল সোনার কারুকার্য ।
এক কথায় চাদর–ই–মেহের মর্ত্ত্যের ইন্দ্রপুরী । নাঃ অনিদ্রায় সারারাত অতিবাহিত হয়েছে বলে হুমায়ুন সুরাপানে মত্ত থেকেছেন, তা কিন্তু নয় । সে সব কবেই ছেড়ে দিয়েছেন । থরে থরে পিচ আপেল আঙ্গুর খোবানি
চেরী সজ্জিত আছে পালঙ্কের ধাপে । প্রত্যেকটি ধাপ সোনারূপার পাতে মোড়া । ঝাড়বাতির আলোয় সেগুলি সর্বক্ষণ ঝলমল করছে । কিন্তু ক্ষিদে
জিনিষটা ঘুমেরই মত বিলকুল বেপাত্তা ।
এই সময় সম্রাটের বিশ্বস্ত অনুচর
রেজ্জাক খাঁ এগিয়ে এসে সবিনয়ে নত মস্তকে ভগ্ন কন্ঠে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল,
অভিবাদন গ্রহণ করুন জাঁহাপনা ! আপনার সঙ্গে
কয়েকটি জরুরী কথা আছে ...
রেজ্জাকের কন্ঠে ঘুমজড়িত
গ্লানিমা ... কোনক্রমে পোষাক বদলে দৌড়ে এসেছে। হুমায়ুন সম্রাট কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব । তাঁর মুখে
ভাবের কোনও রেখাই ফুটল না ।
রেজ্জাক আবার বলল, হুজুরে আলম !
এই কথাগুলি আপনাকে পেশ না করে আমি কিছুতেই যাব না। মির্জা কামরান আর খানিকক্ষণ বাদেই এখানে হুজুর সমীপে দেখা করতে আসছেন । বিশেষ
প্রয়োজন এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
সোনার ঝারি হাতে নফরটি ততক্ষণে চার কদম পেছিয়ে দাঁড়িয়েছে । দুই একটি বুলবুল গান
গাইছে সুমিষ্ট স্বরে বাগিচার ভেতরেই । সূর্যদেব উঠে এসেছেন মাত্র, রুদ্ধশ্বাস গোপন
করে রেজ্জাক বলল, জাঁহাপনা যদি এখান থেকে গোপনে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আর কোথাও যেতে চান
তো সে ব্যবস্থাও করা আছে ... এমন রক্ষীবিহীন অবস্থায় একলা থাকা সম্রাটের পক্ষে ভীষণ অনুচিত ! ...কাতর কন্ঠে বলল রেজ্জাক, হুজুরে আলম
কিছু বলুন !
নিস্তব্ধ হুমায়ুন এবারে একটু
কেঁপে উঠলেন মাত্র এবং ধীরে প্রায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করলেন-
বস্ এহী দো মশলে, জীন্দেগী ভর ন
হাল হুয়ে
ন নিদ পুরী হুয়ী, ন খোয়াব মকম্মল
হুয়ে
বক্ত নে কহা, কাশ থোড়া অউর
সবর্ হোতা –
সবর্ নে কহা, কাশ থোড়া অউর
বক্ত হোতা -
কেঁদে উঠল রেজ্জাক খাঁ । সেই
অবস্থায় হিন্দুস্থানের বাদশাকে প্রথামত কুর্ণিশ করে ধীরে ধীরে পিছু হঠে গেল ।
কোমরের কটিবন্ধে তার নিজস্ব শামসির রাখাই আছে । হিন্দুস্থানের সম্রাটের জীবন
রক্ষার জন্য জান বাজী রাখতেও প্রস্তুত সে ।
ললাট কুঞ্চিত করে মির্জা কামরান
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে হুমায়ুনের দিকে । কক্ষটি সম্পূর্ণ নির্জন । মরহুম
ওয়ালিদ বাদশা বাবুর এর প্রকৃত উত্তরসূরী, মির্জার বড়ে ভাইজান বুদ্ধিভাগ্য সম্পন্ন
হিন্দুস্থানের বাদশা কী করে এক সাধারণ কিশোরী মেয়ের রূপের মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারে, তা
মির্জা কিছুতেই বুঝতে পারছে না । মির্জার ওষ্ঠ ভঙ্গিমায় ঘৃণা ও বিরক্তি মাখানো ।
একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে
হুমায়ুন বললেন, মূলতান ছেড়ে আমি আর কোথাওই যাব না । চৌসার যুদ্ধে শের খানের কাছে
আমি পরাজিত হয়েছি সে কথা সত্য, কিন্তু হিন্দুস্থান আমায় অহরহ ডাকে ।
সঙ্গে সঙ্গে কামরান বলে উঠল, সে
তো বুঝলাম জাঁহাপনা ! ইবলিশের দোসর চতুর শের খাঁ শুধু দিল্লি আগ্রা দখল করে যে
সন্তুষ্ট তা তো নয় । শের খাঁ এখন নিজ পুত্র ও প্রধান সেনাপতি খাওয়াস খাঁকে সসৈন্যে
আপনার পশ্চাতে ধাওয়া করতে সুদূর মূলতান পর্যন্ত পাঠিয়েছে । আপনি কি জানেন, রাভী
নদীর ওপারে খাওয়াস খাঁ-এর দূত এসে উপস্থিত ?
বিমূঢ় হুমায়ুন বললেন, হ্যাঁ
এরপর আরও কত কী দেখতে হবে ! আরও কত কান্ড হবে সে সবের জন্য মনে মনে আমি প্রস্তুত। বড় ইচ্ছে ছিল কিছুদিন পিতৃস্মৃতি
জড়িত কাবুলে বসবাস করব, কিন্তু খোদার বোধহয় সে মর্জি নয় ।
কাবুলে আপনার আর কোনও অধিকার
থাকতে পারে না জাঁহাপনা ! মরহুম বাদশা বাবুরের উত্তরাধিকার সূত্রে তামাম
হিন্দুস্থান তো আপনি আগেই পেয়ে গেছেন।
সমস্ত অন্তরখানি হাহাকারে ভরে
আছে হুমায়ুনের । কিন্তু কন্ঠে সে সব বিন্দুমাত্র প্রকাশ না করে ধীর অবিচলিত স্বরে
কামরানকে বললেন, কাবুলের পূণ্যভূমি শাহী বংশধরদের প্রত্যেকের। আমাদের মহান পিতা
তাঁর ‘তুজুক–ই–বাবুরি’ তে এই সমস্ত কথা স্পষ্ট করে লিখে রেখে গেছেন। পিতা হুজুরের
আদেশ ও ইচ্ছানুসারে কাবুল কখনই একা কারুরই হবে না। কিন্তু তুমি সে আদেশ সম্পূর্ণ
অমান্য করেছো ! সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাকে মূলতানে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে,
গুস্তাকি মাপ জাঁহাপনা ! মূলতান আমারই রাজত্বের অন্তর্গত ।
হ্যাঁ তোমার রাজত্ব তোমারই
থাকবে। এখানে কোনও রকম যুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই আমাদের। তাছাড়া যুদ্ধ করবই বা কী দিয়ে ? শিবিরে উপযুক্ত খাদ্য নেই, রাতের অন্ধকারে কত সৈন্য লুকিয়ে পালিয়ে
গেছে ! উপরন্তু আমার তবিয়তও ঠিক যাচ্ছে না। দেখি কাল সকালেই একবার আম্মীজানের সঙ্গে দেখা করব।
কবে আবার দেখা হয় ...
এ কথায় মির্জা কামরানের ফর্সা
টুকটুকে নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত হল। তার মনে হল বাদশা হুমায়ুনের এন্তেকালের সময়
ঘনিয়ে এসেছে । নইলে এ অবস্থায় এই রকম আগড়ম বাগড়ম কেউ বকে ?
তুমি এই বাগিচাটির ঐশ্বর্য্য
চাক্ষুস করেছ কামরান ? খুবই বিস্ময়ের কথা মূলতানের মত এই শীত প্রধান দেশে এমন
অমূল্য বৃক্ষরাজির জন্ম খুবই অসম্ভব। মনস্থির করেছি এখান থেকে কিছু বৃক্ষ আমি
হিন্দুস্থানে নিয়ে যাব ।
দাঁতে দাঁত পিষে কামরান বললেন,
এ দেশের আর কোন বস্তু দেখে আপনি বিস্মিত হয়েছেন জাঁহাপনা ?
ভ্রাতার নীরব ঈঙ্গিত হুমায়ুন
বুঝলেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ মির্জা
। যে কোনও বিষয় বিস্মিত হতে আমার একটুও দেরী হয় না। খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আগামী
কালই আমি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়া জননী দিলদার বেগমের সাক্ষাৎ পাব । সেই সঙ্গে ভ্রাতা
মির্জা হিন্দাল, বোন মাসুমা ও অন্যান্য আরও
সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা হবে ।
পরদিন সকালেই দিলদার বেগমের
সঙ্গে সাক্ষাৎ হল হুমায়ুনের । বাবরের প্রথমা পত্নী মহাম বেগমের ইন্তেকাল কবেই হয়ে
গিয়েছে। তিনিই ছিলেন হুমায়ুনের গর্ভধারিনী । কিন্তু বিমাতাদের হুমায়ুন আপন জননীর
মতই অত্যন্ত ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। শাহী মহিলা দলের
প্রত্যেকের অঙ্গে মখমলের কালিন ও ঢোলা কুর্তা । বিভিন্ন আমীর ওমরাহ সহ মির্জা হিন্দালও হুমায়ুনকে
কুর্ণিশ করলেন। প্রত্যেকের সঙ্গে ভাব বিনিময় পর্ব চলছে কিন্তু হুমায়ুনের চোখ সেই
একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
সেই একজনকেই। যার স্বপ্নে আজ
তিন তিনটে রাত বিনিদ্র কেটেছে। নাঃ সেই নেই। আসেই নি আজ।
একান্তে হুমায়ুন জননীর শরণাপন্ন হলেন। মাও ছেলের মনোগত অভিপ্রায় বুঝলেন। মুহূর্তকালের ভেতরে শাহী মহলে খবর
রটে গেল যে বাদশা কিশোরী হামিদা বানুকে শাদী করতে চান।
তীব্র প্রতিবাদ উঠল মির্জা
হিন্দালের পক্ষ থেকে। -গুস্তাকি মাপ জাঁহাপনা! এ মেয়েটিকে আমি নিজ কন্যার মত দেখি।
আপনি বাদশা। সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। আপনার পক্ষ থেকে এ ব্যবহার সমীচিন নয়।
খামোশ ! বদতমিজ্ !
ব্যস মাত্র এই দুটি শব্দ।
তারপরই কক্ষ ত্যাগ করে সামনে থেকে চলে গেলেন হুমায়ুন। বিনা বাক্যব্যয়ে সঙ্গে সঙ্গে
উঠে দাঁড়াল বাকি সক্কলে। হঠাৎ যে বাদশা এমন রেগে যাবেন তা কেউ ভাবেনি।
মির্জা হিন্দাল বলল, হে
মহামান্য জাঁহাপনা আপনার সঙ্গে আমার একটি অতি জরুরী কথা আছে। অথচ আপনি শিশুর মত আচরণ করছেন...
এ কথার কোনও রকম জবাব দিলেন না
হুমায়ুন। মির্জা হিন্দাল ও মির্জা কামরান নিজেদের মধ্যে একবার চোখাচোখি করে নিয়ে
বাদশা সমীপে ফের নিজেদের বক্তব্য পেশ করল- হজুর–এ আলম কাল এখানে শের খাঁর দূত আসছে। দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কাল মসনদে আপনার
সঙ্গে আমরাও বসব। কারণ দূতকে দেখাতে চাই আমরা ভাইরা কেউ বিচ্ছিন্ন নই। এক।
এ কথারও কোনও উত্তর দিলেন না
হুমায়ুন। পেছনের ঝরোকা সরিয়ে অন্য কক্ষে চলে গেলেন। তাঁর বদনমন্ডল রক্তবর্ণ। দাউ
দাউ করে জ্বলছে সর্ব শরীর। তবু কাসেদ মারফৎ কয়েকটি ছত্র লিখে পাঠিয়ে দিলেন ভাই
মির্জা হিন্দালের উদ্দেশ্যে-
দর আইনা গারচে খোদ নোয়াই বাসদ্
প্যায়ওয়াস্তা যে খেশস্তান জুদাই
বাসদ্
খোদরা বেমিসালি গায়ের দিদন
আজরয়াস্ত্
ইবুয়াল আজবি কারে খোদায়ে বাসদ্
অর্থাৎ আয়নাতে লোকে নিজেরই
প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। কিন্তু এই প্রতিবিম্ব আর আসল মানুষটি কখনই এক নয়। এটা খুবই
বিস্ময়ের যে মানুষ নিজেকে অন্যরূপে দেখে। এই বিস্ময় খোদারই মর্জি।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন