ভালোবাসার
বাজিতে নিঃস্ব হয়ে যাবার পথে এগিয়ে আছে কে?
উপন্যাস পড়ার নেশা থাকলে
ভালো উপন্যাস পড়ে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। স্কট ফিটসেলাল্ডের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’ তেমনই এক
উপন্যাস যা বহুদিন মনের ভিতর আবেশ ছড়ায়। ভালোবাসার
এইসব বিস্ময়কর উপাখ্যান নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক ‘প্রেম’ নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ করে চলে। আর তা
আমাকে ভাবতে বাধ্য করে নারীপুরুষের
প্রেমাসক্ত অনুভূতির মাত্রা ভিন্ন কিনা, তা নিয়ে। অথবা স্থান কাল ভেদে কোনো
ভিন্ন প্রভাব পড়ে কিনা, তা নিয়ে ভাবতে।
‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’ উপন্যাসের কাহিনী মূলত গ্যাটসবি নামক একজন
নব্য ধনাঢ্য ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি তাঁর প্রেমের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বলিদান
দেন। গ্যাটসবির বন্ধু নিক ক্যারাওয়ে, ওয়াল স্ট্রিটের একজন ট্রেডার এবং লেখক। এলকোহলিক ও ইনসোমেনিক নিক চিকিৎসার জন্য একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অবস্থান করেন। একসময় চিকিৎসকের কাছে অতীত জীবনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি নস্টালজিক হয়ে পড়েন। চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখেন অতীত জীবনের একটি গল্প। ১৯১২ সালের সামারের দিনগুলিতে তিনি আমেরিকার লং আইল্যান্ডের উপসাগরের পাশে একটি বাড়িতে বসবাসের জন্য স্থায়ী হন। বাড়িটির চারপাশে ছিল অসংখ্য গাছপালা। গ্রীষ্মকালে লোকেরা যখন সমুদ্রের তীরে আনন্দ অনুষ্ঠান করত, নিক তখন সেসব তাঁর বারান্দা থেকে দেখতে পেতেন। মাঝেমাঝে নিকের
একটি বিশেষ অনুভূতি হতো যে, কেউ একজন সারাক্ষণ আড়াল থেকে যেন তাকে দেখছে। একদিন সে পাশের বাড়িটি, যেটা ছিল একটি বিশাল প্রাসাদ সেখানকার একটি জানালা দিয়ে একজনকে লুকিয়ে তার দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলো । নিকের বুঝতে বাকী রইলো না যে এই সেই লোক যার নাম জে গেটসবি, লোকটা একাই থাকে আর বেশিরভাগ সময় পার্টি করে আর হৈ চৈ নিয়ে থাকতে ভালোবাসে ।
সামারের শুরুতেই নিক গেটবির পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়। ওখানে ওর সাথে পরিচয় হয়
জর্ডান বেকারের। এবং পরিচয় হয় বিস্ময়কর নিঃসঙ্গ যুবক সয়ং গ্যাটসবির সাথে।
মহাযুদ্ধের সময় একই ডিভিশনে যুদ্ধ করেছিল হলে গ্যাটসবি নিককে মুহূর্তেই চিনে গেলে। পরবর্তীতে
জর্ডানের মাধ্যমেই নিক জানতে পারে যে ১৯১৭ সাথে যেসব তরুণ অফিসার ইউরোপের জন্য কাজ
করতো তাদের সাথেই নিকের কাজিন ডেজি ও তার বন্ধুরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতো। আর তখনই
সৌভাগ্যক্রমে গ্যাটসবি ও ডেজির দেখা হয়ে যায়। প্রথম দেখাতেই গ্যাটসবি ডেজির প্রতি
ভীষণভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়ে আর সেই প্রগাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। ডেজির সমস্ত স্বপ্ন
পূরণ করার তীব্র বাসনা নিয়ে সে তার জীবন অতিবাহিত করছে। জর্ডান আরও জানায় যে
গ্যাটসবি উপসাগরের উপকূলে যে প্রাসাদ কিনেছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে ডেজি ও টমের
বাড়ি ঠিক এর বিপরীত দিকে অবস্থিত। এবং শুধুমাত্র ডেইজির নজর কারার জন্যই সে এতসব
বন্য ও উদ্ভ্রান্ত পার্টি করে থাকে। গ্যাটসবির মনে একটি গোপন আশা ছিল যে ডেজি কোনো একদিন কৌতূহলী হয়ে ওর আঙিনায় পা
দেবে এবং সে তখন ওর সামনে নিজেকে একজন
যোগ্য ও ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে। গ্যাটসবির পার্টিতে
নিককে দাওয়াত দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন নিক, ডেজি ও গ্যাটসবির মধ্যে পুনরায়
যোগাযোগ স্থাপনে সাহায্য করে।
অপর দিকে, নিকের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন এক
জায়গায় থাকে নিকের কাজিন ডেইজি। ডেইজি বিবাহিত নিকেরই কলেজের এক পরিচিত ব্যক্তি
টমের সাথে। এদিকে ডেইজি নিককে জানায় যে সে তার স্বামী টমের সঙ্গে সুখী নয় কারণ
টমের মারটিল উইলসন নামক একজন মিসট্রেস আছে। নিক, গ্যাটসবির উপস্থিতির কথা না
জানিয়েই ডেজিকে চা খাওয়ার দাওয়াত দেয়। দেখা হওয়া মাত্রই দুজনের মধ্যে গভীর প্রেমের
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদিকে টম ডেজি ও গ্যাটসবির সম্পর্কের ব্যাপারে দিনদিন
সন্দিহান হয়ে ওঠে। এর মাঝে একদিন টম গ্যাটসবিকে পার্টিতে দাওয়াত দেয় এবং নিউইয়র্ক
সিটির ভিতর সবাইকে ড্রাইভ করতে বাধ্য করে। পার্টির এক পর্যায়ে গ্যাটসবি ঘোষণা করে
যে ডেজি টমকে ছেড়ে দিতে যাচ্ছে। এবং এটাও
বলে যে ডেজি আর গ্যাটসবি খুব শিগ্রী বিয়ে করতে যাচ্ছে। যদিও টম খুব ভালো করেই
জানতো যে ডেজি টমের এতসব প্রাচুর্য ফেলে সদ্য ধনবান হওয়া গেটসবিকে কখনই বিয়ে করবে
না। যাইহোক পার্টি থেকে বাড়িতে ফেরার পথে টম, নিক এবং জর্ডান দেখতে পায়
যে গ্যাটসবির গাড়ির সাথে টমের মিস্ট্রেস মারটিলের এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং মারটিল
নিহত হয়েছে। যদিও নিক পরে জানতে পারে যে আসলে ডেজি সেসময় ড্রাইভ করছিলো। কিন্তু ডেজিকে বাঁচানোর জন্য গ্যাটসবি নিজে সব দোষ স্বীকার
করে নেয়। এদিকে টম মারটিলের
স্বামী উইলসনকে জানায় যে গ্যাটসবি হচ্ছে মারটিলের গোপন প্রেমিক এবং সে মারটিলকে
খুন করেছে। ফলে মারটিলের স্বামী গ্যাটসবিকে অনুসরণ করে তার প্রাসাদে প্রবেশ করে
এবং তাকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করে। গ্যাটসবির মৃত্যুর পর নিক তার বারিয়ালের
আয়োজন করে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় যে প্রকৃতপক্ষে তার পরিচিত কেউ
গ্যাটসবির মৃত্যু নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়।
গ্যাটসবির মৃত্যুর পর কোনোপ্রকার সৌজন্য না দেখিয়েই একদিকে টম ও ডেজি ছুটি কাঁটাতে শহর ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে এতদিন
যে সমস্ত ব্যক্তিরা অতি উৎসাহ নিয়ে প্রতিনিয়ত গ্যাটসবির পার্টিতে এসে মদ খেতো এবং
নানারকম ফুর্তি করতো তারা সবাই শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আসতে অস্বীকৃতি জানালো। এমনকি গ্যাটসবির বিসনেস পার্টনার জনসম্মুখে তার মৃত্যু নিয়ে
শোক প্রকাশ করতেও অস্বীকৃতি জানালো। জীবিত অবস্থায় যে মানুষটির জনপ্রিয়তা ছিল
অনেকটা আকাশচুম্বী, মৃত্যুর পর মুহূর্তেই সে সকলের মন থেকে চিরবিস্মৃত হয়ে গেলো। আর এটাই হচ্ছে গ্যাটসবির প্রেমের পরিণতি।
এই তো গেলো গ্যাটসবির প্রেম কাহিনী। তবে যেকথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে
আবারো ফিরে যাই। নারী পুরুষের ভালোবাসার উন্মাদনায় আসলে কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা জানতে ইচ্ছে হয়? ভালোবাসার
বাজি ধরে নিঃস্ব হয়ে যাবার পথে এগিয়ে আছে কে? নারী নাকি পুরুষ? সেটা হয়তো হিসেব কষে বলা কঠিন। তবে যুগযুগ ধরে ভালোবাসার
খেলায় নারীদের হিসেবী চেহারাটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পে উপন্যাসে সেটা আরও বেশি করেই হয়ত বা করা হয়েছে। সেই কবে কিশোরী বয়সে যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ পড়েছিলাম আর চারুদত্ত আধারকারের গভীর বেদনায় সহমর্মিতা জানাতে বিশ্বাস করেছিলাম তারই অনুভূতিগুলো–
“যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে।ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিস্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।"
জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্য ত্যাগ। বিবাহিত নারীকে ভালবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন
নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ। পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে
জীবনে কোনদিন কোন নারী রয়নি চিরকুমারী”।
কিন্তু সত্যি কি তাই? তাহলে এন্তভ চেখভের ‘লেট
ব্লসমস’ এর সেই হতভাগিনী
প্রিন্সেস মারুস্যার অবিনাশী প্রেমকে আমরা কীভাবে
দেখবো ? যে কিনা
তার স্বর্গত পিতা প্রিন্স
প্রিকলনস্কির চিরদাস মজুরের ছেলে
ডাক্তার তপকরভের প্রেমে পড়ে
ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে
ধুঁকে মরতে থাকে আর
একটিবার মাত্র ডাক্তারের সান্নিধ্য পাওয়ার
যে নিদারুণ আকুতি প্রকাশ
করে!
তাতে কী প্রমাণ হয়
জানি না। তবে মৃত্যুর পূর্বে
রুগী হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে
গেলে রুগী দেখার পর
ডাক্তার জানায়, ‘রুগী
দেখা হয়ে গেছে আপনি
যেতে পারেন।’
মারুস্যা চেয়ার ছেড়ে উঠলো
না । প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সে কিছুতেই
উঠতে পারলো না, কারণ তার সর্বস্ব ক্ষয়ে গেছে ভালোবাসা নামক শুশুকের শোষণে। শেষ জীবনী
শক্তির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটুকু দিয়ে
যতটা শব্দ উচ্চারণ করা যায় তাই দিয়েই ফিসফিস
করে শুধু এতটুকুই বলতে
পারে, ‘ডাক্তার আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
এসব বাতুলতা বোঝার ক্ষমতা
তো ডাক্তারের থাকার কথা
নয়। সে রুগীর চিকিৎসা করে অর্থ উপার্জনের জন্য। ভালোবাসা নামক এমন
অযাচিত কোনো বস্তু চিকিৎসার বিনিময়ে কোনো রুগী তাকে প্রস্তাব করতে পারে এমন অবাস্তব
কল্পনা করার সময় বা মন কো্নোটাই তো তার থাকার কথা নয়। তাই মারুস্যা আবার
বলল, ‘আমি
তোমাকে ভালোবাসি’। আবারও, ‘আমি
তোমাকে ভালোবাসি ডাক্তার।’ হায়রে প্রিন্সেস!!
ডাক্তার শুধাল, ‘আমি কী
করতে পারি?’ প্রিন্সেস মারুস্যার
তো জীবনবায়ু নিভে গেলো। তাতে ডাক্তারের কী এসে
গেলো?
আবারও ফিরে যাই
যাযাবরের
‘দৃষ্টিপাতে’-
“জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে ভালোবেসেছে
তারপর সারাজীবন কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র,
ভাস্কর পাষাণ খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা।”
তাহলে কী দাঁড়ালো? উপরের প্রত্যেকটি শব্দ শুধুই পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? নারীর মনে প্রেমের কি কোনো স্থান নেই? নারী শুধুই সাধারণ আর পুরুষ মাত্রই অসাধারণ? জগতে নারীরাই শুধু বুদ্ধিমতি? এরা ভালোবাসে বিয়ে
করার জন্য, চাকুরী করে ব্যাঙ্কে টাকা
জমানোর জন্য, স্যাকরার দোকানে যায় গহনা গড়ানোর জন্য, আর তাদের জীবনের একমাত্র
উদ্দেশ্য কি পুত্র-কন্যা- স্বামী নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়!?
কিন্তু প্রেমিক যে পুরুষ, সে সংসারে রইলো বঞ্চিত হয়ে, হৃদয় নিয়ে করলো ব্যঙ্গ, যে উপহাসের পরিবর্তে নারীকে দিল প্রেম। সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন বহু
কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ।
তাহলে তো দেখছি পুরুষই
সবদিক দিয়ে মহান!
কিন্তু সত্যি কি প্রেম
শুধুই পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি? তাই
তাদের জীবনকেই শুধু ঐশ্বর্যময় করে তোলে প্রেম আর মহিমা দেয় মৃত্যুকে? আর প্রেমে পড়ে নারীর সব ত্যাগ এমন কি জীবনও
বুঝি হিসেব কষার খাতার মতই সাধারণ ও মলিন হয়ে রয় পুরুষের চোখে? খুব জানতে ইচ্ছে হয়
কী সেই কারণ যা শিল্প সাহিত্যে যুগ যুগ ধরে
পুরুষকে মহান করে রেখেছে আর নারীকে চিহ্ণিত করেছে খেলো করে? কে বলতে পারে এর কারণ
এমন নয়তো যে সর্বযুগে সর্বকালে পুরুষই আধিপত্য ধরে রেখেছে শিল্প-সাহিত্যের জগতে? আমার
জানা নেই। বিজ্ঞ পাঠক আপনি ভাবুন আর ভেবে বের করুন এর সঠিক কারণ কী হতে পারে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন