বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮

শুভলক্ষ্মী ঘোষ




প্রক্সি


স্কুল পাশ করে কলেজে উঠতে না উঠতেই সুজয়ের বাবা মারা গেলেন। চিরকালের মুখচোরা, সিধেসাধা গোছের সুজয় আর উপায় না দেখে পড়াশোনায় ইতি টেনে ওর বাবার চাকরিতে ঢুকল। না ঢুকে উপায় ছিল না। সংসারটা ভেসে যেত নইলে। সুজয় তার মাইনের ওই ক’টা টাকা দিয়ে বোনের লেখাপড়া, বিয়ে, মায়ের টুকটাক ওষুধ পত্র, সংসারের খুঁটিনাটি সব একা হাতে সামলেছে। বিড়ি সিগেরেটের নেশা নেই, মদ ছোঁয় না, দরকারে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সব কাজে মুখে হাসি... সুজয় কে পাড়ায় সবাই তাই ভালোইবাসত।

সংসার ঠেলতে ঠেলতে ছেলের এদিকে বয়েস বেড়েই চলেছে দেখে সুজয়ের মা দেখেশুনে সুজয়ের বিয়ে দিলেন। মেয়ের নাম স্বাতী। বাপমায়ের একমাত্র সন্তান, পাল্টি ঘর, পড়াশোনা জানা, আর দেখতেও যাকে বলে পরমাসুন্দরী। এ হেন ঘরণী পেয়ে সুজয়ের আহ্লাদে আটখানা হওয়া উচিত হলেও আদতে তা হল না। মেয়ের পছন্দ হল না সুজয়কে। কথায় কথায় মুখ ঝামটা -- “এমন ম্যাদামারা, মেনিমুখো লোকের গলায়, কি দেখে যে আমার বাবা মা আমাকে ঝুলিয়ে দিলেন! উফফফ... অসহ্য। না আছে লোকের সাথে মেলামেশার ধরন, না আছে সাজ পোশাকের ছিরি, না আছে কোন সহবত জ্ঞান --- অপদার্থ লোক একখানা!” সুজয় প্রতিবাদ করত না, অল্প হাসত খালি। সত্যিই তো, মেয়ের যদি এখন তাকে পছন্দ না হয়, সে যদি তার বউ’এর মনের মত না হয়ে উঠতে পারে, দোষ তো তার। কথার পিঠে কথা বলত না বলে ঝগড়াটা এগোতে পারত না বেশিদূর। স্বাতী রাগে ফোঁসফোঁস করত, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলত এদিক সেদিক, রাত্তির জেগে কান্নাকাটি করত... সুজয়ের ভালোলাগত না।

বিয়ের পর সুজয় প্রথমবার যখন ওর অফিসের বন্ধুদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিল, স্বাতীর রূপ গুণের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ, এই সুন্দরী, সপ্রতিভ স্ত্রী যে নেহাতই বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা, ক্যাবলাকান্ত সুজয়ের মুখের উপর সে কথাখানা বলতে কাউকে দুবার ভাবতে হয় নি। সুজয় গায়ে মাখে নি, হেসেছিল। বলা বাহুল্য, স্ত্রীর ব্যাক্তিগত চাহিদা মেটাতেও যে সুজয় কতখানি কাছাখোলা, লাজুক, জড়ভরত, স্বাতীর বদান্যতায় সে কথাও বন্ধুমহলে বেশ রসালো গল্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ক’দিনেই। সুজয় এ সব শুনেও হাসত। বেশী বলত না কিছু।

যাইহোক, সময়ের সাথে মানুষের মন বদলায়, একসাথে থাকতে থাকতেও মানুষের মনে দয়াদাক্ষিণ্য, প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা জন্মাতে পারে... স্বাতীর গত কয়েকমাসের আচরণে সুজয় এখন সেই রকমই কিছুটা ভাবতে শুরু করেছে। ছেলে হিসেবে সে তো নেহাত মন্দ নয়, তাই হয়তো ওর কপাল ফিরছে এদ্দিনে...


***
নয় নয় করে সুজয়ের বিয়ের বছর ঘুরতে চলল। স্বাতী মনের মত করে সুজয়কে গোড়ে পিটে নিয়েছে। সংসারে ঝামেলা এড়াতে সুজয়ও নিজের ভোল পালটাতে দ্বিরুক্তি করে নি। সুজয়ের সাজ পোশাক এখন অনেক অন্যরকম, কথাবার্তা হাবভাবে চটক এসেছে, আগের থেক ঢের বেশী বলিয়ে কইয়ে হয়েছে সে। পাড়ার লোক এখন সুজয়কে বেশ সমীহ করে চলে। কিন্তু সুজয়ের মুখের সেই সর্বক্ষণের হাসিখানা আর নেই! থাকার কথাও নয়... আসলে বড্ড ধকল যায় প্রতিদিন! রাত্তির হলেই স্বাতী যত্ন করে ঘুমন্ত সুজয়কে জাগিয়ে তোলে। স্বাতীর শরীরের তলায় সুজয়ের দেহখানা পিষতে থাকে রোজ। সুজয় পুতুলের মতো হাত-পা নাড়ে... হিসহিসে গলায় সেখানো বুলি আওড়ায়... জায়গামতো হাত বোলায়... কামড়ে ধরে... চুলে বিলি কাটে...। ঘণ্টাখানেক এমনিভাবে সুজয়ের শরীর ঘাঁটাঘাঁটি করার পর স্বাতীর ঘুম পায়। পাশে শুয়ে থাকা বিধ্বস্ত স্বাতীর মুখের দিকে সুজয় কেমন জানি ভয় ভয় তাকিয়ে থাকে --- এই বুঝি ঘুমের মধ্যে স্বাতী আবার বিড়বিড় করে বলে উঠবে ... “জড়িয়ে ধরবে?... জড়িয়ে ধর না আমায়... আআহ... আর একটু আদর...  কোথায়... ওফফ... কোথায় গেলে তুমি? ... রজত?... রঅঅঅজত???...



৩টি মন্তব্য: