ধারাবাহিক উপন্যাস
তাহার নামটি
(ষোলো)
ভোরের দিকে অ্যালার্ম বেজে উঠতে রাজীব চুপচাপ ছাদে এসে দাঁড়ায়।
সে নিশ্চিত রঞ্জনা আজও পায়খানা করতে আসবে ভোরবেলা। রাজীব দেখে অঞ্জনদের ছাদে অন্ধকারে
কে যেন বসে আছে, “জুলপি?!”
অঞ্জন উঠে দাঁড়ায়।
রাজীব অবাক হয়ে বলে, “এত ভোরে কী করছিস ছাদে?”
“তুই কী করছিস?”
“পেচ্ছাপ করতে এসেছিলাম”
“বাথরুমে করিস না?”
কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে রাজীব বলে, “সকালে মাঝে মাঝে টবে করি”
“আচ্ছা”
“তুই কী করছিস?”
কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে অঞ্জন বলে ওঠে, “টোটো, আমি সাব্বির নই”
“সাব্বির? মানে?”
“তোর দিদি গত পরশু থেকে আমাদের স্টোর রুমে লুকিয়ে আছে, কাউকে বলতে বারণ করেছিল।”
“তাই বলে তুই বলবি না! জ্যে আজকেই পুলিশে খবর দেবে বলেছে!”
“সরি টোটো”
“দাঁড়া মা’কে ডেকে আনি, আমি গিয়ে ডাকলে তো দিদি আসবে না”
“এখন যাস না প্লিজ, ও ঘুমোচ্ছে”
রাজীব অঞ্জনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, “ঠিক আছে”
এগারোটা পনেরো নাগাদ অঞ্জন গরিমার বাড়িতে ঢুকে আসে। দোতলার ঘর
অন্ধকার করা, ঘরে হাল্কা গান চলছে। একটা
টপ পরে গরিমা বেরিয়ে আসে, অঞ্জন বোঝে সে
ব্রা পরেনি।
“আমি জানতাম তুই আসবি, বোস”
অঞ্জন বসে না, বলে,
“তোকে আমি সেদিন তো সব বলেছিলাম, তার পরও তুই কেন এরকম করছিস?”
“তুই বলেছিলি আমি শুনেছিলাম, তখন কি আমি জানতাম...” গরিমা অঞ্জনের
চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
“কী?”
“যে আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি!” গরিমার চোখ থেকে একফোঁটা জল পড়েই তার টপের মধ্যে ডুবে যায় কোথায়।
“তুইই তো বলেছিলি, শুধু ভালোবাসলেই শুতে হয় না কি”
“হ্যাঁ, বলেছিলাম, কিন্তু কী করবো আমি, কী করবো বল! হেল্প কর আমায়!” গরিমা কেঁদে ফেলে।
অঞ্জন ধীরে ধীরে গরিমার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
ফুঁপিয়ে ওঠে গরিমা, “আমি তোকে... অঞ্জন, আমি তোকে...”
অঞ্জনের গলা বুজে আসে, কষ্টটাকে ভিতরে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে সে বলে, “গরিমা, সরি... গরিমা, আমিও, আমিও”, চোখ বুজে ফেলে অঞ্জন, সে দেখতে পায় তাদের
ছাদে স্টোর রুমের দরজা খুলে ঢুকে আসছেন সুনীল মজুমদার।
ঘুম ভাঙতেই রঞ্জনা দেখে তার সামনে বসে আছেন সুনীল মজুমদার, -শালা জুলপির বাচ্চা!
“কখন এলে জ্যে?”
“অ্যাঃ, এটা যেন ওনার বাড়ি! ককন এলে জ্যে!” মুখ ভেংচে বলেন সুনীল।
“হ্যাঁ, ঠিকই, এটা আমার বাড়ি নয়, ওটাও আমার বাড়ি না, আমার কোনো বাড়ি
নেই”
“বাড়ি নেই মানে!” বাইরের দিকে আঙুলে ইশারা করে সুনীল বলেন, “ওটা কি তালে মকশো করতে আমি আর তোমার বাবা বানিয়েচিলাম!”
“বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে ওটা আর আমার বাড়ি নয়”
“সেটা আমি টিক করবো, বাড়ি চলো এক্কুনি!”
“না”
“আমি পুলিশ ডাকবো কিন্তু!” উত্তেজিত হয়ে সুনীল বলেন।
“ডাকো, আমারও অনেক কিছু
বলবার আছে”
সুনীল মজুমদার অল্প হেসে ওঠেন, “না, তুমি বলবে না আমি
জানি,
বলবার হলে এতদিন অপেক্কা করতে না”
রঞ্জনা বলে, “চ্যালেঞ্জ করছো?”
“চ্যালেঞ্জ করচি না। আমি তোমায় চিনি, তুমি হোচ্চো তোমার বাবার মত, আমি যকন তোমার বাবার হাত তেকে বিজনেসের সব কিচু আস্তে আস্তে নিয়ে নিচ্চিলাম, তকন কিন্তু সে সব কিচু জানতো, জেনেও কিচু বলেনি, কেন বলেনি জানো?”
রঞ্জনা কিছু বলে না।
সুনীল বলে চলেন, “এই পৃতিবীতে দুই রকম মানুষ হয়, এক আমার মত, যারা অন্যায় করে, করেই চলে, এবং তার জন্য যকন
তাদের অনুতাপ হয়, তকন তারা আরো একটা
অন্যায় করে। আরেক রকম মানুষ হচ্চো তোমরা, এই আমরা যে অন্যায়গুনো করি, তার জন্য অপরাদবোদ
হয় তোমাদের, তোমরা ভাবো তোমাদের দাদা, তোমাদের জ্যেটু অন্যায় করচেন, ককনো ভাবো না অন্যায়গুনো তোমাদের সাতেই করা হচ্চে। আর তোমরা সেই অপরাদবোদ নিয়ে
সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে জানো। তোমরা আসলে মেসোকিস্ট,- ওই মর্ষকামী না কি বলে যেন...”
দম নেওয়ার জন্য বিরতি নেন সুনীল, “অনেক দিন হল জিজি, বাড়ি চলো এবার। তোমার ভাই, তোমার মা তোমার
জন্যে চিন্তা করচেন।”
বিকেল প্রায় শেষ, ছাদে পিমকে কোলে করে ঘুরছে রাজীব, তার চোখ অঞ্জনদের স্টোর রুমের দিকে। রঞ্জনা এখনও বাড়ি ফেরেনি। অঞ্জন অনেক বুঝিয়ে
তার মা বাবাকে রাজি করিয়েছে রঞ্জনাকে থাকতে দেওয়ার জন্য। দুপুরবেলা অঞ্জনের হাত দিয়ে
কাবেরী খাবার পাঠিয়েছেন। রাতেও তাই ব্যবস্থা।
হঠাৎ স্টোর রুমের দরজা খুলে যায়। রঞ্জনা বেরিয়ে ধীরে ধীরে পাঁচিলের
কাছে এসে কিছুক্ষণ রাজীব আর পিমকে দেখে।
“দে...”
রাজীব বলে, “পিমকে?”
“হ্যাঁ”, রঞ্জনা হাত বাড়ায়।
পিমকে কোলে নিয়ে চুপ করে রঞ্জনা তার গায়ে হাত বোলাতে লাগে।
রাজীব বলে, “তুই আমার সাথে
কথা বলিস না কেন জিজি?”
রঞ্জনা কিছু বলে না।
“ছোটবেলায় তো আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম, কতো খেলতাম, মনে আছে, তুই আমায় পায়ের উপর তুলে ঘুঘু
সই খেলতিস... আমি যতবার বলতাম ছাই কুরে পড়ব, তুই তবুও আমায় সোনা কুরে ফেলতিস না”, রাজীব উত্তরের আশায় রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“পিম খুব নরম না?” রঞ্জনা পিমের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে।
“তুই কেন আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলি জিজি? আমি কি কোনো অন্যায় করেছিলাম? বল...”
“আমার ছোটবেলাটা, টোটো,
খুব একটা ভালো নয়, এই জ্যে, প্রায়শই মলেস্ট করত আমায়, প্রথম প্রথম তো বুঝতামও না যে কী হচ্ছে! তারপর ধর মা’কে এসে একদিন জানালাম, মা জ্যে এরকম করে আমার সাথে! মা জাস্ট খেদিয়ে দিল আমায়। আমি ভাবলাম
এরকমই বোধহয় হয়ে থাকে। তারপর বাবার বিজনেস পড়ে গেল, আর সাথে সাথে মাথাটাও গেল কেমন খারাপ হয়ে। তুই তখন অনেক ছোট, মার কোলে কোলে ঘুরিস। হ্যাঁ মাঝে মাঝে আমরা ঘুঘু সই খেলি বটে...
বাকি সময়টা জ্যে খেলে আমায় নিয়ে। না, জ্যে খুব সাবধানে খেলত, সীমার মধ্যেই।
তারপর একদিন মনে হল বাবাকে বলি। বললাম; খুব মন দিয়ে শুনল। কিছুই বলল না। তারপরের দিন আবার জ্যে মলেস্ট করল আমায়, এবার চলন্ত রিক্সায়, ভাবতে পারিস টোটো! রিক্সা থেকে নেমে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে আসতেই শুনি মা সিঁড়িঘর থেকে
চিৎকার করে কাঁদছে, তুই বিছানার ওপর
বসে মন দিয়ে ফুল ফলের ছবিতে রঙ ভরছিস, আর রান্নাঘর ভরে গেছে ইলিশ মাছ পোড়া গন্ধে”
“বাবা!” রাজীব অস্ফুটে
বলে ওঠে।
পিমকে বুকের কাছে চেপে ধরে থাকে রঞ্জনা, “আমি সেদিন যদি বাবাকে না জানাতাম... এর পর থেকে যখনই তোর সাথে
কথা বলতে গিয়েছি, মনে হয়েছে আমার
জন্যই তুই বাবাকে পেলি না, তোর পাশে শুয়ে
সারারাত ঘুমোতে পারতাম না। একদিন ঠিক করলাম আলাদা হতে হবে তোর থেকে। সেদিন থেকে নিজের ঘরে
থাকতে শুরু করলাম, সাব্বিরের সাথে”
“সাব্বির... বাবার সেই স্কুলের বন্ধু না! যার সাথে সেই নানারকম
কান্ড হত! একেই তো তুই চিঠি লিখিস...”
“সাব্বির বলে কেউ নেই টোটো, বাবা গল্পগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলত আমাদের, যাতে আমরা আনন্দ পাই।” অল্প থেমে রঞ্জনা আবার বলে ওঠে, “বাবা চলে যাওয়ার পরে জ্যে একবারও হাত ওঠায়নি আমার গায়ে। বলতে পারিস জ্যে আমায় ভয়
পেত একরকম। বেশি ঘাঁটাত না আর তারপর থেকে। আমাদের বেঁচে থাকার বাঁচিয়ে রাখার সব দায়
দায়িত্বও বলতে পারিস সেই ভয় থেকেই জ্যে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।”
“ভয় না অপরাধবোধ?”
“জ্যের মত মানুষদের অপরাধবোধ নেই টোটো, থাকলে ওরা সারভাইভ করতে পারত না, আর সেই কারণেই নেই।”
দুজনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
“তুই এই কারণে কথা বলিস না আমার সাথে...”
“শুধু তাই নয় টোটো, মানুষের জীবনের কিছু কিছু অংশ থাকে, যেগুলো তীক্ষ্ণ কাচের মত, চকচকে, অথচ ধরতে গেলে হাত পা কেটে রক্তমাংস সব বেরিয়ে আসবে। আবার এই
টুকরোগুলোর সামনে গিয়ে যদি না দাঁড়াই, নিজেকে ভেঙে ভেঙে পুরোপুরি দেখাও হয়ে উঠবে না। তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করার আরো
একটা কারণ এই কাচের টুকরোগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া,” একটু থেমে রঞ্জনা বলে, “তুই এসব বুঝবি না টোটো, তুই এখনো ছোট আছিস।”
“জিজি,”
রঞ্জনা মুখ তুলে তাকায় রাজীবের দিকে।
“বাবা অনেকদিন হল আর নেই, জিজি! অপরাধবোধটা বাবার জায়গা পূরণ করতে পারবে না, সে তুই যতই চেষ্টা করিস না কেন। আমি অনেক কম বুঝি তোর থেকে, মায়ের থেকেও। কিন্তু যেটা বুঝি সেটা হল, এবার তোর ফেরা উচিত। অনেক দিন হল তুই অপরাধবোধে আছিস।”
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন