আলোর পথযাত্রী
-হ্যালো
হ্যালো পাঁচমুড়ো থেকে শ্যামলাল বলছি, শোনা যাচ্ছে?
-শ্যামলাল
আগে টিভিটা মিউট মানে, শব্দটা বন্ধ করে দিন।
-ও। এটা
কি আলোর পথযাত্রী লাইভ অনুষ্ঠান? আমি পোশ্নো করতে পারি?
-নিশ্চয়ই।
প্রথমে টিভিটাকে—
-বলছি,
বলছি— এই রবি আগে তুই টিভির সাউণ্ড বন্ধ করে দে না। এবারে হয়েছে? আপনি কি বনছায়াদিদি? আমাকে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলাবেন?
-হ্যাঁ
পরিষ্কার আসছে। কিন্তু আজ ডাক্তারবাবু না, ডাক্তার দিদিমনি মলিনা সান্ন্যাল। দেখতে
পাচ্ছেন না? টিভি থেকে কি দূরে আছেন?
-পার্টি
অফিসে বসে আছি রবি আর নিত্যর সঙ্গে। এখানে টিভি আছে।
-তাহলে
দেখছেন না কেন ভাই? সামনে এসে বসুন।
-আমি
চোখে দেখতে পাই না, ব্লাইণ্ড। রবি এই পোগ্রামটা
দুয়েকবার দেখেছে। ভালো বলল। তাই জন্যে বসেছি।
-আহা রে,
বুঝতে পারিনি। দুঃখিত, কেমন?
-না
না। আচ্ছা ডাক্তার দিদিমনি কথা বলছেন?
-হ্যাঁ
ভাই, বলুন কী সমস্যা? চোখে কবে থেকে দেখতে পান না? ডাক্তার দেখিয়েছিলেন? আপনার বয়স
কত?
-বয়স
বত্তিরিশ। ছোটকাল থেকেই ঝাপসা দেখতাম। বাবা বেঁচে থাকতে একবার শহরে গিয়ে ডাক্তার
দেখিয়েছিল। ভিটামিন খেতে দিয়েছিল। ব্যাস, আর যাওয়া হয়নি। পয়সা কোথায় পাব? আমরা খুব
গরীব ম্যাডাম। বাবা-মা মিলে পোড়ামাটির পুতুল মানে টেরাকটার—ওই বানাত। বাবা যক্ষ্মা
হয়ে মারা গেল। এখন মাও বুড়ো হয়েছে। বাতে আঙুল বেঁকে গেছে, আর আমি পোতিবন্দী। দিনরাত্তির
গালি দিতে থাকে।
-ছি ছি
শ্যামলাল ওরকম বলতে নেই ভাই। নিজেকে এত অসহায় ভাবতে হয় না। বল, ডিফারেন্টলি এব্ল্।
-আপনি
কিসের ডাক্তার দিদিমনি? চোখের?
-মনের
ডাক্তার। তোমাদের মনের যাবতীয় সমস্যা যেমন নিজেকে ছোট ভাবা, এসব থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে। আমরা আন্তরিকভাবে তোমাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি সব সময়ে।
-তা’লে
আমাকে সাহায্য করবেন? রোজগার করার একটা উপায় বাতলে দেবেন?
-দূর
থেকে তোমাকে যে দেখতে পারছি না ভাই, বরং কাউকে সঙ্গে করে চলে এস আমাদের কাছে। ফোন
কর, ঠিকানা দপ্তর থেকে তোমাদের জানিয়ে দেবে। আমি আগে একজন চোখের ডাক্তারের সঙ্গে
যোগাযোগ করে রাখব।
-চোখের
ডাক্তার? চোখ মায়ের ভোগে গেছে বারো বছর বয়সে। আচ্ছা, গেলে কাজ পাইয়ে দেবেন?
-অন্তত
উপায় বলে দেব। তুমি ব্রেইল জান তো?
-জীবনে
শুনিনি। ওটা কি অন্ধদের জন্য কোনো কাজ?
-বলছি
না, অন্ধ বলবে না! শোন, ওটা একটা সিস্টেম, যেটাতে দৃষ্টিহীনরা পড়তে পারে। শিখতে হবে।
-কে
শেখাবে দিদিমনি? ক্লাস ফাইবে উঠে আর পড়তে পারিনি। ওই যে কী বলে দিষ্টিহীন হয়ে
গেছলাম। তবে পোতিবন্দী সাট্টিফিকেট আছে,
যদি কাজ হয়! আর আমাকে দেখলেও বুঝতে পারবেন—
-আহা রে
মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তবে মানুষের ইচ্ছায় কী না হয়! তুমি চাইলে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে
উঠবে।
-আপনার
নরম মন, যদি একবার গ্রামে আসেন খুবই ভালো হয়।
-আসলে আমি
বড্ড ব্যস্ত থাকি কিনা— রুগী আসে, যায়, চিকিৎসা করি। মনের অসুখ তো, তাই সময় দিতে হয়। তুমি আমার সঙ্গে অন্তত দুতিনটে সিটিং দাও,
দেখবে কথায় কথায় মন হাল্কা লাগছে। আত্মবিশ্বাস আসছে।
-সিটিং?
বসতে বলছেন? কলকাতা যাবার পয়সা আমাকে কে দেবে? একা যেতে পারব না— এই রবি বা নিত্য
বা আর কাউকে নিয়ে যেতে হবে। পয়সা কে দেবে?
-বুঝতে
পারছি শ্যামলাল তোমার আসা যথেষ্ট সমস্যার। কিন্তু একবার যদি দিন পনেরোর জন্যে আসতে
পার, তোমাকে সব কাজ সরিয়ে ডেট দেব। তারপর আই স্পেশালিস্ট—
-দিন
পনেরোর মধ্যে হয়ে যাবে? কোথায় থাকব দিদিমনি? আপনার জানাচেনা কেউ আছে?
-না,
আবার মাসদুয়েক পরে আসতে হবে। আসলে এগুলো লংটার্ম ট্রিটমেন্ট যে।
-আপনি
আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন ম্যাডাম?
-পারছি
শ্যামলাল। তাহলে না হয় ওখানে একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নাও।
-ম্যাডাম,
এখানে হেলথ সেনটারে চোখের ডাক্তারবাবু বছরে দুবার আসেন। আই ক্যাম্প হয়েছিল, দু’বার
গেছি। ও সারবে না। আমার কি বেঁচে থাকা সাজে, বলুন?
-শোন,
এত ভেঙে পড়তে নেই। তুমি আমাদের অফিসের ঠিকানা লিখে নাও।
-হে
হে, আমি লিখব কি করে?
-বন্ধুদের
বল, লিখে রাখবে।
-ওরা
দু’তিন ক্লাস পড়েছিল। সব ভুলে গেছে। ফোনের নম্বরটা অবশ্য লিখতে পারে। কলকাতাও চিনে
না।
...
বিপ্ বিপ্ কুঁউউউউউউ...
-মলিনাদি,
লাইনটা কেটে গেল মনে হচ্ছে!
-সত্যি
বনছায়া কী হেল্পলেস যে লাগছে। শ্যামলাল তুমি যদি পার, আরেকবার ট্রাই কর।
-আরেকটি
ফোন আসছে— বলুন কে বলছেন? কোত্থেকে বলছেন? আচ্ছা দিচ্ছি ডাক্তারবাবুকে— একটু ধরুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন