আকাশ ঢাকা বিজ্ঞাপন
অনেকে কিন্তু বলেছিল – ক্রিকেট ঠিক আছে... ফুটবলে নামাটা এই
বয়স...
বয়স আমার মাত্র তেত্রিশ। নেমেই পড়লাম। অফিসের ডিপার্টমেন্টগুলো ভাগ করে দুটো দল হয়েছে। শুক্রবার হাফছুটি দিয়েছে, তারপর খেলা। বেশ খেলছিলাম — ইস্কুল-টীমে খেলতাম তো! কিন্তু ঝোঁকের মাথায়
একটা উঁচু বল কায়দা করে ‘রিসিভ’ করতে গিয়ে ধাক্কা লাগল এক বেজায় লম্বাটে লোকের
সঙ্গে। বিচ্ছিরি ভাবে পড়লাম, ডান পায়ের গোড়ালিটা মনে হলো খসে পড়ে গেছে!
রঞ্জন-রশ্মির ভূতুড়ে ছবি দেখল ডাক্তার। হাড় ভেঙ্গেছে। প্লাস্টার হলো অনেকটা। নার্সিং হোমের ছ-তলার কেবিনে ছ-সপ্তাহের
মেয়াদ। সারাদিন শুয়ে। ক্রাচ্ নিয়ে কোনোরকমে বাথরুম। ব্যস্, আবার
বিছানা।
তবে হ্যাঁ, আমাদের কোম্পানীটা ভালো। অফিসের খেলায় পা ভেঙ্গেছে তাই ছুটি এবং
নার্সিং হোমের খরচ সব দিচ্ছে। আর সত্যি বলতে কি, কাজের বেশ চাপ থাকলেও মাইনেটা ভালো দেয়। আমার এখানের নিজের খরচ, মা’র কাছে টাকা পাঠানোর পরও ব্যাঙ্কে
পটাপট টাকা জমছে।
কেবিনটা মাঝারি সাইজের। একটা জানালা আছে, কাচের। আশেপাশে তেমন উঁচু বাড়ি নেই, খোলা আকাশ দেখা যাওয়ার কথা, কিন্তু যায়
না। কারণ একটা বিরাট
বড় বিজ্ঞাপনের বোর্ড। যেদিন ভর্তি হয়েছিলাম সেদিন ছিল গয়না-গাটির বিজ্ঞাপন। আজ দেখছি পালটে গেছে। আজকাল ‘স্ক্রীন প্রিন্টিং’ না কী যেন হয়েছে, ফটাফট্ ছবি পালটে দেয়। কলকাতার একটু বাইরে নতুন বাড়ি-ফ্ল্যাট হচ্ছে, তার ছবি। টেনিস কোর্ট, সাঁতার কাটার সুন্দর পুকুর, ক্লাব, হলঘর সব নাকি থাকবে। শহর থেকে মাত্র সাড়ে ন’ মিনিট। এক্ষুণি বুক্ করলে অনেকটা ছাড় – এইসব লেখা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো,
ক’দিন হলো একটা ফ্ল্যাট নেওয়ার
কথা ভাবছিলাম। এরা কি মনের কথা শুনতে পেয়ে ছবিটা চোখের সামনে টাঙ্গিয়ে
দিল! টাকা-পয়সার হিসেব আমার কোনোদিনই ভালো লাগে না। তবু মনে মনে অঙ্ক কষতে শুরু করলাম, হাউসিং লোনে সুদ যদি পৌনে দশ করে হয়,
তাহলে প্রতি লাখে...
দিন দশেকের মধ্যে বাড়ি হয়ে গেল – মানে ছবি পাল্টে গেল। এলো গাড়ি। নতুন মডেলের বিজ্ঞাপন, ছবিতে গাড়ির পাশে এক সুন্দরী। তার পায়ের তলায় ই এম আই। নাঃ, এরা নির্ঘাত মনের কথা
পড়তে পারে! গাড়ি কেনার কথা তো অনেক বার ভেবেছি। মাসে কত দিতে হবে তার হিসেবের সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা তাড়াহুড়োর ভাব এসে পড়ল। যা করতে হবে, এখনি, এখান থেকে ছাড়া পাবার পরই করে ফেলব। শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনেও তো করা যায়, নেট ব্যাঙ্কিং তো আছে! না বাবা থাক, ঠকে যেতে পারি। তবে অফিসে জয়েন করে আর সময় নষ্ট করব না।
ছ-সপ্তাহের মাথায় প্লাসটার কাটা, রঞ্জন-রশ্মি ইত্যাদি সম্পন্ন হলো। সব ঠিক আছে, হাড় জুড়ে গেছে। ছুটি হয়ে গেল। সাতচল্লিশ দিন পরে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম। ট্যাক্সি ডাকা হয়েছে, পাঁচ মিনিটে আসছে। আমি পায়ে হেঁটে নার্সিং হোমের সামনের
বাগানটায় এসে দাঁড়ালাম। চটি খুলে ঘাসে পা রাখলাম, ঘাড় উচু করে মাথার ওপরে তাকালাম। খোলা আকাশ, পুরো
আকাশ। কোনো বিজ্ঞাপন টাঙ্গানো নেই। ক’টা ছোটবড় মেঘের টুকরো ঢিমে তালে চলছে। তিন- চারটে চিল চক্কর দিচ্ছে, হাওয়ায় ভেসে ভেসেই জীবনটা কাটিয়ে দেয় এরা।
আকাশের
নিচে নিজের পায়ে নিজে চলতে পারার অদ্ভুত যে একটা মজা আছে তা জানতাম না। পা না ভাঙ্গলে জানাই হতো না কোনোদিন। আমার ভেতরের খুশির ভাবটা হুস্ করে আকাশ অবধি উঠে কেমন একটা ভালোলাগা
হয়ে আমার ওপরেই যেন নেমে এলো। মনে হলো, বাড়ি-গাড়ি নিয়ে অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওসব না হলেও এই তো দেখছি দিব্যি খোশ-মেজাজে থাকা যায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন