শুধু হাসে মহাকাল - ৩
স্বাধীনতা-উত্তর
ভারতের কার্টুন ও কার্ডে নেতাজি সুভাষ
ভারতের ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদী নেতা ও বহু বিতর্কের মধ্যমণি নেতাজি সুভাষচন্দ্র
নানা দেশের কার্টুনিস্টদের কাছে আগাগোড়াই যে এক বর্ণাঢ্য চরিত্র হিসেবে গণ্য হয়েছেন, আমরা তা জানি। সুভাষচন্দ্র যতদিন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সে সময়ে তো বটেই, ১৯৪৫ সালে তাঁর অন্তর্ধানের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ভারতের জনমানসে ও সংবাদমাধ্যমে এক বহুচর্চিত চরিত্র। তাঁর বর্ণময় জীবনকাহিনি ও রহস্যময় অন্তর্ধান আর তাঁকে নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন এখনও বিরাটসংখ্যক মানুষকে নানাভাবে আকর্ষণ করে এসেছে বলেই শিল্পীরা তাঁকে বিষয়বস্তু করে আজও বিভিন্ন পোস্টার, কার্ড ও ব্যঙ্গচিত্র এঁকে চলেছেন। অতীতে নেতাজির জীবনকালের দু’টি পর্বের সমসাময়িক কার্টুন ও পোস্টারগুলি নিয়ে আমরা এর আগে দু’
বার আলোচনা করেছি, আগ্রহী পাঠকেরা এই পত্রিকার পূর্বের সংখ্যায় গিয়ে সেগুলি দেখে নিতে পারেন [দ্রষ্টব্য-- http://www.kalimationline.blogspot.in/2016/01/blog-post_45.html
এবং http://kalimationline.blogspot.in/2017/02/blog-post_45.html] আমাদের বর্তমান পর্বের উপজীব্য ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর যুগে প্রচারিত কিছু ভিন্টেজ কার্ড ও ছবি আর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু কার্টুন, যার বিষয়বস্তু নেতাজি।
ভিন্টেজ কার্ড ও প্রচারচিত্রে
নেতাজির গরিমাগাথা
ভিন্টেজ কার্ড বললে কি বোঝায়, সেটা এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে হয় তো খুব স্পষ্ট হবেনা, কিন্তু বর্তমানে যারা বয়োবৃদ্ধ, তাঁরা অনেকেই মনে করতে পারবেন, তাঁদের শৈশবে অথবা তারও পূর্ববর্তী সময়ে ছোট ছোট রঙিন ছবি ছাপিয়ে বিভিন্ন পণ্য-উৎপাদক বা প্রেস বিক্রি বা বিতরণ করতো। ছবির বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্রঃ- বিখ্যাত সৌধ বা রম্যস্থান, জীবজন্তু, নিসর্গ থেকে শুরু করে ইতিহাস বা পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র পর্যন্ত সব কিছুই ছিল এর অন্তর্গত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়পর্বটি জুড়ে অক্ষশক্তির সাহায্য নিয়ে ভারতকে ব্রিটিশ কবলমুক্ত করতে কৃতসংকল্প সুভাষচন্দ্র কী ভাবে কলকাতার পত্রিকা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসক আর কম্যুনিস্ট পার্টির নিন্দাব্যঙ্গের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন, তা আমাদের পূর্বোক্ত আলোচনাগুলোতে আমরা দেখেছি। বিশ্বযুদ্ধের শেষে দিল্লীর লালকেল্লায় আত্মসমর্পনকারী
আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিচারের সময় নেতাজির সেনাদলের কীর্তিকাহিনি প্রথম জনগোচর হয় ও সারা দেশের মানসপটে বিদ্যুৎতরঙ্গের সৃষ্টি করে। সেই তরঙ্গের অভিঘাতে ভারতব্যাপী বিক্ষোভ আর বিদ্রোহই যে শেষ পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশসাম্রাজ্যের শবাধারে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিল, সে কথা আজ ইতিহাসে স্বীকৃত হয়েছে।
এই পটভূমিটুকু মনে রাখলে যুদ্ধোত্তরকালে কেন আপামর ভারতবাসীর মনে নেতাজি এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী বীরের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন সেটা বুঝতে সুবিধা হতে পারে। ভারতের স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরেই প্রকাশিত ভিন্টেজ কার্ডগুলিতে সুভাষচন্দ্রের এই বিশাল ভাবমূর্তির প্রতিফলন চোখে পড়ে।
যে সব অখ্যাত শিল্পীরা এই সব ছবি আঁকতেন, তাদের কাছে খুব বেশি কলানৈপুণ্য বা সূক্ষ্ম ভাব আশা করা যায়না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ভাবাবেগে চালিত হয়ে তাঁরা এই ছবিগুলো আঁকতেন, যা গ্রামে গঞ্জে জনপদে লোকের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ত। নেতাজির মতো জনপ্রিয় নায়কের ক্ষেত্রে এই সব ছবিগুলিকে দু’টি মোটা শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীতে উল্লেখ্য সুভাষচন্দ্রের সেই সব ছবি,
যা তাঁর বাস্তব প্রতিকৃতির আদর্শে আঁকা, শিল্পীর কল্পনার বিশেষ কোন ভূমিকা এতে নেই। বিশেষ কোনো বক্তব্যও তাই এসব ছবিতে থাকেনা। অন্য শ্রেণীতে পড়ে সেই ছবিগুলি, যাতে নেতাজির চেহারাটুকুই শুধু বাস্তব বাকিটা শিল্পীর ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই এই শ্রেণীর ছবিগুলোকে বলা যায় ভাবমূলক। এই শেষোক্ত শ্রেণীর ছবিগুলিই আমাদের আলোচ্য। এই ধরনের ছবির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত সামরিক পোষাকে সজ্জিত নেতাজি সুভাষের একটি ছবি, যাতে দেখা যায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন যুদ্ধক্ষেত্রে, তাঁর কোমরে প্রাচীন ভারতের বীরপুরুষদের মতো ঝুলছে এক তরবারি। [ছবি-১]
পেছনে জাতীয় পতাকা হাতে তাঁর সেনাদল। তাঁর সামরিক পোষাকটিতে কিছুটা আইএনএ-র ইউনিফর্মের আদল থাকলেও অনেকাংশে তা কল্পনায় অনুরঞ্জিত [যেমন বুকে আড়াআড়ি তেরঙা ব্যাজ ও একসারি মেডেল ইত্যাদি]। আমরা ছেলেবেলা থেকে পাড়ার ক্লাবে, পানের দোকানে কিংবা বাসের চালকের সীটের পেছনে সর্বত্র দেখেছি সুভাষচন্দ্রের এই কাল্পনিক বীরমূর্তি পরম আদরে শোভা পাচ্ছে। নেতাজির শৌর্যগাথায় মন্ত্রমুগ্ধ আমজনতা কোনদিন এ ছবির প্রামাণিকতা বিচারও করতে যায়নি।
এই সব জনপ্রিয় সুভাষ-আলেখ্যগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটিতে শিল্পীর কল্পনায় সুভাষচন্দ্রকে দেখানো হয়েছে ভারতমাতার সঙ্গে। কখনো চতুর্ভুজা, কখনও বা দশভুজা দুর্গার বেশে জাতীয় পতাকাধারিনী দেশমাতৃকা তাঁর বীরপুত্র সুভাষের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন, কখনও বা তুলে দিচ্ছেন জাতীয় পতাকা।
একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত কোন ভূখন্ডে সুভাষ দাঁড়িয়ে আছেন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে সেখানে ভেসে উঠেছে শৃঙ্খলিতা ভারতজননীর মুর্তি। নেতাজির সামনে উড্ডীন চরকাশোভিত জাতীয় পতাকা একটি স্মৃতি ফলক, তাতে লেখাঃ- “ তুমি কি ভারতীয়? তবে ক্ষণেকের জন্য এই সৃতিসৌধের সামনে দাঁড়াও!” [ছবি-২]
এই কাল্পনিক ছবিটি যেন আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় আন্দামানের সমুদ্রতটে ভারতের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নেতাজি সুভাষের বাস্তব ছবিটির কথা। [ছবি-
২ক]
এ রকমই আর একটি ছবির নীচে হিন্দিতে যা লেখা, তার অর্থ- “সুভাষচন্দ্র বসুর অপূর্ব উপহার” আর ওপরে ইংরেজিতে লেখা ‘জয় হিন্দ’। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পতাকার সামনে দন্ডায়মান নেতাজি এক হাতে তরোয়াল দিয়ে নিজের মস্তক ছেদন করে সেটি আর এক হাতে ধরে রয়েছেন, তা থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে ভারতের মানচিত্রের ওপর,
সেখানে লেখা
‘জয়হিন্দ’।
তাঁর পায়ের কাছে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক শহিদের কর্তিত শির! ছবির অভিব্যক্তিতে কিছুটা বীভৎসতা থাকলেও শহিদের আত্মবলির বীররসে তা নিশ্চয় চাপা পড়ে গেছে। আবার আর একটি ছবিতে দেখা যায়, অখন্ড ভারতবর্ষের পটভূমিতে শঙ্খ-চক্র-ত্রিশূল-পদ্মধারিনী চতুর্ভূজা ভারতমাতার কোলে বসে আছেন তাঁর আদরের সন্তান সুভাষ, তাঁর পরনে ধূতিচাদর, হাতে ত্রিবর্ণ পতাকা।
আমরা এর আগের আলোচনাগুলিতে [কালিমাটি অনলাইন জানুয়ারি ২০১৬ ও ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা দ্রষ্টব্য] উল্লেখ করেছি যে,
অতীতে একদা [১৯২৮] বাংলাদেশে ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস যখন সুভাষচন্দ্রকে ‘সিংহচর্মশোভিত রাসভ’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন ও কাব্য করে লিখেছিলেন “শুধু হাসে মহাকাল”, তখন তিনি সম্ভবত বুঝতে পারেন নি, দু’ দশকের মধ্যেই মহাকালের সেই হাসি আবার ধ্বনিত হবে সুভাষচন্দ্রের এই সমালোচকদের উদ্দেশেই। আমরা দেখলাম, স্বাধীন ভারতের জনমনে সুভাষচন্দ্রের স্থান কোন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার নির্ভুল প্রতিফলন রয়ে গেছে অখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ভিনটেজ কার্ডের এই সব ছবিতে। আমাদের মনে না হয়ে পারে না যে, সে সময় জীবিত সজনীকান্ত দাসও খুব সম্ভব এ রকম দু’ একটি ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
পত্রপত্রিকার ব্যঙ্গচিত্রে সুভাষ-প্রসঙ্গ
ভারতের স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তীকালে জনমনে সুভাষচন্দ্রের সহসা বিশালায়িত ভাবমূর্তি যে কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট এই দুই শিবিরের নেতাদেরই নেতাজি সম্পর্কে ফিরতে ভাবতে ও অতীতের বিরূপতা হজম করে নিতে একরকম বাধ্য করেছিল একথা বোঝা যায় এ সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্রগুলি থেকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে নেতাজির অনন্য ভূমিকা সাধারণত ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল কংগ্রেসের ও কম্যুনিস্ট নেতারা অস্বীকার করতে পারেন নি,
যদিও দিল্লির কেন্দ্র সরকারের পক্ষে এই স্বীকৃতি অনেক সময়েই ছিল বিলম্বিত ও কুন্ঠিত। আমাদের এই পর্বের ব্যঙ্গচিত্রগুলির অধিকাংশই কলকাতার বাংলা পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত হলেও এ কথা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল সম্পর্কেও কমবেশি প্রযোজ্য।
এই পর্বের যেসব কার্টুন আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তার সবচেয়ে পুরানোটি গত শতকের ষাটের দশকের। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন সীমান্তযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সারা দেশে দেশপ্রেমের উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় নেতাজির জন্মদিনে প্রকাশিত চন্ডী লাহিড়ির এক কার্টুনে কোহিমা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সামনে নেতাজির প্রেরণাবাণী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে রবীন্দ্র-কবিতার ছত্রঃ- “যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে/
যখনি জাগিবে তুমি, তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।“ এঁর পাশাপাশি দেখানো হয়েছে নেফা-
লাদাক সীমান্তে চিনা বাহিনীর মোকাবিলায় ভারতীয় ফৌজের সামনে শুধু অন্ধকার।
এরই সমসাময়িক আর একটি কার্টুন [কমিকস] প্রকাশিত হয়েছিল ‘যুগান্তর’ দৈনিকপত্রের ‘ছোটদের পাততাড়ি’ বিভাগে। কাফী খাঁর আঁকা চিত্রকাহিনির বিষয়বস্তু নেতাজির জন্মদিন পালনে সর্বব্যাপী উন্মাদনা, এমন কি মানুষের সঙ্গে বনের পশুরাও তাতে শামিল! এই চিত্রমালার সঙ্গে ছিল ‘স্বপনবুড়ো’-র [অখিল নিয়োগী] ছড়া, যার কিছু অংশ এ-রকমঃ- “জয়হিন্দ, হে নেতাজি ধ্বনি ওঠে ঊর্ধ্বে/ সবে মিলে ছুটে আয়, নব গানে সুর দে।”
সমকালের কোনো ঘটনার সূত্র ধরে অতীতে নেতাজির জীবনের ঘটনাবিশেষকে স্মরণ করার প্রসঙ্গে বিদগ্ধ বাঙালি কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণের একটি ব্যঙ্গচিত্রের কথা মনে পড়ে গেল। সম্ভবত সত্তরের দশকে কোনো রাজনৈতিক সম্মেলন প্রসঙ্গে এটি প্রকাশিত হয়েছিল অধুনালুপ্ত ‘অমৃত’ সাপ্তাহিকপত্রে। ‘চাকা ঘোরে’ শিরোনামায় এই কার্টুনে অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন সম্মেলনে নেহরু, জিন্না, সুভাষ প্রমুখ নেতারা যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব এনেছিলেন, সেগুলোর কয়েকটিকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। এই সূত্রে ১৯৪০ সালে জলপাইগুড়িতে প্রাদেশিক সম্মেলনে সুভাষচন্দ্রের উত্থাপিত ‘ভারত ছাড়ো’
প্রস্তাবেরও উল্লেখ ছিল সুভাষচন্দ্রের তর্জনী তোলা উদ্দীপক ভঙ্গিমার একটি কার্টুন সহ।
ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতাজির ভূমিকা নিয়ে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির পুরানো মূল্যায়নের ভুল স্বীকারের পালা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকেই।
এরই সূত্র ধরে ১৯৭০ সালে পশ্চিম বাংলার তখনকার উপমুখ্যমন্ত্রী সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসু কলকাতায় ‘নেতাজি প্রদর্শনী’ নামে এক মেলায় মন্তব্য করেছিলেন, “নেতাজি সম্পর্কে আমরা কম্যুনিস্টরা অতীতে যে সব কথা বলেছিলাম, তা ভুল। আমরা আজ আমাদের সে ভুল স্বীকার করছি। কারও পদানত হয়ে থাকবার জন্য নেতাজি কারও সাহায্য নেন নি।...... ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া নেতাজির অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না।“ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে গান্ধিজির মতো নেতাজি আর আজাদ হিন্দ ফৌজেরও বিরাট অবদানের কথা স্বীকার করে তিনি সেদিন [২৮-১-৭০] বলেছিলেন, “নেতাজির অস্ত্রের আঘাতের জন্যই ইংরেজকে বাধ্য হয়ে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।“ জ্যোতিবাবুর এই অকপট মন্তব্য নিয়ে সে সময় সংবাদমাধ্যমে প্রভূত কৌতুক-মস্করা করা হয়েছিল। ‘যুগান্তরে’ প্রকাশিত বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণের ব্যঙ্গচিত্রের শিরোনাম ছিল ‘ভ্রান্তি বিপ্লব’। এতে দেখানো হয়েছিল জ্যোতি বসু একটি মইয়ে চড়ে নেতাজির বিশাল মূর্তিতে মালা দিচ্ছেন, আর সিপিআইএম-এর পতাকা হাতে পার্টির সমর্থকেরা অবাক হয়ে দেখছেন। [ছবি-৫ক] এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সিপিআইএম দলটির সব নেতাই অবশ্য জ্যোতিবাবুর এই নেতাজি মূল্যায়নের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁর ভিন্নমতের কথা নেতাজির জন্মশতবর্ষেও জানিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি।
এর পাশাপাশিই উল্লেখ করার মতো ‘দেশ’ সাপ্তাহিকপত্রে রূপদর্শী ওরফে গৌরকিশোর ঘোষের ব্যঙ্গ-নক্শার এক নিয়মিত বিভাগে প্রকাশিত অহিভূষণ মালিকের একটি ব্যঙ্গচিত্র, যাতে দেখা যাচ্ছে, একই রকমভাবে মই লাগিয়ে উঠে এক পার্টি-ক্যাডার নেতাজি-মূর্তির গলায় লাল স্কার্ফ বেঁধে দিচ্ছে। [ছবি-৪ খ] এই রচনাটির কিছু নমুনাঃ- “......জ্যোতি বোসদা তোমাকে দেশপ্রেমিক বলছে,
উফ্ নেতাজী, তুমি এবার আমাদের লালঝান্ডা পাট্টির ছেলেদের কাছে দেশপ্রেমিকের প্রতীক হয়ে গেলে,
ভাবতেও গা
.... শিরশির করে উঠছে। তুমি যদি আজ থাকতে নেতাজী, তোমার গলায় লাল রুমালের ফাঁস লাগিয়ে দিতাম। দাদা বলেছে, কমরেড জ্যোতি বোসদার কাছ থেকে ক্যারেকটার সারটিফিকেট বাগানো খুব শক্ত,
জানো।...” [‘রূপদর্শীর সংবাদ ভাষ্য’, দেশ, ৭-২-১৯৭০]
বর্তমানে কলকাতা শহরে নেতাজির বেশ কয়েকটি মূর্তি থাকলেও বিগত ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই মহানগরীতে তার নাগরিকদের প্রিয় নায়কের কোনও প্রতিমূর্তিই ছিলনা! অথচ শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজির একটি অশ্বারোহী মূর্তিপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব কলকাতা পুরসভার পক্ষে নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৮ সালে! তারপর বছরের পর বছর ধরে সরকারি লাল ফীতের ফাঁসে সেই প্রস্তাব ঝুলে ছিল। জনগণের দাবি সত্ত্বেও বারবার মুর্তি স্থাপনার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ইতিমধ্যে ১৯৬৫ সালে রাজভবনের সামনে নেতাজির আর একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পুরসভার এই ঢিমে চালকে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল কলকাতার নানা কাগজে। [ছবি-৬]
আনন্দবাজার পত্রিকায় ষাটের দশকে প্রকাশিত চন্ডীর একটি কার্টুনে দেখানো হয়েছিল পুরসভার মুর্তিপ্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ফাইলগুলোকেই মাল্যভূষিত করে পুরসভা নেতাজি জয়ন্তী পালন করছে। দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত সঞ্জয়ের একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, পুরসভার কর্তারা নেতাজির অশ্বারোহী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে এক নাগরিককে প্রবোধ দিচ্ছেন, ‘’নেতাজির মূর্তি অন্তরে প্রত্যক্ষ করুন”।
শেষ পর্যন্ত নেতাজির বহুপ্রতীক্ষিত অশ্বারোহী মূর্তি শ্যামবাজারের মোড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। নাগেশ যবলকার নামে বোম্বাইয়ের এক ভাস্করের তৈরি এই মূর্তির গুণমান বাংলার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় সংবাদপত্রের পাতায় বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। এরই প্রতিফলন দেখা যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত চন্ডী লাহিড়ির কার্টুনে- মূর্তিটি দেখিয়ে এক পুরকর্তা মানুষকে বলছেন, “বিশ্বাস করুন,
এটা নেতাজিরই মূর্তি।“[ছবি-৬]
কলকাতায় নেতাজির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের
মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন ১৯৬৫ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এটির নির্মাতা ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর প্রদোষ রায়চৌধুরী। এটিকে নিয়েও আনন্দবাজার পত্রিকায় চন্ডীর একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। রাতে মূর্তিটিকে আলোকিত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ব্যঙ্গচিত্রে ঘোর কালো রঙে আঁকা মূর্তিটির আদলের নীচে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছিল, “আলো, আমার আলো”। [ ছবি- ৭ বাঁ দিকে ]
আকাশবাণীর সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলিতে নেতাজির জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে একটি বিতর্কের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, প্রধানমন্ত্রী পদে তখন আসীন ছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। সেই সময় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, আকাশবাণী প্রতি বছর শুধু গান্ধিজি, নেহরু ও শাস্ত্রী, এই তিনজন নেতারই জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। আর নেতাজি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ আর গোবিন্দবল্লভ পন্ত প্রমুখ নেতাদের ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। কেন্দ্রীয় বেতার মন্ত্রকের দু’জন মন্ত্রী রাজ্যসভায় এই নীতির পক্ষে সাফাই দিতে গেলে সদস্যেরা প্রতিবাদে সরব হন। ফরোয়ার্ড ব্লক, জনসংঘ, এমন কি শাসকদল কংগ্রেসের একজন সদস্যও প্রশ্ন তোলেন, নেতাজির মতো অবিসংবাদী ও অদ্বিতীয় নায়ককে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতি বছর কেন অনুষ্ঠান প্রচারিত হবেনা! ‘অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতা’ শিরোনামে এক সম্পাদকীয়তে আনদবাজার পত্রিকায় লেখা হয়ঃ- “...। যেদিন আকাশবাণীর কর্মকর্তাদের নাম কীটদষ্ট ধূলি ধূসরিত সরকারী নথিপত্রেও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না সেদিনও দেশভক্ত ভারতবাসীর বুকে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকিবে নেতাজীর প্রিয় নাম। কিন্তু আকাশবাণীর ঐ স্পর্ধিত বিকৃত সিদ্ধান্ত অবিলম্বে পালটাইতে হইবে এবং নেতাজীর প্রতি যে অসম্মান দেখানো হইয়াছে তাহার জন্য অবিলম্বে ক্ষমা চাহিতে হইবে। যা অন্যায় তাঁহারা করিয়াছেন, তাহার কোনও প্রায়শ্চিত্ত নাই – এমন কোনো পবিত্র জল নাই যাহাতে সে কলুষ মুক্ত করিতে পারে “ [৩-৫-১৯৬৬] একই সঙ্গে এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল চন্ডীর একটি কার্টুন। এতে দেখা যাচ্ছে দূরে দিল্লির আকাশবাণী ভবনের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে নেতাজি বলছেন, ‘দিল্লি দূর্ অস্ত’। [ছবি-৭ - ডানদিকে] উল্লেখ্য যে,
শেষ পর্যন্ত সাংসদদের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে তথ্য ও বেতারমন্ত্রক পুরানো নীতি সংশোধন করে প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনেও অনুষ্ঠান প্রচারের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল, তবে এই নেতাদের তালিকায় জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তিলক, প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মৌলানা আজাদের নামও।
বিগত সত্তরের দশকের শেষদিকে পশ্চিম বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বামফ্রন্ট সরকার, তার মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন জ্যোতি বসু। এই সরকার দিল্লিতে অধিষ্ঠিত কংগ্রেস সরকারের কাছে বারবার রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা দেবার দাবি তুলেছে। এই সূত্রে আঁকা দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত এক কার্টুনে দেখা যাচ্ছে ঐ দাবি লেখা এক প্ল্যাকার্ড হাতে জ্যোতিবাবু চলেছেন দিল্লির দিকে,
পাশে দেওয়ালে লেখাঃ- ‘দিল্লি চলো-
নেতাজির ডাক’। কার্টুনটি এঁকেছিলেন সুফি। [ ছবি-
৮ ক ]
১৯৮৩ সালের শেষ দিকে ব্রিটেনের গ্রেনাডা টেলিভিশন নামে এক সংস্থার তৈরি একটি টিভি-তথ্যচিত্রে [‘দি ওয়ার অব দি স্প্রিংগিং টাইগার’] নেতাজিকে হেয় করে দেখানোর অভিযোগ উঠেছিল ও ব্যাপারটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরকারী মাধ্যমে ভারত সরকার হয়ে ব্রিটেন পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই তথ্যচিত্রে নেতাজির কিছু একদা-সহকর্মী ছাড়াও ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে কয়েকজন লেখকের সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক বক্তব্যও রাখা হয়েছিল। ছবিটি তৈরি হবার পর দেখা যায়, এতে নেতাজির সহকর্মীদের বক্তব্য কাটছাঁট করে পরিবেশন করা হয়েছে আর ভাষ্যকারের নিজের ও কিছু নেতাজি-বিরোধী ব্যক্তির বক্তব্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ডঃ শিশির বসু, আইএনএ-র শাহনওয়াজ খান,
আবিদ হাসান, পি কে সেগল ও ডঃ লক্ষ্মী সেগল প্রমুখ সহকর্মীরা এর প্রতিবাদে গ্রেনাডা কোম্পানিকে চিঠি লেখেন। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর পক্ষেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ও বিদেশ মন্ত্রী নরসিম্হারাওয়ের কাছে অভিযোগ করা হয়, ভারতে এই ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করারও দাবি ওঠে। লণ্ডনে ভারতের হাই কমিশনার টিভি কোম্পানিকে এ নিয়ে কড়া চিঠি দিলেও তারা ছবির ভাষ্যে কোনো সংশোধন করতে রাজি ছিল না।
১৯৮৪ সালের শুরুতেও এই তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভ চলেছিল, সারা বিশ্বেই এই ছবিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হোক, এই দাবি নিয়ে ইন্দিরা গান্ধিকে চিঠি লিখেছিলেন জ্যোতি বসু। ছবিটিতে তথাকথিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে ভাষ্যকার যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সর্ববিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে অভ্যস্ত ব্রিটেন-নিবাসী বাঙালি লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী, যিনি কিছুদিন সুভাষচন্দ্রের দাদা শরৎ বসুর সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার সূত্রে তাঁর পরিচিত ছিলেন। এই তথ্যচিত্রে টিপ্পনি করতে গিয়ে তিনি বাঙালিজাতি ও সুভাষচন্দ্র, সম্পর্কে এমন কিছু কটূক্তি করেছিলেন, যাতে পশ্চিমবঙ্গে সবিশেষ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। নীরদ চৌধুরীর এরকম মন্তব্যের কয়েকটি নমুনাঃ- “......তিনি তাঁর মোহ-ভ্রান্তিকেই আঁকড়ে থাকলেন।...... সে সময় তাঁর পক্ষে একমাত্র বিচক্ষণ পথ ছিল কয়েকজন খুব সাহসী ও খুব বিশ্বস্ত অনুগামী নিয়ে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বা ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পন করা। ......এর অর্থ তাঁর জীবনের সম্যক, সর্বাঙ্গীন ব্যর্থতা...। আবার মনে করিয়ে দিই বাঙালিদের ভুলকে আঁকড়ে থাকার প্রচন্ড ক্ষমতার কথা। ...... আমি বলতে চাই,
সুভাষ বসুর অবশ্যই কোন রাজনৈতিক প্রতিভা ছিল না। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক চরমপন্থী নেতা, একজন সস্তা জনপ্রিয় নায়ক”।
নীরদ চৌধুরীর এই সুভাষ-নিন্দা ও তাঁর পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে কুট্টির একটি চমৎকার কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়। [১-২-১৯৮৪] এতে দেখা যাচ্ছে, বিশালাকৃতি সুভাষচন্দ্রের এক হাতের তালুতে দাঁড়িয়ে আছেন বামনাকৃতি নীরদচন্দ্র, তাঁর কাঁধে এক ঝান্ডা, তাতে লেখা-
’গ্রেনাডা’, অপর হাতে আতস কাঁচ ধরে তাঁকে দেখে সুভাষ সকৌতুকে বলছেন, “ওঃ নীরদ?”। [ ছবি- ৮ খ]
সম্ভবত আশির দশকের শেষের দিক থেকেই বাংলা সংবাদপত্রে নেতাজি বিষয়ক কার্টুনের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। আমাদের অন্তত কলকাতার খবরের কাগজ বা পত্রিকাগুলিতে এর পরবর্তী সময়ে কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র চোখে পড়েনি। এর কারণ হিসেবে জনমনে নেতাজিকে নিয়ে আবেগ বা উন্মাদনা কমে গিয়েছিল, এমন কথা বললে সম্ভবত তা বাস্তবসম্মত হবেনা, কারণ এই সময়ে নেতাজির জন্মশতবার্ষিকী, তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে নতুন তদন্ত, তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে এক জননেতার অপ্রমাণিত দাবি ইত্যাদি নানা ঘটনায় বারবার সংবাদমাধ্যমে নেতাজির প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে, তবে ইংরেজি বা অন্য ভাষার সংবাদপত্রের তুলনায় হয়তো কম গুরুত্ব সহকারে সেগুলি বাংলা কাগজে ছাপা হয়েছে। এমন কি, নেতাজির শতবার্ষিকী যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে উদ্যাপিত হলেও সে সময় কলকাতার কাগজে আমাদের একটি মাত্র কার্টুন চোখে পড়েছে, যেটির কথা আমরা এই আলোচনার প্রথম পর্বে [কালিমাটি অনলাইন ,জানুয়ারি ২০১৬ সংখ্যা দ্রষ্টব্য] বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ‘আজকাল’ দৈনিকপত্রে কার্টুনিস্ট কুট্টির একটি লেখার সঙ্গে ছাপা হয়েছিল ১৯৪০ সালে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শংকরের আঁকা একটি কার্টুনের সেই স্মৃতিভিত্তিক অনুকৃতি। এতে নেপোলিয়নবেশী সুভাষের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ নেহরু-প্যাটেল-আজাদ প্রমুখ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসী নেতাদের দেখানো হয়েছিল [ছবি- ৯ ক] এখানে অবশ্য একথা স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে, আমাদের আলোচিত ব্যঙ্গচিত্রগুলির বাইরেও ভারতের নানা অঞ্চলের পত্রপত্রিকায় সুভাষ-বিষয়ক উল্লেখযোগ্য কার্টুন প্রকাশিত হয়ে থাকতেই পারে, যা আমাদের চোখে পড়েনি।
আমাদের বর্তমান পর্যায়ের আলোচ্য সর্বশেষ দু’টি কার্টুন বিখ্যাত মাখন প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘আমূল’-এর বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল ২০১৫-১৬ সালে। সাময়িক নানা ঘটনাকে উপজীব্য করে আমূলের নানা ধারাবাহিক কার্টুনের সঙ্গে আজকের মানুষ ভালোভাবেই পরিচিত। নেতাজি বিষয়ক যেসব গোপন ফাইল ভারত সরকারের হেফাজতে অপ্রকাশিত অবস্থায় ছিল, সেগুলি প্রকাশের দাবিতে একবিংশ শতকের শুরু থেকেই জনদাবি সোচ্চার হয়ে উঠছিল। কেন্দ্রের কংগ্রেসি সরকার বহু বছর ধরে তথ্যের অধিকার আইনের ভিত্তিতে ওঠা ঐ দাবিকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে কেন্দ্রের এন ডি এ সরকার ঐ ফাইলগুলি প্রকাশ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমুলের প্রথম কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, আতস-কাচ হাতে উন্মোচিত নেতাজি ফাইল ঘাঁটছে বিখ্যাত আমুল গার্ল, পাশে নেতাজির একটি মাল্যশোভিত আবক্ষ মূর্তি। ছবির ওপরে লেখা “দেশ কে নেতা,
দেশ কে বেটা” আর নীচের অংশে লেখাঃ- “Amul Feeder of the nation!” [ছবি- ৯ খ] এখানে লক্ষণীয়, ‘ফীডার অব দি নেশান’ শব্দগুলি চয়ন করা হয়েছে নেতাজির বিশেষণ ‘লীডার অব দি নেশান’ –এর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে।
নেতাজি-ফাইলগুলি প্রকাশের জন্য কেন্দ্র-সরকারকে চাপ দেবার জন্য নেতাজি- উৎসাহী কিছু সংগঠন দাবি করেছিল যে, ঐ সব গোপন ফাইলে এমন সব সংবাদ রয়েছে, যা থেকে নেতাজির অন্তর্ধান বা মৃত্যুর রহস্যের সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০১৬ সালে দফায় দফায় শ’ দুয়েক ফাইল প্রকাশ হবার পরেও দেখা যায় যে,
ঐ সব ফাইলে তেমন কোনও সমাধান-সূত্র নেই, ফলে রহস্য যেখানে ছিল ,সেখানেই থেকে যায়। আমুলের দ্বিতীয় কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, আমুল-বালিকা আর একটি বালকের সঙ্গে বসে নেতাজি-রহস্য নিয়ে পড়াশোনা করছে, ছেলেটির হাতে আতস-কাচ ও মাথায় বাঁধা সার্চ লাইট, তারার এক হাতে ধরা একটি বইয়ের পাতায় দেখা যাচ্ছে নেতাজির ছবি। ব্যঙ্গচিত্রটির ওপরের অংশে ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ’ প্রবাদের অনুসরণে লেখা-
“মিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ।“ কার্টুনের নীচের দিকে লেখা-
“Amul Loved by Patriots.” [ছবি- ৯ গ]
স্বাধীনতার পরবর্তীকালের যে সব নেতাজি-কার্টুনগুলি আমরা দেখলাম, তার ভিত্তিতে এ টুকু বলা যায় যে, প্রাক-স্বাধীনতা যুগের মতোই এ-যুগের ব্যঙ্গচিত্রীরাো সুভাষচন্দ্রকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। আধুনিক নাগরিকদের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের সমালোচক নেই, এমন কথা বলা না গেলেও ছাপা মাধ্যমে যেসব ভিন্টেজ কার্ড বা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কিন্তু তিনি জাতীয় জীবনের এক অবিসংবাদিত হীরো হিসেবেই চিত্রিত হয়েছেন। ভারতের উত্তর-স্বাধীনতা যুগের শাসকেরা কখনও কখনও তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত হলেও এই সময়ের কোনো কার্টুনিস্ট প্রাক্-স্বাধীনতা কালের মতো সুভাষচন্দ্রকে হীনভাবে চিত্রিত করতে সাহস পাননি। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে হাজির না থাকলেও মহাকালের বিচারে জাতির হৃদয়ে তাঁর আসনটি অমলিনই থেকে গেছে।
অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ লেখা... ভালো লাগল। শুভেচ্ছা নেবেন।
উত্তরমুছুন