সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
ফারুক আহমেদ
(মুজিবর রহমান মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একটি লড়াকু প্রতিভা। তথ্যচিত্র নির্মাণে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনি এক ও অদ্বিতীয় মুখ এই রাজ্যে। মনীষীদের নিয়ে কমবেশি তিনি ইতিমধ্যে ৪০টিরও বেশি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। সম্প্রতি তাঁর তথ্যচিত্র ‘নজরুল জীবন-পরিক্রমা’ পাড়ি দিয়েছিল লন্ডনে। বহু মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে তথ্যচিত্রটি। বিলেতফেরত পরিচালকের একটি সাক্ষাৎকার পাঠক-দরবারে তুলে ধরেছেন ফারুক আহমেদ।)
প্রশ্ন: প্রথমে আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি চলচ্চিত্র জগতে এলেন কীভাবে?
মুজিবর রহমান: ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আমার একটা ঝোঁক ছিল। স্কুলের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি, নাটকে অভিনয় করা ইত্যাদি ভালো লাগত। সেই সময় থেকেই আমার মনের মধ্যে একটা বড় খিদে ছিল,
কিছু একটা করার। তারপর আস্তে আস্তে এই পরিচালনার কাজ শুরু করি।
প্রশ্ন: যখন ছোটবেলার কথা এলো, পড়াশোনা বা ছোটবেলাটা কেমন ছিল আপনার?
মুজিবর রহমান: আমার জন্ম ও বাড়ি সীমান্ত জেলা মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর গ্রামে একটি কৃষক পরিবারে। গ্রামের স্কুল শক্তিপুর কুমার মহীমচন্দ্র ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ ভর্তি হই। কলকাতায় কারমাইকেল হস্টেলে থাকতে শুরু করি। ১৯৯৫ সালে ইংরাজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে থিয়েটারে যোগ দিই। পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকি। এমন সময় 'নন্দনে' চলচ্চিত্র নিয়ে একটি স্বল্প-সময়ের কোর্স করার সুযোগ পাই। একটা কথা বলা দরকার, আমি তখনও কিন্তু থিয়েটারে কাজ করছিলাম কিন্তু কোথাও যেন মনের চাহিদাটা পুরণ হচ্ছিল না। আরও বড় কিছু করার তীব্র বাসনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
প্রশ্ন: বাড়ির লোকজন কীভাবে বিষয়টিকে নিয়েছিলেন?
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, বাড়ির লোকজন বলতে আব্বা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কী করতে চাই। তো আমি বলেছিলাম, সিনেমা করব। প্রত্যেক বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছেলে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করবে। আমার ক্ষেত্রেও তাই। তাছাড়া আমাদের পরিবারে প্রথম স্নাতক বলতে আমিই। চাপ ছিলই। এমন সময় আব্বার সাথে মনোমালিন্য দেখা দেয়। রাগ করে আমি মুম্বাইয়ে পাড়ি দিই। এটা ছিল ৯৭ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ।
প্রশ্ন: তারপর মুম্বাইয়ে কীভাবে নিজেকে তৈরি করলেন?
মুজিবর রহমান: প্রথমে একটি মশলা আমদানি রপ্তানি কোম্পানিতে ছোট একটা ম্যানেজার পদে কাজে যোগদান করি। তখন হাতে না ছিল টাকা না ছিল চেনা-পরিচিতি। এমন সময় এটা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। অবশেষে একটি টিভি সিরিয়ালে চতুর্থ সহকারী পরিচালকের কাজ পাই। আস্তে আস্তে নিম্বাস টিভি, বালাজি টিভি,
সাহারা টিভি প্রভৃতি টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট তৈরি ও সংলাপ রচনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করি। এবং সহকারি পরিচালক থেকে ক্রমশ পরিচালক হিসেবে উঠে আসি।
প্রশ্ন: বাংলায় কবে থেকে কাজ শুরু করলেন?
মুজিবর রহমান: এখানে বলা ভালো, মুম্বাইতে কাজ করার সময়েই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমার মন প্রাণকে বারবার টানতো এই বাংলায়। এমন সময় অর্থাৎ ২০০২ সালে কলকাতার একটি টিভি সিরিয়ালে চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনার কাজের ডাক পাই। তারপরই চলে আসি।
প্রশ্ন: কোথাও কি মুসলিম বলে বাংলা সিনেমা জগতে জায়গা তৈরি করতে সমস্যা
হয়েছিল?
মুজিবর রহমান: আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্বের অভাব আছে। সাংবাদিকতা, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তো খুবই বিরল। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। সব সম্প্রদায়ের মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছেন। মানুষের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।
প্রশ্ন: এবার আসি লন্ডন প্রসঙ্গে। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নজরুল কলম ধরেছিলেন, তারা আজ কী দৃষ্টিতে দেখে নজরুলকে?
মুজিবর রহমান: তথ্যচিত্রের নজরুলকে নিয়ে মহাসমারোহ দেখলাম লন্ডনে। এজন্য আমি আপ্লুত ও অভিভূত। ওখানকার দর্শকদের নজর কাড়তে পেরেছি বলেই মানুষ আগ্রহের সাথে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাছাড়া ছবিটি দেখার পর ওখানকার অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিকরা তাদের প্রিয় কবি রবার্ট বার্নসের সঙ্গে নজরুল ইসলামের তুলনা করেছেন। এটা আমার কাছে খুব প্রেরণা দায়ক।
প্রশ্ন: কোথায় কোথায় তথ্যচিত্রের প্রদর্শনীগুলি হয়েছিল?
মুজিবর রহমান: মোট পাঁচটি শো বিভিন্ন স্থানে হয়েছিল। যেমন গত সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে লন্ডনের Brady Art Centreএ প্রথম প্রিমিয়ার শো হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়েদ। ১৪ তারিখে স্কটল্যান্ডের এডিনবোরায়। এখানে ভারতের সম্মানীয় কনস্যুলেট জেনারেল অঞ্জুরঞ্জন স্বাগত ভাষণ দেন এবং এডিনবোরা নেপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা বাসবী ফ্রেজার আমার সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে সেদেশের অন্যতম কবি ড. মারিও রালিস ও লেডি জয়েস কাপলান প্রদর্শনীর শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। পরবর্তী শো হয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটে সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখে। এই বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক এডওয়ার্ড সিম্পসন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এবং অধ্যাপিকা সংযুক্তা ঘোষ এই চলচ্চিত্রের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই প্রদর্শনীর বিশেষ একটি ঘটনা না বললে নয়। এখানে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের একটি ভিডিও কনফারেন্স হয়, তাতে আমার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পরিচয় করানো হয়। এবং আমার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর খবর তাকে দেওয়া হয়। এরপরে ২৪ তারিখ টেগোর সেন্টারে ছবিটি দেখানো হয়। লন্ডন সফরের শেষ শো’টি হয় ২৭ তারিখে ইস্ট লন্ডনের আইডিয়া স্টোরে। আয়োজন করেছিল লন্ডনের বাংলা টাউনে অবস্থিত ব্রিক লেন সার্কেল।
প্রশ্ন: আপনি এর আগেও তো লন্ডনে গিয়েছিলেন, কেমন লাগলো এবারের যাত্রা?
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, আমি এর আগেও লন্ডনে গিয়েছিলাম। সেটা ২০১২ সাল নাগাদ। তখন অবশ্য রবীন্দ্রনাথের উপর একটি তথ্যচিত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। যেটি দেখে দর্শকদের ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। সেই থেকেই এই ছবির অনুপ্রেরণা বলতে পারেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করতে গিয়েই নজরুলের জীবনের অজানা বিষয় তুলে ধরতে এই ছবির কাজ শুরু করি। প্রথমবার যাত্রার একটা উত্তেজনা তো ছিলই, এবার একটা বাড়তি চাপ অনুভব করছিলাম,
দর্শকদের কেমন লাগবে ছবিটি, এই ভেবে। তবে দর্শকদের রেসপন্স থেকেই বুঝতে পেরেছি, তাদের ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতা যদি পাঠকদের জন্য বলেন!
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, অনেক অভিজ্ঞতাই আছে, যেগুলো না বললে নয়। যেমন টেগোর সেন্টার ইউকে-র পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান ড. অমল চৌধুরী আমাকে একটি মানপত্র দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। এবং মহাকবি শেক্সপিয়ারের স্মৃতি বিজড়িত গ্লোব থিয়েটারে রাজা কিং লিয়ার নাটকের প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পাশাপাশি নাটকের কলা-কুশলীদের সঙ্গে পরিচিত
হয়েছিলাম, তারাও আমাকে স্বস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন। আরেকটা ব্যাপার, ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপক লেখক অধ্যাপক ওরহান পামুকের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। পামুক নজরুলের ইসলাম সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং একজন কবির জীবনের উপর তথ্যচিত্র করার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তাছাড়া বেতার বাংলা নামে একটি রেডিও চ্যানেল আমাকে নিয়ে এক ঘন্টার একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান লাইভ সম্প্রচারিত করেছিল । এবং এনটিভি ইউরোপ নামের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে সেলিব্রিটিদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান Talking point -এ আমার সাক্ষাৎকার লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছিল।
প্রশ্ন: নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কোন কোন মনীষীদের নিয়ে ছবি করেছেন?
মুজিবর রহমান: ছবি করেছি মুন্সী প্রেমচাঁদ, বেগম রোকেয়া, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়,
উস্তাদ আলি আকবর খান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ভীমসেন যোশী প্রমুখদের নিয়ে ।
প্রশ্ন: এই কাজে বিশেষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, এমন কারো নাম?
মুজিবর রহমান: আমার এইসব তথ্যচিত্রগুলির নির্মাণের নেপথ্যে এমন কিছু মহান মানুষ আছেন, যাদের কথা না বললেই নয়, বিশেষ করে বিশিষ্ট সমাজসেবী ও নজরুল প্রেমী ‘পতাকা গোষ্ঠী’র মোস্তাক হোসেন, মরহুম হাজী সুলতান আহমেদ, সমাজসেবী মহ খলিল,
প্রাবন্ধিক আবদুর রাউফ, আল আমীন মিশন। এছাড়াও বহু মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি।
প্রশ্ন: ‘নজরুল’
তথ্যচিত্রটি আমরা কবে দেখতে পাবো?
মুজিবর রহমান: আগামী নভেম্বর মাসে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দনে প্রথম দেখানো হবে। তারপর ডিসেম্বর মাস নাগাদ সকলেই দেখতে পাবেন বলে আশা করছি।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে আর কী কী কাজ করতে চান?
মুজিবর রহমান: আমি আপাতত হাজী মহম্মদ মহসিনের ও স্বামী বিবেকানন্দের উপর কাজ করব, ঠিক করেছি। আসলে বিভিন্ন মনীষীদের জীবন নিয়ে কাজ করার সাথে সাথে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের কাছে ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তাও পৌঁছে দিতে চাই ।
প্রশ্ন: বর্তমান
মুসলমান সমাজ সম্পর্কে আপনি যদি কিছু বলেন!
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, আমাদের মুসলমান সমাজকে শিক্ষিত সমাজ রূপে গড়ে তুলতে হবে। সাহিত্য ও সমাজ বিকাশে আমাদের আরও এগিয়ে আসতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন