আজ ডিসেম্বর সংখ্যা ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সম্পাদকীয়
লিখতে বসে শুধুই মনে পড়ে যাচ্ছে বারীনদার কথা। আমাদের ছেড়ে তাঁর চলে যাওয়ার কথা। আমি
যখন শ্মশানে পৌঁছেছিলাম, তার আগেই টাটা
মেইন হসপিটাল থেকে বারীনদার শবদেহ পৌঁছে গেছিল সাকচির সুবর্ণরেখা ঘাটে। এইরকম একটা
দৃশ্য দেখার জন্য মানসিকভাবে তার আগে থেকেই একটু একটু করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
বারীনদার প্রয়াণের দিন দশেক আগে আমি বারীনদার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে
গেছিলাম। বারীনদা যথারীতি বসেছিলেন তাঁর সেই চেয়ারে। মাঝে টেবিল। উল্টোদিকের
চেয়ারে যথারীতি আমি। বারীনদা কথা বলতে পারছিলেন না, কেননা তখন তাঁর মুখে ছিল নেবুলাইজার। প্রাণদায়ী অক্সিজেন গ্রহণ করছিলেন তিনি।
আমি অপেক্ষা করছিলাম, কখন তাঁর মুখ
থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে সেই চিকিৎসাযন্ত্র। আমি প্রায় নীরব ছিলাম। সামান্য কিছু কথা
বলছিলাম বারীনদার সেবায় নিযুক্ত মানুষটির সঙ্গে। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কফি খেতে ইচ্ছুক কিনা। আরও জানালেন, এইসময় বারীনদাও কফি খেয়ে থাকেন। তারপর একসময় কফি তৈরি হয়ে
এলো,
অপসারিত হলো অক্সিজেনের নল, কিন্তু বারীনদার কথা বলা শুরু হলো না।
একথা ঠিক যে, বারীনদা মানুষটাই ছিলেন
স্বল্পভাষী। অন্যদের অনেক কথাবার্তা শুনে অল্প কিছু কথা বলতেন। কিন্তু সেদিন মনে
হলো,
বারীনদা কথা বলার শক্তি যুগিয়ে উঠতে পারছেন না। এমনকি তাঁর
সামনে রাখা কালোকফি ও বিস্কুট খেতেও রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে তাঁর। আমি অবশ্য
বারীনদাকে অনেক কথাই বলছিলাম, আগামী
কলকাতা বইমেলায় আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হবে যে বইগুলি, সেই প্রসঙ্গে। কেননা বারীনদার লেখাও তাতে সংকলিত হয়েছে।
বারীনদা আমরা কথা শুনছিলেন। কিন্তু বিশেষ
কোনো অভিব্যক্তি তাঁর মুখের রেখায় ফুটে উঠছিল
না। এভাবেই কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছিল। এবার আমাকে ফিরে যেতে হবে। আমি চেয়ার ছেড়ে
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। বারীনদার দু’ চোখ তখন আমার মুখের ওপর। বললাম, বারীনদা আজ আসি আমি। বারীনদা কিছু বললেন না। কী মনে হলো, আমি সামনের চেয়ার ও টেবিল পেরিয়ে বারীনদার পাশে গিয়ে
দাঁড়ালাম। আলতো করে আমার ডান হাতের চেটো বোলাতে লাগলাম বারীনদার মুখে মাথায় হাতে।
তারপর চলে আসছি। দরজার কাছে পৌঁছে গেছি, বারীনদার কন্ঠস্বর এবার ফুটে বেরোলো – ‘যাচ্ছ!’ আমি পেছন ফিরে মুখ ঘুরিয়ে
দেখি,
বারীনদা এক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। বারীনদার সেই
কন্ঠস্বর ও দৃষ্টিতে কী যে ছিল, জানি না, কিন্তু আমার
শরীর ও মন একটা অদ্ভুত আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠল। মনের গভীরতম তলদেশ থেকে কে যেন
অস্ফূটে বলে উঠল – এটাই শেষ দেখা!
তবু আমি সেই মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললাম – আমি আবার আসব
বারীনদা! হ্যাঁ, আমি বারীনদার সঙ্গে আবার
দেখা করতে গেছিলাম, তিনি তখন শ্মশানঘরের
চাতালে শুয়েছিলেন, ঘুমোচ্ছিলেন, কথা বলে সেই ঘুম ভাঙানোর কোনো উপায় ছিল না। তার দিন দশেক
পরে আবার গেছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তিনি জেগেই ছিলেন, একটি ফুল দিয়ে
সাজানো টেবিলের ওপর তিনি ছবি হয়ে তাকিয়েছিলেন সরল দৃষ্টিতে। সেদিন ছিল তাঁর
শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এরপর
একদিন সরাসরি পৌঁছে গেছিলাম বারীনদার বাড়ির দোতলার সেই ঘরটিতে, যে ঘরে কতবার যে এসেছি বসেছি কত কত কথা বলেছি, সেই ঘরে। ঘর অবিকল সেইরকমই আছে, শুধু ঘরের মানুষটি সামনে নেই, আছেন আড়ালে। আমরা সেদিন অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলাম সেই ঘরে। আমার বন্ধু
প্রণবকুমার দে আয়োজন করেছিল স্মরণসভার। বারীনদা থাকলে যেমন আমরা বিভিন্ন আলোচনায়
মুখর হয়ে উঠতাম, সেদিনও তাই হয়েছিল। আমরা
প্রায় সবাই মুখর হয়ে উঠেছিলাম, তবে আলোচনার বিষয় ছিল একটাই, শুধুই বারীনদা। কত স্মৃতি, কত পুরনোদিনের
কথা,
কত ব্যক্তিগত সান্নিধ্য বন্ধুত্ব স্নেহ ভালোবাসা অনুপ্রেরণার
কথা!
আমার সম্পাদিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার একেবারে গোড়া
থেকে না হলেও, পত্রিকার উত্তর পর্যায়ে
নিয়মিত লেখক ছিলেন বারীনদা। তাঁর অজস্র গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘কালিমাটি’ পত্রিকায়।
আবার বছর কয়েক আগে যখন প্রথম পর্যায়ে অনলাইন পত্রিকা ‘কবিতার কালিমাটি’ ও ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করি, তখন বারীনদা
প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় লেখা পাঠিয়ে পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘কবিতার কালিমাটি’ ও ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’কে সম্মিলিত করে যখন ‘কালিমাটি
অনলাইন’
ব্লগজিন প্রকাশ করি, তখন তার সঙ্গেও একই ভাবে জড়িয়ে থাকেন
তিনি। এবং শুধু তাই নয়, এই ব্লগজিনের
অন্তর্গত ‘কথনবিশ্ব’ বিভাগে তিনি লিখেছেন বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মননশীল গদ্য।
আমি খুব উল্লাস বোধ করি, যখন ভাবি, আমারই মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা আমি সমীরদার (সমীর রায়চৌধুরী)
সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করে, আমরা দুজনে বাংলাগল্পের
একটি নতুন ‘ফরম্যাট’এর সূচনা করি, তখন বারীনদা সেই নতুন ‘ফরম্যাট’কে স্বাগত জানিয়ে অনেকগুলি ‘ঝুরোগল্প’ লিখেছিলেন। এটা আমার নতুন
ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে একটা বিরাট স্বীকৃতি বলে আমি মনে করি। প্রসঙ্গত এখানে
উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, বছর দুয়েক আগে
‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশন’ থেকে আমার সম্পাদনায় ঝুরোগল্পের প্রথম সংকলন ‘ঝুরোগল্প ১’ প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে বারীনদার লেখা দশটি ঝুরোগল্প সংকলিত হয়েছিল। এছাড়া
বারীনদার লেখা আরও দশটি ঝুরোগল্প সংকলিত হয়েছে ‘ঝুরোগল্প ২’ গ্রন্থে, যা আর কিছুদিনের মধ্যেই ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত
হবে। কিন্তু আমার কাছে এটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে, সেই সংকলন আমি আর বারীনদার হাতে তুলে দিতে পারব না।
‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ২০১৭ সালের এটাই শেষ সংখ্যা।
নতুন বছরে নতুন সংখ্যায় আবার নতুন সম্পাদকীয় লিখব। সেই নতুন বছরের জন্য আগাম
শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখলাম সবাইকে।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com /
kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ :
08789040217 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal
Sen, Flat 301,
Phase 2,
Parvati Condominium, 50
Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন